ক্ষণিকের মিছে মায়া

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 851 বার পঠিত

১লা জানুয়ারী, ২০১৬। দারুলহাদীছ আহমাদিয়া সালাফিইয়াহ, বাঁকাল, সাতক্ষীরায় সহকারী আরবী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন শেখ আব্দুছ ছামাদ উস্তাদজী। আমি তখন মাদরাসার নবম শ্রেণীর ছাত্র। সেই থেকে শুরু হয় এক অকৃত্রিম সর্ম্পকের পথ চলা। তিনি যতটা আমাদের শিক্ষক ছিলেন, তার চেয়ে বেশী ছিলেন বড় ভাইয়ের মত। যেকোন প্রয়োজনে তাঁর দ্বারস্থ হয়ে কখনো খালি হাতে ফিরে আসিনি। সেই সদা পরোপকারী মানুষটিই গত ২৬শে মে, ২০২১ রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে ক্ষণিকের মিছে মায়ার পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চিরপ্রস্থান করলেন। জীবনের একেবারে শেষ মুহূর্তগুলোতে তাঁর সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই শেষ স্মৃতিগুলোই এখানে বর্ণনা করব, ইনশাআল্লাহ।

১১ই মে ২০২১ তাঁর সাথে প্রায় ২০মিনিট ফোনে কথা হয়। তিনি বলেছিলেন, আবু জাহিদ! পাইলস অপারেশন করার পর  অন্যান্য রোগগুলোও আষ্টেপৃষ্টে ধরছে। সপ্তাহ খানেক পর শুনলাম, উস্তাদজী রক্তশূন্যতার কারণে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সেখানে দুই দিন থাকলেও তাঁর অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। ডাক্তার বললেন, ‘ব্লাড ক্যান্সার হতে পারে। আপনারা ঢাকায় নিয়ে যান’।

তখন রামাযান মাস। রাতে আনুমানিক রাত ১১টায় আমার চাচা মাওলানা মুজাহিদুর রহমান (কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ) আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, আব্দুছ ছামাদ ভাইকে ঢাকাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তুমি একটু যাও। আমি পরদিন সাহারী খেয়ে ঢাকা থেকে রওনা হলাম মিরপুরের উদ্দেশ্যে। সেখানে তাঁরা এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। পৌঁছানোর পর উস্তাদজী আমাকে ডেকে বললেন, আবু জাহিদ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিনা। সাথে থাকা সকলের চোখে-মুখে হতাশা আর নির্ঘুম সফরের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সকালে আব্দুল্লাহ আল মামুন (উস্তাদজীর আত্মীয়) ভাই রিপোর্টগুলো নিয়ে চলে গেলেন মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে রেফারেন্স ছাড়া কোন রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। উস্তাদজীর রেফার্ডপত্র ছিল ঢাকা মেডিকেলের জন্য। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে তখন কোভিড-১৯ ছাড়া কোনো রোগী ভর্তি নিচ্ছিল না। এরপরে ঢাকা পিজি হাসপাতালে গেলেও কোন ব্যবস্থা হ’ল না। এদিকে উস্তাদযীর অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছে। তার দিনে ২ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন। নিরুপায় হয়ে তাকে নেয়া হল ডেল্টা হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে ডাক্তাররা রোগীর চেয়ে নিজেদের জীবন নিয়েই বেশি শঙ্কিত। শুরু হ’ল সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে অনলাইন চিকিৎসা। ইতোমধ্যে উস্তাদজীর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। কোনভাবে একটা বেড ব্যবস্থা করে তাকে শেয়ানো হ’ল। আমি বসলাম তাঁর মাথার কাছে। তিনি বললেন, আমি বাড়ি যাব। এখানে তো ব্লাড পাচ্ছি না, বাড়ি গেলে আমি ব্লাড পাবো। তারপরে আমি রাজশাহীতে যাব। সেখানে আমার চিকিৎসা করাব। তুমি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিবের সাথে কথা বল। অবশেষে পরিবারের সকলের পরামর্শে তাকে ভর্তি করা হ’ল ইবনে সিনা হাসপাতালে। শুরু হল চিকিৎসা।

