শিক্ষার্থীদের প্রতি নছীহত (২য় কিস্তি)

মুখতারুল ইসলাম 8797 বার পঠিত

(৩) তালেবে ইলমের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হলো তার সময়। সময় জ্ঞান সচেতনতা, যৌবনকালের যথাযথ মূল্যায়ন করা, অযথা সময়ক্ষেপনের হাত থেকে বাঁচাই হবে তালেবে ইলমের বড় চ্যালেঞ্জ। তার প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় হবে পাঠ মুখস্থ করায় বা অধ্যয়নে বা পড়াশোনায় অথবা কোন কিছু কাউকে শিক্ষায় দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ঠিক স্থির লক্ষ্যেপানে।

ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, ‘আমি যখনই জা‘ফর (রহঃ) এর কাছে গেছি তখনই দেখেছি তিনি হয় ছালাতে দাঁড়িয়ে আছেন অথবা বসে বসে কুরআন পড়ছেন অথবা বসে বসে যিকির-আযকার করছেন। এমনকি কিছু কিছু আলেম বলেন, কতই না সুন্দর সে দৃশ্য!

আবুল ওয়াফা ইবনু আক্বীল হাম্বলী বলেন, ‘কখনোই আমার উচিৎ নয় যে, আমি কোন সময় নষ্ট করি। আমার জিহবা পড়া মুখস্থ করবে, আমার চক্ষু পড়া দেখতে থাকবে, আরামের সময় আমায় চিন্তা শক্তি যিকির-ফিকির করতে থাকবে, আমি কোন কাজেই উদ্যত হইনা যা আমার ক্ষতি ডেকে নিয়ে আসে’। সমকালীন বিখ্যাত আলেম শায়েখ আব্দুল্লাহ বিন বায, শায়েখ উছাইমীন, শায়েখ নাছিরুদ্দীন আলবানী, শায়েখ ইবনু জিবরীন, শায়েখ মুখতার শানক্বীতী, শায়েখ ফাওযান ইত্যাদি আলেমের জীবনী পড়লে আমরা দেখতে পাব তারা কিভাবে সময়ের মূল্যায়ন করেছেন। তারা ইলমের জগতের কোথায় গিয়ে পোঁছেছিলেন!

(৪) জ্ঞার্নাজনে কষ্ট সহিষ্ণুতা, ধৈর্য খুবই যরূরী । ইলম বা জ্ঞান হলো আল্লাহ প্রদত্ত  একটি মহান রিসালাত যা বহনে আত্মিক সুখ বিসর্জন দিতেই হবে। বিশেষকরে প্রাথমিক বিদ্যার্জনে। তালেবে  ইলমকে অবশ্যই ধৈর্যের অস্ত্র নিয়ে ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে এ ময়দানে লড়াই করতে হবে।

কোন কোন আলেম বলতে চেয়েছেন, জিবরাঈল (আঃ) অহীর অবতীর্ণের শুরুতে রাসূল (ছাঃ)-কে তিনবার চেপে ধরেছিলেন তিনি এতে দারুণ কষ্ট পেয়েছিলেন যা আমাদের প্রতিটি তালেবে ইলমের জানা । প্রথমবার তিনি বলেছিলেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক্ব ৯৬/১)। অতএব কোন তালেবে ইলমের-ই কষ্ট বিনা বিদ্যার্জন সম্ভব নয়।

আবু হাতেম (রহঃ) বলেন, ‘বিদ্যার্জনে অধিক পড়াশোনা, আলেম-ওলামার মজলিসে উপস্থিত থাকা, নতুন কিছু জানার জন্য গবেষণায় রত থাকতে সময়াভাবে আমাদের এমন অনেক দিন আমরা পার করেছি যে সমস্ত দিনে কোন রান্না করা গোশত বা তরকারীর ঝোল পর্যন্ত আমাদের পেটে পড়েনি’। অতএব হে তালেবে ইলম! অধিক ধৈর্যশীল, অধিক জ্ঞান অন্বেষকারী হিসাবে নিজেকে আবিস্কার কর। আর আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামতরাজি ইলমকে নিজের করে নাও।

