সর্বোত্তম জিহাদ

নাজমুন নাঈম 202 বার পঠিত

গল্পের একটি প্রধান চরিত্র উমাইয়া খেলাফতের আলোচিত-সমালোচিত গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আছ-ছাক্বাফী (৫৫)। হাজ্জাজ ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৪০ হিজরীতে তায়েফের ছাক্বীফ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইউসুফ জ্ঞান ও সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তায়েফবাসীর নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে তায়েফের শিশুদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ শৈশবে তার পিতার নিকট কুরআন হিফয করেন। অতঃপর তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, আনাস ইবনু মালেক, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িবসহ অনেক ছাহাবী ও তাবেঈর মজলিসে দ্বীন শিক্ষা করেন। যৌবনের শুরুতে তিনি পিতার ন্যায় ছোটদের কুরআন শিক্ষাদানে রত হন। খর্বদেহী হাজ্জাজ ছিলেন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বিশেষ করে বাগ্মীতা ও প্রচন্ড সাহসিকতার কারণে তিনি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেন।

সেসময় উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকলেও মক্কা, মদীনা, তায়েফসহ হেজায অঞ্চল ছিল ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়েরের নিয়ন্ত্রণাধীন। অন্যান্য অঞ্চলেও খেলাফতের ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খেলাফতের অধীনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং শীঘ্রই খলীফা আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ানের বিশ্বস্ত হয়ে উঠেন। ফলে খলীফা তাকে সেনাপতি করে হেজায অভিযান প্রেরণ করেন। অভিযানে হাজ্জাজ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়েরকে হত্যা করে হারামাইনকে খেলাফতের অন্তর্ভূক্ত করেন। এই সাফল্যের পুরস্কার স্বরূপ খলীফা তাকে হেজাযের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি প্রচন্ড রাগী ও শাসনকার্য পরিচালনায় কঠোর ছিলেন। তুচ্ছ কারণে তিনি হত্যা ও রক্তপাত ঘটাতেন। তিনি তৎকালীন অনেক আলেমকেও হত্যা করেছেন বলে জানা যায়। ভয়ে তার সামনে কেউ কথা বলত না। ফলে দু’বছরের মধ্যে সেখানে বিশৃঙ্খলা ও খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আশংকা দূর হয়ে যায়।

অন্যদিকে ইরাকে তখন খেলাফতের অবস্থা নাজেহাল। দিকে দিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। বিশেষ করে খারেজীদের বিরুদ্ধাচারণ চরম আকার লাভ করে। ফলে খলীফা আব্দুল মালিক হাজ্জাজকে ইরাকের গভর্ণর নিযুক্ত করেন। ইরাকে পেঁŠছে প্রথম ভাষণে তিনি ঘোষণা দেন, সামর্থ্যবান সকল যুবককে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে। তিন দিনের মধ্যে কেউ বের না হলে তাকে হত্যা করা হবে এবং তিনি বাস্তবে তা করতেও শুরু করেন। ফলে তিনি একটি বিরাট সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা পরিচালনা করে খারেজীদের প্রতিহত করে ইরাকে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।

কুরআন প্রশিক্ষক থেকে পুরোদস্ত্তর সেনানায়ক ও রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা হাজ্জাজের কুরআনের প্রতি আগ্রহ ছিল আজীবন। তিনি খলীফার নির্দেশে বিখ্যাত তাবেঈ ও আরবী ব্যাকরণবিদ আবুল আসওয়াদ আদ-দুআইলীর দুই ছাত্র নাছর বিন আছেম লায়ছী ও ইয়াহইয়া বিন ইয়া‘মার আদওয়ানীর মাধ্যমে কুরআনে হরকত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। হরকত ছাড়া কুরআন পড়তে অপারগ অনারব মুসলমানদের জন্যই এরূপ করা হয়েছিল। এছাড়া কুরআন শিক্ষার জন্য তিনি প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা করতেন।

তিনি সরকারী কাজে ফাহলাউই (পুরাতন ফার্সী)-এর পরিবর্তে আরবীর ব্যবহার ও আরবী মুদ্রা চালু করেন। তিনি মধ্য এশিয়ার বলখ, তাখারিস্তান, ফারগানা ও চীনের কাশগড় ইসলামী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৯৫ হিজরী সনের ২৫শে রামাযান মৃত্যুবরণ করেন। তার অসংখ্য ভালো কাজ থাকলেও শাসনকার্যে অত্যধিক কঠোরতা ও ব্যাপক রক্তপাতের কারণে ইতিহাসে ‘রক্ত পিপাসু’ যালেম শাসক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন।-অনুবাদক]