রাত ৮টা নাগাদ ডাক্তার আসলেন। আগের রিপোর্টসমূহ চেক করে নতুন কিছু পরীক্ষা দিলেন। পরদিন ইবনে সিনা হাসপাতালে দু’টি ও এভার কেয়ার হাসপাতাল থেকে একটি পরীক্ষা করানো হয়। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত করলেন, তিনি ব্ল্যাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। দপ করে বাকি আশাটা নিভে গেল। স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যরা অনেকটাই ভেঙে পড়লেন। ডাক্তার জানালেন, কেমোথেরাপিই এর শেষ চিকিৎসা। ৬টা কেমো দিতে হবে, যার প্রথমটার দাম আড়াই থেকে-তিন লক্ষ টাকা। হতাশার মরুভূমি যেন আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠল। উস্তাদজীর স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা কুলকিনারাহীন হয়ে পড়লেন। ইতোমধ্যে শুনতে পেলাম প্রথম কেমোর ব্যবস্থা সংগঠন থেকে তথা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর পক্ষ থেকে করা হবে আলহামদুলিল্লাহ। আরো অনেকেই অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে শুরু করল। গ্রীষ্মের শুকনা নদীতে হঠাৎ শ্রাবণের বান ডাকার মত। কেমোর ব্যবস্থা হ’ল। কিন্তু দেখা দিল নতুন বিপত্তি। ডাক্তার জানালেন, জন্ডিস ধরা পড়েছে। এ অবস্থায় কেমো দেওয়া সম্ভব নয়। শুরু হ’ল জন্ডিসের চিকিৎসা। কিন্তু উস্তাদজীর অবস্থা দিন দিন দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।

এভাবে কেটে গেল পুরো রামাযান। ঈদুল ফিৎর পালিত হ’ল বিষাদময়। পরদিন সকালে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় মামুন ভাই ফোন করে জানালেন, উস্তাদযী কবুতর বা দেশী মুরগির বাচ্চা খেতে চাচ্ছে। পাশের বাড়ি থেকে একটা মুরগির বাচ্চা ক্রয় করে রান্না করা হ’ল। বেলা দশটার দিকে রওয়ানা হলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে পৌঁছালে আবার ফোন বেজে উঠল। এবার কথা বললেন উস্তাদজী নিজেই, আবু জাহিদ তুমি কোথায়? আমি বসে আছি দুটো ভাত খাব বলে। তুমি আমার জন্য মুরগির বাচ্চা আনছো তো? মনে পড়লে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠের আওয়ায এখনো আমার কানে বাজে। বেলা এগারটায় পৌঁছলাম হাসপাতালে। খাওয়া শেষে উস্তাদযী বললেন, অনেকদিন পর আজ অনেক কিছু খেতে পারলাম।

তারপর কিছুদিন আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ২০শে মে সকালে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে গেলাম। উস্তাদজীকে দেখে চোখে পানি চলে আসলো। সদ্য বোল ফোটা শিশুর মত অস্পষ্ট ভাষায় বললেন, আবু জাহিদ, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। ডাক্তার আমার হাত দু’টি ছিদ্র করে ঝাজরা করে ফেলেছে, একটু পর পর ইনজেকশন দেয়। এখন আর হাতে দিতে পারছেনা, তাই বুকে ইনজেকশন দেওয়া শুরু করেছে। উস্তাদজী একে একে ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, ড. মুযাফফর বিন মুহসিন, ড. নূরুল ইসলাম, আব্দুল আলীম মাদানী সহ অনেকের সাথে কথা বললেন। উস্তাদজী বারবার বলছিলেন, এই হাসপাতাল আমার চিকিৎসা করতে পারছে না। আমি এখানে থাকতে পারছি না, আমি বাড়িতে যাব। তখন উস্তাদজীকে দু’দিন পর পর রক্তের প্লাটিলেট এবং একটা করে সাধারণ রক্ত প্রদান করতে হয়। এতদসত্ত্বেও উস্তাদজীর আকুতিতে ২১শে মে তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়।