(৫) তালেবে ইলমকে জীবনের প্রতিটি বিষয়ে অধিক পরহেযগার হতে হবে। হালাল ভক্ষণে অভ্যাসী হতে হবে। পানাহার, পোষাক পরিধান, বসতবাড়ি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে ও প্রয়োজনে রাসূল (ছাঃ)-এর পূর্ণ পাবন্দ হ’তে হবে। রাসূল (ছাঃ) রাস্তায় পড়ে থাকা একটি খেজুর দানা পর্যন্ত খাননি ছাদাক্বার মাল হওয়ার  ভয়ে।

শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘পরহেযগারিতা হলো আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এমন যাবতীয়  বিষয়কে পরিহার করা’।

(৬) সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য যাবতীয় বিষয়ে হুশিয়ার হওয়া। ইসলামের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখা। বাহ্যিকভাবে সুন্নাতের পাবন্দী ও তা প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করা।

(৭) খাদ্য কম খাওয়া, কম ঘুমানো। অধিক খাদ্য গ্রহণ ও ঘুম অলসতা নিয়ে আসে যা তালেবে ইলমের বিদ্যার্জনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আর কম খাওয়া ও কম ঘুমানো  হলো এ দু‘য়ের হক।

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘আমি ষোল বছর পর্যন্ত পরিতৃপ্ত আহার করিনি। কেননা বেশী খাবারে বেশী পানি প্রয়োজন। আর বেশী পানাহার বেশী অলসতা ও অধিক নিদ্রা আনয়নকারী। মেধা কমিয়ে দেয়া, জ্ঞান লোপ পাওয়া, শরীরে অলসতার জন্য দায়ী। শুধু তাই নয়  শারীরিক অসুস্থতাও অধিক পানাহারের সাথে জড়িত যা ইসলামী শরী‘আতেও অপসন্দনীয়’। আর অধিকাংশ অসুখের কারণ-ই হলো অধিক পানাহার। মহান আল্লাহ বলেন,

وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ-

‘তোমরা খাও ও পান কর। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’ (আরাফ ৭/৩১)

 কিছু আলেম বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে যাবতীয় চিকিৎসার সমাধান দিয়েছেন’।

লুক্বমান (রহঃ) বলেন, ‘হে বৎস! যখন তুমি পেট পূর্ণ করে খাবে তখন তোমার চিন্তা শক্তি ঘুমিয়ে পড়বে, তোমার বুদ্ধি লোপ পাবে আর তোমার সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ আল্লাহর ইবাদত থেকে অবসর নেবে’।

(৮) সৎ সঙ্গ হলো তালেবে ইলমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সালাফে ছালেহীন সৎসঙ্গকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতেন। কথায় আছে,  ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। মহান আল্লাহ বলেন, وَاجْعَلْ لِي وَزِيرًا مِنْ أَهْلِي  ‘আর আমার পরিবারের মধ্য থেকে আমার জন্য একজন সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দিন’ (ত্বোয়াহা ২০/২৯)

(৯) তালেবে ইলমের সুন্দর আদব ও আচরণ যরূরী। আর সুন্দর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হলো লজ্জাশীলতা, ভদ্রতা, শান্ত, গীবত ও চোগলখুরী মুক্ত, সাধারণ জীবন-যাপন, অহংকার বিবর্জিত আচরণ, হিংসা পরিহার করা ইত্যাদি।

কিছু সালাফে ছালেহীন বলেন, আমি যখন কোন মজলিসে যাই তখন আমি নিজেকে সবচেয়ে ছোট মনে করি আর  বেরিয়ে আসি সবার চেয়ে বড় হয়ে। আর আমি যদি কোন মজলিসে বড় হয়ে প্রবেশ করি তবে আল্লাহ যেন আমাকে সবচেয়ে ছোট করে বের করে নিয়ে আসেন।

