রাসূল (ছাঃ)-এর মহৎ গুণাবলী

ইহসান ইলাহী যহীর 1907 বার পঠিত

ভূমিকা : মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সার্বিক জীবন-চরিত উম্মতের জন্য পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ। কেননা যুগ-যুগান্তর ধরে মানুষ যে জ্ঞান, মনীষা, পান্ডিত্য, মেধা-মনন ও মুক্তির সাধনা করে এসেছে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) সেগুলোর পূর্ণতা দান করেছেন। একনিষ্ঠতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, পবিত্রতা, মনুষ্যত্ববোধ, চারিত্রিক নিষ্কলুষতাসহ সমস্ত মানবিক গুণাবলীর সামগ্রিক সাধনা তাঁর মাঝে এসে চূড়ান্তভাবে পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর নবুঅতের সামগ্রিক জীবন মুসলিমদের পরিপূর্ণ অনুকরণীয় (হাশর ৫৯/৭)। যে আদর্শ অনুকরণের মাধ্যমে মুমিনের ইহকালীন জীবন জান্নাতী আবেশে গড়ে উঠবে এবং পরকালীন চূড়ান্ত মুক্তি সম্ভব হবে। আধুনিক যুগে মানুষের শিক্ষা-দীক্ষার চমকপ্রদ নানান বিষয় যুক্ত হলেও রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ এবং তাঁর চারিত্রিক ও মানবিক গুণে গুণান্বিত হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় না। বড়ই পরিতাপের বিষয় হ’ল মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি ব্যতীত অনেক আলেম-ওলামা পর্যন্ত বিশ্বনবী (ছাঃ) সম্পর্কে স্বল্প পড়াশুনা করেন। সেকারণে আলোচ্য প্রবন্ধে বিশ্ব মানবতার নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কতিপয় গুণাবলী উপস্থাপন করা হ’ল।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উত্তম আদর্শ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উত্তম আদর্শ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيُ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতকে কামনা করে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী :

তাঁর সর্বোত্তম চরিত্রের প্রশংসা কুরআনে এভাবে এসেছে যে, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ- ‘আর নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত’ (কলম ৬৮/৪)

এমনকি মক্কার যে বিধর্মীরা তাঁর জীবনের দুশমন ছিল তারাও তাঁর বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ও সত্যবাদিতা স্বীকার করত। আবু জাহল বলত, মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে মিথ্যাবাদী বলি না, কিন্তু তোমার আনিত বাণীকে সঠিক মনে করতে পারছি না। এমনকি মক্কাবাসীরা তাদের দামী জিনিসগুলো হেফাযতের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আমানত রাখত। হিজরতের রাতে রাসূল (ছাঃ) আলী (রাঃ)-কে নিজের ঘরে পরদিন তাদের আমানত বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য রেখে গিয়েছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন সর্বগুণে গুনান্বিত। তিনি ছিলেন একজন সাহসী, পরমুখাপেক্ষীহীন, ধৈর্যশীল, শোকরগুযার, অল্পেতুষ্ট, ত্যাগী, বিনয়ী, দানশীল। এছাড়াও তিনি মানবিক সকল গুণের অধিকারী ছিলেন। ফলে তাঁর ব্যক্তিত্ব বিশ্ব মানবতার জন্য আয়না স্বরূপ, যা দেখে সকল মানুষ নিজের ভিতর-বাহির ঠিক করে নিতে পারে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর যখন প্রথম অহী নাযিল হ’ল, তিনি (ছাঃ) বললেন,أَىْ خَدِيجَةُ مَا لِى، لَقَدْ خَشِيتُ عَلَى نَفْسِى، ‘হে খাদীজা! আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি’। তখন তাঁর জীবনসঙ্গিনী খাদিজা (রাঃ) বলেছিলেন,كَلاَّ أَبْشِرْ، فَوَاللهِ لاَ يُخْزِيكَ اللهُ أَبَدًا، فَوَاللهِ إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ، وَتَصْدُقُ الْحَدِيثَ، وَتَحْمِلُ الْكَلَّ، وَتَكْسِبُ الْمَعْدُومَ، وَتَقْرِى الضَّيْفَ، وَتُعِينُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ- ‘কখনোই না; আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম! আল্লাহ কখনোই আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। কেননা আপনি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, সর্বদা সত্য কথা বলেন, বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ান, দুর্বলের ভার বহন করেন, মেহমানের সাথে সদাচরণ করেন, সত্যসেবীদের সহায়তা করেন’।[1] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّمَا بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ صَالِحَ الأَخْلاَقِ- ‘নিশ্চয়ই আমি সর্বোত্তম চরিত্র সমূহের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি’।[2]