একদিন পর ২৩ তারিখ বিকালে তাঁর শরীরে প্রচন্ড খিঁচুনি শুরু হয়। সেই সাথে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ততক্ষণাৎ তাঁকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তাররা তাঁকে পুনরায় ঢাকায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। রাতে উস্তাদজীকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু পিজি হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। পরিবারের সদস্য ছাড়াও সাথে ছিলেন যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সমাজ কল্যাণ সম্পাদক মাওলানা মুজাহিদুর রহমান। কিন্তু সেখানে কোন সীট খালি না থাকায় ভর্তি করা সম্ভব হল না। বরং সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডাক্তারদের নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হলাম। হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে উস্তাদজী কাতরাচ্ছেন, ‘আমি বাঁচতে চাই, আমি বাঁচতে চাই’।

দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা অপেক্ষার পর উস্তাদজীকে নেওয়া হল আজগার আলী হাসপাতালে। ডাক্তার তাঁর রিপোর্টগুলো দেখে বললেন, দ্রুত ইমারজেন্সিতে নিয়ে যান। অক্সিজেন লাগবে’। তখন তাঁর ব্লাড প্রেসার ছিল ৯৭/৯৮। একটু পর বয়স্ক একজন ডাক্তার এসে বললেন, বাবা! আমার হাতে কয়টা আঙ্গুল, গোন? উস্তাদজী বললেন, ‘চারটা’। ডাক্তার এরপর ডান পা ও বাম পা উঁচু করতে বললেন। উস্তাদজীও করলেন ভালোভাবে। ডাক্তার সাহস দিয়ে বললেন, আপনার জ্ঞান আছে, সমস্যা নেই। আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। মন শক্ত করেন। কিছুক্ষণ পর আসলেন ডা. মনজুর মোরশেদ। তিনিই মূলত উস্তাদজীর চিকিৎসা করবেন। তিনি দেখে বললেন, ‘পেশেন্টের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তবুও জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ। আমি চেষ্টা করতে পারি। আপনারা ২০/২২ লাখ টাকার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসা হবে ইনশাআল্লাহ।

উস্তাদজীকে ভর্তি করা হ’ল আইসিইউতে। এবার পরিবারের থেকে আলাদা কবরসম নিস্তব্ধ এক ঘরে তাঁর চিকিৎসা শুরু হল। আর বাইরে স্বজনদের উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা। প্রতিদিন সকালে মিনিট পাঁচেকের জন্য দু’জনকে দেখার সুযোগ দেওয়া হবে। পরদিন সকালে তিনজন ভিতরে গেলেন স্ত্রী, ভাই এবং বোন। ফিরে এসে তাদের কান্না হাসপাতালের ওয়ার্ড ভারী করে তুলছিল। ওদিকে উস্তাদজী উদগ্রীব হয়ে একমাত্র সন্তানকে দেখতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু ছোট বাচ্চার ঢুকার অনুমতি ছিল না। অনেক অনুনয় করে ফুয়াদকে সাথে নিয়ে দেখতে গেলাম আমি আর মুজাহিদ চাচা। তখন তাঁর কথা বলার শক্তি ছিল না। শুধু আধবোজা দু’চোখে অপলক চেয়েছিলেন ছেলেটির দিকে। হয়ত নিজের অতীত আর ছেলের ভবিষ্যতের সমীকরণ মেলাচ্ছিলেন। বিদায়, বিদায় অথবা সেই শক্তিও তাঁর ছিল না।

