শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিছের রাজনৈতিক জীবনের একটি অধ্যায় (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ) 177 বার পঠিত

মোটের উপর আভ্যন্তরীণভাবে সমস্ত ঠিকঠাক করিয়া ফেলার পর শাহ ছাহেব মারহাট্টাদের দমন করার জন্য আহমদ শাহ আব্দালীকে আমন্ত্রিত করেন। ধর্মপরায়ণতায়, নৈতিক বলে আর সামরিক নৈপূণ্যে ও বীরত্বে তৎকালে জাহানে ইসলামে আব্দালী অদ্বিতীয় পুরুষ ছিলেন। আব্দালী ইতিপূর্বে যথাক্রমে ১৭৪৭, ১৭৫০, ও ১৭৫২ সনে ৪ বার ভারত আক্রমণ করিয়াছিলেন কিন্তু ১৭৫৭ আর ১৭৫৯ সনে তিনি আমন্ত্রিত হইয়াই ভারতে প্রবেশ করেন। শাহ সাহেব আহমদ শাহ আব্দালীকে যে সুদীর্ঘ ‘‘দাওয়াতনামা’’ প্রেরণ করিয়াছিলেন তাহার একস্থানে তিনি লিখিয়াছিলেন,

‘‘হিন্দে কাফেরদের প্রাদুর্ভাব আর অত্যাচার আর মুসলমানদের অসহায় অবস্থার বিবরণ লিখিত হইল। বর্তমানে আপনি ব্যতীত এমন কোন ক্ষমতাশালী ও প্রভাবান্বিত নরপতি নাই, যিনি স্বীয় সামরিক বলবিক্রম, বুদ্ধি-কৌশল ও দূরদর্শিতা দ্বারা শত্রুদলকে পরাভূত করিতে পারেন। অতএব এবিষয়ে ইহা সুনিশ্চিত যে, আপনার পক্ষে হিন্দে অগ্রসর হইয়া মারহাট্টাদের শক্তিকে চূর্ণ আর অসহায় মুসলিমদিগকে কাফেরদের কবল হইতে উদ্ধার করা ‘‘আইনী ফরয’’ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নতুবা আল্লাহ না করুন অবস্থার গতি যদি অপরিবর্তিতই থাকিয়া যায় তাহা হইলে অনতিকাল মধ্যেই এদেশে মুসলমানরা ইসলামকে ভুলিয়া যাইবে’’।

শাহ ছাহেবের অতুলনীয় সাংগঠনিক প্রতিভার প্রমাণ এই যে, আহমদ শাহ আব্দালীর বিরুদ্ধে বাহাও অযোধ্যার অধিপতি সফদর জঙ্গের পুত্র শুজাউদ্দওলাকে আপন দলে ভিড়াইবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ব্যর্থকাম হইয়াছিল। ‘মুতাআখ্খিরীনে’র সংকলয়িতা শুজাউদ্দওলার উক্তি উধৃত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছিলেন,

‘‘দীর্ঘকাল হইতে দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণরা হিন্দ ভূমিতে জবর দখল করিয়া রহিয়াছে। তাহাদের সীমাহীন লোভ, বিশ্বাসঘাতকতা আর কটুক্তির ফলে আহমদ শাহ আব্দালীর বিপদ তাহাদের মস্তকে অবতীর্ণ হইয়াছে। তাহারা জনগণের ইয্যত, আব্রূ, সুখ-শান্তি আর মর্যাদার কোন পরওয়াই রাখেনা, তাহারা সমস্তই নিজেদের আর স্বীয় জাত ভাইদের জন্য গ্রাস করিয়া রাখিতে চায়। জনগণ ইহাদের আচরণে ওষ্ঠাগতপ্রাণ হইয়া নিজেদের রক্ষা করার মানসে আর কতকটা সুখ-শান্তিলাভের আশায় বহু অনুরোধ-উপরোধ করিয়া শাহ আব্দালীকে আহবান করি আনিয়াছে। আব্দালীর আক্রমণের ক্ষতিকে মারহাট্টাদের অত্যাচারের তুলনায় তাহারা লঘু মনে করিয়াছে। অতএব এখন সন্ধির কথা উঠিতেই পারেনা’’ (৯১২ পৃঃ)।

আহমদ শাহ আব্দালীর অভিযান : শাহ সাহেব যে উদ্দেশ্যে আব্দালীকে আমন্ত্রিত করিয়াছিলেন, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁহার নির্বাচন কিরূপ অভ্রান্ত ছিল, এইবারে আমরা তাহা উল্লেখ করিব। সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরও আব্দালীর সহিত পত্রব্যবহার করিতেন আর গোপনে তিনিও শাহ ছাহেবের প্রধান বাহু নজীবুদ্দওলার শুভানুধ্যায়ী ছিলেন বলিয়া ‘‘মুতাআখ্খিরীনে’’ উল্লিখিত রহিয়াছে (৯০৮ পৃঃ)। আমরা সংক্ষেপের উদ্দেশ্যে আহমদ শাহ আব্দালীর ৫ম ও ৬ষ্ঠ অভিযানের কাহিনী একসঙ্গেই বর্ণনা করিব।

