ক্রোধ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 969 বার পঠিত

আল-কুরআনুল কারীম :

1- الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ-

(১) ‘যারা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৩৪)

2- وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ- وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ- وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ-

 (২) ‘ভাল ও মন্দ কখনো সমান হতে পারে না। তুমি উত্তম দ্বারা (অনুত্তমকে) প্রতিহত কর। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে যেন (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হতে পারে, যারা ধৈর্যধারণ করে এবং এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হতে পারে, যারা মহা ভাগ্যবান। যদি শয়তানের পক্ষ থেকে আপনি কিছু কুমন্ত্রণা অনুভব করেন, তবে আল্লাহর শরণাপন্ন হোন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪-৩৬)

3- وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا-

(৩) ‘রহমান’ (দয়াময়)-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন মূর্খ লোকেরা (বাজে) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে ‘সালাম’ (আল-ফুরক্বান ২৫/৬৩)

4- وَالَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ وَإِذَا مَا غَضِبُوا هُمْ يَغْفِرُونَ-

(৪) ‘আর যারা কবীরা গোনাহ সমূহ ও নির্লজ্জ কর্মসমূহ হ’তে বিরত থাকে এবং যখন তারা ক্রুদ্ধ হয় তখন ক্ষমা করে’ (আম্বিয়া ৪২/৩৭)

5- فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ-

(৫) ‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে-ইমরান ৩/১৫৯)

হাদীছে নববী :

6- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِى يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ-

(৬) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং সেই প্রকৃত বীর, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম’।[1]

7- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَوْصِنِى قَالَ لاَ تَغْضَبْ فَرَدَّدَ مِرَارًا قَالَ لاَ تَغْضَبْ-

(৭) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট বললো, আপনি আমাকে অছিয়ত করুন। তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটা কয়েকবার তা বললেন, নবী করীম (ছাঃ) প্রত্যেক বারই বললেন, রাগ করো না’।[2]

8- عَنْ عَدِىِّ بْنِ ثَابِتٍ حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ صُرَدٍ قَالَ اسْتَبَّ رَجُلاَنِ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ عِنْدَهُ جُلُوسٌ، وَأَحَدُهُمَا يَسُبُّ صَاحِبَهُ مُغْضَبًا قَدِ احْمَرَّ وَجْهُهُ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِنِّى لأَعْلَمُ كَلِمَةً لَوْ قَالَهَا لَذَهَبَ عَنْهُ مَا يَجِدُ لَوْ قَالَ أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ. فَقَالُوا لِلرَّجُلِ أَلاَ تَسْمَعُ مَا يَقُولُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنِّى لَسْتُ بِمَجْنُونٍ.

(৮) সুলায়মান ইবনু সুরাদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, দু’জন লোক নবী (ছাঃ)-এর সামনে একে অন্যকে গালি দিচ্ছিল। আমরাও তাঁর কাছেই উপবিষ্ট ছিলাম, তাদের একজন এত ক্রুদ্ধ হয়েছিল যে, তার চেহারা ফুলে বিগড়ে গিয়েছিল। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমি অবশ্যই একটি কালিমা জানি। যদি সে ঐ কালিমাটি অর্থাৎ ‘আঊযু বিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রাজীম’ পড়তো, তাহলে তার ক্রোধ চলে যেত। তখন লোকেরা সে ব্যক্তিকে বলল, নবী করীম (ছাঃ) কী বলেছেন, তা কি তুমি শুনছো না? সে বলল, আমি নিশ্চয়ই পাগল নয়’।[3]

9- ...كَتَبَ أَبُو بَكْرَةَ إِلَى ابْنِهِ وَكَانَ بِسِجِسْتَانَ بِأَنْ لاَ تَقْضِىَ بَيْنَ اثْنَيْنِ وَأَنْتَ غَضْبَانُ فَإِنِّى سَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لاَ يَقْضِيَنَّ حَكَمٌ بَيْنَ اثْنَيْنِ وَهْوَ غَضْبَانُ-

(৯) হযরত আব্দুর রহমান ইবন আবু বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আবু বকর (রাঃ) তাঁর ছেলেকে লিখে পাঠালেন- সে সময় তিনি সিজিস্থানে অবস্থানরত ছিলেন যে, তুমি রাগের অবস্থায় বিবাদমান দু’ব্যক্তির মাঝে ফায়ছালা করো না। কেননা, আমি রাসূলূল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, কোন বিচারক রাগের অবস্থায় দু’জনের মধ্যে বিচার করবে না’।[4]

10- عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَا مِنْ جُرْعَةٍ أَعْظَمُ أَجْرًا عِنْدَ اللَّهِ مِنْ جُرْعَةِ غَيْظٍ كَظَمَهَا عَبْدٌ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ-

 (১১) ইবনে উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহর সন্তুুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে তা অন্য কিছু সংবরণে নেই’।[5]

