মাওলানা বেলাল হোসাইন(পাবনা) (শেষ কিস্তি)

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 152 বার পঠিত

[মাওলানা বেলাল হোসাইন (৬৬) আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য ও পাবনা যেলা ‘যুবসংঘ’, ‘আন্দোলন’-এর সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা। তিনি পাবনা খয়েরসূতি দারুলহাদীছ রহমানিয়া মাদ্রাসার প্রবীণ শিক্ষক ও দক্ষ মুনাযের। তিনি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর শুরুকাল থেকে অদ্যাবধি এই আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছেন এবং দাওয়াতী ময়দানে জিহাদী ভূমিকা রেখেছেন। তঁার নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তাওহীদের ডাক’-এর নির্বাহী সম্পাদক আসাদুল্লাহ আল-গালিব। এর প্রথমাংশ গত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। শেষাংশ এ সংখ্যায় প্রকাশিত হল]

তাওহীদের ডাক : আপনি চাকুরী জীবনে কী কোন সমস্যায় পড়েছেন?

মাওলানা বেলাল হোসাইন : চাকুরী জীবনে আমি দুইবার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি।

(১) ১৯৯৪ সালের দিকে একবার এলাকার লোকজনসহ প্রতিষ্ঠানে মিটিং হ’ল। মিটিংয়ের বিষয়বস্ত্ত ছিল ‘যুবসংঘে’র লোক জমঈয়তের প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করবে কেন? পরিস্থিতি অঁাচ করতে পেরে ‘যুবসংঘে’র ছেলেরা আমাকে মাদ্রাসায় যেতে নিষেধ করল। বললাম, আমি মিটিংয়ে অবশ্যই যাব। মার খেলেও যাব, না খেলেও যাব। মিটিংয়ে গিয়ে দেখি মারমুখী অবস্থান। কয়েকজন প্রভাবশালী লোক হুংকার দিচ্ছে। তখন আমি দঁাড়িয়ে বললাম, কী হয়েছে আপনাদের? এভাবে হুংকার দিচ্ছেন কেন? তখন তারা বলল, তুমি জানো না এটা ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছে’র মাদ্রাসা? এখানে ‘যুবসংঘে’র কেউ চাকুরী করতে পারবে না। আমি পাল্টা জবাব দিয়ে বললাম, ‘যুবসংঘ’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দাওয়াত দেয়। জমঈয়ত কি সে দাওয়াত দেয় না? জমঈয়তের প্রতিষ্ঠানে যদি একজন মওদূদী জামায়াতপন্থী চাকুরী করতে পারে, একজন হানাফী চাকুরী করতে পারে, তাহ’লে আমি আহলেহাদীছ হয়েও কেন চাকুরী করতে পারব না? তৎকালীন মাদ্রাসার সভাপতির ছেলে বললেন, বেলাল ছাহেব সঠিক কথা বলেছেন। এখানে আমরা কে কোন দলের লোক তা দেখব না। বরং কে যোগ্য সেটাই দেখব। উনি এখানেই চাকুরী করবেন। তখন তার কথায় মিটিং ভেঙ্গে গেল। আল্ল­াহ ওখানেই আমাকে বহাল রাখলেন। আলহামদুলিল্লাহ!