(১০) জ্ঞানীদের নিকট থেকে জ্ঞান অন্বেষণ করা। তালেবে ইলমের দেখা উচিৎ ‘আলেম বিল আমল’-এর কাছ থেকে জ্ঞার্নাজন করা। অর্থাৎ যে আলেম জানে ও যথাযথভাবে আল্লাহকে স্বরণ করে।

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘আমি তোমার মালের ব্যাপারে সন্তুষ্ট যা আমার ও আল্লাহর মাঝে দলীল স্বরুপ হবে’। অর্থাৎ  যখন আল্লাহ আমাকে ক্বিয়ামতের মাঠে পাকড়াও করবেন এই বলে যে, তুমি কার নিকট থেকে ইলম অর্জন করেছিলে। তখন আমি বলব ‘তোমার সম্পদ থেকে’।

মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) বলেন, ‘হে মানবমন্ডলী!  এই জ্ঞান হলো দ্বীন। অতএব তোমরা কাদের নিকট থেকে দ্বীনের জ্ঞানার্জন করছ সে ব্যাপারে খেয়াল রেখ’।

(১১) কিতাব ও সুন্নাহর অনুসরণ করা। কেননা যে কিতাব ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে সে সঠিক পথের সন্ধান লাভ করে এবং সে যাবতীয় ফেৎনা থেকে মুক্ত থাকে। আর তার অন্তরে আত্মিক প্রশান্তি কাজ করে। আল্লাহ তার অন্তর দরজা খুলে দেন। মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ-

‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দেবে। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা (ভ্রান্ত পথ সমূহ থেকে) বেঁচে থাকতে পার’ ( আনআম ৬/১৫৩)

(১২) ইলম অনুযায়ী আমল করা এবং তার পথে দাওয়াত দেয়া। যখনই জানবে এটা  রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত তখনই তা আমল করবে। এ ব্যাপারে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ‘ইলম আমলের ব্যাপারে আওয়াজ দিলে যদি সেটি গ্রহণ করা হয় তবে তা থাকবে নচেৎ তা চলে যাবে’। প্রবাদ রয়েছে, ‘হাদীছকে একবার হলেও আমল করে তার আমলকারী হয়ে যাও। যে ইলম অনুযায়ী আমল করে সে আল্লাহর ইলমের ওয়ারিছ হয়ে যায় নতুবা নয়’।

আর তালেবে ইলমকে অবশ্যই সুন্নাতের হেফাযতকরী হতে হবে। বিশেষকরে ক্বিয়ামুল লাইল, সকাল-সন্ধায় পঠিতব্য  দো‘আ আমল ইত্যাদি। আর দ্বীনী দাওয়াত প্রচার-প্রসারে পিছপা হলে চলবে না । কেননা ইলমের যাকাত হলো তার প্রচার-প্রসার ও অন্যদের দ্বীন শিক্ষা দেয়া।

(১৩) যাবতীয় অশালীন মজলিস, তর্ক-বিতর্ক বাহাছ পরিত্যাগ করা। কেননা ফায়েদা বিহীন মজলিস, অনর্থক কথা-বার্তাতে তালেবে ইলমের ইলমী বরকত হারিয়ে যাবে। আর সত্য পথ থেকে ছিটকে পড়বে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى أُمَامَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِى رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا وَبِبَيْتٍ فِى وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا وَبِبَيْتٍ فِى أَعْلَى الْجَنَّةِ لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ.

