নৈতিক দৃঢ়তা

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1408 বার পঠিত

ঈমান আনার পর আল্লাহ রববুল ‘আলামীন যে বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন তা হ’ল ঈমানের উপর দৃঢ় থাকা। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ঈমানী দৃঢ়তা অর্জনের জন্য আহবান করা হয়েছে মুমিনদেরকে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ! তুমি এবং তোমার সাথে যারা তওবা করেছে সবাই সরলপথের ওপর দৃঢ় থাক, যেভাবে তোমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর তোমরা সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই তোমরা যা কিছু করছ তা তিনি দেখছেন (হূদ ১১২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই যারা বলেছে আমাদের প্রভূ আল্লাহ এবং তার ওপর দৃঢ় থেকেছে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না (আহক্বাফ ১৩)। অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ) নিজেও ছাহাবীদেরকে সতর্ক করেছেন। সুফিয়ান বিন আব্দুল্লাহ ছাক্বাফী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে একবার জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন একটি কথা বলুন, যে সম্পর্কে আমি আর অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করব না। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি বল, আমি ঈমান এনেছি, অতঃপর তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাক’ (মুসলিম হা/৬২)

ইস্তিক্বামাত তথা ঈমানী দৃঢ়তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘ইস্তিক্বামাত এমন একটি শব্দ যা দ্বীনের সর্বাংশকে শামিল করে। এটি হ’ল আল্লাহর সম্মুখে পূর্ণ বিশ্বস্ততা এবং অঙ্গিকারাবদ্ধতা নিয়ে দন্ডায়মান হওয়া। এর সম্পর্ক কথা, কর্ম ও নিয়তের সাথে। সবকিছু কেবলমাত্র আল্লাহ্র জন্য হওয়া, আল্লাহ্র পথে হওয়া এবং আল্লাহ্র নির্দেশ মোতাবেক হওয়ার মাধ্যমে ইস্তিকামাত অর্জিত হয়’ (মাদারিজুস সালিকীন)। অন্যত্র তিনি বলেন, অন্তরে নৈতিক দৃঢ়তা বা ইস্তিক্বামাত সৃষ্টির মাধ্যম হ’ল, আল্লাহর আদেশ ও নিষেধকে গুরুত্ব প্রদান করা। আর সেটা জাগ্রত হয় আদেশ ও নিষেধকর্তা তথা আল্লাহ্র প্রতি শ্রদ্ধা পোষণের মাধ্যমে (আল-ওয়াবেলুছ ছাইয়েব)। কোন কোন বিদ্বান বলেন, ইস্তিক্বামাত হ’ল রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করা এবং প্রবৃত্তির পথে না চলা।

একজন মুসলমানের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় তার ইস্তিক্বামাত তথা নৈতিক ও আদর্শিক দৃঢ়তার মাধ্যমে। যিনি যত শক্তিশালী ঈমানদার, তার নৈতিক দৃঢ়তা তত বেশী। শয়তানের প্রতারণা এবং দুনিয়াবী কোন লোভ-লালসার কাছে তিনি পরাজিত হন না। যদি কখনওবা পদস্খলিত হনও, তবে সম্বিত ফিরে পাওয়া মাত্র নিজেকে সংশোধন করে নেন। অপরদিকে যিনি যত দুর্বল ঈমানদার, তার নৈতিক দৃঢ়তা তত কম। শয়তানের কাছে তিনি সহজেই পরাজিত হন। সামান্য দুনিয়াবী স্বার্থের টোকায় তিনি পথভ্রষ্ট হয়ে যান। এমনকি একসময় সংশোধনের পথ অনুসন্ধানের চেতনাও তিনি হারিয়ে ফেলেন।