কোমল ও রহম দিলের নবী :

তিনি লোকদের সাথে নম্র আচরণ করতেন। বৈঠকে তিনি কোনরূপ অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন না। বেদুঈনদের রূঢ় আচরণে তিনি ধৈর্য ধারণ করতেন’।[3] বলা চলে যে, তাঁর এই মহানুভবতা, বিনয়ী ব্যবহার ও অতুলনীয় ব্যক্তি মাধুর্যের প্রভাবেই রুক্ষ্ম স্বভাবের মরুচারী আরবরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছিল। আল্লাহ বলেন,فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ، ‘আর আল্লাহর বিশেষ রহমতেই তুমি স্বীয় উম্মতের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশ ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে, তাহ’লে তারা অবশ্যই তোমার পাশ থেকে সটকে পড়ত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। রাসূল (ছাঃ)-এর এই অনন্য চারিত্রিক মাধুর্য ছিল নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিশেষ দান।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ لاَّ يَرْحَمُ لاَ يُرْحَمُ- ‘যে ব্যক্তি দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না’।[4] হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন,اَلرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ، اِرْحَمُوا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ- ‘দয়াশীলদের উপর পরম করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা যমীনবাসীকে দয়া কর, তাহ’লে আসমানবাসী আল্লাহ তোমাদেরকে দয়া করবেন’।[5]

পৃথিবীবাসীর জন্য রহমতের রাসূল :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অতিশয় মহানুভব মানুষ ছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা তাকে পৃথিবীবাসীর জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন,وَمَآ أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ- ‘আর আমরা তো তোমাকে পৃথিবীবাসীর প্রতি প্রেরণ করেছি কেবল রহমত হিসাবেই’ (আম্বিয়া ২১/১০৭)। তাঁর সম্পূর্ণ জীবনটাই কেটেছে মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মধ্য দিয়ে। রাসূল এরশাদ করেন,لاَ يَرْحَمُ اللهُ مَنْ لاَّ يَرْحَمُ النَّاسَ- ‘আল্লাহ এমন ব্যক্তির উপর দয়া করেন না, যে মানুষের উপর দয়া করে না’।[6]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মুশরিকদের উপর বদ-দো‘আ করার জন্য দরখাস্ত করা হ’ল। তিনি বললেন,إِنِّى لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَةً- ‘আমাকে দুনিয়াতে অভিসম্পাত করার জন্য প্রেরণ করা হয়নি, বরং আমি রহমত হিসাবেই প্রেরিত হয়েছি’ ।[7]

পশু-পাখির হকের প্রতি খেয়াল :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শুধু মানুষের উপরই সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দেখিয়েছেন তা নয়; বরং জীব-জন্তু, পশু-পক্ষীকুলও তাঁর ভালবাসায় সিক্ত হয়েছে।

আব্দুর রহমান বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমরা কোন এক সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। তিনি তাঁর প্রয়োজনে বাইরে গেলে আমরা সেখানে একটা চড়ুইয়ের মত ছোট পাখি দেখতে পাই। যার দু’টি বাচ্চা ছিল। তখন আমরা তার বাচ্চা দু’টি নিয়ে আসলে পাখিটি অস্থির হয়ে ডানা ঝাপটিয়ে আমাদের উপর আছড়ে পড়তে লাগল। এ সময় নবী করীম (ছাঃ) এসে বললেন,مَنْ فَجَعَ هَذِهِ بِوَلَدِهَا؟ رُدُّوا وَلَدَهَا إِلَيْهَا- ‘কেন বাচ্চা এনে একে কষ্ট দিচ্ছ? এর বাচ্চা একে ফিরিয়ে দাও’।[8]

একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন এক আনছার ছাহাবীর বাগানে গেলেন। সেখানে একটি শীর্ণকায় উট দেখতে পেলেন। রাসূল (ছাঃ)-কে দেখে উটটি আওয়াজ করতে লাগল। তিনি কাছে গিয়ে সেটির গায়ে আদরের পরশ বুলিয়ে দিলেন। এরপর লোকদের কাছ থেকে এর মালিকের খোঁজ নিলেন। জানা গেল উটটি একজন আনছারীর। তখন রাসূল (ছাঃ) লোকটিকে বললেন,أَلاَ تَتَّقِى اللهَ فِى هَذِهِ الْبَهِيمَةِ الَّتِى مَلَّكَكَ اللهُ إِيَّاهَا؟ فَإِنَّهُ شَكَاكَ إِلَىَّ وَزَعَمَ أَنَّكَ تُجِيعُهُ وَتُدْئِبُهُ- ‘এই প্রাণীটির হক সম্পর্কে তুমি কি আল্লাহকে ভয় করবে না, যাকে আল্লাহ তোমার অধীনস্ত করেছেন? কেননা সে তোমার বিরুদ্ধে আমার নিকট অভিযোগ করেছে যে, তুমি তাকে দিয়ে অবিরাম পরিশ্রম করাও, কিন্তু তাকে ক্ষুধার্ত রাখ’।[9]

পরিবেশ রক্ষা :

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ এত ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে যে, কোনভাবেই এ বিপর্যয় ঠেকানো যাচ্ছে না। পরিবেশের এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে বেশী বেশী বৃক্ষরোপণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও বৃক্ষ রোপণ করেছেন। তিনি ছাহাবীদেরকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করেছেন। বৃক্ষরোপণের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا، فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانٌ أَوْ بَهِيمَةٌ، إِلاَّ كَانَ لَهُ بِهِ صَدَقَةٌ، ‘কোন মুসলমান যদি বৃক্ষ রোপণ করে বা ফসল চাষাবাদ করে, অতঃপর তা থেকে পাখী, মানুষ অথবা চতুষ্পদ প্রাণী কিছু খেয়ে নেয়, তবে তার জন্য সেটি ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে’।[10]

সালমান ফারেসী (রাঃ)-কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, كَاتِبْ يَا سَلْمَانُ، ‘হে সালমান! তোমার মনিবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হও’। তিনি বলেন,فَكَاتَبْتُ صَاحِبِى عَلَى ثَلاَثِ مِائَةِ نَخْلَةٍ أُحْيِيهَا لَهُ، ‘অতঃপর আমি মনীবের সাথে আমার মুক্তির জন্য বাগানে ৩০০ খেজুর গাছ রোপণ ও পরিচর্যার শর্তে চুক্তিবদ্ধ হ’লাম’।[11]

তৎকালীন আরবের কিছু লোকের বদ অভ্যাস ছিল। তারা রাস্তার কিনারায় পেশাব-পায়খানা করত। রাসূল (ছাঃ) এটা খুব অপসন্দ করতেন এবং তাদেরকে নিষেধ করতেন। তিনি তাদেরকে পেশাব-পায়খানার নিয়ম শিখিয়ে দিতেন।[12] এমনিভাবে পরিবেশকে নোংরা ও অপরিচ্ছন্নতা থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পেশাব-পায়খানার আদব শিক্ষা দিয়েছেন।

ইবাদতে একনিষ্ঠতা ও কষ্টসহিষ্ণুতা :

রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদত এত সুন্দর ছিল যে, রাতে দীর্ঘ ক্বিয়ামের কারণে পদযুগল ফুলে যেত। হযরত মুগীরাহ বিন শো‘বা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতেন। তাঁকে বলা হ’ল, لِمَ تَصْنَعُ هَذَا وَقَدْ غُفِرَ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكِ وَمَا تَأَخَّرَ؟ ‘আপনি এত কষ্ট করছেন কেন? অথচ আপনার জীবনের পূর্বাপর সকল পাপই তো মোচন করা হয়েছে’। তখন জবাবে তিনি বললেন, أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا؟ ‘আমি কি আল্লাহর অধিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী বান্দা হবনা?’[13]

তিনি প্রতিদিন সত্তর বারের অধিক তওবা-ইস্তেগফার করতেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,وَاللهِ إِنِّى لأَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِى الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِينَ مَرَّةً- ‘আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন সত্তর বারের অধিক আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করি’।[14] অন্য বর্ণনায় এসেছে,يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللهِ، فَإِنِّي أَتُوبُ إِلَيْهِ فِي الْيَوْمِ مِائَةَ مَرَّةٍ- ‘হে জনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর। কেননা আমি দৈনিক একশ‘ বার আল্লাহর নিকট তাওবা করি’।[15] রাসূল (ছাঃ) এতটাই কষ্ট সহিষ্ণু ছিলেন যে, ক্ষুধার যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য কখনো পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন। যেমন হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,كَانَ يَرْبُطُ الْحَجَرَ عَلََى بَطْنِهِ مِنَ الْغَرَثِ- ‘তিনি ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন’।[16]

