যাকাত ও ওশর আদায়ের ফযীলত

মুহাম্মাদ আবুল কালাম 2008 বার পঠিত

দারিদ্র বিমোচনের অন্যতম নিয়ামক হ’ল ইসলামী অর্থনীতি তথা যাকাত ব্যবস্থা চালু করা এবং সুদী ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি পরিহার করা। স্রষ্টার প্রতিটি বিধান মানবতার জন্য কল্যাণকর। যেখানেই আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে অবমূল্যায়ন করে মানব রচিত বিধান প্রয়োগ হয়েছে, সেখানেই অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের হক আছে। যাকাত ও ওশরের নির্ধারিত অংশ শরী‘আত নির্দেশিত খাতে বন্টনের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব। এর বাইরে দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই। যাকাত ধনীদের উপর ফরয করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ- ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর’ (বাক্বারাহ ২/৪৩)

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ-

‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর। আর তোমরা নিজেদের জন্য যে সকল সৎকর্ম অগ্রিম প্রেরণ করবে, তা তোমরা আল্লাহর নিকটে প্রাপ্ত হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমরা যা কর তা প্রত্যক্ষ করেন’ (বাক্বারাহ ২/১১০)

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত হ’ল অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ  وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ. ‘ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি। (১) আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং  মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল এ কথার সাক্ষ্য  প্রদান করা। (২) ছালাত কায়েম করা (৩)  যাকাত আদায় করা (৪) হজ্জ সম্পাদন করা (৫) রামাযানের ছিয়াম পালন করা’।[1]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আহলে কিতাব বা ইহুদী-খৃষ্টানদের নিকট কোন দাওয়াতী কাফেলা পাঠালে তাদেরকে যে বিষয়গুলির প্রতি দাওয়াত দেওয়ার  নির্দেশ দিতেন তার মধ্যে যাকাতও ছিল। যেমনভাবে হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ لَهُ إِنَّكَ تَأْتِى قَوْمًا أَهْلَ كِتَابٍ فَادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنِّى رَسُولُ اللَّهِ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِى الْيَوْمِ وَاللَّيْلَةِ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِى أَمْوَالِهِمْ تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهَا لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ- আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামানে পাঠাবার সময় বলেন, মু‘আয! তুমি আহলে কিতাবদের (ইহুদী ও খৃষ্টান)  নিকট যাচ্ছ। প্রথমতঃ তাদেরকে এ লক্ষ্যে দ্বীনের প্রতি আহবান করবে। এক আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল। যদি তারা  এটা মেনে নেয় তাহ’লে তাদের সামনে এই ঘোষণা দেবে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর দিন রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। তারা এটা মেনে নিলে তাদেরকে জানাবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয  করেছেন। তাদের ধনীদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করে তাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। যদি তারা এ হুকুমের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাহলে তুমি (তাদের) ভাল ভাল মাল গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। মাযলুমের ফরিয়াদ হ’তে বাঁচার চেষ্টা করবে। কেননা মাযলুমের ফরিয়াদ আর আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে কোন আড়াল থাকে না’।[2] 

যাকাত আদায় না করার পরিণতি :

নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক যাকাত আদায় না করলে সে কবীরা গুনাহগার হবে। যদি সে যাকাতের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে তাহলে সে কাফের হবে। যাকাত পরিত্যাগকারীর পরিণতি অত্যন্ত ভয়ংকর। যে সম্পদ সে জমা করে রেখেছিল অতি যত্নসহকারে, সেই সম্পদের মাধ্যমেই তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।

মহান আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ كَثِيرًا مِنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ- يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ- ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই বহু (ইহূদী-নাছারা) পন্ডিত ও দরবেশ মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে এবং লোকদের আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। বস্ত্ততঃ যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চিত রাখে, অথচ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে তুমি মর্মান্তিক আযাবের সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে সেগুলিকে উত্তপ্ত করা হবে। অতঃপর তাদ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশ সমূহ দাগানো হবে, (আর বলা হবে) এগুলো হ’ল সেইসব স্বর্ণ-রৌপ্য, যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করেছিলে। এক্ষণে তোমরা যা কিছু সঞ্চয় করে রেখেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন কর’ (তাওবাহ ৯/৩৪, ৩৫)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ-