দশ বছরের কম বয়সী একটি ছোট ছেলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের তাবুতে প্রবেশ করল। সেখানে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আরবের বিভিন্ন প্রান্তের গোত্রনেতাদের সাথে বসেছিলেন। ছেলেটি সবুজ তাবুর চতুর্দিকে একবার দৃষ্টি ফিরাল। তারপর সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাদের প্রতি বিদ্রুপ ও তাচ্ছিল্য স্বরে কুরআনের একটি আয়াত পাঠ করল। যার অর্থ, ‘তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে অনর্থক স্তম্ভ নির্মাণ করছ? আর তোমরা কি বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ করছ এই ভেবে যে, তোমরা সেখানে চিরকাল থাকবে? আর তোমরা যখন কাউকে মার, তখন নিষ্ঠুর যালেমের মত প্রচন্ডভাবে মার’ (শোআরা ২৬/১২৮-১৩০)

হাজ্জাজ তখন হেলান দিয়ে বসেছিলেন। তিনি সোজা হয়ে বসে বললেন, হে বৎস! তোমাকে মেধাবী ও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। তুমি কি কুরআন হিফয করেছ? বালকটি বলল, আমি কি কুরআন হারিয়ে যাওয়ার ভয় করি, যে তা হিফয করব। আর আল্লাহ্ই কুরআন হেফাযত করেছেন। আল্লাহ্ বলেন, ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর হেফাযতকারী’ (হিজর ১৫/৯)

হাজ্জাজ বললেন, তাহ’লে তুমি কুরআন সংরক্ষণ করেছ? বালকটি বলল, এটা কি আগে অরক্ষিত ছিল যে আমি তার সংরক্ষণ করব? অথচ আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই এর সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদের’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৭)

বালকের কথায় হাজ্জাজ হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তাহ’লে তুমি কুরআনকে মযযূত করেছ? বালকটি বলল, এটাকে কি মযবূত করে নাযিল করা হয়নি যে আমি মযবূত করব? অথচ আল্লাহ বলেন, ‘এটি (কুরআন) এমন একটি কিতাব, যার আয়াত সমূহ মযবূত করা হয়েছে। অতঃপর প্রজ্ঞাময় সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হ’তে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে’ (হূদ ১১/১)

এভাবে সেখানে শব্দ খেলার এক তুমুল লড়াই চলতে থাকে। উল্লেখ্য যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন সেযুগের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের একজন। তবুও তার বুদ্ধি সামান্য এক বালকের সামনে অসহায়ভাবে পরাস্ত হচ্ছিল। অনেক ভেবে হাজ্জাজ বললেন, তাহলে তুমি কুরআন মনে রেখেছ? বালকটি বলল, আমি কুরআনকে অবহেলিত অবস্থায় মনের কোণে ফেলে রাখা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

হাজ্জাজ বললেন, তোমার ধ্বংস হোক! আমি কী বলব? বালকটি বলল, আপনার ধ্বংস হোক! আপনি বলুন, তুমি কুরআনকে তোমার বুকে ধারণ করেছ। তখন মজলিসে উপস্থিত নেতারা আশংকা করছিল যে, হাজ্জাজ বালকটিকে হত্যার নির্দেশ দিবেন। কিন্তু তিনি এমন কিছু করলেন না। বরং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? সে বলল, আমি আল্লাহর বান্দা। হাজ্জাজ আবার প্রশ্ন করলেন, তোমার পিতা কে? সে বলল, যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন।

হাজ্জাজ তার পরিচয় জানার চেষ্টা করছিলেন। তাই পুনরায় প্রশ্ন করলেন, তুমি কোথায় লালিত-পালিত হয়েছ? ছেলেটি উত্তর দিল, পাহাড়ে। তিনি প্রশ্ন করলেন, কে তোমাকে আমার নিকটে পাঠিয়েছে? সে বলল, আমার বিবেক। হাজ্জাজ বললেন, তুমি কি পাগল? ছেলেটি বলল, আমি যদি পাগল হতাম তাহ’লে আপনার সামনে তাদের মত বিনয়ী হয়ে দঁাড়াতাম, যারা আপনার অনুগ্রহ আশা করে ও আপনার শাস্তির ভয় করে।