আবু উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন,‘যে ব্যক্তি ন্যায়সঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও ঝগড়া পরিহার করবে আমি তার জন্য জান্নাতের বেষ্টনীর মধ্যে একটি ঘরের যিম্মাদার। আর যে তামাশার ছলেও মিথ্যা বলে না আমি তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘরের যিম্মাদার আর যে ব্যক্তি তার চরিত্রকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে আমি তার জন্য জান্নাতের সবের্বাচ্চ স্থানে অবস্থিত একটি ঘরের যিম্মাদার’।[1]

মারূফ কিরখী (রহঃ) বলেন, ‘যখন আল্লাহ কোন বান্দার কল্যাণ চান তখন তার জন্য আমলের দরজা খুলে দেন এবং ঝগড়া-ফাসাদের দরজা বন্ধ করে দেন। আর যখন কোন বান্দার অকল্যাণ চান তখন ঝগড়া-ফাসাদের দরজা খুলে দেন এবং আমলের দরজা বন্ধ করে দেন’।

যদি জ্ঞানী সম্প্রদায় জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে তখন তা সংরক্ষিত হয় আর যদি জ্ঞানকে অন্তরে মর্যাদার জায়গায় রাখে তবে সম্মানিত হয়।

তালেবে ইলম কিভাবে জ্ঞানার্জন করবে

হে তালেবে ইলম! ইলমী জগতে পদচারণায় তোমাকে স্বাগতম। ইলম অর্জনের বাস্তব সম্মত কিছু ধারা নিম্নে আলোচনা করা হলো-

জ্ঞানার্জন করতে জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় শাখায় বিচরণ করতে হবে। ক্রমান্বয়ে আস্তে আস্তে আগাতে হবে। বলা হয় যে ইলমী জগতে বাক্য কেন্দ্রিক যে আগায় সে সেটায় পায়। আর যদি শ্রোতার ভীড়ের মধ্যে জ্ঞান তালাশ করে তার বুঝে ভুল থেকে যায়। সবচেয়ে সুন্দর পন্থা হলো বিষয় ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞার্নাজন করা। অতপর অন্যটি শুরু করা। বিশেষকরে যে বিষয়ের জ্ঞান নিজ দেশের আলেমদের কাছে পাওয়া যায় না সে বিষয়গুলির প্রতি বেশী খেয়াল রাখা।

বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানার্জন

বিষয় বা মানহাজ ভিত্তিক জ্ঞার্নাজনের দু‘টি দিক রয়েছে।

(ক) উদ্দেশ্য ভিত্তিক (খ) যন্ত্র ও মাধ্যম ভিত্তিক।

উদ্দেশ্য ভিত্তিক জ্ঞান আবার চারভাগে ভাগ বিভক্ত সেগুলো হলো-

১. আক্বীদা ও তাওহীদ ভিত্তিক জ্ঞান এর আবার তিনটি  দিক রয়েছে।

(ক) দ্বীনকে বুঝা ও তার ভিত্তি সম্পর্কে জানা। তাওহীদে ইবাদতকে জানা কেননা এটি মুমিন ও মুশরিকের পার্থক্যকারী জ্ঞান। এ বিষয়ে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে।

*كتاب الاصول الثلاثة- বইটিতে লেখক তাওহীদে রুবূবিয়্যাহ, তাওহীদে উলূহিয়্যাহ, ‘ওয়ালা’ ওয়াল ‘বারা’ ইত্যাদি বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। বইটির বেশ কয়েকটি শারাহ বা ব্যাখ্যা গ্রন্থও বেরিয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুহাম্মাদ বিন ছালেহ উছায়মীন (রহঃ) ও আল্লামা আব্দুর রহমান বিন কাসেম (রহঃ) লিখিত শারাহদ্বয়।

*كتاب التوحيد- বইটিকে শায়খ ৬৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত করে তাওহীদ ও শিরক সম্পর্কে দলীল ভিত্তিক বিশদ আলোচনা করেছেন। এই বইটিরও অনেকগুলো শারাহ বা ব্যাখ্যা গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