১৭৫৯ খৃষ্টাব্দে আহমদ শাহ আব্দালী রাজপুতানা আক্রমণ করিয়া সরহিন্দ হইতে মারহাট্টাদিগকে বিতাড়িত করেন। এই স্থানে তাহারা মুসলমানদের অনেকগুলি মসজিদ ও সাধুসজ্জনদের সমাধি বিধ্বস্ত করিয়াছিল। দাতা সিন্ধিয়া দিল্লীর উপকণ্ঠে বাউলী প্রান্তরে উপস্থিত হয়। আহমদ শাহও যমুনা পার হইয়া থানেশ্বরে দাতাজী সিদ্ধিয়ার সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করেন। এই যুদ্ধে দিল্লীর ১০ মাইল দূরবর্তী বিরারী ঘাটে দাতাজী সিন্ধিয়া নিহত হয়। রাও হোলকারকে শায়েস্তা করার জন্য আব্দালী শাহ পছন্দ খান ও শাহ কলন্দর খানকে ১৫ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যসহ প্রেরণ করেন। তাঁহারা নারনোলের পথে একদিন ও এক রাত্রিতে ৭০ ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া দিল্লী পৌঁছেন। তথায় একদিন বিশ্রাম করিয়া তাঁহারা রাত্রিযোগে যমুনা পড়ি দেন এবং প্রত্যুষে আকস্মিকভাবে রাও হোলকারের সৈন্যদলের উপর পতিত হন। হোলকার মাত্র ৩ শত সৈন্য লইয়া পলায়ন করে, অবশিষ্ট সমুদয় সৈন্য বিনষ্ট হয়।

১৭৬০ খৃষ্টাব্দে দিল্লী হইতে মারহাট্টাদের বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে আহমদ শাহ আব্দালী লাহোর হইতে নিষ্ক্রান্ত হন। গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী স্থানে উপস্থিত হওয়ামাত্র সাআদুল্লাহ খান নজীবুদ্দওলা, আহমদ জঙ্গশ, হাফেয রহমত খান ও দুন্দীখান আব্দালীর সহিত মিলিত হন (মুতাআখখিরীন ৯১০ পৃ:)। কেহ কেহ বলেন, আব্দালী নজীবুদ্দওলা ও শুজাউদ্দওলার সঙ্গেই যাত্রা করিয়াছিলেন। নজীবুদ্দওলার কুটনৈতিক ব্যবস্থার ফলেই অযোধ্যার যুবরাজের সহিত আব্দালীর বন্ধুত্ব স্থাপিত হইয়াছিল। ভরা বর্ষায় যমুনা পাড়ি দিয়া আব্দালী তদীয় বাহিনীসহ দিল্লী উপস্থিত হন।

সদাশিব রাও বালাজীর পুত্র বিশ্বাস রাওকে দিল্লীর সিংহাসনে বসাইয়া ভারতে মুগল রাজত্বের অবসান আর মারহাট্টা ব্রাহ্মণদের রাজত্বের অভিষেক ঘোষণা করার পাঁয়তারা করিতেছিল, ঠিক এমনি সময়ে আহমদ শাহ আব্দালীর এই অপ্রত্যাশিত অভিযানে প্রথমতঃ সে হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে, তারপর হিন্দু রাজত্ব ঘোষণার পূর্বে আব্দালীকে বিধ্বস্ত করা সমীচীন মনে করিয়া ইহার জন্য বন্ধপরিকর হয়। এই উদ্দেশ্যে সদাশিব রাও ভাও ১৭৬০ খৃষ্টাব্দের ২৯শে অক্টোবরে পানিপথে ৩ লক্ষ সৈন্য সন্নিবেশিত করে। তাহার সহিত জনৈক ভূতপূর্ব ফরাসী সেনাধ্যক্ষ গার্দীও ১২ হাজার বন্দুক ও তোপসহ যোগদান করিয়াছিল।

আব্দালী সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা ইংরেজ ঐতিহাসিকগণের বর্ণনাসুত্রে ১ লক্ষের অধিক ছিল না। তিনি দিল্লী হইতে ৩০টি কামান আর কয়েকটি প্রাচীরভেদী যন্ত্রও হস্তগত করিয়াছিলেন। ১৭৬০ খৃষ্টাব্দের পহেলা নভেম্বরে আহমদ শাহ পানিপথে উপস্থিত হন। আড়াই মাস ধরিয়া পানিপথে মারহাট্টাদের সহিত বিরামহীন যুদ্ধ চলিতে থাকে। অ্যাডভান্স গার্ডসের অধিনায়ক রূপে প্রথম সারিতে জাহান খান, শাহপছন্দ খান ও নজীবুদ্দওলা, তাঁহাদের পশ্চাতে অযোধ্যার যুবরাজ শুজাউদ্দওলা (সফ্দরজঙ্গের পুত্র), আহমদ খান বঙ্গশ, হাফেয রহমতুল্লাহ, দুন্দীখান, আলী মুহাম্মদ রোহিলার পুত্র ফয়েযুল্লাহ খান, তাঁহাদের পশ্চাতে শাহওলীখান ওযীরসহ স্বয়ং আহমদ শাহ আব্দালীকে লইয়া মুসলিম বাহিনী সজ্জিত হইয়াছিল। যোহরের নমায পড়ার পর আব্দালী যুদ্ধ আরম্ভ করেন। সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানিক পূর্বেই নজীবুদ্দওলা ১০ হাজার রোহিলা পদাতিক সমভিব্যাহারে মারহাট্টাদের তোপখানা কাড়িয়া লয়। সদাশিবের শ্বশুর বলবন্ত রাও গুলির আঘাতে নিহত হয়।