মধ্যমপন্থী আচার-আচরণ :

একদা তিন জন ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের বাড়ী গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তাদেরকে সে বিষয়ে অবহিত করা হ’লে তারা তাঁর আমলকে তুচ্ছ মনে করল। তারা পরষ্পরে বলাবলি করল, নবী করীম (ছাঃ)-এর তুলনায় আমরা কোথায়? তাঁর তো আগে-পরের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের একজন বলল, আমি সারা রাত ছালাতরত থাকব। আরেকজন বলল, আমি সারা বছর ছিয়াম পালন করব, কখনই তা ভঙ্গ করব না। অন্যজন বলল, আমি নারী সংশ্রব ত্যাগ করব, কোন দিন বিয়ে করব না। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের কাছে এসে বললেন,أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّى لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّى أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّى وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِى فَلَيْسَ مِنِّى- ‘তোমরাই তো তারা, যারা এমন এমন কথা বলেছ? শোন, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তোমাদের তুলনায় আল্লাহকে অনেক বেশী ভয় করি। কিন্তু আমি ছিয়াম পালন করি, আবার বিরতিও দেই; ছালাত আদায় করি, আবার ঘুমাই এবং বিয়ে-শাদীও করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, সে আমার দলভুক্ত নয়’।[17]

নিঃসন্দেহে এটি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনের একটি উজ্জ্বল দিক। তিনি সকল ক্ষেত্রেই মধ্যমপন্থা ও সহজতা আরোপ করতেন। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও বৈরাগ্য কখনো পসন্দ করেননি। হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ زِمَامَ وَلاَ خِزَامَ وَلاَ رَهْبَانِيَّةَ وَلاَ تَبَتُّلَ وَلاَ سِياحَة فِى الإِسْلاَمِ- ‘ইসলামে (পুরুষের জন্য) নাক-কান ফোঁড়ানো ও তাতে আংটা বাঁধা নেই, সন্যাসবাদ নেই, অবিবাহিত থাকা নেই, ভবঘুরে থাকাও নেই’।[18]

ক্ষমার মহৎ গুণ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ক্ষমার মহৎ গুণ পৃথকভাবে আলোচনা করার মতই একটি বিষয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যক্তিগত বিষয়ে কারও থেকে কখনো প্রতিশোধ নেননি। ভাল দিয়ে মন্দের বদলা নিয়েছেন। এমনকি তিনি চিরশত্রুকেও ক্ষমা করেছেন। হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন, একবার যুদ্ধ হ’তে ফেরার সময় বিশ্রামের জন্য আমরা একস্থানে থামলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি গাছে তাঁর তরবারী ঝুলিয়ে রেখে সেখানেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা একটু দূরে ছিলাম। হঠাৎ তাঁর ডাকে আমি উঠে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি, একজন বেদুঈন রাসূল (ছাঃ)-এর তরবারী নিয়ে নেয়। আমি দেখি রাসূল (ছাঃ)-এর খোলা তরবারী তার হাতে। সে রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, مَنْ يَّمْنَعُكَ مِنِّي؟ ‘আমার কবল থেকে তোমাকে এখন কে রক্ষা করবে?’ তিনি বললেন, اللهُ ‘আল্লাহই রক্ষা করবেন’ (৩ বার)। তখন তার হাত থেকে তরবারী পড়ে গেল।...জাবের (রাঃ) বলেন, وَلَمْ يُعَاقِبْهُ، এরপরও তিনি তার থেকে কোনরূপ প্রতিশোধ নেননি’।[19]

রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর এই ক্ষমার আদর্শ শুধুমাত্র সেখানেই সীমায়িত ছিল না, বরং তাঁর এই গুণ রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল। মক্কার সেইসব দুষ্টমতি লোকদের কথা কে না জানে, যারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর প্রিয় ছাহাবীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল! যাদের কারণে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা নগরী ত্যাগ করে হিজরতের অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এইসব মানুষদেরকে ক্ষমার তো কোন সুযোগই ছিল না। কিন্তু রহমতের নবী মক্কা বিজয়ের দিন তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেন,مَنْ دَخَلَ دَارَ أَبِى سُفْيَانَ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ أَلْقَى السِّلاَحَ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ أَغْلَقَ بَابَهُ فَهُوَ آمِنٌ- ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি অস্ত্র পরিত্যাগ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি তার নিজ গৃহে অবস্থান করে ঘরের দরজা বন্ধ করবে, সেও নিরাপত্তা লাভ করবে’।[20]

সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ :

আজ সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতি চলছে। নগ্নতা ও বেহায়াপনাকে বলা হচ্ছে আধুনিক সভ্যতা। অথচ রাসূল (ছাঃ) ইসলামী সংস্কৃতি ও শিল্পকলা ব্যবহার করেছেন মানুষের সুস্থ ও সুন্দর রুচিবোধ, মানবিকতা ও উত্তম চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে।

যেমন হযরত হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ) মুশরিকদের তীর্যক কবিতার প্রত্যুত্তরের জন্য নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَجِبْ عَنِّي، اللَّهُمَّ أَيِّدْهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ- ‘হাসসান, তুমি আমার পক্ষ হ’তে কাফেরদের প্রতি ছন্দাকারে জবাব দাও! হে আল্লাহ! রূহুল কুদ্দুস জিব্রীলের মাধ্যমে তাকে শক্তিশালী কর’।[21]

রাসূল (ছাঃ) কখনো কখনো বিভিন্ন কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَصْدَقُ كَلِمَةٍ قَالَهَا الشَّاعِرُ كَلِمَةُ لَبِيدٍ : أَلاَ كُلُّ شَيْءٍ مَا خَلاَ اللهَ بَاطِلٌ- ‘কবিরা যেসব কাব্য রচনা করে থাকে তন্মধ্যে সর্বাধিক সত্য হ’ল লাবীদের উক্তি, ‘আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই ধ্বংসশীল’।[22]

হযরত রুবাই বিনতে মু‘আবিবয বিন ‘আফরা (রাঃ) বলেন, আমাকে যখন স্বামীগৃহে পাঠানো হ’ল, তখন নবী করীম (ছাঃ) আমার গৃহে এসে বিছানায় বসলেন, যেমন তুমি আমার কাছে বসে আছ। এ সময় আমাদের ছোট বালিকারা একমুখী দফ বাজাতে লাগল এবং বদর যুদ্ধে নিহত আমার পিতৃপুরুষের শোকগাঁথা বলতে লাগল। এমন সময় তাদের একজন বলে উঠল, وَفِينَا نَبِىٌّ يَعْلَمُ مَا فِى غَدٍ، ‘আর আমাদের মধ্যে এমন একজন নবী আছেন, যিনি আগামীকালের খবরও জানেন’। এ কথা শুনে রাসূল (ছাঃ) বললেন, دَعِى هَذِهِ وَقُولِى بِالَّذِى كُنْتِ تَقُولِينَ- ‘এটি বাদ দাও এবং সেটাই বল পূর্বে যা বলছিলে’।[23]

হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, খন্দক যুদ্ধের পূর্বে আনছার ও মুহাজিরগণ মদীনার পাশে পরিখা খনন করছিলেন এবং তারা পিঠে মাটি বহন করছিলেন। তখন তাঁরা এই কবিতা আবৃত্তি করছিলেন,

نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدًا * عَلَى الْجِهَادِ مَا بَقِينَا أَبَدًا-

‘মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করেছি, আমরা সেই জাতি + যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা জীবিত আছি, জিহাদের উপরই সর্বদা অটুট থাকি’।

ছাহাবায়ে কেরামের কাব্যিক ছন্দের প্রত্যুত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, اللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الْآخِرَهْ * فَاغْفِرْ لِلْأَنْصَارِ وَالْمُهَاجِرَهْ- ‘হে আল্লাহ! আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবন ছাড়া আর কোন জীবন নেই + অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা কর’।[24] সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রশংসা এবং বাতিলের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রামে ইসলামী জাগরণী গাওয়ায় কোন বাধা নেই এবং এতে ইসলামের সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ পরিলক্ষিত হয়।

বৈধ ক্রীড়া-কৌতুক :