১- - فتح المجيد শায়খ আব্দুর রহমান বিন হাসান আলে শায়খ। ২- - تيسير العزيز  الحميد শায়খ সুলাইমান বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়খ। ৩- - القول المفيد শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ উছায়মীন। ৪- - اعانة المستفيدশায়খ ছালেহ ফাওযান। ৫- -التمهيد لشرح كتاب التوحيد শায়খ ছালেহ আলে শায়খ। এছাড়া শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহহাব-এর আরো তিনটি বই রয়েছে। সেগুলো হলো- কিতাবু ক্বাওয়াদুল আরবা‘, কাশফুশ শুবহাত ও মাসায়েলুল জাহেলিয়্যাহ। আর প্রতিটি বইয়ের বিভিন্ন লেখকের শারাহ গ্রন্থও রয়েছে।

(খ) দ্বিতীয় পর্যায়ের বইগুলো হলো-শায়খ ইবনু তায়মিয়্যাহ (রহঃ)-এর ‘কিতাবুল ওয়াসিত্বিয়্যাহ’। বইটিতে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত-এর আক্বীদা সবিস্তারে বিধৃত হয়েছে। অতপর কিতাবুল ফাতাওয়া হামাবিয়্যাহ, কিতাবুর রিসালাহ আত-তাদমিরিয়্যাহ ইত্যাদি। উল্লেখিত বইগুলোর একাধিক শারাহ গ্রন্থ রয়েছে। ইবনু কুদামা লিখিত ‘কিতাবু লুম‘আতিল  ই‘তিকাদ’ বইটিও উল্লেখযোগ্য।

(গ) এ পর্যায়ে ইমাম আহমাদ বিন মুহাম্মাদ ত্বহাবী লিখিত ‘মাতনু ত্বহাবিয়া’ উল্লেখযোগ্য। এর শারাহ গ্রন্থ লিখেছেন ইবনু আবী উয্যা হানাফী।

২. ইলমুল ফিক্বহ এর তিনটি দিক রয়েছে।

এ বিষয়ে তালেবে ইলমকে অবশ্যই মাযহাব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখতে হবে। এ প্রকারে তিনটি বিষয় লক্ষনীয় তা হলো- মাযহাব সংক্রান্ত মতন মুখস্থ করা, মাযহাব সংক্রান্ত মাসায়েল জানা ও মাসআলার হুকুম ও কওলে রাজেহর ব্যাপারে জ্ঞান রাখা।

ক. ইবনু কুদামা লিখিত ‘কিতাবু উমদাতুল ফিক্বহ’। বইটির শারাহ লিখেছেন বাহাদ্দীন মাক্বদীসী ‘শারহু উমদাত’ু ও হাশিয়া লিখেছেন আব্দুল্লাহ বাস্সাম ‘হাশিয়াতু উমদাতু ফিক্বহ’।

খ. ইমাম মুহাম্মাদ বা‘লী লিখিত ‘কিতাবুত তাসহীল’। এর শারাহ লিখেছেন আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ ফাওযান ‘ফিক্বহুদ দালীল’।

গ. মুসা বিন আহমাদ হাজাবী লিখিত ‘কিতাবু যাদুল মুসতাক্বনা‘। বইটি খুবই কঠিন হওয়ায় এর অনেকগুলো শারাহ গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মানছুর বিন ইউনুস বাহুতী লিখিত ‘ আর-রাওযুল মুরাববা‘। মুহাম্মাদ বিন ছালেহ উছায়মীন-এর লিখিত ‘আল-মুমতা‘ আলা যাদুল মুসতাক্বনা‘’।

ঘ. মার‘আ কারীমীর লিখিত ‘কিতাবু দালীলুত তালেব’। বইটি অনেক শারাহ গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে শায়েখ ইবরাহীম যূইয়ান-এর ‘মানারুস সাবীল’ উল্লেখযোগ্য।

তৃতীয় পর্যায়ঃ ইলমুত তাফসীর

এ বিষয়ে জানতে হলে অবশ্যই তালেবে ইলমকে নিম্নোক্ত বইগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