‘আল্লাহ যাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে কিছু দান করেছেন, তাতে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন এটাকে তাদের জন্য কল্যাণকর মনে না করে। বরং এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর। যেসব মালে তারা কৃপণতা করে, সেগুলিকে ক্বিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী হিসাবে পরানো হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্বাধিকারী হ’লেন আল্লাহ। অতএব (গোপনে ও প্রকাশ্যে) তোমরা যা কিছু কর, সবই আল্লাহ খবর রাখেন’। (আলে ইমরান ৩/১৮০)।

নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক যদি যাকাত আদায় না করে তাহ’লে তার সম্পদকে বিষধর সাপে রূপান্তরিত করে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ، لَهُ زَبِيبَتَانِ، يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ- يَعْنِى شِدْقَيْهِ  ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ، أَنَا كَنْزُكَ ثُمَّ تَلاَ ( لاَ يَحْسِبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ ) الآيَةَ - হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে  টেকো (বিষের তীব্রতার কারণে) মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। আল্লাহর রাসূল তিলাওয়াত করেন, আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরেই কিয়ামত দিবসে যা নিয়ে কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে’[3] (ইমরান ৩/১৮০)।

যাকাতের ফরযিয়াতকে অবজ্ঞা করে কাপর্ণ্যতা বশত যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করবে না, কিয়ামতের দিন তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হ’তে হবে। এমর্মে আবু হুরায়রা (রাঃ)  হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সোনা-রূপার (নিছাব পরিমাণ) মালিক হবে অথচ তার হক্ব (যাকাত) আদায় করবে না তার জন্য কিয়ামতের দিন (তা দিয়ে) আগুনের পাত বানানো হবে। এগুলোকে জাহান্নামের  আগুনে এমনভাবে গরম করা হবে যেন তা আগুনেরই পাত। সে পাত দিয়ে তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। তারপর এ পাত পৃথক করা হবে। আবার আগুনে উত্তপ্ত করে তার শরীরে লাগানো হবে। আর লাগানোর সময়ের মেয়াদ হবে পঞ্চাশ হাযার বছর। (এ অবস্থা চলবে) বান্দার (জান্নাত-জাহান্নামের) ফায়ছালা হওয়া পর্যন্ত। তারপর তাকে নেয়া হবে জান্নাত অথবা জাহান্নামে। ছাহাবীগণ আরয  করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! উটের বিষয়টি (যাকাত না দেবার পরিণাম) কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, উটের মালিক যদি এ হক্ব (যাকাত) আদায় না করে (যেদিন উটকে পানি খাওয়ানো হবে সেদিন তাকে দুয়ানোও তার একটা হক্ব), কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তিকে সমতল ভূমিতে উটের  সামনে মুখের উপর উপুড় করে তার সবগুলো উট গুনে গুনে (আনা হবে) মোটা তাজা একটি বাচ্চাও কম হবে না। এসব উট মালিককে নিজেদের পায়ের নিচে ফেলে পিষতে থাকবে, দাঁত দিয়ে কামড়াবে। এ উটগুলো চলে গেলে, আবার আর একদল উট আসবে। যেদিন এমন ঘটবে সেদিনের মেয়াদ হবে পঞ্চাশ হাযার বছর। এমনকি বান্দার হিসাব নিকাশ শেষ হয়ে যাবে। তারপর ঐ ব্যক্তি জান্নাত অথবা জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হবে। ছাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! গরু ছাগলের যাকাত আদায়  না করলে (মালিকদের) কি অবস্থা হবে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি গরু ছাগলের মালিক হয়ে এর হক্ব (যাকাত) আদায় করে না, ক্বিয়ামতের দিন তাকে সমতল ভূমিতে উপুড় করে ফেলা হবে। তার সব গরু ও ছাগলকে আনা হবে একটুও কম-বেশী হবে না। গরু-ছাগলের শিং বাঁকা কিংবা ভাঙ্গা হবে না। শিং ছাড়াও কোনটা  হবে না। এসব গরু ছাগল শিং দিয়ে মালিককে গুতো মারতে থাকবে, খুর দিয়ে পিষবে। এভাবে একের পর আরেক দল আসবে। এ সময়ের মেয়াদও হবে পঞ্চাশ হাযার বছর। এর মধ্যে বান্দার হিসাব-নিকাশ হয়ে যাবে। তারপর  ঐ ব্যক্তি জান্নাত অথবা জাহান্নামে তার গন্তব্য দেখতে পাবে।

ছাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ঘোড়ার অবস্থা কি হবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ঘোড়া তিন প্রকারের। প্রথমতঃ যা মানুষের জন্য গুনাহের কারণ হয়। দ্বিতীয়তঃ যা মানুষের জন্য পর্দা। আর তৃতীয়তঃ মানুষের জন্য ছওয়াবের কারণ।

যে সব ঘোড়া গুনাহের কারণ তা হ’ল, ঐ মালিকের ঘোড়া, যেগুলোকে সে মুসলিমদের উপর তার গৌরব, অহংকার ও শৌর্যবীর্য দেখানোর জন্য পালন করে। আর মালিকের জন্য পর্দা হবে ঐ ঘোড়া, যে মালিক  আল্লাহর পথে ঘোড়ার লালন-পালন কওে এবং সেগুলোর পিঠ ও গর্দানের ব্যাপারে আল্লাহর হক্ব ভুলে যায় না। মানুষের জন্য ছওয়াবের কারণ হবে ঐসব ঘোড়া, যে মালিক আল্লাহর পথের মুজাহিদদের জন্য তা পালন করে। এদেরকে সবুজ মাঠে রাখে। এসব ঘোড়া যখন আসে ও চারণভূমিতে সবুজ ঘাস খায়, তখন ওই (খোসের সংখ্যার সামান্য) ছওয়াব তার মালিকের জন্য লেখা হয়। এমনকি এদের গোবর ও পেশাবের পরিমাণও তার জন্য ছওয়াব হিসাবে লেখা হয়। সেই ঘোড়া রশি ছিড়ে যদি এক বা দুই ময়দান দৌড়ে ফিরে, তখন আল্লাহ তা‘আলা এদের কদমের চি‎হ্ন ও গোবরের (যা দৌড়াবার সময় করে) সমান ছওয়াব তার মালিকের জন্য লিখে দেন। যদি এসব ঘোড়াকে  পানি পান করানোর জন্য নদীর কাছে নেয়া হয়, আর এরা নদী হ’তে পানি পান করে, তাহ’লে আল্লাহ তা‘আলা ঘোড়াগুলোর পান করা পানির পরিমাণ ছওয়াব ওই ব্যক্তির জন্য লিখে দেন, যদিও মালিকের পানি পান করানোর ইচ্ছা না থাকে। ছাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! গাধার ব্যাপারে কি হুকুম? তিনি বললেন, গাধার ব্যাপারে আমার উপর কোন হুকুম নাযিল হয়নি। সকল নেক কাজের ব্যাপারে এ আয়াতটিই  যথেষ্ট ‘যে ব্যক্তি এক কণা পরিমাণ নেক আমল করবে তা সে দেখতে পাবে। আর যে ব্যক্তি এক কণা পরিমাণ বদ আমল করবে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)[4]

গচ্ছিত সম্পদের যাকাত আদায় না করলে কিয়ামতের দিন তা সাপের আকৃতিতে রূপান্তরিত হবে এবং মালিকের হাতে দংশন করতে থাকবে। কেননা সে হাত দ্বারাই সম্পদ অর্জন করেছিল। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَكُونُ كَنْزُ أَحَدِكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ يَفِرُّ مِنْهُ صَاحِبُهُ، وَهُوَ يَطْلُبُهُ حَتَّى يُلْقِمَهُ أَصَابِعَهُ ‘ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের ধনসম্পদ বিষধর সাপের রূপ ধারণ করবে। মালিক এর থেকে পালিয়ে থাকবে আর সে মালিককে খুঁজতে থাকবে। পরিশেষে সে মালিককে পেয়ে যাবে এবং তার আঙ্গুলগুলোকে লোকমা বানিয়ে মুখে পুরবে’।[5]

যাকাত আদায়ের ফযীলত :

যাকাত আদায় করা ফরয। যে ব্যক্তি এর ফরযিয়াতকে মেনে নিয়ে যাকাত আদায় করবে মহান আল্লাহ তাকে এর বিনিময়ে নেকী দান করবেন। কিয়ামতের দিন তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিত ও হবে না। এমর্মে মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ- ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্মাদি সম্পাদন করে, ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৭)

