মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য

সারোয়ার মেছবাহ 185 বার পঠিত

ভুমিকা : মাদ্রাসা শব্দটি শুনলেই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে পাঞ্জাবি-টুপি পরা কিছু মানুষের ছবি, নিতান্তই সহজ-সরল কিছু মুখ। দুনিয়াবী লেনেদেনে যাদের খুব সহজে ঠকিয়ে দেওয়া যায়। মসজিদ, মাদ্রাসা আর পুরাতন দেখতে আরবী, ঊর্দু কিতাবই এদের জীবন। জীর্ণ কুটিরে ডাল-ভাত খেয়েও যারা মনের তৃপ্তিতে বলে আলহামদুলিল্লাহ। তবে দিনে দিনে সেই কল্পনায় বেশ পরিবর্তন আসছে। আজকের দিনে আর মাদ্রাসা শব্দটি শুনলে সেই পুরাতন সাদা-কালো ছবি কল্পনায় ভেসে ওঠে না। আজকে মাদ্রাসা আধুনিক মাদ্রাসা হয়েছে। আরো একধাপ এগিয়ে অত্যাধুনিক হয়েছে বললেও ভুল হয় না। তালেবে ইলমদের পোশাক পরিচ্ছদের পাশাপাশি আদব-আখলাক, ইখলাছ-আমল সবকিছু রেঙেছে রংধনুর সাত রঙে। বাহ্যিক কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি জীবনের লক্ষ্য ও গতিধারায় এসেছে বিরাট পরিবর্তন। যার ফলে দিনে দিনে একটি দুনিয়ালোভী আলেম সমাজ গড়ে উঠছে। এই অবস্থার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবী।

আজ আমি তালেবে ইলমদের চোখ থেকে রঙিন চশমা সরিয়ে তাদেরকে নিয়ে যেতে চাই উম্মুল মাদারিস মাদ্রাসাতুছ ছুফফায়। পরিচয় করিয়ে দিতে চাই ছুফফার সেরা ছাত্র আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর সাথে। কেমন ছিল তাঁর জীবনধারা, ক্যারিয়ার ভাবনা। কী ছিল তাঁর ইলম অর্জনের উদ্দেশ্য। তাঁদের চোখে কেমন ছিল এই জৌলুসভরা দুনিয়া।

আছহাবুছ ছুফফাহ : ছুফফাহ শব্দের অর্থ ছাপড়া ঘর, শামিয়ানা, ঘরের চাল ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিঃস্ব ও স্বজনহারা একদল ছাহাবী মসজিদে নববীর পাশে একটি ছাপড়া ঘরে বসবাস করতেন। তাঁদেরকে আহলুছ ছুফফাহ বা আছহাবুছ ছুফফাহ বলা হ’ত। সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন ৭০-এর অধিক। আজ যেমন আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মাদ্রাসায় এক ছাদের নিচে জমা হয়ে পড়ালেখা করি, তেমনই তাঁরাও মাসজিদে নববীর পাশে এক ছাদের নিচে একত্রিত হয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে তাঁদের সেই মাদ্রাসা আমাদের মাদ্রাসার মত বিলাসবহুল ছিল না। আমাদের মত তিন বেলা পেটপুরে খেয়ে তাঁদের জীবন অতিবাহিত হয়নি। বরং তাঁরা ক্ষুধার তাড়নায় কখনো কখনো জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।

তাঁদের অবস্থা কেমন ছিল তা আমরা আছহাবুছ ছুফফার অন্যতম সদস্য আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর থেকে জানব। তিনি বলেন, আমি আছহাবুছ ছুফফার ৭০জনকে দেখেছি, তাদের গায়ে কোনো বড় চাদর ছিল না। কারো ছিল শুধু লুঙ্গী, আবার কারো ছিল শুধু একটি ছোট চাঁদর। সেটাকেই তাঁরা ঘাড়ে বেঁধে রাখতেন। সেটা কারো অর্ধ হাঁটু পর্যন্ত আবার কারো টাখনু পর্যন্ত ঝুলে থাকত। লজ্জাস্থান দেখা যাওয়ার ভয়ে তাঁরা কাপড়ের দুইধার হাতে ধরে একত্রিত করে রাখতেন’।[1]

এই সেই আবু হুরায়রা (রাঃ) যিনি রাসূল (ছাঃ)-এর থেকে ৫৩৭৪টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যা ছাহাবায়ে কেরামের মাঝে সর্বোচ্চ। তাঁর থেকে প্রায় আট শতাধিক তাবেঈ হাদীছের জ্ঞান আহরণ করেছেন। আমরা আজকের যুগে তাঁর ইলমের প্রশংসা করছি এমনটা নয়, সে যুগেও তাঁর ইলমের প্রশংসা ছিল। তিনি নিজেই এবিষয়ে বলেছেন, আপনারা বলে থাকেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে আবু হুরায়রা (রাঃ) বেশী বেশী হাদীছ বর্ণনা করে থাকে। একথাও বলেন, মুহাজির ও আনছারদের কী হ’ল যে, তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেন না? মূল ব্যাপার হল এই যে, যখন আমার মুহাজির ভাইগণ বাজারে কেনা-বেচায় ব্যস্ত থাকতেন তখন আমি কোন প্রকারে আমার পেটের চাহিদা মিটিয়ে (খেয়ে বা না খেয়ে) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর নিকটে পড়ে থাকতাম। তাঁরা যখন (কাজের ব্যস্ততায়) অনুপস্থিত থাকতেন, আমি তখন উপস্থিত থাকতাম। তাঁরা যা ভুলে যেতেন, আমি তা সংরক্ষণ করতাম’।[2] এই হল আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর ইলম সাধনা। সর্বাধিক হাদীছ বর্ণনা করার ভেদ।

এখন প্রশ্ন হ’ল, তাঁরা কি সুনাম অর্জন বা দুনিয়া অর্জনের জন্য ইলম শিক্ষা করতেন? তাঁরা কি খুব বড় আলেম বা বক্তা হিসাবে নিজেকে যাহের করার উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে পড়ে থাকতেন? ইলম অর্জনের উদ্দেশ্য আসলে কী হওয়া দরকার? এই বিষয়ে আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ইলম বা জ্ঞান দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, সেই জ্ঞান কেউ দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে শিক্ষা করলে সে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না’।[3] নিশ্চয়ই এই জ্ঞান সেই জ্ঞান যেটা আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষা দেয়া হয়। এই জ্ঞান বিশুদ্ধ অহির জ্ঞান- কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান।

যদি আমরা তাঁদের আর্থিক অবস্থা এবং জীবনের সুখ ও সমৃদ্ধির দিকে তাকাই তাহ’লে ফাযালা ইবনে উবায়দ (রাঃ) এর হাদীছ দেখতে পাই। তিনি বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) যখন লোকদের নিয়ে ছালাতে দাঁড়াতেন তখন কিছু লোক ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় দাঁড়ানো থেকে ছালাতের মাঝেই পড়ে যেতেন। এরা ছিলেন, আছহাবুছ ছুফফাহ বা ছুফফার সদস্য। এমনকি তাদের এই অবস্থা দেখে মরুবাসী আরবরা বলত, এরা পাগল নাকি! রাসূল (ছাঃ) ছালাত শেষ করে এদের দিকে ফিরতেন এবং বলতেন, তোমরা যদি জানতে আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য কী নে‘মত আছে? তাহ’লে তোমরা আরো ক্ষুধার্ত থাকতে, আরো অভাবী থাকতে ভালবাসতে। ফাযালা (রাঃ) বলেন, আমি ঐ সময় রাসূল (ছাঃ) এর সাথেই ছিলাম’।[4]

একবার চিন্তা করুন, যাঁদের পেটে খাবার না থাকার কারণে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করতে পারেন না। সম্বল মাত্র একটি লুঙ্গী বা চাঁদর, যা পরে কাপড়ের দুই পার্শ্ব হাত দিয়ে ধরে না থাকলে লজ্জাস্থান বের হয়ে যাবার ভয়; তাঁদেরকে বলা হচ্ছে, তোমরা আরো অভাবী থাকতে ভালোবাসতে! এই ছিল আমাদের উম্মুল মাদারিস আহলে ছুফফাহর অবস্থা। এই ছিল সেখানকার গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার ভাবনা। এটাই ছিল তাঁদের জীবনধারা।