বেলা একটু বাড়লে উস্তাদজীর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সহপাঠী দেখা করতে আসলেন। তাদের বিদায়ের পর আসলেন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আসাদুল্লাহ মিলন ভাই। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার ভিতরে প্রবেশ করলেন। আমরা বাইরে অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি বের হয়ে বললেন, রোগীর অবস্থা ভালো না। লাইফ সাপোর্ট দরকার আপনারা কি লাইফ সাপোর্ট দিতে ইচ্ছুক? আমরা বিভিন্ন জনের কাছে ফোন দিলাম পরামর্শের জন্য। জানতে পারলাম, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে লাইফ সাপোর্ট থেকে বেঁচে ফেরা সৌভাগ্যবান রোগীর সংখ্যা মাত্র দুইজন। সিদ্ধান্ত হ’ল আমরা লাইফ সাপোর্ট নিব না। তখন ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, আপনারা অন্য কোথাও চিকিৎসা করাতে পারেন। এখানে অনেক খরচ হবে। সেখানে একদিনের বিল হ’ল এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার টাকা।

বিকালে উস্তাদজীকে আজগার আলী হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হ’ল। কিন্তু রিসিপশন থেকে জানানো হ’ল, সেখানে কোন আইসিইউ বেড খালি নাই। এদিকে একজন বললেন, প্রাইভেট হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। কারণ উস্তাদজীর তখন অক্সিজেন প্রয়োজন। একথা শুনেই চারপাশে দালাল ঘিরে ধরল। সবাই মাছের বাজারের মত দরদাম করতে লাগল। রোগী নিয়ে তাদের সেই নির্মম ব্যবসার নগ্ন উল্লাস অশুভ মূল্যবোধের নিষ্ঠুর জানান দিল। কতটা নীচে নেমে গেছে আমাদের সমাজ, নীতি-নৈতিকতা আর আদর্শ!

কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় নিয়ে গেলাম ইবনে সিনা হাসপাতালে। ডাক্তাররা রোগীর অবস্থা দেখে ভর্তি নিতে চাইলেন না। অবশেষে ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ভাইয়ের যোগাযোগে উস্তাদজীকে ভর্তি করানো হল। রাত তখন আটটা বাজে। ডাক্তার হাতে একটা প্রেসক্রিপশন দিয়ে বললেন, এখানে কিছুু ওষুধ লেখা আছে, দ্রুত নিয়ে আসেন। ফার্মেসীতে গেলে ওষুধ ভর্তি একটা বড়সড় কার্টুন ধরিয়ে দিল। ফার্মেসী থেকে আসার সময় ভাবছিলাম, এত ওষুধের ভার তিনি কি নিতে পারবেন?

রাত পার হয়ে দিন চলে আসলো। সকালে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলে জানালেন, স্যুপ খাওয়ানো যাবে। এক বাটি স্যুপ কিনে দিয়ে আসলাম। সকাল দশটার দিকে মাত্র একজনকে দেখার সুযোগ দিল। উস্তাদজীর স্ত্রী গেলেন  মিনিট কয়েকের দর্শনের জন্য। কে জানে সেটাই তার শেষ দেখা। ফিরে এসে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সেই কান্না ভর করল ভাই-বোন সহ অন্যদের চোখেও। আমার চোখেও একবিন্দু পানি জমেছিল। চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করলাম। সারাদিনে আর তেমন কিছু ঘটেনি। রাতে আমরা হালকা নাশতা করলেও উস্তাদজীর স্ত্রীকে কিছুই খাওয়ানো গেল না।