হাজ্জাজ একটি কালির দোয়াতের দিকে ইশারা করে বললেন, আমাকে ঐ দোয়াতটি এগিয়ে দাও। বালকটি বলল, না। তিনি প্রশ্ন করলেন, কেন? সে উত্তর দিল, আমি ভয় করি যে আপনি তা দিয়ে অন্যায় কিছু লিখবেন। আর আমি আপনার পাপের অংশীদার হব। হাজ্জাজ বললেন, বরং আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাযার দিরহাম দেওয়ার জন্য আদেশ লিখতে চাই। তুমি এটা দিয়ে তোমার প্রয়োজন পূরণ কর। আর কখনো আমার কাছে ফিরে এসো না। হাজ্জাজের কথায় বালকটি হেসে উঠল। হাসির কারণ বুঝতে না পেরে হাজ্জাজ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হাসছ কেন? সে বলল, আপনার রবের বিরুদ্ধে আপনার সাহসিকতা দেখে আশ্চর্য হলাম। বরং আপনি এই পরিমাণ অর্থ তাদেরকে দান করে দিন, যাদের উপর আপনি যুলুম করেছেন এবং যাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছেন। কেননা ভালো কাজ খারাপ কাজসমূহকে মিটিয়ে দেয়।

এবার হাজ্জাজ আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তিনি আশেপাশে থাকা গোত্রনেতা ও সভাসদদের কাছে পরামর্শ চেয়ে বলেলেন, এর ব্যাপারে তোমরা কী মনে করছ? তারা তাকে হত্যার পরামর্শ দিল। তখন বালকটি বলল, হে হাজ্জাজ! আপনার ভাইয়ের সাথীরা আপনার সাথীদের থেকে উত্তম ছিলেন। তিনি বললেন, আমার কোন ভাই? ওয়ালীদ? ছেলেটি বলল, না, ফিরআউন (তার যুলুমের কারণে যালেম ফিরআউনের ভাই সম্বোধন করা হয়েছে)। কেননা সে যখন মূসা (আঃ)-এর ব্যাপারে তার সাথীদের কাছে পরামর্শ চেয়েছিল তারা তাকে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। আরা আপনার সাথীরা আমাকে হত্যার পরামর্শ দিল।

উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন বলল, সর্দার ছেলেটি আমাকে দিয়ে দিন। হাজ্জাজ বলল, আচ্ছা যাও। সে এখন থেকে তোমার। আল্লাহ যেন তোমাকে এই ছেলের মধ্যে কোন বরকত না দান করেন। বালকটি আবার হাসতে শুরু করল। এমনকি হাসতে হাসতে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। অতঃপর সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি জানিনা আপনাদের দুজনের মধ্যে কে বেশী বোকা। দানকারী নাকি দানপ্রার্থী? লোকটি বলল, আমি তোমাকে হত্যা থেকে বঁাচালাম আর তুমি আমাকে এরূপ বলছ? ছেলেটি বলল, আপনার নিজের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে? লোকটি বলল, না। সে বলল, তাহলে আপনি আমার উপর ক্ষমতাশীল হবেন কীভাবে?

হাজ্জাজ ছেলেটির বাকপটুতায় মুগ্ধ হয়ে বলল, তোমাকে এক হাযার দিরহাম দিলাম। আর অল্প বয়স ও তীক্ষ্ম বুদ্ধির জন্য তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। আর কখনো যদি তোমাকে এখানে দেখি আমি তোমার গলা কেটে আলাদা করে ফেলব। ছেলেটি দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি কখনোই সেই উপহার গ্রহণ করব না যা ধমক ও হুমকির সাথে দেওয়া হয়। আর ক্ষমা, সে তো আল্লাহর হাতে। আপনার হাতে নয়। আল্লাহ আমাকে ও আপনাকে যেন তদ্রূপ অবস্থায় একত্রিত না করেন, যেরূপ মূসা (আঃ) ও সামেরীকে একত্রিত করেছিলেন। অতঃপর বালকটি কোনদিকে না তাকিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।

নিজেদের জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর ধার্মিক মনে করা শাসকবৃন্দ ও বিশ্বনেতারা আজ কোথায়? দশ বছর বয়সী এই বালকের মত কয়জন আছে, যারা অত্যাচারী শাসককে সদুপদেশ ও পরামর্শ দেন? অথচ আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মানুষের সাথে উত্তম কথা বল’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)

শিক্ষা : স্বৈরাচারী এবং অত্যাচারী শাসকের সামনে হক কথা বলা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা অন্যতম জিহাদ। যারা এই কাজ করতে গিয়ে নিহত হন, তারা শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘শহীদগণের সর্দার হ’ল হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্ত্বালিব এবং সেই ব্যক্তি, যে কোন অত্যাচারী শাসকের কাছে গিয়ে তাকে সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে। ফলে তাকে হত্যা করা হয়’ (মুস্তাদরাক হাকেম হা/৪৮৮৪; ছহীহাহ হা/৩৭৪)

[গল্পটি আরবী থেকে অনূদিত]

-মূল : মুহসিন জববার,

অনুবাদ : নাজমুন নাঈম

[অনুবাদক : সহ-পরিচালক, সোনামণি]]



আরও