আল-কুরআনের দুর্বোধ্য বিষয়গুলো জানার জন্য তালেবে ইলমকে প্রথমেই যে বইটি হাতে নিতে হবে তা হলো- শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল আযীয খুযাইরী-এর লিখিত ‘আস-সিরাজু ফি বায়ানে গারীবুল কুরআন’। অতঃপর কুরআনের সাধারণ অর্থ জানতে আব্দুর রহমান আস-সা‘দী লিখিত ‘তাইসীরু কারীমির রহমান ফী তাফসীরু কালামিল মান্নান’।

এছাড়াও দলীল ভিত্তিক আরো অনেক তাফসীর গ্রন্থ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইমাম বাগাবী (রহঃ)-এর লিখিত ‘মায়ালিমুত তানযীল’, ইবনে কাছীর (রহঃ)-এর লিখিত ‘তাফসীরু কুরআনিল আযীম’। কুরআনের তা’বীল সংক্রান্ত আরো বৃহৎ বৃহৎ গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো ইমাম ত্ববারী (রহঃ)-এর লিখিত ‘জামে‘উল বায়ান ‘আন তা’বীলিল কুরআন’। ছালেহ আল-উছায়মীন লিখিত ‘তাফসীরু কুরআনিল কারীম’ আধুনিক কালের অন্যতম একটি লেটেস্ট গ্রন্থ। অত্র গ্রন্থে প্রচুর কায়দা-কানুন,তাফসীর সংক্রান্ত আলোচনাসহ বিভিন্ন বিষয়াদি উঠে এসেছে যা একজন তালেবে ইলমের জানা অতীব যরূরী। আর অন্য কোন এমনটি পাওয়া  যাবে না।

চতুর্থ পর্যায়ঃ ইলমুল হাদীছ

ইলমুল হাদীছ হলো রাসূল (ছাঃ)-এর সারগর্ভ কথামালার এক অমূল্য রত্ন ভান্ডার। ইলমুল হাদীছের প্রথমেই যে গ্রন্থটির নাম উঠে এসেছে তার নাম হলো ‘আল-‘আরবাঈনা নাবাবিয়্যাহ’ যার লেখক হলেন ইমাম নাবাবী শাফেঈ (রহঃ)। গ্রন্থটিতে ইবনু ছালেহ লিখিত ‘আহাদীছু কুললিয়্যাহ’ থেকে হাদীছ সংগৃহীত হয়েছে। গ্রন্থটিতে ছাবিবশটি হাদীছ নেয়া হয়েছে। অতঃপর ইমাম নাবাবী (রহঃ) আরো বিয়াল্লিশটি হাদীছ সংযুক্ত করে গ্রন্থটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। ‘আরবাঈনা’ গ্রন্থটিরও শারাহ গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ)-এর লিখিত ‘জামে‘উল উলূম ওয়াল হুকুম’। মুহাম্মাদ ছালেহ আল-উছায়মীন লিখিত শারাহ গ্রন্থও রয়েছে। এছাড়াও হাদীছের আহকাম সংক্রান্ত আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে। প্রথমটি হলো আব্দুল গিনা আল-মাক্বদেসী লিখিত ‘উমদাতুল আহকাম’। বইটিতে তিনি তিনশত ত্রিশটি হাদীছ নিয়ে এসেছেন যেখানে অধিকাংশ হাদীছসমূহ বুখারী ও মুসলিম-এর শর্তানুযায়ী সংকলিত। তবে সেখানে ছয় চল্লিশটি হাদীছ তিনি ‘শায়খায়েন’-এর শর্তের খিলাফ করেছেন। গ্রন্থটির বেশ কয়েকটি শারাহ গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে ইবনু দাক্বীকুল ঈদ লিখিত ‘ইহকামুল আহকাম’, শায়েখ আব্দুল্লাহ বাস্সাম-এর লিখিত ‘তাইসিরুল আল্লাম’ ও শায়েখ সা‘আদী-এর লিখিত শারাহ গ্রন্থটিও রয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হলো হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী আশ-শাফেঈর লিখিত ‘বুলূগুল মারাম’। গ্রন্থটিতে তিনি ১৪৩৬ টি হাদীছ শুধুমাত্র আহকামের জন্য নিয়ে এসেছেন। আর ১৩২টি হাদীছ হলো আদব ও আখলাক সংক্রান্ত। সর্বমোট ১৫৬৮ টি হাদীছ তিনি সংকলন করেছেন। বিখ্যাত হাদীছ গ্রন্থটির অনেকগুলো শারাহ গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে শায়েখ আব্দুল্লাহ বাস্সাম লিখিত ‘তাওযীহূল আহকাম মিন বুলূগুল মারাম’, মুহাম্মাদ ছালেহ উছায়মীন লিখিত ‘ফাতহ যিল জালালি ওয়াল ইকরাম’, ও আব্দুল্লাহ ফাওযান লিখিত ‘মানহাতুল আল্লাম’ ইত্যাদি।