(২) করোনাকালীন সময়ে আমি কিছুদিন অসুস্থ ছিলাম। তখন তারা আমার অগোচরে ষড়যন্ত্র করে আমাকে অবসর দিয়ে দেয়। সুস্থ হওয়ার পর আমি মাদ্রাসায় যাওয়ার পর শুনলাম, আমাকে অবসর দেওয়া হয়েছে। তখন আমি বললাম, আমাকে অবসর দিলে অফিসিয়াল কাগজপত্র লাগবে। মুখে মুখে তো অবসর হয় না। আমি ক্লাস করাতে থাকলাম। ইতোমধ্যে মাদ্রাসার সেক্রেটারী এসে বললেন, আপনাকে অবসর দেওয়া হয়েছে। বললাম, অফিসিয়াল একটা সিস্টেম আছে। এভাবে তো অবসর হয় না। কী কী কারণে আমাকে অবসর দিলেন সমস্ত কারণ উল্লে­খ করতে হবে। উনি রেগে গিয়ে হুংকার দিতে দিতে চলে যেতে লাগলেন। আর আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিলেন। এরপর স্থানীয় এক নেতাকে ফোন দিয়ে বললেন, আপনাদের সাথে নিয়েই তো বেলালকে অবসর দেয়া হ’ল, অথচ সে মাদ্রাসায় এসেছে। তিনি তাদের চক্রান্ত বুঝতে পেরে বললেন, সেটা আমাদের ভুল হয়েছিল। এরপর তিনি স্থানীয় আরেক প্রভাবশালীকে ফোন দিলে তিনিও একই কথা বলেন। আবার মিটিং ডাকা হ’ল। মিটিংয়ে সাধারণ জনগণ এসে হাযির। বিরোধীরা বলল, এত লোকজন কেন? লোকজন উত্তর দিল, এটাতো জনগণের মাদ্রাসা, জনগণ তো আসবেই। উনাকে অবসর দিয়েছেন কেন? একজনকে অবসর দিতে হ’লে তাকে অবসর ভাতা দিতে হয়। আপনারা কি দিয়েছেন? অযথা আপনারা অবসর দিয়ে দিলেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মাদ্রাসার সহ-সভাপতি প্রাক্তন ইউ.পি চেয়ারম্যান বললেন, উনি যতদিন সক্ষম মাদ্রাসায় আসবেন এবং চাকুরী করবেন। আলহামদুল্লিাহ এখন পর্যন্ত আমি সুস্থভাবে পাঠদান করে যাচ্ছি।

তাওহীদের ডাক : আপনি দীর্ঘদিন ‘যুবসংঘ’ ও ‘আন্দোলনে’র দায়িত্ব পালন করেছেন। জনমনে সংগঠনের প্রতি আগ্রহ কেমন দেখেছেন?

মাওলানা বেলাল হোসাইন : যারা ইসলাম জানতে চায়, বুঝতে চায় তাদের আগ্রহ অনেক বেশী। এক্ষেত্রে সচেতন ও জাগ্রত চিন্তাধারার মানুষের মধ্যে ‘যুবসংঘে’র কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বেশী।

তাওহীদের ডাক : আপনার অনেকগুলো জাগরণী প্রকাশ হয়েছে। সেগুলো লেখার পেছনে অনুপ্রেরণা পেতেন কীভাবে?

মাওলানা বেলাল হোসাইন : আলহামদুলিল্লাহ আল-হেরা শিল্পীগোষ্ঠীর জাগরণী বইয়ের প্রথম জাগরণীটা আমারই লেখা। আমি সমসাময়িক বিভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে জাগরণী লিখেছি। একেকটা জাগরণীর পেছনে একেক রকম ঘটনা রয়েছে। সে সমস্ত ঘটনাবলীই মূলত আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি মনে করি, বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি মানুষের কাছে হক পৌঁছানো যায়; তার চেয়ে সাহিত্যিক মাধুর্য মিশিয়ে অল্প কথায় অর্থবোধক কবিতা কিংবা জাগরণীর মাধ্যমে মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে দ্রুত আঘাত করা যায়। আমি আমার সামান্য জ্ঞান দিয়ে সেই চেষ্টা করি।

তাওহীদের ডাক : এখন পর্যন্ত আপনার কতগুলো কবিতা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে?

মাওলানা বেলাল হোসাইন : আমি তৃতীয় শ্রেণী থেকে কবিতা লিখি। ছোট-বড় অনেক কবিতা লিখেছি। আমার লেখা কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। এমনকি বহু কবিতা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছে।

তাওহীদের ডাক : আপনার জীবনের কোন স্মরণীয় ঘটনা আছে কি?