11- عَنْ أَبِى ذَرٍّ قَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَنَا إِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ وَهُوَ قَائِمٌ فَلْيَجْلِسْ فَإِنْ ذَهَبَ عَنْهُ الْغَضَبُ وَإِلاَّ فَلْيَضْطَجِعْ-

(১১) আবূ যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বলেন, যদি তোমাদের কেউ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রাগান্বিত হয়, তবে সে যেন বসে পড়ে। যদি এতে রাগ চলে যায়, তবে ভাল; নয়তো সে শুয়ে পড়বে’।[6]

12- عَنْ سَهْلِ بْنِ مُعَاذٍ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ قَادِرٌ عَلَى أَنْ يُنْفِذَهُ دَعَاهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى رُءُوسِ الْخَلاَئِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ اللَّهُ مِنَ الْحُورِ مَا شَاءَ-

(১২) সাহল ইবন মুআয (রাঃ) তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্রোধকে সম্বরণ করে, অথচ সে কাজ করতে সে সক্ষম; (তার এ ছবরের কারণে) ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সকলের সামনে ডেকে বলবেন, তুমি যে হুরকে চাও, পসন্দ করে নিয়ে যাও’। [7]

মনীষীদের বক্তব্য :

১. ওমর ইবনু আব্দুল আযীয বলেন, সফলকাম তো সেই ব্যক্তি যে নিজের মনোস্কামনা, আশা এবং ক্রোধ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে।[8]

২. আব্দুল মালেক ইবনু মারওয়ান বলেন, ক্রোধের সময়ে ব্যক্তির সহনশীলতা বুঝা যায়। প্রকৃত সহনশীল ব্যক্তি সেই যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।[9]

৩. ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, প্রকৃত শক্তিশালী ঐ ব্যক্তি যে ক্রোধের সময় হিতাহিত জ্ঞান না হারিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর ক্রোধ যদি তার উপর বিজয় লাভ করে, তাহলে বুঝতে হবে প্রকৃতপক্ষে সে শক্তিশালী বা বীর কোনটিই নয়।[10]

৪. ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ক্রোধ হলো জ্ঞানের জন্য ছলনাময়ী ভূতের মত, যা ব্যক্তিকে তার শিকারে পরিণত করে যেমনভাবে একটি নেকড়ে দলছুট ছাগীকে শিকারে পরিণত করে। আর শয়তানের সবচেয়ে বড় শিকার হল প্রবৃত্তি পূজারী এবং ক্রোধান্বিত ব্যক্তি’[11]

৫. ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন, কথায় সচ্চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটাও এবং ক্রোধকে সর্বত্রভাবে বিদায় জানাও’।[12]

সারবস্ত্ত :

১. বান্দার ক্রোধ মহান পরম করুণাময় মহা আল্লাহকে অসন্তুওষ্ট করে এবং অভিশপ্ত শয়তানকে সন্তুষ্ট করে।

২. শত্রুর মোকাবেলায় ক্রোধ নয়। বরং ধৈর্যই বেশী কাজে দেয়।

৩. ক্রোধ মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে এবং জীবনের ধ্বংস ত্বরান্বিত করে।

৪. ক্রোধ জান্নাত পাগল মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। কেননা ক্রোধান্বিত ব্যক্তি শয়তানের অনুগামী হয়।

৫. যে ব্যক্তি ক্রোধ দমন করে, মহান আল্লাহ তার হৃদয়কে ঈমান ও শান্তি দ্বারা পূর্ণ করবেন এবং জান্নাতী মেহমান হিসাবে অভ্যর্থনা জানাবেন।


[1]. বুখারী হা/৬১১৪; মিশকাত হা/৫১০৫।

[2].বুখারী হা/ ৬১১৬;মিশকাত হা/৫১০৪।

[3]. বুখারী হা/৬১১৫; মুসলিম হা/২৬১০।

[4]. বুখারী হা/৭১৫৮; মুসলিম হা/১৭১৭।

[5]. ইবনু মাজাহ হা/৪১৮৯।

[6]. আবুদাউদ হা/৪৭৮২।

[7]. আবুদাউদ হা/৪৭৭৭।

[8].শারহু ছহীহুল বুখারী লি ইবনি বাত্তাল ১/৩৬৮ পৃ.।

[9]. রাওযাতুল উক্বালা লি ইবনে হিববান বাসতী ১৪১ পৃ.।

[10]. ইস্তেক্বামাহ ২/২৭১ পৃ.।

[11]. আত-তিবইয়ানু ফী আক্বসামিল কুরআন ২৬৫ পৃ.।

[12]. জামেঊল ঊলূম ওয়াল হাকাম লি ইবনে রজব ১/৩৬৩ পৃ.।



বিষয়সমূহ: শিষ্টাচার
আরও