তৃতীয় পর্যায়ে ‘কুতুবে সিত্তাহ’। ১. ছহীহুল বুখারী-এর শারাহ ইবনু হাজার আসক্বালানী লিখিত ফাতহুল বারী। ২. ছহীহ মুসলিম-এর শারাহ গ্রন্থ শারহুন নাবাবী। ৩. সুনানে তিরমিযী-এর শারাহ গ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযী।৪. সুনানে নাসাঈ-এর শারাহ গ্রন্থ হাশিয়াতুস সুয়ূত্বী। ৫. সুনানে আবুদাউদ-এর শারাহ ‘আওনুল মা‘বূদ। ৬. সুনানু ইবনু মাজাহ-এর হাশিয়াতুস সানাদী।

রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতে নাবাবী বুঝার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনচরিত সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞার্নাজন করতে হবে। কেননা তাঁর গুণাবলী, কর্ম  ও অনুমোদনের সমন্বিত রুপকে হাদীছ বলা হয়। আর রাসূল চরিত জানার জন্য একজন তালেবে ইলমকে অবশ্যই মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়ায়হাব রচিত মুখতাছারু সিরাতির রাসূল (ছাঃ), ছফীউর রহমান মুবারকপুরী লিখিত ‘আর-রাহীক্বুল মাখতূম’ ও ইবনু ক্বাইয়্যিম রচিত ‘যাদুল মা‘আদ ফী হাদয়ি খইরিল ইবাদ’ ইত্যাদি।

পঞ্চম পর্যায়ঃ ইলমুল উছূল

উছূলুল ফিকহ সম্পর্কে  জানা একান্ত কর্তব্য। এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রথমেই যে বইটির নাম এসে যায় তাহলো শায়েখ আব্দুর রহমান আসসা‘দী লিখিত ‘রিসালাতুন লাত্বীফাতুন ফী উছূলুল ফিকহ’। এছাড়াও ইমাম জুওয়ানী লিখিত ‘আল-ওরাক্বাত’। এর আবার আব্দুল্লাহ ফাওযান লিখিত শারাহ রয়েছে। মুহাম্মাদ বিন ছালেহ উছায়মীন লিখিত ‘নাযমুল ওরাক্বাত’ নামক শারাহ রয়েছে। এছাড়াও ইবনু কুদামার লিখিত শারাহ রয়েছে যার নাম হলো ‘রওযাতুন নাযের ওয়া জুন্নাতুল মানাযের’।

উছূলুত তাফসীর সম্পর্কে তালেবে ইলমকে জ্ঞার্নাজন করা আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম তালেবে ইলমকে শুরু করতে হবে শায়েখ আব্দুর রহমান লিখিত ‘কাওয়ায়েদুল হাস্সান লি তাফসীরুল কুরআন’। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) লিখিত ‘মুকাদ্দামাতু ফী উছূলুত তাফসীর’। অত্র গ্রন্থটির মুহাম্মাদ ছালেহ আল-উছায়মীন লিখিত শারাহ রয়েছে। এছাড়াও  আল্লামা সুয়ূত্বী লিখিত ‘আল-ইতক্বান ফী উলূমিল কুরআন’।