মাওলানা বেলাল হোসাইন : (১) আমি পুষ্পপাড়া নামক এক জায়গায় ‘যুবসংঘ’-এর দাওয়াতী কাজে যাই। সেখানে এক মাদ্রাসায় একজন নামকরা বড় মুহাদ্দিছ ছিলেন। শোনা যেত তিনি ত্রিপুরার অধিবাসী, জাদরেল হানাফী, অনেক অভিজ্ঞ এবং বিশাল জ্ঞানী মানুষ। তাকে সবাই ত্রিপুরার হুজুর নামেই জানত। তার কাছে আমি দাওয়াত নিয়ে গেলে তিনি খুব খুশী হ’লেন। ছাত্রদের ডেকে বললেন, দেখ হক মুসলমান এখানে এসেছে। এরা সঠিক ইসলামের অনুসারী। কুরআন ও হাদীছ ভিন্ন কিছুই আমল করে না। ওখানে প্রোগ্রাম শেষ করে আসতে রাত প্রায় ৯টা অথবা সাড়ে ৯টা বেজে গেল। এদিকে রাস্তায় আমাদেরকে মারার জন্য একদল মাস্তান পিছু লাগল। তারা কারা ছিল আমি আজও জানতে পারিনি। পুষ্পপাড়া থেকে কিছুদূর যেতেই বড় মাঠ। কয়েক মাইল ফঁাকা। আশেপাশে কোন ঘর-বাড়ী নেই। মাইক্রো দু’টি সামান্য ফঁাকা রেখে রাস্তা আটকিয়েছে। আমি ১১০ সিসি হোন্ডা নিয়ে গিয়েছিলাম। হোন্ডার আলো খুব ভাল ছিল। দেখলাম, সেই ফঁাকা জায়গায় চকচকে ধারালো ছুরি নিয়ে লম্বা একটি লোক দঁাড়িয়ে আছে। আমাকে বলছে, থামো থামো। আমি চিন্তা করলাম, আজ তো আমার মৃত্যু নিশ্চিত। আমি যদি মরে যাই তাহ’লে তো কোন লাভ হ’ল না। বরং ডাকাতকে মেরেই মরবো। আমি যদি হোন্ডা ঘুরিয়ে আবার পেছনে যাই তাহ’লে তারা আমাকে ধরে ফেলবে। তখন বিসমিল্লাহ বলে ফুল স্পিডে হোন্ডা ছুটালাম। নিয়ত ছিল যে ছুরি নিয়ে দঁাড়িয়ে আছে তার গায়ের উপর তুলে দেব। আমি মাথা নিচু করে তাদের দিকে জোরে আগাতে লাগলাম। যাতে উপর থেকে কোপ দিলে আমাকে না লাগে। এভাবে যেতেই ছুরি হাতে দঁাড়ানো সেই লোকটি ভয়ে পাশে লাফ দিল। সবাই চিৎকার চেচামেচি করে গাড়িতে উঠতে লাগল। ততক্ষণে আমি অনেক দূর চলে গেলাম। তারা আর আমাকে ধরতে পারল না।

(২) ‘যুবসংঘ’ পাবনা টাউন হল ময়দানে সম্মেলন উপলক্ষে পৌরসভা মিলনায়তনে মিটিং করতে গিয়েছিলাম। সেখানে জামায়াতপন্থী জমঈয়তের রাজা হাজী নামে এক লোক ছিল। তার দাপটে কেউ মুখের উপরে কথা বলার সাহস করত না। সে এসে বলল, এখানে মিটিং করতে দেব না। আর গালিব ছাহেবকেও টাউন হল ময়দানে আসতে দেব না। সে আমাকে আর আমানুল্লাহ মাদানীকে মারতে চলে আসে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বাধা দিলে সে পালিয়ে যায়। আমাদেরকে সেখানে মারতে না পেরে সে মাস্তান নিয়ে রাস্তায় মারার পরিকল্পনা করে। তারা রাস্তায় গাড়ি দিয়ে ব্লক করে। পিছনে দুইটা হোন্ডা রাখছে। একেকটায় দুজন করে আছে। আমরা যখন চলে আসব তখন এক গ্রুপ সামনে থেকে এবং অন্য গ্রুপ পিছন থেকে মারার পরিকল্পনা করে।