যাকাত আদায় করার মাধ্যমে সঠিক পথের উপর টিকে থাকা যায় এবং সঠিক পথে থাকার মাধ্যমে সফলতা লাভ করা যায়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ- ‘আল্লাহর মসজিদ সমূহ কেবল তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। যারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। নিশ্চয়ই তারা সুপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (তাওবাহ-৯/১৮)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ بِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ-أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘যারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আখেরাত সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে। এরাই তাদের প্রতিপালকের প্রদর্শিত পথে আছে এবং এরাই সফলকাম’ (লোক্বমান ৩১/৪-৫)

আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ তার নির্দেশিত পথে ব্যয় করলে তথা যাকাত আদায় করলে তা দ্বিগুন, বহুগুন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ رِبًا لِيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِنْدَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ ‘লোকদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে মনে করে তোমরা যে সুদ প্রদান করে থাক, আল্লাহর নিকটে তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। পক্ষান্তরে (জান্নাতে) আল্লাহর চেহারা অন্বেষণে তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক, তারা বহুগুণ লাভ করে থাকে’ (রূম ৩০/৩৯)

অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّ الْمُصَّدِّقِينَ وَالْمُصَّدِّقَاتِ وَأَقْرَضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعَفُ لَهُمْ وَلَهُمْ أَجْرٌ كَرِيمٌ ‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী এবং যারা আল্ল­াহকে উত্তম ঋণ দেয়, তাদেরকে দেওয়া হবে বহুগুণ। আর তাদের জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরষ্কার’ (হাদীদ ৫৭/১৮)

যারা যাকাত আদায় করবে ও আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করবে তারা আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘আর মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎ কাজের আদেশ করে ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এসব লোকের প্রতি আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান’ (তাওবাহ ৯/৭১)

অন্যত্র তিনি বলেন, وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হ’তে পার’ (নূর ২৪/৫৬)

যাকাতের ফযীলত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অত্যন্ত  চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ أَعْرَابِيًّا أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ دُلَّنِى عَلَى عَمَلٍ إِذَا عَمِلْتُهُ دَخَلْتُ الْجَنَّةَ. قَالَ  تَعْبُدُ اللَّهَ لاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيمُ الصَّلاَةَ الْمَكْتُوبَةَ، وَتُؤَدِّى الزَّكَاةَ الْمَفْرُوضَةَ، وَتَصُومُ رَمَضَانَ. قَالَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ أَزِيدُ عَلَى هَذَا . فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى هَذَا. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, এক বেদু্ঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলুন যে আমলের মাধ্যমে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর ইবাদত করবে আর তার সাথে অপর কোন কিছু শরীক করবে না। ফরয ছালাত আদায় করবে। ফরয যাকাত প্রদান করবে। রামাযান মাসে ছিয়াম পালন করবে। সে বলল, যার হাতে আমরা প্রাণ রয়েছে তার শপথ করে বলছি, আমি এর চেয়ে বেশী করব না। যখন সে ফিরে গেল, নবী করীম (ছাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি কোন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখতে পসন্দ করে সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে নেয়’।[6] হাদীছে আরও এসেছে, عَنْ أَبِي أُمَامَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلُّوا خَمْسَكُمْ، وَصُومُوا شَهْرَكُمْ، وَأَدُّوا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ، وَأَطِيعُوا ذَا أَمْرِكُمْ، تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ. আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর, রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর, তোমাদের সম্পদের যাকাত প্রদান কর এবং আমীরের আনুগত্য কর; তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ কর’।[7] 

 (ক্রমশঃ)

 [লেখক : কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ ]


[1]. বুখারী হা/০৮।

[2]. বুখারী হা/১৩৯৫, ১৪৫৮, ১৪৯৬; মুসলিম হা/১৯; আবুদাউদ হা/১৫৮৪; তিরমিযী হা/৬২৫; মিশকাত হা/১৭৭২।

[3]. বুখারী হা/১৪০৩; মিশকাত হা/১৭৭৪।

[4]. মুসলিম হা/৯৮৭; মিশকাত হা/১৭৭৩।

[5]. আহমাদ হা/১০৮৮৫; মিশকাত হা /১৭৯১।

[6]. বুখারী হা/১৩৯৭, ১৩৯৬।

[7]. তিরমিযী হা/৬১৬; মিশকাত হা/৫৭১।



আরও