মুছতালাহুল হাদীছ সম্পর্কে জানতে হলে তালেবে ইলমকে যা করতে হবে তা হলো মুহাম্মাদ বিন বাইকূনীর লেখা ‘মানযূমাতুল বাইক্বুনিয়্যাহ’ পড়া। এর শারাহ গ্রন্থ হাসান বিন মুহাম্মাদ মাশাত লিখিত ‘তাক্বরীরাতুল সুন্নিয়াহ’। এছাড়াও মুহাম্মাদ বিন ছালেহ উছায়মীনের রয়েছে ‘শারাহু মানযূমাতুল বাইকুনিয়্যাহ’, শায়েখ মাহমূদ তাহানের রয়েছে ‘তাইসীরু মুছতালাহুল হাদীছ, হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী লিখিত ‘নুখবাতুল ফিকর’ এর শারাহ গ্রন্থ হলো ‘নাযহাতুন নাযার’ ও ইবনু কাছীর (রহঃ) লিখিত ‘মুখতাছারু উলূমুল হাদীছ’

আরবী ভাষা সম্পর্কে তালেবে ইলমকে অবশ্যই পূর্ণ জ্ঞানার্জন করতে হবে। উমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, আরবী শেখ, তা মানবিকতা বাড়িয়ে দেয়’। ইবনু ওয়ারদী বলেন, ইলমু নাহুর জ্ঞান বাড়াও ‘যে ব্যক্তি নাহুর ই‘রাবের জ্ঞান থেকে মাহরুম হলো সে হতবুদ্ধ হলো’। সুতরাং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নাহুর জ্ঞার্নাজন করা। আর সেজন্য তালেবে ইলমকে ইমাম আজরূম লিখিত ‘মাতনুল আজরূমিয়্যাহ’ সাথে সাথে এর শারাহ গ্রন্থ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ উছায়মীন কৃত শারাহ গ্রন্থ দেখতে হবে। এছাড়াও হুরাইরীর লিখিত ‘মালহাতুল ‘আরাব, ইবনু হিশামের ‘ক্বাতরু নাদা ওবলু ছদা, আলফিয়াতু ইবনু মালেক’-এর শারাহ ‘শারহু ইবনু আক্বীল’, দালীলুস সালেক শায়েখ ফাওযানের লেখা উল্লেখযোগ্য। অতঃপর তালেবে ইলমকে ঐ সমস্ত উপকারী বই পড়তে হবে যা তালেবে ইলমের অন্তরের ক্ষুধা মিটাবে, আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, যবান শানিত করবে, বুঝার ময়দান প্রশস্ত করবে ও সর্বশেষ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি এনে দেবে। আর এসব ক্ষেত্রে রাসূল জীবনী বইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।  বিশেষকরে ড. আব্দুর রহমান পাশা লিখিত ‘ছূরাতু মিন হায়াতিছ ছাহাবা ওয়াত তাবেঈন’, ইমাম যাহবী লিখিত ‘সিয়ারু ‘আলামুন নুবালা’ ইত্যাদি। আর তালেবে ইলমকে অবশ্যই ইবনু তায়মিয়্যাহ ও ইবনু কাইয়্যিাম (রহঃ) দ্বয়ের কিতাবগুলো বেশী বেশী পড়া। অবশেষে মহান আল্লাহর নিকটে উপকারী ইলম, সৎ আমল ও খালেছ নিয়তের আরজি রেখে শেষ করলাম। আল্লাহ তুমি আমাদের সবাইকে তোমার পথের পথিক হওয়ার তাওফীক দিও-আমীন।      (ক্রমশঃ)

[লেখক : আব্দুল্লাহ বিন মুহসিন মুতায়রী-এর লিখিত আরবী প্রবন্ধ লিখিত  -كيف تكون طالب العلمঅবলম্বনে রচিত] 

[1]আবুদাউদ হা/৪৮০২





বিষয়সমূহ: জ্ঞানার্জন
আরও