আমি আমানুল্লাহ ছাহেবকে বললাম, সময় খুব খারাপ। পেছনে দু’টি হোন্ডা আসছে, আপনি আমাকে শক্ত করে ধরে থাকেন। ভয় পাবেন না। পাশে একটা গলি ছিল। সেই গলি দিয়ে প্রচন্ড স্পিডে হোন্ডা চালাতে লাগলাম। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যে রাস্তা দিয়ে এসেছি সেই রাস্তাতেই ফিরে যাব। তারা আমাদের জন্য যে রাস্তা ব্ল­ক করে রেখেছিল সেখানে ফিরে আসলাম। এসে দেখি রাস্তা ফঁাকা। ওরা চারদিকে খেঁাজাখঁুজি করছে। তারা সারারাত ধরে খেঁাজাখুঁজি করেছে আর আমরা সোজা বাড়ী চলে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ!

তাওহীদের ডাক : আপনি একজন দক্ষ মুনাযের। মুনাযারা বা বাহাছ সম্পর্কে যদি কোন স্মরণীয় ঘটনা জানাতেন?

মাওলানা বেলাল হোসাইন : (১) সুজানগর উপযেলায় কোন আহলেহাদীছ ছিল না। সেখানকার এক মাস্টার ছাহেব আমাদের ছালাত দেখে খুব রাগান্বিত হয়ে গরম গরম প্রশ্ন করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, সারা দুনিয়া চলে এক রকম আর তোমরা চল আরেক রকম। বুকে মেয়েরা হাত বঁাধে। তোমরা বুকে হাত বঁাধ কেন? আমরা তাকে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বইটি দিলাম। তিনি বইটি স্থানীয় আলেমদের কাছে দিলে তারা আমাদের সাথে বাহাছে বসার ডাক দেন। তারা বিভিন্ন কায়দায় সাধারণ মানুষকে বোকা বানাতে থাকে। যেমন-আহলেহাদীছরা তোমাদের পথভ্রষ্ট করছে, তারা ইহূদীদের দালাল, তারা কুরআন-হাদীছের কথা বলে মাত্র কিন্তু সেগুলো কুরআন-হাদীছ নয় ইত্যাদি। তারা বাহাছের জন্য আমাদের পক্ষের একজন আলেমের নাম চাইল। শেষ পর্যন্ত আমাকেই নির্ধারণ করা হ’ল। তাদের পক্ষে ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ থেকে অনার্স, মাস্টার্স ও দাওরায়ে হাদীছ ফারেগ এক আলেম। আমি বললাম, আমি মসজিদে কোন প্রোগ্রাম করব না। যারা কিছু বুঝতে চায় এমন শিক্ষিত মানুষের সাথে ঘরোয়া পরামর্শ বৈঠকে বসব।

দিনটি ছিল শুক্রবার। গিয়ে দেখি চতুর্দিক থেকে লোকজন মসজিদের দিকে ছুটে আসছে। আমি চিন্তা করলাম, কী ব্যাপার মসজিদে এত লোকজন এসেছে কেন? খুৎবার সময় হ’লে তারা আমাকে খুৎবা দিতে বলল। আমি সূরা মাঊনের বিষয়বস্ত্তর উপর খুৎবা দিলাম। ছালাতের উপরে যে সমস্ত হাদীছ রয়েছে সেগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লে­ষণ করে বললাম, মানব রচিত ছালাত আদায়কারীর জন্য আল্ল­াহ দুর্ভোগের ঘোষণা দিয়েছেন। ছালাত হ’তে হবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী। এটা শুনে মানুষের মধ্যে অন্য রকম একটা ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেল। আমরা বুকের উপর হাত বঁাধি এটা যদি আল্ল­াহর বিধান অনুযায়ী সত্য হয় তাহ’লে নাভির নিচে হাত বঁাধাটা মানব রচিত। আর যদি নাভির নিচে হাত বঁাধা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হয় তবে বুকের উপরে হাত বঁাধাটা মানব রচিত। যে কোন একটা ছাড়তে হবে। মানব রচিত বিধান মোতাবেক কোন ইবাদত আল্ল­াহ কবুল করবেন না। আল্ল­াহ যে বিধান দিয়েছেন তা অগ্রাহ্য করে আমরা নিজেদের বিধান মোতাবেক ছালাত পড়ছি। এভাবে জোরালো একটি বক্তব্য দিলাম।

এরপরে সেই আলেম ছাহেব যিনি সারা জীবন নাভির নিচে হাত বঁাধতেন তিনি বুকের উপরে হাত বঁাধলেন। উনার বুকে হাত বঁাধা দেখে যারা তাকে বাহাছের জন্য নিয়ে এসেছে তাদের মেজাজ গরম হয়ে গেছে। আমার খুৎবা শুনে ঐ মসজিদে আরও ৮/৯ জন বুকে হাত বেঁধেছিল। আমি সুন্নাত ছালাত পড়ে চলে যাব, এমন সময় অন্যান্য মসজিদ থেকে আরও যে সমস্ত লোকজন ও আলেম-ওলামা এসেছিল তাদের একজন আমাকে বলল, আপনি যাবেন না। কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেতে হবে। আমি মনে মনে ভাবলাম, এইবার আমার ১২টা বাজবে! এখন মার খাওয়া ছাড়া তো কোন উপায় নাই। মসজিদের বাইরে মানুষে ভরে গেছে। আমি বললাম, আপনারা যত প্রশ্ন করবেন আল্লাহ তাওফীক দিলে সবগুলোর জবাব দেয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্ল­াহ। তবে আমার শর্ত হ’ল, যদি কেউ প্রশ্ন করেন তার জবাব দেয়ার পরে আমার অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। একজনের কথার মধ্যে আরেকজন কথা বলতে পারবে না। যখন আমি দেখব, আপনারা আমার অনুমতি ছাড়া অনেকেই কথা বলছেন তখন আমি বুঝব, আপনারা প্রশ্ন করে দ্বীন শিখতে নয় বরং সবাই মিলে একটা ঝামেলা সৃষ্টি করতে এসেছেন। তখন আমি এখান থেকে চলে যাব। আপনাদের কোন প্রশ্নের জবাব দেব না। যদি শর্ত মানেন তবে জবাব দেওয়া হবে।

তখন কয়েকজন বলল, শর্ত মানা হবে। একজন বললেন, আপনি কোন মাযহাবের অনুসারী? আমি বললাম, আমাদের মাযহাবের নাম মুহাম্মাদী মাযহাব। যার নেতা স্বয়ং মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আমরা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া বিধান মানি। সেকারণে আমরা নিজেদেরকে মুহাম্মাদী তথা আহলেহাদীছ বলে পরিচয় দিই। তারা বলল, তাহ’লে আমাদের পরিচয় কি ঠিক না? আমি বললাম, আপনারা কেন মেয়ে মানুষের নামে পরিচয় দেন? হানীফা একজন মেয়ের নাম যার পিতার নাম নু‘মান এবং তঁার দাদার নাম ছাবিত। অর্থাৎ ছাবিতের নাতনী ও নু‘মানের মেয়ের নাম হানীফা। আপনারা কেন মেয়ের নামে পরিচয় দেন সেটা আমি কীভাবে বলব? বললাম, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর জন্ম ৮০ হিজরীতে আর মৃত্যু ১৫০ হিজরীতে। তিনি কোন নবী নন। তিনি একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন মাত্র। তঁার নামে মাযহাব বানিয়ে পরিচয় দিতে হবে এটা আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না। এরকম একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ওখানে প্রায় অনেক লোকই আহলেহাদীছ হয়ে গেল। আলহামদুলিল্লাহ।

(২) এ ঘটনার পর তারা ২০০৩ সালে আবারও বাহাছের আয়োজন করল। আমীরে জামা‘আতের কাছে এসে বললাম, তারা তো বাহাছের আয়োজন করেছে। আমীরে জামা‘আত বললেন, আমি তোমাকে দো‘আ করে দিলাম। তুমি বাহাছ কর। আমি চলে গেলাম বাহাছে। তারা সারাদেশ থেকে প্রায় ২২ জন খ্যাতনামা আলেম নিয়ে এসেছে। বাহাছ হবে সুজানগর থানার বরইপাড়া স্কুল মাঠে। আমি একাই বাহাছ করতে যাই। বাহাছের ময়দানে যাওয়ার পরে ঐ হানাফী আলেমের আহলেহাদীছ হওয়ার বিষয়টা তুলে ধরলাম। বললাম, আপনারা মেয়ে মানুষের নামে নিজেদের পরিচয় দেন কেন? এই প্রশ্নের জওয়াবটা দিবেন। এরপরে মুনাজাতের বিষয়টি তোলা হ’ল। মুনাজাতের পক্ষে হাদীছ বলা হ’ল। আমার সাথে যিনি কথা বলছেন তিনি কোন এক মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল। তার ইবারতের ভুলগুলি ধরিয়ে দিয়ে বললাম, আমি শুনেছি আপনি একজন বড় প্রিন্সিপ্যাল ছাহেব। আপনার বহু ছাত্র এখানে আছে। বহু ছাত্র বিভিন্ন মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল। অথচ আপনি এত বড় ভুল করলেন? যে দো‘আকে বলা হয়েছে আত্তাহিইয়াতু, দরূদ, দো‘আ মা‘ছুরা এগুলো ছাহাবীরা পড়েছেন, রাসূল (ছাঃ) পড়েছেন, তারপরে সালাম ফিরিয়েছেন। আপনি ছালাতে সালামের আগের হাদীছকে টেনে এনে সালামের পরে মুনাজাতের পক্ষে দলীল দিচ্ছেন? এ কাজটা আপনি ঠিক করলেন না। এভাবে তুলে ধরাতে বাহাছ এলোমেলো হয়ে গেল। তখন আশপাশের মানুষজন বলল, উনি যে প্রশ্ন করেছেন সে প্রশ্নের উত্তর আপনারা দেন নাই। তখন এক ধরনের গন্ডগোল লেগে গেল। একদল লোক এসে আমাকে বলছে, এতদিন আমাদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। আপনি হুকুম দেন তাদের গাড়ি ভেঙ্গে চুরমার করে দেব। আমি বললাম, তারা সম্মানী মানুষ। তাদের গায়ে হাত দিয়েন না। তাদেরকে যেতে দেন। পরে তাদেরকে হাদিয়া দেয়া তো দূরের কথা, বসতে পর্যন্ত দেয়নি। ফলে সেদিন নত মস্তকে তাদের চলে যেতে হয়। এরকম ঘটনা আমার জীবনে অনেক ঘটেছে।

(৩) একদিন শুনলাম এক জায়গায় তালাক নিয়ে প্রচন্ড গন্ডগোল হয়েছে। পাবনার কোন মাদ্রাসার আলেম ফায়ছালা দিতে পারেনি। ঢাকা পর্যন্ত এ খবর চলে গেছে। কিন্তু কোন ফায়ছালা হয়নি। ঘটনাটি হ’ল, পাবনার কুমিল্ল­া গ্রামের নায়েব আলী নামে এক রিকশাচালক তার স্ত্রীকে এক বৈঠকে তিন তালাক দেয়। পরবর্তীতে তারা পুনরায় সংসারে ফিরে যেতে চাইলে স্থানীয় আলেমরা হিল্লা করে পবিত্র হওয়ার ফৎওয়া দেন। কিন্তু তার স্ত্রী আহলেহাদীছ ঘরের মেয়ে হওয়ায় এই ফৎওয়া মানেনি। তখনই ঘটে বিপত্তি। ফৎওয়া না মানার অপরাধে তাদেরকে সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখা হয়। কোন মাধ্যমে খবর পেয়ে তারা আমার কাছে এসে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। আমি তাদেরকে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের ‘তালাক ও তাহলীল’ বই থেকে তিন তালাকের বিধান সম্বলিত কুরআন ও হাদীছের দলীল উল্লে­খ করে ফৎওয়া লিখে দিই। কিন্তু তারা বাহাছে বসার আহবান জানাল। তখন আমার এলাকার এক রিকশাওয়ালাকে সাথে নিয়ে প্রায় ৯ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে উপস্থিত হই। রিকশাওয়ালা মুরববী আশপাশের লোকজনের মারমুখী কথাবার্তা শুনে বলছে, বেলাল তাড়াতাড়ি রিকশায় ওঠ। তখন আমি বললাম, আল্ল­াহ যদি আমাকে হেফাযত করেন তাহ’লে পৃথিবীর কোন মানুষ আমাকে মারতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। আপনার রিকশা ভেঙ্গে দিতে পারে আপনি চলে যান। উনাকে বিদায় দিলাম। এসেছি হকের দাওয়াত দিতে, আল্লাহই হেফাযত করবেন। কোন মানুষের ভয় আমি পাই না। সেখানে যেতেই লোকজন মার মার শব্দ করতে থাকে। তখন আমি বললাম, আমি কি আপনাদের কোন ক্ষতি করেছি? আপনারা আমাকে কেন মারবেন? তখন ঐ এলাকার মেম্বর ছাহেব সবাইকে শান্ত করলেন। বললাম, আমি একা আপনাদের এলাকায় এসেছি। আমার সাথে কোন লাঠি-বন্দুক নেই। আমাকে মারা আপনাদের কোন ব্যাপার না। আপনারা আমাকে পরে মারেন। আগে আমার মুখের কথা শুনেন।

ইতোমধ্যে যে মাওলানা ছাহেব বাহাছ করবেন তিনি উপস্থিত হ’লেন। তার নাম কী ছিল সেটা মনে নেই। আমি একটা কাগজে এক বৈঠকে তিন তালাক যে হবে না সেটা সূরা বাক্বারাহ ও সূরা তালাকের আয়াত দিয়ে লিখে দিয়েছিলাম। তিনি সেই কাগজটা নিয়ে খুব আত্মম্ভরিতার সাথে আমাকে প্রশ্ন করে বললেন, বাসা কোথায়? বললাম, খয়েরসূতী। এখানে কেন এসেছেন? উত্তর দিলাম, আপনারা ডেকেছেন তাই এসেছি; না ডাকলে তো আসতাম না। তিনি কাগজটা দেখিয়ে বললেন, এটা কী লিখেছেন? তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে কাগজটি কেড়ে নিয়ে বললাম, এর মধ্যে যা লিখেছি তা পড়ে সবাইকে শুনান। তখন তিনি বললেন, কেড়ে নিলেন কেন? বললাম, কেড়ে নিলাম এ জন্যে যে, আমি যা লিখেছি তা আপনি বুঝতে নাও পারেন কিন্তু জনগণকে সঠিক জানতে হবে। আপনি পড়ে শুনান। তিনি পড়ে শুনালেন, আল্লাহ বলেন, ‘তালাক হ’ল দু’বার। অতঃপর হয় তাকে ন্যায়ানুগভাবে রেখে দিবে, নয় সদাচরণের সাথে পরিত্যাগ করবে’। ...‘অতঃপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়) তালাক দেয়, তাহ’লে সে যতক্ষণ তাকে ব্যতীত অন্য স্বামী গ্রহণ না করে, ততক্ষণ উক্ত স্ত্রী তার জন্য সিদ্ধ হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২২৯-২৩০)। এরপর আমি এ আয়াতের ব্যাখ্যাসহ ‘তালাক ও তাহলীল’ বই থেকে আরও কুরআনের আয়াত ও হাদীছের উদ্ধৃতি দিলাম।

তখন মাওলানা ছাহেব বললেন, আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেছেন, এক বৈঠকে তিন তালাক দিলে সেটা তিন তালাকই হবে। আমাদের এখানকার বাইকুলার হুজুর ইসহাক ছাহেব যিনি সঊদী আরবে গিয়ে তিন ঘণ্টা আরবীতে বক্তব্য দিয়ে পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনিও একই ফৎওয়া দিয়েছেন। তখন আমি বললাম, লা-হাওলা ওয়ালা-কুওওয়াতা ইল্ল­া-বিল্ল­াহ! আশরাফ আলী থানবী এবং বাইকুলার মুফতী ছাহেবদের কাছে কি নতুনভাবে অহি নাযিল হ’ল? যেখানে স্বয়ং আল্ল­াহ বলছেন, তিন মাসে তিন তালাক দিতে হবে আর আপনি কুরআনের বিপক্ষে গিয়ে আশরাফ আলী আর বাইকুলার মুফতীর দোহাই দিচ্ছেন? তারা কি নবী হয়ে গেল? একথা বলাতে জনগণ হুযুরের উপর ক্ষেপে গেল। তখন হুযুর চলে যেতে লাগল। বললাম, হুযুর চলে যান কেন? ফিরে আসুন! কথা তো কেবল শুরু। তিনি আর পিছনে তাকালেন না। লোকজন ঘটনা বুঝতে পারল। আলহামদুলিল্লাহ মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের ‘তালাক ও তাহলীল’ বইটি নিরবে অনেক পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে।

অতঃপর তারা আর আমাকে সেখান থেকে আসতে দিল না। আমি তাদের উদ্দেশ্যে কিছু নছীহত করলাম। হুযুরের জন্য যে খাবার রান্না করা হয়েছিল, তা আমি খেলাম। অবশেষে বাসায় ফিরতে রাত ১০টা বেজে গেল।

তাওহীদের ডাক : আপনার পক্ষ থেকে যুবসমাজের উদ্দেশ্যে কোন নছীহত আছে কী?

মাওলানা বেলাল হোসাইন : আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) কোন মুসলিম যুবককে দেখলে খুশী হয়ে বলতেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাকে ‘মারহাবা’ জানাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীছ বুঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন’ (বায়হাক্বী, শো‘আবুল ঈমান হা/১৭৪১)। তদ্রূপ আমিও বলতে চাই, আগামী দিনের যুবকদের ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হ’তে হবে। আর অবশ্যই এই জ্ঞানের ভিত্তি হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। যুবকদের পরকালীন জীবনে মুক্তি লাভের জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্মমূলে জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করতে হবে। যুবকদের প্রতি এটিই আমার নছীহত।

তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে কি?

মাওলানা বেলাল হোসাইন : দ্বী-মাসিক ‘তাওহীদের ডাক’ একটি উন্নতমানের পত্রিকা। এর সাহিত্যিক ভাব ও ভাষা দেশে প্রচলিত অন্যান্য পত্রিকা থেকে শ্রেষ্ঠ। এটি ‘যুবসংঘে’র তথা যুবকদের ঈমান, আমল ও উত্তম চরিত্র গঠনের মুখপত্র হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলার ঘরে ঘরে এই পত্রিকার দাওয়াত পেঁŠছানোর জন্য প্রচার-প্রচারণা আরও বাড়াতে হবে। সেজন্য আমাদের সকলের বাস্তবিক কিছু উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমি এই পত্রিকার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি।

তাওহীদের ডাক : এতক্ষণ আমাদের সাথে আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্ল­াহ খায়ের।

মাওলানা বেলাল হোসাইন :বারাকাল­াহু ফীকুম। আমার মত নগণ্যের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আপনাদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্ল­াহ যেন এই সাক্ষাৎকারের কল্যাণকর অংশটুকু যুবকদের দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে অনুপ্রেরণা হিসাবে কবুল করেন।-আমীন!



আরও