দীর্ঘকাল অবরোধ অবস্থায় থাকার ফলে মারহাট্টাদের মধ্যে নৈরাশ্যের সঞ্চার হয়। অবশেষে ১৭৬১ খৃষ্টাব্দের ৭ই জানুয়ারী (৬ই জমাদিস্সানী ১১৭৪ হিঃ) মারহাট্টারা ‘‘হর, হর, বোম’’ চীৎকারে আকাশ বাতাস মুখরিত করিয়া মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে কিন্তু শুজাউদদ্দওলা ও নজীবুদ্দওলা সিংহবিক্রমে তাহাদিগকে ভুশায়ী করিয়া ফেলেন। বালাজীর পুত্র বিশ্বাস রাও (যাহাকে দিল্লীর সিংহাসনে বসাইবার ব্যবস্থা করা হইয়াছিল) আর প্রধান সেনাপতি সদাশিব রাও ভাও এবং প্রায় ২ লক্ষ মারহাট্টা সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হয়। চক্ষের নিমিষে মারহাট্টাদের বিক্রম কর্পূরের মত উড়িয়া যায়। স্যার যদুনাথ সরকার দুঃখ করিয়া লিখিয়াছেন, মহারাষ্ট্রে এমন কোন পরিবার ছিলনা যাহার গৃহে ক্রনদনের রোল উত্থিত হয়নাই। নেতাদের একটি পূর্ণ পিঁড়ি এক যুদ্ধেই নিঃশেষিত হইয়াছিল। ফরাসী কম্যান্ডাগার্দী আর জানকী সিন্ধিয়া কোর্টমার্শালে মৃত্যুদন্ড পায়। মূহলর রাও হোলকার আর নানাফণবীশ প্রাণ লইয়া পলায়ন করিতে সমর্থ হয়। পলাতক মারহাট্টা সৈন্যের অধিকাংশ, মারহাট্টাদের অত্যাচারে সর্বস্বান্ত কৃষকদের হস্তে নানাস্থানে নিহত হয়। ইহার ৫ মাস পর বালাজীরাও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ইহার পর ভারত ভূমিতে ব্রাহ্মণতন্ত্র আর হিন্দুরাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হইয়া যায়।

শাহ ওলীউল্লাহ দেহলভী পানিপথে যে সমরাঙ্গন সজ্জিত করিয়াছিলেন, তাহার পরিণতি স্বরূপ ভারতে ইসলামী রাজত্বের সংস্কার ও প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু কার্যতঃ মুগলদের ভিতর কোন শক্তি বিদ্যমান না থাকায় বিশেষতঃ ইহার পরেই শিখ আর জাঠদের ষড়যন্ত্র বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু করা সম্ভবপর হয়নাই। শিখদের নবম গুরু তেগবাহাদুরের মুসলিমবিদ্বেষ অতঃপর বীভৎসমূর্তি ধারণ করে। মারহাট্টাদের পতনের পর পরেই ১৭৬৪ খৃষ্টাব্দে শিখরা পুনরায় লাহোর দখল করিয়া বসে। তাহারা সরহিন্দে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানীর জন্মভূমি ও সাধু-তাপসগণের সমাধি ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত করে। পানিপথের পরবর্তী বৎসর ১৬৬২ খৃষ্টাব্দে আলাজাঠ নামক জনৈক দস্যু সরদার দিল্লী আক্রমণ করার জন্য ২ লক্ষ সৈন্য সন্নিবেশিত করে। ঠিক এই সময়ে হযরত শাহ ছাহেবের নিকট তাঁহার প্রভুর আহবান আসিয়া পড়ে। তিনি তাঁহার আরদ্ধ কার্য অসমাপ্ত রাখিয়াই ১১৭৬ হিজরীতে পরলোকের যাত্রী হন। কিন্তু যাহা তিনি অসমাপ্ত রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার ছাত্র, পুত্র ও পৌত্রগণ তাহা সমাপ্ত করার জন্য উত্তরকালে তাঁহাদের মস্তক উৎসর্গ করিয়াছিলেন। শেষ পর্যন্ত ইসলামি রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আল্লাহর অভিপ্রায়ে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর হস্তেই বাস্তবায়িত হইয়াছিল।

[গৃহীত : তর্জুমানুল হাদীস, অষ্টম বর্ষ-দ্বাদশ সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৫৯।]



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও