দায়িত্বশীলদের গুণাবলী

মুহাম্মাদ আবুল কালাম 9359 বার পঠিত

ভূমিকা : মতবাদ বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর মানুষ অশান্তির দাবানলে দাউ দাউ করে জ্বলছে। তারা বাঁচতে চায়, তারা মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তি কোথায়? এ জন্য প্রয়োজন একদল বিপ্লবী সমাজকর্মী, যারা এক আল্লাহর উপর ভরসা করে দুনিয়ার সমস্ত বাধার মুকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সৎসাহস রাখে। নিম্নে আমরা এই বিপ্লবী কাফেলার দায়িত্বশীলদের গুণাবলী সম্পর্কে আলোকপাত করব।

আল্লাহভীরুতা : আল্লাহভীরুতা মানুষের একটি মহৎ গুণ। মানুষে মানুষে পার্থক্যের মানদন্ড হ’ল আল্লাহভীরুতা। যার যত আল্লাহভীতি বেশী, তার মর্যাদা স্তর তত বেশী। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পাপরাশি মিটিয়ে দেন এবং তাকে ক্ষমা করেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَتَّقُوا اللَّهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ ‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহভীরু হও, তাহ’লে তিনি তোমাদের জন্য সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার পথ বের করে দিবেন এবং এর ফলে তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন ও তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ হলেন মহা অনুগ্রহশীল’ (আনফাল ৮/২৯)। وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার গুনাহসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তাকে পরকালে মহা পুরস্কার দিবেন’ (তালাক্ব ৬৫/৫)। আল্লাহর নিকট সম্মানিত হওয়ার মাপকাঠি হ’ল আল্লাহ ভীতি। তিনি বলেন, إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সে যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক পরহেযগার’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا - وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ  ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্যে উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না’ (তালাক্ব ৬৫/২-৩)। তিনি আরও বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُون‘হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা অবশ্যই (প্রকৃত) মুসলমান না হয়ে মরো না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)। তিনি বলেন, فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ  ‘তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর’ (তাগাবুন ৬৮/১৬)। তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’ (আহযাব ৩৩/৭০)। তিনি বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا  ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেয়’ (তালাক্ব ৬৫/৪)। এভাবে বহু জায়গায় আল্লাহভীরুতা অর্জনের জন্য জোরালো তাকীদ প্রদান করা হয়েছে।

আল্লাহভীরু ব্যক্তিই মানুষের মাঝে বেশী মর্যাদাবান। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ أَكْرَمُ النَّاسِ قَالَ أَتْقَاهُمْ ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হ’ল মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, যে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু’।[1] রাসূল (ছাঃ) বলেন, أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ كَانَ عَبْداً حَبَشِيًّا‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার ভয় করার এবং নেতার কথা শোনার ও তার আনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি যদিও সে হাবশী (কৃষ্ণাঙ্গ) গোলাম হয়’।[2] ক্বিয়ামতের দিন সাত শ্রেণীর মানুষকে আল্লাহ তাঁর ছায়ার নিচে আশ্রয় দিবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। তার এক শ্রেণী হচ্ছে যে ব্যক্তি একাকী আল্লাহকে স্মরণ করে আর আল্লাহর ভয়ে তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে’।[3]

সুন্নাতের পাবন্দ ও রাসূলের আনুগত্য :

মহান আল্লাহ  বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর’  (হাশর ৫৯/৭)। তিনি বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)। দ্বীনের ব্যাপারে অনেক মতভেদ ও মতবিরোধ পরিলক্ষিত হবে। তখন সব মতকে উপেক্ষা করে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ  ‘এমতাবস্থায় তোমাদের কর্তব্য হবে আমার সুন্নাতকে ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং এই পথ ও পন্থার উপর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে’।[4]

রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত বহির্ভহত কোন আমলই সঠিক আমল হিসাবে গণ্য হবে না। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه يَقُولُ جَاءَ ثَلاَثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا أُخْبِرُوا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوهَا فَقَالُوا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَإِنِّى أُصَلِّى اللَّيْلَ أَبَدًا وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلاَ أُفْطِرُ وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلاَ أَتَزَوَّجُ أَبَدًا فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللَّهِ إِنِّى لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّى أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّى وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِى فَلَيْسَ مِنِّى-  ‘আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, তিন জনের একটি দল নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য তাঁর স্ত্রীদের নিকট আসলেন। যখন তাদেরকে এ সম্পর্কে জানানো হ’ল তখন তারা ইবাদতের পরিমাণ কম মনে করল এবং বলল, নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে আমাদের তুলনা হ’তে পারেনা। কারণ তাঁর আগের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় তাদের মধ্য হ’তে একজন বলল, আমি সারা জীবন রাতভর ছালাত আদায় করতে থাকব। অপর একজন বলল, আমি সব সময় ছিয়াম পালন করব এবং কখনো তা বাদ দিব না। অপরজন বলল, আমি নারী সংসার ত্যাগ করব, কখনও বিয়ে করব না। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের নিকট আসলেন এবং বললেন, তোমরা কি এসব লোক যারা এমন এমন কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি বেশী অনুগত; অথচ আমি ছিয়াম পালন করি, আবার বিরত থাকি। ছালাত আদায় করি, নিদ্রা যাই এবং বিবাহও করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগভাজন হবে তারা আমার দলভুক্ত নয়’।[5]

উপরোক্ত হাদীছের মাধ্যমে এ বিষয়টি পরিস্কারভাবে ফুটে উঠে সমাজে রাসূলের সুন্নাতের বাইরে গিয়ে মনগড়া যেসব ইবাদত চলছে বিশেষ করে শবেবরাত, শবেমে‘রাজ, মিলাদ, ক্বিয়াম, কুলখানী, চেহলাম বা চল্লিশা, কলেমাখানী ইত্যাদি রাসূলের সুন্নাত পরিপন্থী হওয়ায় তা পরিত্যাজ্য। এগুলির যদি কোন বিশেষ ফযীলত থাকত, তবে রাসূল (ছাঃ) নিজে করতেন ও তার ছাহাবীগণও তার উপরে আমল করতেন এবং মুসলিম উম্মাহর নিকটে তা প্রচার করে যেতেন। কিন্তু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এসবের কিছুই পাওয়া যায় না।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্যের মাধ্যমে জান্নাত পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে তার অবাধ্য হ’লে জাহান্নাম অবধারিত। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى ‘আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, অস্বীকারকারী ব্যতীত। জিজ্ঞেস করা হ’ল কে অস্বীকারকারী? তিনি (ছাঃ) বললেন, যারা আমার আনুগত্য স্বীকার করে তারা জান্নাতে যাবে। আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্য হয় সেই (জান্নাতে যেতে) অস্বীকার করে (জাহান্নামে প্রবেশ করবে)’।[6]

নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য :

মহান আল্লাহ  বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর (নিসা ৪/৫৯)। এই আয়াতে তিন ব্যক্তির আনুগত্য করার নির্দেশ রয়েছে। ১. আল্লাহ্। ২. আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ৩. নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। অতঃপর আল্লাহ তার আনুগত্যকে তাঁর রাসূলের আনুগত্যের উপর নির্ধারিত করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহর আনুগত্য করে (নিসা ৪/৮০)। আর রাসূল (ছাঃ) নিজের আনুগত্যকে নেতার আনুগত্যের উপর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ عَصَى اللَّهَ وَمَنْ يُطِعِ الأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِى وَمَنْ يَعْصِ الأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِى ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল সে আল্লাহ &র অবাধ্যতা করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল সে আমার আনুগত্য করল। আর যে আমীরের অবাধ্যতা করল সে আমার অবাধ্যতা করল’।[7]

আমীরের আনুগত্য ছিন্নকারী এবং জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বল্গাহীন জীবন-যাপনকারী মৃত্যুবরণ করলে তা হয় জাহেলিয়াতের মৃত্যু। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য হ’তে বেরিয়ে যায় ও জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় অতঃপর মারা যায় সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করে’।[8] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ لَقِىَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ حُجَّةَ لَهُ وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً  ‘যে ব্যক্তি আমীরের প্রতি আনুগত্যের হাত ছিনিয়ে নিল, সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে এমন অবস্থায় যে, তার জন্য (ওযর স্বরূপ) কোন দলীল থাকবে না। যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমন অবস্থায় যে তার গর্দানে আমীরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত নেই সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’।[9]

পদের প্রতি লোভহীনতা : 

জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপন নেতৃত্ব ও আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা নেতৃত্ব বা দায়িত্ব দান করেন। মহান আল্লাহ বলেন, قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ ‘তুমি বল, হে আল্লাহ! তুমি রাজাধিরাজ। তুমি যাকে খুশী রাজত্ব দান কর ও যার কাছ থেকে খুশী রাজতব ছিনিয়ে নাও। তুমি যাকে খুশী সম্মানিত কর ও যাকে খুশী অপমানিত কর। তোমার হাতেই যাবতীয় কল্যাণ’ (আলে ইমরান ৩/২৬)। কিন্তু যে ব্যক্তি দায়িত্বের প্রতি লালায়িত, পদের প্রতি আকাংখিত তাকে আল্লাহ্্র রাসূল (ছাঃ) কোন দায়িত্বে নিযুক্ত করতেন না।

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى مُوسَى رضى الله عنه قَالَ دَخَلْتُ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَا وَرَجُلاَنِ مِنْ قَوْمِى فَقَالَ أَحَدُ الرَّجُلَيْنِ أَمِّرْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَقَالَ الآخَرُ مِثْلَهُ فَقَالَ إِنَّا لاَ نُوَلِّى هَذَا مَنْ سَأَلَهُ وَلاَ مَنْ حَرَصَ عَلَيْه-  আবু মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার কওমের দু’ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসলাম। সে দু’জনের একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে (কোন বিষয়ে) আমীর নিযুক্ত করুন। অন্যজনও ঐরূপ কথা বলল। তিনি বললেন, যারা নেতৃত্ব চায় এবং এর লোভ করে আমরা তাদেরকে এ পদে নিয়োগ করি না’।[10]

সুতরাং নেতৃত্বের লোভ করা প্রার্থী হওয়া, আকাংখিত হওয়া, লালায়িত হওয়া ইসলামে বৈধ নয়। যে ব্যক্তি দায়িত্ব চেয়ে নেয় সকল দায়িত্বভার তার উপরই অর্পিত হবে। আর যদি না চাওয়া সত্ত্বেও কোন দায়িত্ব দেয়া হয় তাহ’লে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। এ সম্পর্কে হাদীছ,  عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ لِى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ سَمُرَةَ لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ فَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا وَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا- আব্দুর রহমান আবনু সামুরাহ হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (ছাঃ) আমাকে বলেছেন, ‘হে আব্দুর রহমান ইবনু সামুরাহ! নেতৃত্ব চেয়ে নিও না। কেননা যদি চাওয়ার পর তোমাকে দেয়া হয়, তাহলে তার সকল দায়িত্বভার তোমার উপরই অর্পিত হবে। আর যদি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে তা দেয়া হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সহযোগিতা করা হবে’।[11]

দায়িত্বানুভূতির তীব্রতা :

দায়িত্ব পালনে যত্নবান হওয়া যরূরী। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সঠিক কর্মপন্থায় দায়িত্ব পালন করার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। দায়িত্বের জাবাবদিহীতা রয়েছে। যে ব্যক্তি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে অবজ্ঞা, অলসতা ও অবহেলা করে সঠিকভাবে পালন করে না আল্লাহর কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হবে। মহান আল্লাহ  বলেন, وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا ‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ  ‘নিশ্চয় তোমরা প্রত্যেক দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[12]

সততা ও যোগ্যতা :

সততা, ন্যায়পরায়ণতা, শালীনতা, ভদ্রতা যোগ্যতা ও নম্রতা মানব জীবনের মহৎ গুণ। এসব গুণের কারণে মানুষ নন্দিত বা নিন্দিত হয়। হিকমাত ও যোগ্যতার সাথে দাওয়াতী কাজ করলে তা ফলপ্রসূ হয়। মহান আল্লাহ  বলেন, ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দর পন্থায়’ (নাহল ১৬/১২৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, পাহাড়ের গুহায় আটকে পড়া তিন ব্যক্তির তৃতীয় জন বলেছিলেন,

اللَّهُمَّ إِنِّى كُنْتُ اسْتَأْجَرْتُ أَجِيرًا بِفَرَقِ أَرُزٍّ فَلَمَّا قَضَى عَمَلَهُ قَالَ أَعْطِنِى حَقِّى . فَعَرَضْتُ عَلَيْهِ حَقَّهُ ، فَتَرَكَهُ وَرَغِبَ عَنْهُ ، فَلَمْ أَزَلْ أَزْرَعُهُ حَتَّى جَمَعْتُ مِنْهُ بَقَرًا وَرَاعِيَهَا ، فَجَاءَنِى فَقَالَ اتَّقِ اللَّهَ وَلاَ تَظْلِمْنِى ، وَأَعْطِنِى حَقِّى . فَقُلْتُ اذْهَبْ إِلَى ذَلِكَ الْبَقَرِ وَرَاعِيهَا . فَقَالَ اتَّقِ اللَّهَ وَلاَ تَهْزَأْ بِى . فَقُلْتُ إِنِّى لاَ أَهْزَأُ بِكَ ، فَخُذْ ذَلِكَ الْبَقَرَ وَرَاعِيَهَا . فَأَخَذَهُ فَانْطَلَقَ بِهَا ، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّى فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ ، فَافْرُجْ مَا بَقِىَ ، فَفَرَجَ اللَّهُ عَنْهُمْ-  

‘হে আল্লাহ ! আমি একজন ব্যক্তিকে এক ‘ফারক’ চাউলের বিনিময়ে মজুর নিয়োগ করেছিলাম। সে তার কাজ শেষ করে এসে বলল, আমার প্রাপ্য দিয়ে দিন । আমি তার প্রাপ্য তার সামনে উপস্থিত করলাম। কিন্তু সে তা ছেড়ে দিল ও প্রত্যাখান করল। তারপর তার প্রাপ্যটা আমি ক্রমাগত কৃষিকাজে খাটাতে লাগলাম। তা দিয়ে অনেকগুলি গরু ও রাখাল জমা করলাম। এরপর সে একদিন আমার কাছে এসে বলল, আল্লাহকে ভয় কর, আমার উপর যুলম কর না এবং আমার প্রাপ্য দিয়ে দাও। আমি বললাম ঐ গরু ও রাখালের কাছে চলে যাও। সে বলল, আল্লাহকে ভয় কর আমার সাথে উপহাস কর না। আমি বললাম তোমার সাথে আমি উপহাস করছি না। তুমি ঐ গরুগুলি ও রাখাল নিয়ে যাও। তারপর সে ওগুলি নিয়ে চলে গেল। (হে আল্লাহ ) আপনি জানেন যে তা আমি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্যেই করেছি, তাই আপনি অবশিষ্ট অংশ উন্মুক্ত করে দিন। তারপর আল্লাহ তাদের জন্য তা উন্মুক্ত করে দিলেন’।[13] উপরোক্ত ঘটনাটি সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি চাইলে সম্পদের বর্ধিত অংশ না দিয়ে শুধুমাত্র কাজের বিনিময় দিতে পারতেন।

আমাতনদারিতা :

আমনতদারী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমানতদারী না থাকাকে ঈমান না থাকার সাথে তুলনা করা হয়েছে। মুনাফিকের আলামত সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি হ’ল আমানতের খিয়ানত করা। খিয়ানতকারীর জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। মহান আল্লাহ খিয়ানত করতে নিষেধ করে বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা (অবাধ্যতার মাধ্যমে) আল্লাহ ও রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না এবং (এর অনিষ্টকারিতা) জেনে-শুনে তোমাদের পরস্পরের আমানত সমূহে খেয়ানত করো না’ (আনফাল ৮/২৭)

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَلَّمَا خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ قَالَ لاَ إِيمَانَ لِمَنْ لاَ أَمَانَةَ لَهُ وَلاَ دِينَ لِمَنْ لاَ عَهْدَ لَهُ-  আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরূপ খুৎবা খুব কমই দিয়েছেন যাতে এ কথা বলেন নি যে, যার আমানতদারী নেই তার ঈমানও নেই এবং যার ওয়াদা-অঙ্গীকারের মূল্য নেই তার দীনও নেই’।[14]

তিনি আরো বলেন,  عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ-  আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি। ১. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। ২. যখন অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে ৩. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে’।[15]

অপর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,  عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَر- আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী (ছাঃ) বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে সে হচ্ছে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোন একটি স্বভাব থাকবে তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। ১. আমানত রাখা হ’লে খিয়ানত করে। ২. কথা বললে মিথ্যা বলে। ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে। ৪. বিবাদে লিপ্ত হ’লে অশ্লীলভাবে গালাগালি দেয়।[16]

হালাল রূযী :

ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত হ’ল হালাল রূযী। হালাল ব্যতীত কখনো জান্নাত পাওয়া সম্ভব নয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا وَإِنَّ اللَّهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ فَقَالَ ( يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّى بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ) وَقَالَ (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ). ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِىَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ-

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া গ্রহণ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ রাসূলগণকে যা আদেশ করেছেন, মুমিনদেরকেও তাই আদেশ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, হে রাসূলগণ! পবিত্র বস্ত্ত আহার করুন এবং সৎকাজ করুন। তিনি আরো বলেন, হে মুমিনগণ! আমার দেয়া পবিত্র রিযক হ’তে ভক্ষণ করুন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) দৃষ্টান্ত হিসাবে এক ব্যক্তির অবস্থা উল্লেখ করে বলেন, এক ব্যক্তি সফরে থাকায় ধূলায় মলিন হয়। এ অবস্থায় ঐ ব্যক্তি আকাশের দিকে দু’হাত উঠিয়ে কাতর কন্ঠে প্রার্থনা করছে হে রব! হে রব! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবিকা নির্বাহ হারাম কিভাবে তার  দো‘আ কবুল হবে?’।[17]

হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِحَرَامٍ-

‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত  সে দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[18] অপর এক হাদীছে এসেছে,

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ النَّارُ أَوْلَى بِه-   

জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে দেহের গোশত হারাম উপার্জনে গঠিত তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম ধন-সম্পদ গঠিত ও লালিত-পালিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযোগী’।[19]

হারাম বর্জন করে হালাল গ্রহণ করা অতীব যরূরী। রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবী হারাম থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করতেন। এর প্রমাণে নিম্নের হাদীছটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ: كَانَ لأَبِى بَكْرٍ غُلاَمٌ يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ، وَ كَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِهِ، فَجَاءَ يَوْمًا بِشَىْءٍ فَأَكَلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ لَهُ الْغُلاَمُ تَدْرِى مَا هَذَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ وَمَا هُوَ قَالَ كُنْتُ تَكَهَّنْتُ لإِنْسَانٍ فِى الْجَاهِلِيَّةِ وَمَا أُحْسِنُ الْكِهَانَةَ ، إِلاَّ أَنِّى خَدَعْتُهُ ، فَلَقِيَنِى فَأَعْطَانِى بِذَلِكَ ، فَهَذَا الَّذِى أَكَلْتَ مِنْهُ . فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهُ فَقَاءَ كُلَّ شَىْءٍ فِى بَطْنِهِ-

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আবু বকর (রাঃ)-এর একজন ক্রীতদাস ছিল। সে প্রতিদিন তার উপর ধার্য কর আদায় করত। আর আবু বকর (রাঃ) তার দেওয়া কর হ’তে আহার করতেন। একদিন সে কিছু খাবার জিনিস এনে ছিল। তা হ’তে তিনি আহার করলেন, তারপর গোলাম বলল, আপনি জানেন কি ওটা কিভাবে উপার্জিত হয়েছে যা আপনি খেয়েছেন? তিনি বললেন, কিভাবে! গোলাম উত্তর দিল আমি জাহেলী যুগে এক ব্যক্তির ভবিষ্যৎ গণনা করে দিয়েছিলাম কিন্তু ভবিষ্যৎ গণনা করা আমার ভালভাবে জানা ছিল না। তথাপি প্রতারণা করে তা করেছিলাম। আমার সাথে তার দেখা হলে গণনার বিনিময়ে সে এ দ্রব্যদি আমাকে হাদিয়া দিল যা হ’তে আপনি আহার করলেন। আবু বকর এটা শুনামাত্র মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং পেটের ভিতর যা কিছু ছিল সবই বমি করে বের করে ফেললেন’।[20]

ইসলামী পরিবার :

সন্তানের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র হ’ল পরিবার। সন্তানকে আদর্শ হিসাবে গড়ে তোলার মুখ্য ভূমিকা পালন করে তার পরিবার। পরিবার যদি ইসলামী মূল্যবোধের উপর দৃঢ় থাকে। পরিবারের সদস্যগণ যদি ফরয সুন্নাত ও নফল ইবাদত গুযার হয়, ভ্রাতৃত্ববোধ দৃঢ় হয়, সুন্দর আচরণের অধিকারী হয়, তাহলে সেখানে আল্লাহর রহমত নাযিল হয় এবং সন্তানও সেই আলোকে গড়ে উঠে। অপরপক্ষে পরিবারে যদি অন্যায় অশ্লীলতা থাকে। ইসলামী বিধান থেকে দূরে থাকে। বিভিন্ন অনৈসলামী আচরণের সাথে যুক্ত থাকে। সুদ-ঘুষ, জুয়া-লটারী, মাদকতা, বেহায়াপনা ও কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়ে, তাহ’লে সন্তানের উপরও তার কুপ্রভাব পড়ে। কেননা সব সন্তানই ফিৎরাতের উপর জন্ম গ্রহণ করে। কিন্তু পিতা-মাতার প্রভাবেই সে ভাল কিংবা মন্দ হয়। সুতরাং ইসলামী পরিবার গঠন করা অপরিহার্য। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,  مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلاَّ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ ، كَمَا تُنْتَجُ الْبَهِيمَةُ بَهِيمَةً جَمْعَاءَ ، هَلْ تُحِسُّونَ فِيهَا مِنْ جَدْعَاءَ. ثُمَّ يَقُولُ أَبُو هُرَيْرَةَ رضى الله عنه فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِى فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ ‘প্রত্যেক সন্তানই ফিৎরাতের উপর জন্ম গ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইয়াহুদী, নাছারা অথবা অগ্নিপূজক বানিয়ে ফেলে। যেমন চতুষ্পদ জন্তু পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা প্রসব করে। তোমরা কি তাতে কোন (জন্মগত) কান কাটা দেখতে পাও? অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) তিলাওয়াত করলেন, আল্লাহর দেয়া ফিৎরাতের অনুসরণ কর, যে ফিৎরাতের উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, এটাই সরল সুদৃঢ় দ্বীন’।[21]

সংগঠনের জন্য ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা :

যে কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য চাই ত্যাগ। ত্যাগী কর্মী বা দায়িত্বশীল ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। ত্যাগের অনুপম দৃষ্টান্ত ছাড়া কোন ইতিহাসই রচিত হয়নি। যে কোন বিপ্লবের পিছনে রয়েছে অতুলনীয় ত্যাগ। মহান আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ ‘লোকদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে, যে আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল’ (বাক্বারাহ ২/২০৭)। ছুহায়েব রূমী (রাঃ)-এর আত্মত্যাগের প্রশংসা করে অত্র আয়াতটি নাযিল হয়। ঘটনাটি হ’ল তিনি ইয়াছরিবের হিজরতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে কিছু দূর যেতেই মুশরিকরা তাকে রাস্তায় ঘিরে ফেলে তখন সওয়ারী থেকে নেমে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দেখ তোমরা জান যে, আমার তীর সাধারণত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। অতএব আমার তূনীরে একটা তীর বাকী থাকতেও তোমরা আমার কাছে ভিড়তে পারবে না। তীর শেষ হয়ে গেলে তলোয়ার চালাব। অতএব তোমরা যদি দুনিয়াবী স্বার্থ চাও, তবে মক্কায় রক্ষিত আমার বিপুল ধন-সম্পদের সন্ধায় বলে দিচ্ছি, তোমরা সেগুলি নিয়ে নাও এবং আমার পথ ছাড়। তখন তারা পথ ছেড়ে দিল। মদীনায় পেঁŠছে এই ঘটনা বর্ণনা করলে রাসূল (ছাঃ) তাকে প্রশংসা করে বলেন, ياَ اَباَ يَحْيَ رَبِحَ الْبَيْعُ  ‘হে আবু ইয়াহইয়া! তোমার ব্যবস্যা লাভজনক হয়েছে’।[22] ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রচিত হয়েছে ইয়ারমুকের যুদ্ধে। যা আমরা প্রত্যক্ষ করি নিম্নের ঘটনার মাধ্যমে। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর খিলাফত কালে ৬৩৬ খৃষ্টাব্দে ইয়ারমুক যুদ্ধ। যুদ্ধের বিশাল ময়দানের এক প্রান্তে ক্ষুদ্র মুসলিম সেনাদল এবং অন্য প্রান্তে রোমকদের বিশাল সৈন্যবাহিনী। উভয় বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয় এবং প্রচন্ড আকার ধারণ করে। অবশেষে আল্লাহর রহমতে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। যুদ্ধের ময়দানে আবু হুযায়ফা (রাঃ) তার সাথে রক্ষিত সামান্য পানি নিয়ে আহতদের মাঝে তার চাচাতো ভাইকে খুঁজতে শুরু করলেন। শেষে তিনি তাঁর চাচাতো ভাইকে এমন অবস্থায় পেলেন যে তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল এবং অবস্থা ছিল আশংকাজনক। তিনি তাকে বললেন, তুমি কি পানি পান করবে? সে কথায় কোন উত্তর দিতে সক্ষম না হয়ে হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত করল। আহত চাচাতো ভাই হুযায়ফার কাছ থেকে পানি পান করার জন্য হাত নিতেই তার পাশে এক সৈন্যকে পানি পানি বলে চিৎকার করতে শুনল। পিপাসার্ত ঐ সৈনিকের বুকফাঁটা আর্তনাদ শুনে তিনি তার পূর্বে সেই ব্যক্তিকে পানি পান করানোর জন্য ইঙ্গিত করল। হুযায়ফা (রাঃ) তার নিকট গিয়ে বললেন, আপনি কি পানি পান করতে চান? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তিনি পানি পান করার জন্য পাত্র উপরে তুলে ধরতেই পানির জন্য অন্য একজন সৈন্যের চিৎকার শুনতে পেলেন। ফলে তিনি পানি না করে হুযায়ফা (রাঃ)-কে বললেন, তার দিকে দ্রুত ছুটে যাও এবং সে পানি পান করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাকে দিও। হুযায়ফা (রাঃ) আহত সৈন্যটির কাছে গিয়ে দেখলেন, সে মারা গেছে। অতঃপর দ্বিতীয় জনের কাছে ফিরে এসে দেখলেন সেও মারা গেছে। অতঃপর চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফিরে আসলেন দেখেন সেও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে জান্নাতবাসী হয়ে গেছে। পানির পাত্রটি তখনও হুযায়ফা (রাঃ)-এর হাতে।  অথচ তা পান করার মত এখন আর কেউ বেঁচে নেই। যাদের পানির প্রয়োজন ছিল তারা আরেক জনের পানির পিসাসা মিটানোর জন্য এতই পাগল হয়ে উঠেছিলেন যে, অবশেষে কেউ সে পানি পান করতে পারে নি। অথচ সবার প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত’।[23]

শেষকথা : সাংগঠনিক জীবন মানেই বিপ্লবের জীবন। বিপ্লবের জন্য চাই সমাজ সংস্কারের ব্রতী একদল কঠিন আত্মত্যাগী মানুষ। আর এ জন্য চাই যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং আনুগত্যশীল ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। পরহেযগারিতা, ঐক্য, নিষ্ঠাসহ যাবতীয় ভাল গুণাবলীর সমাবেশ ঘটলেই কেবল একজন কর্মী, একটি দেশ, একটি সংগঠন পৌঁছতে পারে তার লক্ষ্যপানে। হতে পারে জাতির মুক্তির সোপান। বিদ্রোহী কবি কাযী নযরুল ইসলামের বার্তা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই-

‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,

ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?

কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত। (কান্ডারী হুশিয়ার)


[1]. বুখারী হা/৩৩৫৩, ৩৩৭৪, ৩৩৮৩, ৩৪৯০, ৪৬৮৯।

[2]. আহমাদ হা/১৬৬৭৪; আবুদাউদ হা/৪৬০৭; তিরিমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হ/৪২; তাহক্বীক মিশকাত হা/১৬৫।

[3]. বুখারী হা/৬৬০, মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

[4]. আহমাদ হা/১৬৬৭৪, আবু দাঊদ হা/৪৬০৭; মিশকাত হা/১৬৫।

[5]. বুখারী হা/৫০৬৩, তাহক্বীক মিশকাত হা/১৪৫।

[6]. বুখারী হা/৭২৮০; তাহকীক্ব মিশকাত হা/১৪৩।

[7]. বুখারী হা/২৯৫৭; মিশকাত হা/৩৬৬১।

[8]. বুখারী হা/২৯৫৭; মুসলিম হা/১৮৩৫; মিশকাত হা/৩৩৬১।

[9]. মুসলিম হা/১৮৫১, তাহক্বীক মিশকাত হা/৩৬৭৪।

[10]. বুখারী হা/৭১৪৯; তাহক্বীক মিশকাত হা/৩৬৮৩।

[11]. বুখারী হা/৭১৪৭; মিশকাত হা/৩৬৮০।

[12]. বুখারী হা/৭১৩৮; মিশকাত হা/৩৬৮৫।

[13]. বুখারী হা/৫৯৭৪।

[14]. বায়হাকী, মিশকাত হা/৩৫।

[15]. বুখারী হা/৩৩, মিশকাত হা/৫৫।

[16]. বুখারী হা/৩৪; মিশকাত হা/৫৬।

[17]. মুসলিম হা/১০১৫; মিশকাত হা/২৭৬০।

[18]. বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান মিশকাত হা/২৭৮৭।

[19]. আহমাদ, দারেমী, বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমান মিশকাত হা/২৭৭২।

[20]. বুখারী হা/৩৮৪২; মিশকাত হা/২৭৮৬।

[21]. বুখারী হা/১৩৫৯; মিশকাত হা/৯০।

[22]. সীরাতুর রাসূল, ২য় সংস্করণ পৃঃ ২২২।

[23]. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৭/৮-১১ পৃঃ সংগৃহীত তাওহীদের ডাক জুলাই-আগস্ট-২০১৪ পৃঃ ১৬।

 



বিষয়সমূহ: সংগঠন
আরও