আমাদের বর্তমান মাদ্রাসাগুলোর ভিত্তি : শুনতে খারাপ লাগলেও বলতেই হবে যে, আমাদের বর্তমান মাদ্রাসাগুলো দুনিয়ামুখী চিন্তাধারা নিয়ে বেড়ে উঠছে। তারা কুরআন-হাদীছ পড়াচ্ছে, একথা ঠিক। তবে এই বিদ্যার মাধ্যমে তারা দুনিয়া উপার্জন করছে এবং শিক্ষার্থীদেরকেও দুনিয়া উপার্জনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কুরআন-হাদীছের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যে যত বেশী দুনিয়া উপার্জন করতে পারছে সে ততই অনুসরণীয় হয়ে উঠছে। কুরআন হাদীছ সবখানেই শিখানো হচ্ছে, কম বা বেশী। তবে ইখলাছ এবং লিল্লাহিয়্যাতের শিক্ষা কোথাও যেন দেওয়া হচ্ছে না। মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে যদি ইখলাছের শিক্ষা না থাকে তবে সেই মাদ্রাসা আর স্কুল-কলেজের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। এ অবস্থায় স্কুল-কলেজে পড়ে হয়ত কিছু দুনিয়া অর্জন হয়, তবে ইখলাছ ছাড়া মাদ্রাসায় পড়ে না হয় দুনিয়া, না হয় আখেরাত।

আমাদের মাদ্রাসাগুলো যে দিন দিন ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে উঠছে, এই কথাটিও বলতে খারাপ লাগে। আপনি একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, একই বাজারে দুই তিনটা মাদ্রাসা! একধাপ বেড়ে বলা যায় একই বিল্ডিংয়ের আলাদা আলাদা ফ্লোরে আলাদা আলাদা মাদ্রাসা! এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় প্রাইভেট মাদ্রাসা। আপনি জরিপ করলে দেখবেন, অধিকাংশ প্রাইভেট মাদ্রাসার পরিচালকই ভালো আলেম নন। অনেকে তো ভালো খারাপ দূরে থাক, আলেমই নন। আর মুখলিছ আলেমে দ্বীন তৈরীর ব্রতী নিয়েও তারা মাদ্রাসা চালু করেননি। সে সকল মাদ্রাসার লিফলেটে আপনি সব আন্তর্জাতিক মানের কথা পাবেন! পাঁচ বেলা খাবার থেকে শুরু করে যত রকমের সার্ভিস আর বিশ্বের নামজাদা ওস্তাদ যেন সব সেখানেই আছেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় হ’ল, সব প্রাইভেট মাদ্রাসাতেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরষ্কারপ্রাপ্ত ছাত্র আছেই। এটা না হ’লে যেন লিফলেটই হয় না।

এগুলো কোনো দোষের বিষয় নয়। বাজারে বাজারে নয়, ঘরে ঘরে মাদ্রাসা হ’তে পারে। তবে সে মাদ্রাসার বুনিয়াদ হ’তে হবে ইখলাছের ওপর। অন্য যে নিয়তেই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হোক তা তালিবে ইলমদের মধুর নামে বিষই পান করাবে। যা পান করলে তালিবে ইলমদের অকাল মৃত্যু নিশ্চিত। প্রচলিত মাদ্রাসাগুলোতে মধুর পাত্রে বিষ মিশানো হয় তখন, যখন একজন শিশু তাদের কাছে কুরআন হিফয করার জন্য ভর্তি হয়। আর সেই শিশুর মাথায় ঢুকানো হয়, তোমাকে আন্তর্জাতিক হিফয প্রতিযোগিতায় দুবাই থেকে পুরস্কার আনতে হবে! এটার জন্য তোমাকে ভালো ইয়াদ করতে হবে। অমুক তমুক ক্বারীর লাহানে তিলাওয়াত করতে হবে। এটাই তোমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য! তাদেরকে সারাদিন মশক করানো হয়। আন্তর্জাতিক হিফয প্রতিযোগিতার জন্য যা করা লাগে তাই করানো হয়। ফলে কুরআন হিফযের উদ্দেশ্য হয় দুনিয়াবী যশ, ইহকালীন খ্যাতি। সে ছেলেটি জানতেই পারে না, কুরআন হিফয কেন করতে হয়! দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা করলে তার ভয়াবহতা কী! ফলে একদিন সে দুবাই, সাঊদী আরব, কাতার থেকে পুরস্কার নিয়ে নিজেকে চুড়ান্তভাবে সফল মনে করে। আর ওদিকে এই ফলাফলকে পুঁজি করে মাদ্রাসা পরিচালক সর্বোচ্চ ফায়দা কুড়ান। এভাবেই চলে আসছে এই প্রাইভেট ব্যবস্থা। এভাবেই চলে আসছে কুরআন-হাদীছের জ্ঞানকে পুঁজি করে ব্যবসা। তারা ব্যবসা করুক, তবে একজন তালেবে ইলমের আখেরাত নষ্ট করে কেন! একজন তালেবে ইলমের ইলম অর্জনের উদ্দেশ্য নষ্ট করার অধিকার তাদের কে দিল!

কিছু মাদ্রাসা এমনও দেখেছি, যোগ্য আলেম গড়ে তোলার তুলনায় প্রচারেই তাদের খেয়াল বেশী। কুরআন হাদীছ শিক্ষার মান অধঃতলে নাকি রসাতলে এদিকে তাদের খেয়াল নেই। অথচ চার আনার পয়সাকে ষোল আনার রূপ দিয়ে জনসম্মুখে প্রচার করতে তারা বেশ পারদর্শী। মোটেও ইংরেজী পড়ানো হয় না এমন মাদ্রাসার সভা, সেমিনারে ছাত্রদেরকে ইংরেজী রচনা মুখস্থ করিয়ে ইংরেজী বক্তব্য উপস্থাপন করিয়ে তারা কী প্রচার করতে চান? দেয়ালিকায় বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় লেখা প্রকাশের মাধ্যমে কী বুঝাতে চান? সেখানে যারা বক্তব্য দেয়, লেখা জমা দেয় তারা নিজেরাও জানেনা, লেখাতে বা বক্তব্যে আসলে কী বলা হ’ল। এটাই কি তাদের মুখলিছ আলেম তৈরীর নমুনা?

দেখুন! শুধু ফার্সী কবিতা আর ইংরেজীতে বক্তব্য করতে পারলেই যোগ্য আলেম হয় না। যোগ্য আলেম বানাতে ছাত্রদের মাঝে কুরআন-হাদীছ অনুধাবন শক্তি বাড়ানোর প্রচেষ্টা করতে হয়। নাহু, ছরফ, বালাগাতে দক্ষ করে তুলতে হয়। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হ’ল, তালেবে ইলমকে মুখলিছ এবং আখেরাতমুখী করে গড়ে তুলতে হয়। কারণ, আলেমগণ যদি দুনিয়াদার হয় তবে জাতি অভিভাবকশূন্য হয়। আজ লক্ষ লক্ষ ছাত্র প্রতিবছর দাওরায়ে হাদীছের গন্ডি পেরিয়ে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করছে কিন্তু জাতি পাচ্ছে না তাদের রাহবার। পাওয়া যাচ্ছে না দ্বীনের একনিষ্ঠ খাদেম।

আরো দুঃখের বিষয় হল, আমাদের কিছু ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসাও গড়ে উঠেছে। তারা খুব সুক্ষ্মভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ কিংবদন্তী তারকাদের আমাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছেন। তারা বলেন, ভালো আলেম হয়ে সেই ইলম তো বহির্বিশ্বে প্রচার করতে হবে। এজন্য ইংরেজী বোঝা ও কথা বলার দক্ষতা অর্জন করা অবশ্যই দরকার। সে লক্ষ্যে ইংরেজী ভাষা শেখানোর জন্য আরবীর তুলনায় বেশী বেতন দিয়ে শিক্ষক রাখা হয় এবং আরবীর তুলনায় ছাত্রদেরকে ইংরেজী শিক্ষায় বেশী আগ্রহী করে তোলা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, বেশীর ভাগ ছাত্র ইংরেজী তো শিখে যায় কিন্তু লেখাপড়ার শেষ অবস্থায় এসেও একলাইন আরবী শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে, বলতে সক্ষম হয় না। অথচ এই ছাত্রগুলো বড় আলেম হওয়ার জন্যই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিল। আজ তারা কুরআন বুঝে না, হাদীছ বুঝে না, ফিক্বহ বুঝে না, ইলমে শরী‘আর কোনোটাই বুঝে না। ফলস্বরূপ খুতবায় মানুষকে কুরআন-হাদীছ শোনানোর বদলে ইংরেজী স্পোকেন শুনিয়ে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে। বিষয়টা অনেকটা গাভী কেনার টাকা দিয়ে দুধ দোহনের সারঞ্জাম কিনে গাভী কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলার মত।

শেষ কথা : হেজাযের কাফেলা তুর্কিস্তানের পথ ধরে কখনো হেজাযে পৌঁছাতে পারে না। আজ আমাদের কাফেলা যে পথ ধরে এগিয়ে চলেছে সে পথ আমাদের নয়। এই ক্যারিয়ার ভাবনা আমাদের নয়। এই জীবনধারা আমাদের নয়। বিশ্বের প্রত্যেকটি মাদ্রাসা কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান টিকিয়ে রাখার একেকটি দুর্গ। জানিনা, সেই দূর্গের সৈনিকদের মাথায় কে ঢুকিয়ে দিল, আলেম হওয়ার পাশাপাশি তোমাকে ভালো ডাক্তারও হ’তে হবে। ভালো ইঞ্জিনিয়ারও হ’তে হবে। ভালো বক্তাও হ’তে হবে। হ্যা, ভালো ডাক্তার, ভালো ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পাশাপাশি আলেম হওয়া যায়। তবে সেই আলেম শুধু নিজেকে ফিতনা থেকে রক্ষা করতে পারে; কুরআন হাদীছের দুর্গ রক্ষার কাজ তার দ্বারা সম্ভব হয় না। কারণ, কুরআন-হাদীছের দূর্গ রক্ষার জন্য প্রয়োজন আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর মত নিবেদিতপ্রাণ সৈনিকের। আবু দারদা (রাঃ) এর মত দুনিয়াবিমুখ কিছু মানুষের। ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে ইসলামের যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে তা দুনিয়াবিমুখ মানুষদের মাধ্যমেই হয়েছে। 

আমাদের পূর্বসূরীগণ যদি একটি হাদীছ জানার জন্য মদীনা থেকে দামেশ্ক পায়ে হেঁটে সফর না করতেন, রাতের পরে রাত শুধু ছাদাক্বায়ে জারিয়ার উদ্দেশ্যে ইলম সাধনায় অতিবাহিত না করতেন, পারিশ্রমিক নেই, বেতন নেই, রোজগার নেই বলে বিভিন্ন শাস্ত্রের কিতাবাদি রচনা করে না যেতেন, তবে আমরা মূর্খতার অতল গহবরে নিমজ্জিত হতাম। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশের কোন অবকাশ নেই। এরা যদি কুরআন হাদীছের জ্ঞান কিছু অর্জন করেও ফেলে তবুও এদের মাধ্যমে পেটপুঁজা ছাড়া আর কিছু সম্ভব নয়। কারণ, কুরআন-হাদীছের জ্ঞানের জন্য ইখলাছ তেমনই প্রয়োজন যেমন মাছের জন্য পানি প্রয়োজন।

প্রিয় তালেবে ইলম! মাদ্রাসা সভ্যতা এসেছে মসজিদে নববীর বারান্দা থেকে। আহলুছ ছুফফাহ থেকে। আমরা যদি সত্যিই মাদ্রাসা থেকে প্রকৃত আলেম এবং দ্বীনের একনিষ্ঠ খাদেম হ’তে চাই তবে আমাদেরকে আবার পুরাতন ধারায় ফিরে যেতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে, আখেরাতের জীবনই আসল জীবন এবং সেই জীবনের পুঁজি সংগ্রহের জন্যই কাজ করে যেতে হবে। দুনিয়ার বুকে ভালো খেয়ে পরে আরাম আয়েশ করে যাওয়ার জন্য আমরা দুনিয়াতে আসিনি। বিশ্বকে আমাদের কিছু দেওয়ার আছে। আমাদের কাছে তাদের কিছু পাওনা আছে। তাই এসো, পরলৌকিক জীবনের জন্য ছাদাক্বায়ে জারিয়ার নিবৃত্তে ইলম সাধনা করি। এসো, আবার রাত জাগি। এসো, আমাদের পূর্বসূরিদের মত আমরাও ইলমের ময়দানে অবদান রাখি। জশ, খ্যাতি বা দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে নয় বরং জান্নাত লাভের জন্য ইলম অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।-আমীন!


[1]. বুখারী হা/৪৪২, ‘ছালাত’ অধ্যায়।

[2]. বুখারী হা/১৯১৯, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।

[3]. আহমাদ হা/৮২৫২ সনদ ছহীহ।

[4]. তা‘লীকুর রাগীব ৪/১২০, তিরমিযী হা/২৩৬৮ সনদ ছহীহ।



বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও