দুর্গশহর কোয়েটায়..

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 289 বার পঠিত

পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের নানা শহর-বন্দর পাড়ি দিয়ে প্রায় ২ দিন টানা জার্নির পর বালুচিস্তানের রাজধানী দুর্গ শহর কোয়েটায় পা রেখেছি ১৩ অক্টোবর’১৩ বুধবার বিকালে। ইসলামাবাদের হিসাবে সূর্য তখন পাটে যায় যায় হওয়ার কথা। তবে কোয়েটায় তখনও ঘন্টাখানিক সময় বাকি। বালুচ সহযাত্রীদের বিদায় জানিয়ে আমি আর শাহীন (আমাদের আত্মীয় ও সমবয়সী বন্ধু, কোয়েটায় বোলান মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকুরীরত) ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। রেলস্টেশনের অভ্যন্তরে না ঢুকে উল্টো পথে কয়েক সারি রেললাইন অতিক্রম করে এগুলাম স্টেশন রোডের দিকে। রেললাইনের উপর কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষের পুরানো পরিত্যক্ত যাত্রীবাহী ট্রেনের সারি। সম্পূর্ণ কাঠের ফ্রেমের বগিগুলো। একটার ভিতরে ঢুকে মনে হল হঠাৎই যেন টাইম মেশিনে চড়ে সেই মেঘের মত ধোঁয়া উড়িয়ে চলা প্রাচীন স্টীম ইঞ্জিনের যাত্রী হয়ে গেছি।

স্টেশন রোডে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর লোকাল ট্রান্সপোর্টের একটি বাস আসতে দেখা গেল। এখানকার লোকাল ট্রান্সপোর্ট বলতে সিএনজি (এদের ভাষায় রিকশা)। আর ২০ মিনিট পর পর একটি মুড়ির টিন মার্কা বাস পর্যন্তই সীমিত। এর বাইরে বাকি সব প্রাইভেট গাড়ি কিংবা মটর সাইকেল। দু’চারটা গাধা-খচ্চর টানা কার্ট ছাড়া ইঞ্জিনবিহীন কোন যানবাহন রাস্তায় নেই। বাস না থামতেই বিচিত্র সুরেলা কণ্ঠে হেলপারের চিৎকার বারূ...রী.., বারূ...রী..। তারপর বাসে উঠার জন্য সামনের দরজার পাদানিতে পা রাখতেই লক্ষ্য করলাম সামনের অর্ধেকটা অংশ পুরোপুরি মহিলাদের দখলে। মাঝখান থেকে টপ-টু-বটম ব্লক করা, তারপর পিছনের অংশটা পুরুষদের। অগত্যা নেমে এসে পিছনের দরজা দিয়ে উঠলাম। বাসে ভীড় না থাকলেও কোন সীট ফাঁকা নেই। ভাবছি দাঁড়িয়েই যেতে হবে। কিন্তু একদম সামনের সীটে বসা ৯-১০ বছরের ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বসার জন্য ইশারা করল। শাহীন জানালো, এখানে বড়দের উপস্থিতিতে ছোটরা সীটে বসে না। এটা কেবল ভদ্রতা নয়, এখানকার অবশ্য পালনীয় রীতি। শুরুতেই এই নতুন দু’টো ব্যাপার দেখে বেশ ভাল লাগল।

শাহীনের ভাষ্যমতে, এই শহরকে বহিরাগতরা ‘তালেবান শহর’ বলে। এখানে কোথাও কোন বেপর্দা মহিলা দেখা যায় না। শার্ট-প্যান্ট-স্যুট পরিহিত লোকেরও দেখা মেলা ভার। কোলের শিশু থেকে শুরু করে শতবর্ষী বৃদ্ধ, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুচী পর্যন্ত সবারই ঐ একই পোষাক। এমনকি ট্রাকের তলায় শুয়ে কালি মেখে ভুত হয়ে যে লোকটি সার্ভিসিং-এর কাজ করছে, তারও গায়ে সেই পোষাক অর্থাৎ  ৩-৪ গজী চওড়া কুচিদার পাঠানী ঢোলা পাজামা আর কাবুলী কামীজ (আমাদের ব্যবহৃত শব্দ ‘পাঞ্জাবী’ এখানে কামীজ, কোর্তা বা স্যুট নামে ব্যবহৃত হয়। পাঞ্জাব প্রদেশের অধিবাসীরা এই জাতীয় ড্রেস পরে বলেই আমাদের কাছে এর নাম ‘পাঞ্জাবী’, কিন্তু যেই নিয়তে আমরা ‘পাঞ্জাবী’ উচ্চারণ করি, তাতে ‘পাঞ্জাবে’র কথা ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসে না। নইলে আমাদের বাহাদুর দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা শব্দ-ব্যবচ্ছেদ করে নিশ্চিতভাবে আমাদের এই প্রিয় পোষাক থেকে ‘পাঞ্জাব’ নামক ‘পাকিস্তানী ভুত’ তাড়াতে আন্তরিক হতেন)। এটাই এদের জাতীয় পোষাক। পার্থক্য একটাই, মাদরাসা-মসজিদ সংশ্লিষ্টরা পরে সাধারণ কলারের পাঞ্জাবী আর অন্যরা শার্ট কলারের। প্রত্যেকের মাথায় রুমাল, পাগড়ী বা টুপি জাতীয় মস্তকাবরণ কিছু একটা সাধারণতঃ থাকেই। বয়স্ক বালুচী পাঠানদের কাঁধে থাকে বিশেষ চাদর আর হাতে তাসবীহ। সময়-অসময় নেই একটু ফাঁক পেলেই এনাদের হাতের তাসবীহ দানাগুলো সচল হয়ে ওঠে। তবে কাজটি চলে এমন সুতীব্র গতিতে যে সেটা তাসবীহ গণনা নাকি অবসর কাটানো ক্রীড়া তা ঠাওর করতে বেগ পোহাতে হয়। মহিলাদের সম্মানের দিকটা এরা সবসময় খেয়াল রাখে। এজন্য টাউন সার্ভিসের প্রতিটি বাসই পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পার্টিশন দিয়ে দুইভাগে ভাগ করা। এমন কোন খাবার হোটেল নেই, যেখানে মহিলাদের বসার জন্য পর্দাটানা পৃথক ব্যবস্থা নেই। মোটামুটি ধর্মীয় আবহ লক্ষ্য করা যায় সর্বত্রই। এদের জাতিসত্ত্বার সাথে ধর্মীয় কালচারটা যে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এদের ছালাতের অভ্যাসটাও বেশ প্রশংসনীয়। আসার সময় ট্রেনে দেখছিলাম আমাদের বগির বালুচ ছেলেদের বেশ কয়েকজনকে স্টেশনে ট্রেন থামলে প্লাটফর্মেই চাদর পেতে ছালাতে দাঁড়াতে। যদিও বিদ্যুৎগতির সে ছালাতে খুশু-খুযু’র অস্তিত্ব টের পাওয়া খুব শক্ত। আবার শাহীনের দারস্থ হলাম। ও বলল, ধর্মটা আসলে এদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের আচরিত সামাজিক কালচার। ধর্মীয় আচারাদি পালনে এরা অনেক অগ্রগামী বটে, তবে প্রকৃত সচেতনতার সাথে ধর্ম পালন করে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ধরাধামের আর সব জায়গার মত এখানেও দুষ্কর।     

২০ মিনিট পর শহরের দক্ষিণে বারূরী রোডস্থ বোলান মেডিকেল কলেজ (বিএমসি) হাসপাতালের সামনে এসে বাস দাঁড়িয়ে গেল। মেডিকেল কলেজ থেকে ৫ মিনিটের পায়দল দূরত্বে শাহীনদের হোস্টেল। ফ্রন্টিয়ার করপ্স (এফসি)-এর নিরাপত্তা চৌকিটি পেরিয়ে দোতলা হোস্টেলটিতে ঢুকলাম। বিএমসির বাঙালী স্টুডেন্ট আব্দুল আযীয (ফেনী) আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। গোসল সেরে খেতে বসলাম। খিচুড়ি আর ডিম ভাজার আয়োজন করেছে আব্দুল আযীয। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে পাকিস্তান এসেছি, অথচ মনে হল অনন্তকাল পর আজ বাঙালী খানা খাচ্ছি। খুব তৃপ্তি ভরে খেলাম। একটানা রুটি, আর তেলে ভাজা চাউল (ফ্রাইড রাইস) খেয়ে এ ক’দিনেই হাপিয়ে উঠেছি (পাকিস্তানীরা ভাতকে বলে চাউল, প্রথম প্রথম হোটেলে ঢুকে ’ভাতের’ পরিবর্তে ‘চাউল’ চাওয়াটা ছিল বড় অস্বস্তির)।

হোস্টেলটি বিএমসির ফরেনার স্টুডেন্টদের বলে সুযোগ-সুবিধা বেশ ভালই। শাহিনের সিঙ্গেল রুমটিতে এটাচ্ড বাথসহ রুম হিটার ও ফ্রীজের ব্যবস্থা রয়েছে। রুমের আসবাবপত্র, কিচেন সামগ্রী, এমনকি লাইট বাল্বগুলো পর্যন্ত বিএমসি থেকে সরবরাহ করা হয়। রুম ভাড়া দিতে হয় বার্ষিক মাত্র ৫০০০ রুপী। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শতাধিক ফরেনার ছাত্র এখানে পড়াশোনা করে। হোস্টেল মসজিদে ছালাত পড়তে গিয়ে মনে হল যেন আহলেহাদীছ মসজিদ। আরব আর আফ্রিকানরা সবাই সালাফী আক্বীদা-আমলসম্পন্ন। ফিলিস্তীনের গাজা থেকে আসা মুহাম্মাদের সাথে পরিচিত হতে গিয়ে সে নিজেকে সরাসরি আহলেহাদীছ বলেই পরিচয় দিল।

পরদিন সকালে কোয়েটার সুপ্রসিদ্ধ লিয়াকত বাজার এবং জিন্নাহ বাজার ঘুরে আসলাম। নানা পদের প্রচুর তাজা এবং শুকনা ফলমূলে ভরপুর বিরাট কাঁচাবাজারটি। সদ্য পেড়ে আনা তাজা আপেলের স্বাদের সাথে আমাদের চিরচেনা আপেলের যে কত তফাৎ তা এক টুকরা গালে নিতেই বোঝা গেল। সেই সাথে তাজা আঙ্গুর আর কমলার পসরা। সব্জির বাজারে টাটকা শাক-সব্জি দেখে টাশকি খাওয়ার দশা। এই মরুভূমিতে এত সব্জির সমারোহ দেখতে পাব কল্পনাই করিনি।

পরে জানতে পারলাম, কোয়েটা শহর নাকি সারা পাকিস্তানেই ফলমূলের জন্য বিখ্যাত। এ জন্য এর আরেক নাম ‘ফ্রুট গার্ডেন অফ পাকিস্তান’ বা পাকিস্তানের ফলের বাগান। কোয়েটা শহরের ২৫ কি.মি. উত্তরের ‘উরাক’ ভ্যালিকে বলা হয় ‘ছামারিস্তান’ বা ফলের দেশ। এখানে মাইলের পর মাইল আপেল গাছের সারি চাঁপাইয়ের আম বাগানের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ উচ্চতার শহর (১৬৮০ মিটার বা ৫৫০০ ফুট) হওয়ার কারণে এখানে পানি সংকট অত্যাধিক। মটর দিয়ে পানি তুলতে মাটির নিচে কমপক্ষে ৩০০-৩৫০ ফুট গভীর পাইপ বসাতে হয়। শহরের পার্শ্বস্থ এলাকায় স্যুয়ারেজের পানি ব্যবহৃত হয় চাষাবাদে। এর মধ্য দিয়েই নির্বিঘ্নে চাষাবাদ চলছে। শাক-সব্জির দাম যে পাকিস্তানের অন্যান্য শহরের তুলনায় বেশী, তাও নয়।                           

শাহীনের এক আফগানী বন্ধুর সৌজন্যে দুপুরের খাবার খেলাম লিয়াকত বাজারে নেহারীর জন্য সুপ্রসিদ্ধ হোটেল মাশহাদে। পাকিস্তানে এসে এই প্রথম স্থানীয় কোন খাবার খেলাম খুব তৃপ্তির সাথে। আফগানী রুটির সাথে বিরাট সাইজের পায়া (গরু বা মহিষ), যা একার পক্ষে খেয়ে শেষ করা কঠিন। বালুচ ও পশতুনরা পায়া বা নেহারীর চরম ভক্ত। গোশতের বাজারে ঢুকলে প্রথমেই দেখা যাবে থরে থরে সাজিয়ে রাখা গরু-মহিষ-ছাগল-দুম্বার পা। আরেকটা জিনিস হল কাঠি কাবাব। আমাদের শিক কাবাবের মতই অনেকটা। তবে গোশতের টুকরাগুলো বড় বড়। প্রায় রাস্তার মোড়ে এই কাবাবের অস্থায়ী দোকান দেখা যায়। এছাড়া সাজ্জি কাবাব (মুরগি বা ভেড়ার রান দিয়ে তৈরী বিশেষ রোস্ট), লান্ধি কাবাব (ভেড়ার পূর্ণ রানের রোস্ট), খাদি কাবাব ইত্যাদি এখানে সুপ্রসিদ্ধ। পাকিস্তানের আর সব প্রদেশের মত এদেরও প্রধান খাবার রুটি। এখানে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় কিছু না হলেও অন্তত একটা রুটির দোকান থাকবেই। নিতান্ত বিপদে না পড়লে এই রুটি বাড়িতে তৈরী করার ঝক্কিতে যেতে চায় না কোন গৃহকর্তী। তাই দোকানের রুটিই এদের ভরসা।

খাওয়া শেষে কান্দাহারের বাসিন্দা ঐ আফগানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, চামান তথা কান্দাহার বর্ডার ক্রসিং-এ যেতে চাই, কোন সমস্যা আছে কিনা। শুনেই আঁতকে উঠলেন লোকটা। বলল, ‘কোয়েটা পর্যন্ত এসেছেন এটাই অনেক বেশী হয়ে গেছে। আর অমুখে যাওয়ার চিন্তা ভুলেও করবেন না। ফরেনারদের কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ আদায় করা আফগান সীমান্তবর্তী এলাকার বিদ্রোহী বালুচ যোদ্ধাদের উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম। আমরা আফগানীরা পর্যন্ত প্রাণ হাতে নিয়ে যাতায়াত করি’।

কোয়েটা থেকে বাসে বা ট্রেনে যাতায়াত ব্যবস্থা খুব ভাল চামান বর্ডার পর্যন্ত। ওপারে আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশ। ১২৫ কিঃমিঃ দূরত্বের এই পথে যেতে প্রায় দু’ঘন্টা সময় লাগে। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে মানুষজনের ক্রমাগত ভীতি প্রদর্শনে সে ইচ্ছাকে ছাইচাপা দিতে হল। একই কারণে কোয়েটার প্রধান পর্যটনস্থল গুলো অর্থাৎ উরাক ভ্যালি, পিশিন ভ্যালি, হান্না লেক, মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর অবকাশ কেন্দ্র ‘যিয়ারাত’ একে একে সবই সফর তালিকা থেকে বাদ দিতে হল। একে তো ঈদের মৌসুম, অন্যদিকে জঙ্গি হামলার ভয়। ফলে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরায় বাঁধ সেঁধেছে নানা বিধি-নিষেধ আর ভয়-ভীতির শক্ত আবরণ। বড় দুঃসময়েই যেন অনাহুতের মত এসে বসেছি কোয়েটায়। অবশ্য মৌলিকভাবে যা দেখার ছিল তা লাহোর থেকে কোয়েটার পথে দীর্ঘ ২৪ ঘন্টার ট্রেন যাত্রায় দেখা হয়ে গিয়েছিল। 

পাকিস্তানের আয়তনে সর্ববৃহৎ প্রদেশ এই বালুচিস্তান ইতিহাসের বহু চড়াই-উৎরাইয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সিন্ধু সভ্যতারও বহু পূর্বে ইতিহাসের পাতায় এর নাম পাওয়া যায়। ৬৪৪ খৃষ্টাব্দে খলীফা ওমর (রাঃ)-এর আমলে সুহায়েল বিন আদী (রাঃ)-এর নেতৃত্বাধীন একটি বাহিনী পশ্চিম বালুচিস্তান জয় করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলামের প্রবেশ ঘটে। তারপর ওছমান (রাঃ)-এর আমলে আব্দুর রহমান বিন সামুরাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বাধীন বাহিনী সমগ্র বালুচিস্তান জয় করে এবং এটি খোলাফায়ে রাশেদীনের আওতাভুক্ত রাজ্যে পরিণত হয়। এই অঞ্চলটি আরবদের কাছে অধিক পরিচিত ছিল ‘তুরান’ নামে, যার রাজধানী ছিল কুছদার (যা এখন কোয়েটা থেকে প্রায় ৩০০ কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত একটি যেলা শহর, পশতু উচ্চারণ অবশ্য ‘কুছদার’ নয়, ‘খুযদার’)। বর্তমানে পাকিস্তানের মোট ভূখন্ডের ৪৪ শতাংশই গঠন করেছে এই প্রদেশ। তবে জনবসতি খুবই কম। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৫ ভাগ বাস করে এখানে। তার কারণ এর পুরোটাই পর্বতময় কিংবা পাথুরে মালভূমি, যার মধ্য দিয়ে চলে গেছে মাইলের পর মাইল বালু-পাথরে ভরা ধু ধু মরুভূমি আর শুষ্ক অনাবাদি সমভূমি। সারাবছর বৃষ্টিপাত নেই বললেই চলে। ফলে সাধারণত কোন ফসলাদিও হয় না। কোন উঁচু গাছ-পালাও নেই। আবার শীতকালে এমন ঠান্ডা পড়ে যে তুষারপাত হয়। এই প্রদেশেরই বর্তমান রাজধানী দুর্গ শহর কোয়েটা। বালুচিস্তানের এক-পঞ্চমাংশ মানুষ তথা প্রায় ২০ লক্ষ অধিবাসী বসবাস করে এ শহরে। চতুর্দিক থেকে চিল্টান, টাকাটু, যারগুণ ও মারদার নামক চারটি পর্বত একে প্রবল প্রতাপ নিয়ে ঘিরে রেখেছে দুর্গের মত। এই কারণেই সম্ভবত এর নাম ‘কোয়েটা’, পশতু ভাষায় যার অর্থ ‘দুর্গ’। পাহাড়গুলোর সবগুলোরই সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ১০,০০০ ফুটের উপরে। পূর্বদিকের যারগুণ পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গটির উচ্চতা ৩৫৭৮ মিটার বা ১১,৭৩৮ ফুট, যা সমগ্র বালুচিস্তানেরই উচ্চতম শৃঙ্গ। এই পাহাড়গুলোর ঢালের উপর গড়ে উঠেছে শহরটি আর ক্রমশ ঢালু হয়ে কেন্দ্রস্থলে উপনীত হয়েছে। ফলে শহরের যে কোন প্রান্তে দাঁড়ালে স্টেডিয়ামের গ্যালারী থেকে দৃশ্যমান ফুটবল মাঠের মত পুরো শহরটা দৃষ্টির সামনে অবারিত হয়ে ধরা পড়ে। বিরাট শহরটি তখন মনে হতে থাকে অতিশয় ক্ষুদ্র, হাতের মুঠোয় নিয়ে ধরার মত বস্ত্ত। আর রাতের বেলার সে অদ্ভুত ঝলমলে সৌন্দর্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। অবাক করা ব্যাপার হল, এখানে খোলা ছাদের উপর ওঠাকে সামাজিকভাবে খুব খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়। কারণ তাতে প্রতিবেশীদের প্রাইভেসী নষ্ট হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। বিষয়টি নাকি এতটাই স্পর্শকাতর যে, কখনও এর ব্যত্যয় ঘটলে এমনকি গোলাগুলি পর্যন্ত লেগে যায়। ফলে উন্মুক্ত ছাদের উপর দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মনোহর শোভা উপভোগের সুযোগ এখানে নেই। বার দুয়েক হোস্টেলের ছাদে উঠার চেষ্টা করতে গিয়ে যখন জানলাম অভিনব বিষয়টা, তখন মুখে শাপশাপান্ত করলেও মনে মনে তাদের আত্মমর্যাদাবোধের দিকটা প্রশংসা না করে পারলাম না।  

১৬ অক্টোবর’১৩ বুধবার ছিল ঈদুল আযহা। ঈদ উপলক্ষে গরু বা উট কুরবানী করার তেমন চল নেই এখানে। কুরবানী হিসাবে দুম্বাই এদের প্রথম পসন্দের। তাই ঈদের আগের দিন হোস্টেলে ফেরার সময় বিভিন্ন রাস্তায় দেখলাম কেবল দুম্বা আর ছাগলের সারি। তবে বাংলাদেশের মত উৎসবমুখর আমেজ নেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে। তাছাড়া অধিকাংশ শহরবাসী ক্রেতারা গ্রামাঞ্চলে গিয়ে রাখালদের কাছ থেকে কুরবানীর পশু কিনে নিয়ে আসে। ফলে আমাদের দেশের মধ্যে ঘটা করে আলাদা ‘বিরাট গরু-ছাগলের হাট’ বসানোর দরকারও হয় না।

পরদিন  ঈদের ছালাত আহলেহাদীছ জামা‘আতে পড়ার সুযোগ পেয়ে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিলাম খুবই। এই বিচ্ছিন্ন জগতে এসে আহলেহাদীছ আক্বীদার দেখা পাব, এটা সত্যিই ভাবনার বাইরে ছিল। জামা‘আতে উপস্থিত মুছল্লী সংখ্যা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম। পরে আব্দুল বাছীর ভাইয়ের কাছে যা শুনলাম, তাতে শহরে আহলেহাদীছের সংখ্যা নিতান্ত কম তো নয়ই, বরং শহরের অভ্যন্তরভাগে এবং শহরতলীর বিভিন্ন এলাকা মিলে এই কোয়েটায় ছোট-বড় প্রায় ২৫-৩০টি আহলেহাদীছ মসজিদ আছে। রয়েছে ৪/৫টি আহলেহাদীছ মাদরাসা এবং দু’টি আহলেহাদীছ সংগঠনের (মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ ও জামা‘আতুত দাওয়াহ) সক্রিয় কার্যক্রম। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোন একটি মসজিদ-মাদরাসা বা সাংগঠনিক অফিসে যাওয়ার সুযোগ করতে পারলাম না।    

ঈদের দিনে অনেকটা সময় ধরে পাশ্ববর্তী পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়েছি। এদের কুরবানী, খোলা মাঠে রঙ-বেরঙের পোষাকে শিশু-কিশোরদের খেলাধূলা, উট ও ঘোড়া বিচিত্র সাজে সাজিয়ে রাখালদের বিচরণ আর তাতে চড়ে বাচ্চাদের ঘুরে বেড়ানো, পশ্চিমের চিল্টান পাহাড়ের পাথুরে গাত্রে চড়ে কোয়েটা শহরকে মুঠোবন্দী করে দেখা সবকিছু বেশ উপভোগ করেছি। ভাল লেগেছে কোথাও উচ্চস্বরে গান-বাদ্য বাজানোর ব্যবস্থা না দেখে। যদিও এরা যে গান-বাজনার যথেষ্ট ভক্ত তা বোঝা যায় সিএনজি বা লোকাল গাড়িতে চড়লে।

যে এলাকায় ছিলাম সেখান থেকে ‘হাজারা’ টাউন শুরু হয়েছে। এরা মূলত মধ্য আফগানিস্তানের হাজারা সম্প্রদায়ভুক্ত শী‘আ। বর্তমানে এদের বিরাট একটা অংশ আফগানিস্তান থেকে হিজরত করে কোয়েটায় এসে বসবাস করছে। সংখ্যায় প্রায় ৭০ হাযারের মত। এদের বিরুদ্ধে প্রায়ই জঙ্গী হামলা হয়ে থাকে। বিশেষ করে সুন্নীপন্থী জঙ্গী গ্রুপ লস্করই-জংভী এদেরকে কোয়েটা থেকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে আসছে। গত ১৬ই ফেব্রুয়ারী’১৩ এখানে এক পানির ট্যাংকিতে পেতে রাখা বোমার ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রায় দেড়’শ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং আহত হয়েছিল কয়েক শত। সেকারণে এই টাউনের প্রতিটি গলিতে দেখলাম ছোট ছোট ব্যারাক বানিয়ে নিরাপত্তা সংস্থা এফসি’র সশস্ত্র প্রহরা। এই ঈদের দিনেও এর কোন ব্যত্যয় নেই। 

মটর সাইকেল এদের অতিপ্রিয় এবং অপরিহার্য বাহন। এখানকার প্রায় প্রতিটি বস্তিবাড়ীতে পর্যন্ত মটর সাইকেল শোভা পায়। রাখালেরা মরুভূমিতে দুম্বা চরাতে যায় মটরসাইকেলে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাথরের মাঝে ফাঁক খুঁজে খুঁজে সর্পিল পথে মটর সাইকেল চালানোর সে দৃশ্য দেখে ছোটকালের সেই মটোরেসার গেমের রকি ট্র্যাক-এর কথা মনে পড়ে গেল। ৮-১০ বছরের ছোট্ট বাচ্চা-কাচ্চা যে দক্ষতার সাথে মটর সাইকেল চালায়, তা অবাক করার মত। ঈদের দিন বিকেল হতেই রাস্তায় রাস্তায় কুচিদার ঢোলা পায়জামা ফুলিয়ে বালুচ তরুণরা সাইলেন্সারহীন মটরসাইকেল চালিয়ে বেড়াচ্ছিল বিকট আওয়াজ তুলে। দৃশ্যটা বিরক্তিকর হলেও এক নতুন অভিজ্ঞতা ছিল বটে। রাতে প্রথমবারের মত কোন তাবলীগী মারকাযে গিয়ে বয়ান শোনা আর শাহী আয়োজনের খানাপিনায় অংশগ্রহণ করার অভিজ্ঞতাটাও নেহায়েত মন্দ হয়নি।

ঈদের দু’দিন পর শাহিনের এক বন্ধু নাযির ভাইয়ের গাড়িতে আমরা গেলাম কোয়েটার এক বিস্ময়কর পাহাড়ী গুহা ‘জাবালে নূরুল কুরআন’-এ। চিল্টান পর্বতশ্রেণীর একটি পাহাড়ের মাঝামাঝি একটা অংশ জুড়ে মনুষ্য নির্মিত এই গুহায় সংরক্ষণ করা হয়েছে এখন পর্যন্ত ২ লক্ষেরও বেশী অব্যবহৃত, পরিত্যক্ত কুরআন মাজীদ। সমগ্র পাকিস্তান থেকে এই কমপ্লেক্সের কর্তৃপক্ষ পরিত্যক্ত কুরআন সংগ্রহ করে থাকে এবং বস্তাবন্দী করে গুহায় সংরক্ষণ করে। এসব কুরআন পরিবহনের জন্য এদের নিজস্ব কয়েকটি গাড়িও আছে। ১৯৯২ সালে এই অভিনব কার্যক্রমের সূচনা হয়। পরবর্তীতে সরকার পাহাড়ের এই অংশটি কমপ্লেক্সকে দান করে। অবশ্য সরকারী কোন সহযোগিতা প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণ করে না। কেবল মানুষের ব্যক্তিগত ডোনেশন দিয়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

১৯৯২ সালে জনৈক হাজী আল্লাহ নূর দাভী নামক এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে এই প্রকল্পটি শুরু করেন। পরে তাঁর এই অভিনব ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে অনেকেই সহায়তা করেন। সেই থেকে এই পাহাড়ের অভ্যন্তরভাগে অব্যাহতভাবে টানেল খোঁড়ার কাজ চলছে। প্রায় ১৫/১৬টি টানেল লম্বালম্বি কিংবা আড়াআড়িভাবে বিভিন্ন দিকে গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। তবে প্রতিটি টানেলই আবার একে অপরের সাথে সাব-টানেল দিয়ে সংযুক্ত। গোলকধাঁধায় যেন না পড়তে হয় এ জন্য দিকনির্দেশক সাইন দেয়া আছে। গুহা খুড়তে শাবল, গাইতি ছাড়া কোন মেশিনারিজ ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা হয় না। এজন্য গুহা গাত্র জুড়ে এবড়ো থেবড়ো পাথর-মাটি দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এটা প্রাকৃতিক গুহা নয়। এই গুহাগুলোতেই মানুষের হাটার জন্য পথ রেখে বাকি অংশে অথবা সাব-টানেলগুলোতে প্লাস্টিকের বস্তায় বেঁধে হাযারো কুরআনের কপি স্তূপ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। দর্শকদের সুবিধার জন্য ভিতরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে ছালাতেরও জায়গা করে দেয়া আছে। সন্দেহ নেই বহু মানুষ স্থানটিকে বিশেষ বরকতময় মনে করে নানা শিরক-বিদ‘আতে লিপ্ত হয়। অনেককেই দেখলাম এসব জায়গায় ছালাত আদায়সহ যিকির-আযকারে মশগুল থাকতে।

গুহার প্রধান গেটে ঢোকার মুখে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে বিভিন্ন যুগে প্রকাশিত নানা আকৃতির কুরআন। প্রাচীন আমলের প্রকাশিত বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীরও রাখা হয়েছে সেখানে। পয়সার আকৃতির অতি ক্ষুদ্র কয়েকটি কুরআনও দেখলাম। কর্তৃপক্ষের সংগ্রহ তালিকায় একটি বাংলা অনুবাদ কুরআনের কথা লেখা ছিল। তবে অনেক খুঁজেও আমি শোকেসে পেলাম না।

বাইরে বের হয়ে দেখলাম একটি বিশাল গুদাম ঘরে সদ্য আগত কয়েকশ’ বস্তা কুরআন ভিতরে প্রবেশ করানোর অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। তারপর মূল কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে পার্কিং লটে দাঁড়ালাম আমরা। মেইন রাস্তা থেকে পাহাড়ের উপর প্রায় ১০০ মিটার উঁচুতে এ স্থানটি। কোয়েটা শহরের বার্ড-ভিউটা এবার খুব চমৎকারভাবে নযরে আসল। বিস্তীর্ণ মরুভূমির বুকে বিশাল বিশাল স্মৃতিসৌধের মত পাহাড়গুলো সগৌরবে দন্ডায়মান। আর তাদেরই কোলে পরম যত্নে কেউ যেন ছবির মত শহরটা আঁকিয়ে রেখেছে। ওদিকে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে তখন শহরের ঠিক মাথার উপর পূর্ণিমার ঝাপসা বিশাল চাঁদটাও তোড়জোড় শুরু করেছে আপন উজ্জ্বল্যে ফেরার প্রতীক্ষায়। সে এক অবর্ণনীয় মুহূর্ত। আঠার মত চোখজোড়া লেগে আছে সেদিকে আর অন্তরজুড়ে বয়ে যাচ্ছে এক অপার্থিব শিহরণ। মনে হ’ল অনন্তকাল ঝিম ঝিম চোখে এ দৃশ্যই কেবল দেখতে থাকি। মাগরিবের ছালাতটা সেখানেই আদায় করে ফিরে আসলাম হোস্টেলে।

‘জাবালে নূরুল কুরআন’ পাহাড়ের এই আইডিয়াটা আমার কাছে খুব ইউনিক মনে হয়েছে। উদ্যোক্তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল অবহেলা-অযত্নে পড়ে থাকা কুরআনের নুসখার মর্যাদা সংরক্ষণ করা এবং এ ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা জাগ্রত করা। সেই উদ্দেশ্যে তারা কতটুকু সফল হয়েছেন জানা নেই, তবে এখানে কোন ব্যক্তি একবার আসলে এই বোধটুকু নিশ্চয়ই জাগ্রত হবে যে, অব্যবহৃত কুরআনের নুসখাগুলো ধুলোবালির মধ্যে অযত্নে ফেলে রাখা কোনভাবেই সমীচীন নয়। হাদীছের নির্দেশ অনুযায়ী হয় মাটিতে পুতে ফেলতে হবে, নতুবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে, কিংবা পানিতে ডুবিয়ে দিতে হবে। কার্নিশে বা স্টোর রুমে অবহেলায় ফেলে রেখে কুরআনের প্রতি যে অসম্মানমূলক আচরণ আমরা প্রায়ই করে থাকি, তা সত্যিই দুঃখজনক।

কোয়েটা শহরে বিএমসি হোস্টেলে অবস্থানরত দু’জন বাঙালী ছাড়া কর্মসূত্রে আরও দু’একজন বাঙালী আছে শুনেছিলাম। ঈদের ক’দিন পর শাহীন ওর এক বাঙালী আন্টির বাড়িতে নিয়ে গেল। ষাটোর্ধ্ব বয়সী সেই আন্টিকে ৭১-এর যুদ্ধের সময় এক পাকিস্তানী কর্ণেল বিয়ে করে এনেছিলেন। সেই থেকে তিনি পাকিস্তানে আছেন। শশুরবাড়ী পেশাওয়ার। তবে উনার স্বামী কোয়েটাতেই বাড়ি করে স্থায়ী হন। কয়েকবছর পূর্বে তিনি মারা গেছেন। বর্তমানে আন্টি তাঁর এক ছেলে আর পুত্রবধু নিয়ে এই বাড়িতে বসবাস করছেন। তাঁর মেয়ে থাকে আমেরিকায়। প্রতিবছর একবার করে তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে তাঁর আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে যান। স্বামী অঢেল ধন-সম্পদ রেখে গেছেন। ফলে খুব স্বচ্ছলভাবেই জীবন কাটাচ্ছেন। ছেলে আলী ভাইয়ের সাথে কথা হ’ল। আলাপ-ব্যবহারে খুব ভদ্র ও সহজ-সরল, আর মনেপ্রাণে এখন পুরোপুরি পাকিস্তানী। কোয়েটার কোন এক সরকারী অফিসে বড় চাকুরী করেন। বাংলাদেশে দু’একবার গেলেও বাংলা জানেন না। আন্টি আগেই শাহীনকে ফোন করে দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন, তবে বাঙালী রান্না না খাইয়ে খাওয়ালেন পাকিস্তানী রান্না। দুম্বার রোস্ট, মুরগীর রোস্ট, কলিজা ভুনা, আরো নাম না জানা কিছু আইটেম আর সাথে সেই রুটি। আমার পাকিস্তানে এসে ভাতের কষ্টে থাকার কথা শুনে উনি খুব আফসোস করলেন ভাত রান্না করেননি বলে। খাওয়া শেষে উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দেশ ছেড়ে এভাবে এতদিন আছেন, খারাপ লাগে না’। উনি পরিতৃপ্তির সুরে বললেন, ‘না, আমি অনেক সুখে আছি। কখনও অর্থকষ্টে বা অন্য কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। স্বামী অনেক ভাল মানুষ ছিলেন। আর দেশের জন্যও কখনও বিশেষ খারাপ লাগেনি। কারণ প্রতিবছরই দেশে যাওয়া পড়ে। আত্মীয়-স্বজনের সাথে কখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। যখনই কোন আত্মীয় বিপদে পড়ে, আমি সাধ্যমত সহযোগিতা করি এখান থেকে। তাই দেশের সাথে কোন দূরত্ব অনুভব করি না। দেশে থাকলেও হয়ত ফ্যামিলির সাথে এর চেয়ে বেশী যোগাযোগের সুযোগ পেতাম না’। খাওয়া শেষে আমরা বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। আসার সময় উনাদের বাগানের আপেল দিলেন আর সাথে ছাগলের ২ কেজী কাঁচা গোশত দিয়ে দিলেন রান্নার জন্য।

কোয়েটা থেকে ফিরে আসার আগের দিন টিকিট কাটতে গেলাম শহরে। ট্রেনে সীট না পেয়ে বাসেই টিকিট কাটলাম। তারপর বৃটিশ আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক সেনানিবাসের পার্শ্বে সেনাবাহিনী পরিচালিত আসকারী পার্কে গেলাম। পার্কে দেখার মত তেমন কিছু নেই। প্রায় ঘাসবিহীন নিষ্প্রাণ বিরাট খোলা মাঠ। কিছু ছোটখাটো গাছপালা আর দর্শনার্থীদের জন্য বসার কিছু ব্যবস্থা। সেই সাথে বাচ্চাদের জন্য কিছু প্রচলিত রাইড। কিন্তু এটুকু ব্যবস্থাই যেন কোয়েটাবাসীর কাছে বিরাট কিছু। শত শত মানুষ সেখানে ভিড় করেছে। কেউ ক্রিকেট খেলছে, কেউ গোল হয়ে কাওয়ালীর আসর বসিয়েছে। পশতু, বালুচ, সিন্ধি কত প্রকার যে ভাষা তাদের মুখে। কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। তবে যে বিষয়টা চোখে পড়ল, কোয়েটার অন্যান্য স্থানের মত এখানেও নারীদের উগ্র পদচারণা নেই। কিছু ফ্যামিলি এসেছে। তবে পর্দা ও শালীনতার সাথে। আর নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সচরাচর যেসব চিত্র এ জাতীয় স্থানে আমরা দেখি, তা এখানে শতভাগ অনুপস্থিত। পার্কের শ্রীহীন দশা হতাশ করলেও এই দিকটি ভাল লাগল।

বলা বাহুল্য, দশদিনের কোয়েটা সফরে কোথাও বেপর্দা নারী দেখিনি। পর্দাহীনভাবে ঘোরাটা এদের স্বাভাবিক কালচারেরই বাইরে মনে হয়েছে। ইসলামাবাদের মত এখানেও অনেক মহিলা নিজেই ড্রাইভ করে। বাজার-ঘাটে মহিলাদের উপস্থিতিও যথেষ্ট। অথচ কোথাও এর কোন ব্যত্যয় দেখিনি। তবে এরা প্রচলিত বোরকার পরিবর্তে সালোয়ার-কামীজের উপর লম্বা চাদর পরিধান করে ঘোমটা দেয়। সঊদী বোরকা বা আফগানী বোরকাধারী মহিলা তেমন দেখা যায় না বললেই চলে।

প্রাদেশিক রাজধানী হিসাবে কোয়েটায় বহু অর্থশালী মানুষের বসবাস। শহরে মার্সিডিজ, ল্যান্ডরোভারের মত গাড়ি যথেষ্টই দেখা যায়। রাজপ্রাসাদের মত সুসজ্জিত বাড়িঘরের কোন অভাব নেই। কিন্ত প্রায়ই তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না, বাড়ির বাইরের দেয়াল প্লাস্টার না করার এক অদ্ভুত কালচারের কারণে। এই কৃচ্ছতাসাধনের পিছনে মিতব্যয়িতা নাকি অন্য কোন কিছু করছে তা আমার মোটেই বোধগম্য হয়নি। যে কোন সুন্দর বাড়ী বাইরে থেকে নিতান্তই শ্রীহীন দেখায় এই একটি মাত্র কারণে।

শহরটি অনেক দিন থেকেই তালেবানদের রিক্রটিং কেন্দ্র হিসাবে সুপ্রসিদ্ধ। এমনকি সাবেক তালেবান প্রেসিডেন্ট মোল্লা ওমর নাকি এখন এই শহরে লুকিয়ে আছেন বলে জনশ্রুতি আছে। যুক্তরাষ্ট্র একবার এখানে ড্রোন হামলাও করেছিল। তারও পূর্ব থেকে স্বাধীনতাকামী বালুচ বিদ্রোহীদের কারণে এখানে সবসময়ই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে। অস্ত্রবাজি এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। খোঁজ নিলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নাকি অস্ত্র-শস্ত্রের খোঁজ মিলবে। বালুচ বিদ্রোহী সংগঠন বালুচ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) এবং বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মী (বিএলএম)-এর মত সংগঠনগুলো গত ৬ দশকেরও বেশী সময় থেকে ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান অংশের বালুচিস্তান মিলে সম্মিলিত একটি ‘গ্রেটার বালুচিস্তান’ রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চালিয়ে আসছে। পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন সময় এ আন্দোলন দমনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিলেও তাদের তৎপরতা নিঃশেষ করা যায়নি। এখনও বিক্ষিপ্ত চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে সংগঠনগুলো তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ওয়াকিবহাল মহলের অভিযোগ, পাকিস্তানকে দুর্বল করার কৌশল হিসাবে এই বিদ্রোহীদেরকে গোপনে অস্ত্র-সহযোগিতা করছে ভারত ও আমেরিকা। তবে এটা সত্য, বিদ্রোহ দমনের নামে সেনাবাহিনী প্রতিনিয়ত বালুচ সম্প্রদায়ের লোকজনকে আতংকগ্রস্ত করে রাখে। এ পর্যন্ত বহু মানুষ সন্দেহভাজন হিসাবে সেনাবাহিনীর হাতে কিডন্যাপড হয়েছে শুনলাম। এ নিয়ে এখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ রয়েছে। ট্রেনে আসার সময় দেখছিলাম বিভিন্ন পাহাড়ের মাথায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল চৌকি। বালুচ বিদ্রোহীরা প্রায়ই পাঞ্জাব থেকে আসা ট্রেনে চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। এমনকি সিবি থেকে কোয়েটার পথে তো আমাদের ট্রেনেরই কোন এক বগিতে গুলি এসে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে হুলুস্থল শুরু হল। এফসি’র কমান্ডোরা কুকুর নিয়ে অভিযান শুরু করল চলন্ত ট্রেনের মধ্যে। তারপর সবকিছু ঠান্ডা। কি হল, কেন হল, তা জানার কেউ আর প্রয়োজনও বোধ করল না। বিষয়টা সবার কাছে এক প্রকার গা সওয়া হয়ে গেছে।