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আমি আর চাচা বসে আছি ওয়েটিং রুমে। অন্যরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। চাচা বললেন, আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি। আমি একা বসে থাকলাম। রাতের নীরবতা ভেঙে বক্সে বেজে উঠল, কোভিড আইসিইউ বেড নম্বর-৫ এর গার্ডিয়ান আইসিইউ ডিপার্টমেন্টে আসুন। আমি এক দৌড়ে চলে গেলাম উপর তলায় আইসিইউ রুমের সামনে। ডাক্তার বললেন, পেশেন্ট আপনার কে হন? আমি বললাম, ‘আমার শিক্ষক’। তিনি বললেন, মানুষ পৃথিবীতে আসে চলে যাওয়ার জন্য। আমাদের এনালাইসিস বলছে আপনাদের রোগী আর সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩ ঘন্টা বাঁচতে পারে। তারপর হয়তো চলে যাবে। আপনারা এই সময়টুকু ভিডিও কলের মাধ্যমে সকলকে দেখাতে পারেন। আমি কোন কথা না বলে নীচে চলে আসলাম। এসে দেখি চাচা বসে আছেন। আমি বললাম, চাচা ডাক্তার বললেন উনি আর বেশিক্ষণ থাকবেন না। চাচা আর আমি দু‘জনে ভেঙ্গে পড়লাম। দ্রুত চাচা আর আমি দু’টি পিপিই কিনে আইসিইউ রুমের সামনে চলে গেলাম। ডাক্তার বললেন, আপনাদের রোগী পৃথিবীতে আর নেই।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করবো কিছু বুঝতে পারছিনা। চাচা ফোন দিলেন আসাদুল্লাহ মিলন ভাইকে। উনি খুব দ্রুত চলে আসলেন। রাত ১২টার দিকে সর্বপ্রথম ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব উস্তাদজীকে জানানো হল। একটু পরে তিনি মৃত্যুর খবর ফেসবুকে পোস্ট করলে একের পর এক ফোন আসা শুরু হ’ল। তিনজন পরামর্শ করে ঠিক করলাম এখন পরিবারের কাউকে বলা যাবে না। চাচা বললেন, আববু! তুমি ওদের সবার মোবাইল নিয়ে নাও। আমি সকলের মোবাইল নিয়ে বন্ধ করে ফেললাম। এরপর সকলকে ডেকে নীচে নামানো হল। উস্তাদজীর সহধর্মিনী প্রশ্ন করলেন, আমরা এত রাতে কোথায় যাচ্ছি?’ বলা হ’ল, হাসপাতাল থেকে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন সাতক্ষীরায় নিয়ে চিকিৎসা করলে সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা একটা অ্যাম্বুলেন্সে উঠলাম। কিন্তু তিনি উস্তাদজীকে না দেখে গাড়িতে উঠতে চাইলেন না। অনেক বুঝিয়ে তাঁকে গাড়িতে তোলা হল।

যাত্রা শুরু করলাম সাতক্ষীরা উদ্দেশ্যে। দু’টি অ্যাম্বুলেন্স আগেপিছে করে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু গাড়ি মানিকগঞ্জে এসে দু’টি গাড়ি একসাথে হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি লাশবাহী গাড়িটা দেখে ফেলেন। তাকে বলা হল ওটা আমাদের গাড়ি না। তখন চাচা লাশবাহী গাড়ি নিয়ে অন্য ফেরীতে গেলেন। ২০ মিনিটের দূরত্ব বজায় রেখে পৌঁছলাম সাতক্ষীরায়। বাড়িতে রাস্তায় অনেক ভিড় ও লাশবাহী গাড়ি দেখে শুরু হ’ল আহাজারি।

প্রিয় উস্তাদজীর জানাযা ২৭শে মে দুপুর দু’টায় অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে বুলারাটির পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। পর দিন উস্তাদজীর ছোট্ট ছেলে আব্দুল্লাহ আফীফ ফুয়াদ পিতার খোঁজে ছুটে যায় আববুর কবরের কাছে। সে বার বার বলছিল, আমার আববু এই মাটির মধ্যে আছে। আম্মু, আম্মু, আমার আববু এই মাটির মধ্যে আছে। আল্লাহ উস্তাদজীকে জান্নাত নছীব করুন এবং তার পরিবার-পরিজনকে ধৈর্য্য ধারণের তাওফীক দিন- আমীন!

মুহাম্মাদ আবু জাহিদ

ছাত্র, দাওরায়ে হাদীছ, আল মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।



আরও