সমাজে চলার পথে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ পাই, যারা একসময় দ্বীনের পথে চলতেন, কিন্তু দুনিয়াবী ব্যস্ততার অজুহাতে দ্বীন থেকে এত দূরে সরে গেছেন যে, ফরয ছালাতটুকু আদায়ের চেতনাও হারিয়ে ফেলেছেন। অনেক মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্রকে দেখা যায় কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারায় পরিবর্তিত হয়েছেন, এমনকি নিজের সমৃদ্ধ অতীতকে পর্যন্ত বেমালূম ভুলে গেছেন। অনেক ভাইকে দেখা যায়, তীব্র আবেগ নিয়ে দ্বীনের পথে এসেছেন, কিছুকাল পরই সে আবেগে ভাটা পড়ে আবার দ্বীন থেকে দূরে সরে গেছেন। জীবনের উষাকালে যে বোনটি পর্দার সাথে চলতেন এবং ধার্মিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করার পর সহসাই তিনি এখন দ্বীনের সাথে সম্পর্কচ্যুত। কিছুকাল পূর্বে যে ভাইটি সমাজে আদর্শবান ও দ্বীনী ব্যক্তিত্ব হিসাবে বরিত হয়েছেন, সময়ের আবর্তে তিনি এখন ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ। এসবই ইস্তিক্বামাত হারানোর পরিণাম। ভয়ংকর ব্যাপার এই যে, কোন ব্যক্তি একবার দ্বীনের পথ থেকে বিচ্যুত হলে, খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, তিনি ফিরে আসতে পেরেছেন। শয়তানের চক্রান্ত তাদের উপর এত শক্তিশালীভাবে বিজয়ী হয়ে যায়, যে তা থেকে তওবার পথ যেন তাদের জন্য চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন!

তারুণ্য ও যৌবনে পদার্পণকারী সত্যপিয়াসী ভাই ও বোনদের প্রতি আমাদের আহবান, ইসলামকে প্রকৃত অর্থে জানুন এবং বুঝুন। দ্বীনকে স্বীয় চিত্তে দৃঢ়ভাবে ধারণ করুন। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্র আনুগত্যের কাছে সঁপে দিন। রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশিত পথকে নিজের জন্য একান্ত আপন করে নিন। শয়তান ও প্রবৃত্তির পথে চলাকে নিজের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর করে দিন। আত্মসমালোচনা, তওবা, ইস্তিগফারকে নিজের দৈনন্দিন কর্মসূচীতে পরিণত করুন। এভাবে নিত্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে নৈতিক ও আদর্শিক দৃঢ়তা সৃষ্টি হবে, তা-ই হকের উপর আমৃত্যু আমাদেরকে টিকিয়ে রাখবে। দুনিয়াবী স্বার্থের কাঁটা এবং শয়তানী চক্রান্ত সহজে গ্রাস করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। পবিত্র কুরআনে এসেছে, আল্লাহ মুমিনদের দৃঢ় বাক্য দ্বারা মযবূত রাখেন ইহকালীন জীবনে ও পরকালে (কবরে) এবং সীমালংঘনকারীদের পথভ্রষ্ট করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যা চান তাই করেন’ (ইবরাহীম ১৪/২৭)। নিঃসন্দেহে সেই ‘দৃঢ় বাক্য’ হ’ল তাওহীদের কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।

এছাড়া নৈতিক দৃঢ়তা সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হ’ল, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা। নফল ইবাদত, যিকির-আযকার, হালাল-হারামের সীমারেখা মেনে চলার মাধ্যমে যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর যত নিকটবর্তী করে নিতে পারবে তার জন্য আল্লাহর উপর সর্বাবস্থায় ভরসা রাখা এবং দৃঢ় নৈতিক অবস্থান নিয়ে টিকে থাকা সহজ হয়ে যায়। সমস্ত দুনিয়াও যদি এরূপ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চলে যায়, তবুও তারা পদস্খলিত হয় না। এরূপ মুমিনদের লক্ষ্য করেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটি বড়ই বিস্ময়কর। তার সমস্ত বিষয়টিই কল্যাণময়। মুমিন ব্যতীত আর কারু জন্য এরূপ নেই। যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে শুকরিয়া আদায় করে। ফলে এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে ছবর করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’ (মুসলিম হা/২৯৯৯)। আল্লাহ আমাদের সকল ভাইকে দৃঢ় নৈতিকতাসম্পন্ন ও আদর্শবান বান্দাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমীন!



বিষয়সমূহ: সম্পাদকীয়
আরও