সহযাত্রী বালুচ সহযাত্রীরা ছিল প্রত্যেকেই বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সমর্থক। ফলে তাদের কাছ থেকে একটানা কেবল পাঞ্জাবীদের বদনামই শুনে যাচ্ছিলাম। তবে কোয়েটা পৌঁছে কয়েকজন মুরববী ও শাহীনের বন্ধুদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, এখানকার শিক্ষিতদের মধ্যে পাক সেনাবাহিনীর অনাচারমূলক বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে চাপা ক্ষোভ থাকলেও তারা মূলতঃ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষপাতী নয়। কারণ তাদের মতে, এই বিচ্ছিন্নতা বালুচদের জন্য ভবিষ্যতে কোন উপকার বয়ে আনবে না, বরং আরও বেশী ক্ষতির কারণ হবে। কেননা বালুচিস্তানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও এসবের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে যে শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন তা বালুচদের হাতে নেই। শুধু তাই নয় বালুচিস্তানের জনগোষ্ঠী নানা গোত্রে-উপগোত্রে বিভক্ত। তারা বিভিন্ন গোত্রীয় শাসকের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। তাই বালুচিস্তান যদি কখনও স্বাধীনতার স্বাদ পায়, তবুও সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ সে সময় ক্ষমতারোহনের প্রশ্নে অপরিহার্যভাবে এই গোত্রগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্বগুলো জেগে উঠবে। শুরু হবে আরেক নতুন যুদ্ধ। তাই শিক্ষিতজনেরা সমূহ বিপদ আঁচ করতে পেরে এই বিচ্ছিন্নতার পথে হাটতে চান না। কিন্তু আবেগপ্রবণ স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীরা এসব ভবিষ্যৎ ভাবনার মধ্যে নেই। তাদের যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা চাইই-চাই।      

শাহীনের সাথে বোলান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে ঘূরে দেখছিলাম। সরকারী হাসপাতাল হলেও ব্যবস্থাপনা খুবই উন্নত।  আমাদের স্কয়ার, ইউনাইটেড হাসপাতালের মত উন্নত হাসপাতালগুলোর তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু চিকিৎসা সেবা সম্পূর্ণ ফ্রি। অবশ্য তারপরও রোগীর সংখ্যা যথেষ্ট কম। কারণ গ্রামাঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা অনুকূল না থাকায় মানুষ সাধারণতঃ হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে পারে না। আর বড় রকম সমস্যা দেখা দিলে মানুষ কোয়েটার পরিবর্তে কাছাকাছি বড় শহর করাচীতে চলে যায়। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় উঠে লিফটের সামনে যেতেই দেখি চারিদিকে পোড়া, ভয়াবহ ধ্বংসের চিহ্ন। গত ১৬ই জুন বালুচ বিদ্রোহীরা মেডিকেলে সুইসাইড বোমা হামলা চালালে ৪ জন এফসি’সহ ১০ জন নিহত হয়েছিল। এসব তারই চিহ্ন। নীচ তলায় সিঁড়ির পথেও দেয়ালে দেয়ালে ভয়াবহ গোলাগুলির চিহ্ন এখনো টাটকা। সেদিন যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল মেডিকেলে তার বর্ণনা শুনলাম শাহীনের কাছে।

ঐ দিনই শাহীনের বর্তমান কর্মস্থলেও গেলাম। সেখানে দেখি বিদ্রোহী যোদ্ধাদের জন্য আলাদা একটি ওয়ার্ডই আছে। তালেবানসহ অন্যান্য যোদ্ধারা এখানে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। সেই ওয়ার্ডে ঢুকে সদ্য আহত কয়েকজনকে দেখতে পেলাম। কোন অপারেশনে গিয়ে কারো হাতে, কারো পায়ে গুলি লেগেছে। কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু ওদের কটমটে দৃষ্টির তীব্রতায় সে ইচ্ছা উবে গেল। সেখানে কেবল প্রবল ঘৃণা কিংবা ক্ষোভের আগুন। যে আগুনকে অবদমিত করার সাধ্য যেন কারো নেই। মনটা তিক্ত বিষাদে ভরে গেল। মানুষে মানুষে এই হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ কি লেগেই থাকবে চিরকাল? যুলুমবাযদের যুলুম কি কখনই থামবে না? অত্যাচারের কষাঘাতে জর্জরিত, আত্মীয়-স্বজন, সহায়-সম্পদহারা মানুষগুলোর বুকে জমে থাকা তুষের আগুন কি কখনই নিভবে না? ঐ সুন্দর চোখগুলোতে নরকের আগুনের পরিবর্তে সত্য-ন্যায়ের দীপ্তি কি কখনই জ্বলে উঠবে না? শত্রুকে পরাজিত করতে পারলেই সব হয়ে যায়? শত্রুর ভেসে যাওয়া রক্তের বন্যায় গোসল করতে পারলেই কি বিজয়ী হওয়া যায়? বিজয়ের সংজ্ঞা এত রক্তাক্ত, এত পাশবিক, এত নিষ্ঠুর, এত ক্ষুদ্র আর কত কাল থাকবে এভাবে? জয়-পরাজয়ের সংজ্ঞাকে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনরা যেভাবে মানবতা, ভালবাসা আর কল্যাণের পুষ্পে সুশোভিত করে তুলেছিলেন, তার নযীর আজ কোথায়?                               

২২ অক্টোবর সকাল দশটায় রেলস্টেশনের পাশেই সাদাবাহার কাউন্টার থেকে ইসলামাবাদের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ল। বাংলাদেশের হানিফের মত এই কোম্পানীরও নেটওয়ার্ক প্রায় সারা পাকিস্তান জুড়ে বিস্তৃত। সহযাত্রী হিসাবে পেলাম তেহরানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কাশ্মীরী ছাত্র তারেক। বাসে ১৪ ঘন্টা জার্নি করে গতকালই সে তাফতান বর্ডার থেকে কোয়েটা এসে পৌঁছেছে। আজ আবার ইসলামাবাদের উদ্দেশ্যে উঠেছে এই বাসে। আরবী ভাল জানে বলে ইরান সম্পর্কে তার কাছ থেকে অনেক কিছু শোনার সুযোগ হ’ল। শী‘আদের সম্পর্কে তার সুধারণা দেখে বুঝতে পারলাম কতটা প্রভাবিত হয়েছে সে। তার কথা হল, ইরানকে বা শী‘আদেরকে আমরা যেভাবে দেখি এটা ঠিক নয়। ওরা সুন্নীদের পিছনে এবং সুন্নীদের মসজিদে ছালাত আদায় করতে দ্বিধা করে না। সুন্নীদেরকে তারা মুসলিম হিসাবে সমান দৃষ্টিতেই দেখে। ছাহাবায়ে কেরামকে গালিগালাজ তারা করতেই পারে না, বড় উদার মনের তারা। তারা এমনই উদার যে কোম শহরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে বিশ্বের সমস্ত ধর্মের বই-পত্র রয়েছে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্ররা ভর্তি হয়, তাদের কাজ হ’ল ধর্ম নিয়ে নিজের ইচ্ছামত সেখানে গবেষণা করবে টানা দুই বছর ধরে, তারপর যে ধর্মকে সে সত্য বলে অনুধাবন করতে পারবে সে ধর্মের ব্যাপারে তার গবেষণালব্ধ ফলাফল লিখিতভাবে প্রকাশ করবে..এতে কাউকে কোনরূপ চাপ দেয়া হয় না...ইত্যাদি। আমি সব শুনে তারপর শী‘আদের বেসিক আক্বীদা সম্পর্কে কয়েকটি পয়েন্ট যখন ধরিয়ে দিলাম তখন সে চুপ করল। অবশেষে স্বীকার করল ওদের আক্বীদাগত গলদগুলো।