একদিন স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে এসে তার এক বৃদ্ধা খালা রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন, যেন তিনি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে অমুকের মা! কোন বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যে! একথা শুনে উক্ত মহিলা নিরাশ হয়ে কাঁদতে শুরু করল। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, তাদের কি দোষ? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি কি কুরআনে পড়নি? যেখানে আল্লাহ বলেছেন,إِنَّآ أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَآءً- فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا- عُرُبًا أَتْرَابًا- لِأَصْحَابِ الْيَمِينِ- ‘আমরা জান্নাতী নারীদের বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছি’। ‘অতঃপর তাদের চিরকুমারী করেছি’। তারা অনুরক্তা, সমবয়স্কা’। ‘ডান সারির লোকদের জন্য’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৩৫-৩৮)[25] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘জান্নাতবাসী নারী-পুরুষ সবাই ৩০ থেকে ৩৩ বছর বয়সী হবে’।[26]

[ক্রমশঃ]

[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ এবং পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]

 

[1]. বুখারী হা/৪৯৫৩; ৬৯৮২; মুসলিম হা/১৬০, ৪২২; আহমাদ হা/২৫৯০৭।

[2]. আহমাদ হা/৮৯৩৯; ছহীহুল জামে‘ হা/২৩৪৯।

[3]. বুখারী হা/২২০; মিশকাত হা/৪৯১।

[4]. বুখারী হা/৫৯৯৭; মুসলিম হা/২৩১৮; মিশকাত হা/৪৬৭৮।

[5]. আবুদাঊদ হা/৪৯৪১ প্রভৃতি; মিশকাত হা/৪৯৬৯; ছহীহাহ হা/৯২৫।

[6]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৯৬; বুখারী হা/৭৩৭৬; মিশকাত হা/৪৯৪৭।

[7]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩২১; মুসলিম হা/২৫৯৯; মিশকাত হা/৫৮১২।

[8]. আহমাদ হা/৩৮৩৫; আবুদাঊদ হা/২৬৭৫, ৫২৬৮; হাকেম হা/৭৫৯৯; ছহীহাহ হা/২৫, ৪৮৭; মিশকাত হা/৩৫৪২।

[9]. আহমাদ হা/১৭৪৫, ১৭৫৪; আবুদাঊদ হা/২৫৪৯; হাকেম হা/২৪৮৫; ছহীহাহ হা/২০।

[10]. বুখারী হা/২৩২০; মুসলিম হা১৫৫২/; মিশকাত হা/১৯০০।

[11]. আহমাদ হা/২৩৭৮৮; হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৮৩৩; ছহীহাহ হা/৮৯৪।

[12]. মুসলিম হা/২৬২; মিশকাত হা/৩৭০।

[13]. বুখারী হা/১১৩০; মুসলিম হা/২৮২০; মিশকাত হা/১২২০।

[14]. বুখারী হা/৬৩০৭; আহমাদ হা/৭৭৮০; মিশকাত হা/২৩২৩।

[15]. মুসলিম হা/২৭০২; মিশকাত হা/২৩২৫।

[16]. ছহীহাহ হা/১৬১৫, সনদ হাসান।

[17]. বুখারী হা/৫০৬৩; মুসলিম হা/৬২, ১৪০১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩১৭; মিশকাত হা/১৪৫।

[18]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২০৫৭২; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১২৫৪৭; ছহীহাহ হা/১৭৮২-এর আলোচনা।

[19]. বুখারী হা/৪১৩৫; মুসলিম হা/৮৪৩; মিশকাত হা/৫৩০৪।

[20]. মুসলিম হা/১৭৮০; মিশকাত হা/৬২১০।

[21]. বুখারী হা/৩২১২; মুসলিম হা/২৪৮৫; মিশকাত হা/৪৭৮৯।

[22]. বুখারী হা/৩৮৪১; মুসলিম হা/২২৫৬; মিশকাত হা/৪৭৮৬।

[23]. বুখারী হা/৪০০১; মিশকাত হা/৩১৪০।

[24]. বুখারী হা/২৮৩৫; মুসলিম হা/১৮০৫; মিশকাত হা/৪৭৯৩।

[25]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ওয়াক্বি‘আহ ৩৫-৩৮ আয়াত; রাযীন, মিশকাত হা/৪৮৮৮, সনদ ছহীহ।

[26]. তিরমিযী হা/২৫৪৫; আহমাদ হা/২২১৫৯; ছহীহাহ হা/২৯৮৭; মিশকাত হা/৫৬৩৯, দ্র. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ৭৮৪ পৃ.।



আরও