কোয়েটা আসার সময় রেলপথে এসেছিলাম, এখন ফিরতি পথে বোলান পাস হাইওয়ে হয়ে যাচ্ছি। রেলপথের অভিজ্ঞতা ছিল একধরণের, আর এই পথে হ’ল আরেক অভিজ্ঞতা। ট্রেন থেকে বিপরীত দিকের পাহাড়ের গা বেয়ে খাইবার পাসের আদলে এঁকে বেঁকে চলা হাইওয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছিল এক বিস্ময়কর স্বপ্নগাঁথা। আর এখন হাইওয়ে থেকে বিশাল পাহাড় ডিঙিয়ে এগিয়ে চলা ফিতের মত ট্রেন, আর তার হঠাৎ হঠাৎ গর্তে তথা টানেলের মধ্যে নিমিষে হারিয়ে গিয়ে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে তেমনই রূপকথা মনে হচ্ছে। আসার সময় টানেলগুলোতে ট্রেন ঢুকতেই হঠাৎ নেমে আসা অমাবস্যার ঘুটঘুটে আধারে যাত্রীরা যেমন হতবিহবল হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠছিল, যাওয়ার সময় তেমনি এখন পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল ঢালু রাস্তায় বিপদজনক বাঁক নেয়ার সময় নিম্নবর্তী উদর এবং কর্ণকুহরে অপ্রকাশ্যে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়ে যাচ্ছে। সে আন্দোলন অবশ্য সুখকর নয় মোটেই। বিশেষ করে বায়ুচাপজনিত কানের ব্যাথায় এত অসহ্য বোধ করছিলাম যে শত-সহস্র বছরের ইতিহাসের করাঘাতকেও পাত্তা দেয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। একেবারে সমতলে নেমে আসার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রাস্তার বাম সাইড দিয়ে আরেক সহযাত্রী হিসাবে বয়ে যাচ্ছে সুপ্রশস্ত বোলান নদী। তবে তাতে পানির দেখা নেই। কেবল আপন অস্তিত্বের জানান দিতে এক চিলতে স্রোতধারা বয়ে চলেছে নিঃশব্দে তির তির করে। আর বাকি অংশটাতে অজস্র নুড়ি পাথরের একচ্ছত্র রাজত্ব। মাঝে মাঝে সেই নুড়ি পাথরে ট্রাক বোঝাই করার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । পানির স্পর্শ পেয়ে কোন কোন স্থানে দূর্দান্ত সবুজ ঝোপ-জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে। তপ্ত মরুভূমির বুকে এক টুকরো মরুদ্যান তথা সবুজের পরশ যে কতটা প্রশান্তির হতে পারে তা আর বোঝার বাকি রইল না। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল কালচে পাহাড় ঘেষে বেশ বড়-সড় লোকালয়। সহযাত্রীরা জানালেন, মরুভূমির এই কালচে পাহাড়গুলো মূলতঃ কয়লার খনি। এখানে কর্মরত খনি শ্রমিকরাই এসব লোকালয় গড়ে তুলেছে।   

তারপর দিগস্ত বিস্তৃত খারান মরুভুমি, অভ্যন্তরভাগ থেকে অদ্ভূতভাবে খাঁজ কাটা সারি সারি পাহাড়ের ঢিবি, আর তিমির পিঠের মত মসৃণ হয়ে নেমে যাওয়া তার পাথুরে পৃষ্ঠদেশ, পাহাড়ী ঢালে ছাগল-দুম্বার চরে বেড়ানো, খেজুর বাগানে উটের পালের গলা উঁচু করে অলস খাবার অনুসন্ধানের দৃশ্যগুলো অপলক দেখতে দেখতে সিবি চলে আসলাম। সিবি থেকে ডেরা গাজী খাঁ পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। পরবর্তী গন্তব্য ডেরা ইসমাঈল খাঁ। রাত ১১টার দিকে ডেরা ইসমাইল খাঁ পৌঁছে রাতের খাবারের বিরতি দেয়া হ’ল। তারপর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বাস যখন মিয়াওয়ালী পৌঁছালো তখন রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গেছে। মাঝে ঘুমটাও হয়েছে মোটামুটি ভালই। তবে চরম বিরক্তিকর মুহূর্ত ছিল রাতে খাওয়াদাওয়ার পর যখন গাড়ির টিভি সেটে বাজে হিন্দি গান-বাজনা শুরু হ’ল। ভাঙা উর্দূতে কন্ট্রাক্টরকে ডেকে কয়েকবার নিষেধ করার পরও কাজ হলো না। ভলিউম কিছুক্ষণ লো করে রেখে আবার হাই করে দেয়। আশ্চর্য হলাম গাড়ির একটা লোকও কিছু বলল না। অথচ প্রতিবার ছালাতের ওয়াক্তে বাস থেমে যাচ্ছে কোন মসজিদের পার্শ্বে, আর বাসযাত্রীদের অধিকাংশই নেমে ছালাতও আদায় করছে! যাহোক কোন এক সময় ঘুমিয়ে পড়ায় সে যাত্রায় বাঁচলাম। মিয়াওয়ালী পাঞ্জাবের একটি প্রসিদ্ধ নগরী। শহরটি পার হওয়ার পর সুন্দর সবুজ পাহাড়ী পথ বেয়ে যাত্রা শুরু হ’ল। এই পথে আরো ১৫/২০ কিঃমিঃ যাওয়ার পর পাহাড়ের উপর থেকে দেখা গেল অনেক নীচে সুপ্রসিদ্ধ নামাল লেক এবং লেকের পাড় ঘেষে ইমরান খানের উদ্যোগে নির্মিত সেই অত্যাধুনিক ইউনিভার্সিটি ‘নামাল কলেজ’। এটি নির্মিত হয়েছে সম্প্রতি ২০০৮ সালে, যেখানে ইমরান খান ১০০০ একর জমির উপর অক্সফোর্ডের মত একটি ‘সিটি অব নলেজ’ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন।   

ঠিক বেলা ১০টায় ২৪ ঘন্টার জার্নি শেষে রাওয়ালপিন্ডির ফয়যাবাদ বাসস্টান্ডে এসে নামলাম। নামার সময় ড্রাইভিং সীটে দেখি সেই একই ড্রাইভার। সুবহানাল্লাহ! টানা ২৪ ঘন্টা এই লম্বা পথ নির্ঘুম ড্রাইভ করা কিভাবে সম্ভব!! কি ধরণের মানুষ এরা!!

সহযাত্রী তারেককে বিদায় জানিয়ে একটা ট্যাক্সিযোগে ইসলামাবাদে আমার অস্থায়ী ডেরা কুয়েত হোস্টেলে এসে পৌঁছলাম। রুমে এসে হাবীব ভাইয়ের কাছে খবর পেলাম, যে ট্রেনে আমার ফেরার কথা ছিল অর্থাৎ জাফর এক্সপ্রে্স ট্রেনে গতকাল দুপুরে বোমা হামলা হয়েছে এবং কয়েকজন যাত্রী তাতে নিহত হয়েছে। এ খবর শুনে দুর্ঘটনার শিকার যাত্রীদের প্রতি সহমর্মিতার পরিবর্তে ট্রেনের টিকিট না পাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্বার্থপরের মত শুধু ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ পড়লাম। পরে নিজের স্বার্থপরতা টের পেয়ে বিব্রত হলাম নিজেই। খুনে পৃথিবী কেবল খুনই ঝরায় না, মানুষের স্বাভাবিক মনুষ্যত্ববোধকেও বোধহয় হরণ করে নেয় এভাবে।

 আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব

ছাত্র, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান ও সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও