কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমানের শাখা (৪র্থ কিস্তি)

হাফেজ আব্দুল মতীন 1820 বার পঠিত

(২৯) ওয়াদা পূরণ করা :

মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا-

‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৩৪)

 এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন,

لاَ إِيمَانَ لِمَنْ لاَ أَمَانَةَ لَهُ وَلاَ دِينَ لِمَنْ لاَ عَهْدَ لَهُ-

‘ঐ ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানত নেই এবং ঐ ব্যক্তির দ্বীন নেই যার ওয়াদা ঠিক নেই’।[1]

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির জন্য যে সমস্ত বিষয় হালাল করেছেন সে বিষয়গুলি হালাল হিসাবে গ্রহণ করা বরং যে সমস্ত বিষয় হারাম করেছেন তা হারাম হিসাবে মেনে নেওয়া, আর যে সমস্ত  বিষয় ফরয করেছেন তা ফরয হিসাবে গ্রহণ ও জীবনে বাস্তবায়ন করা। এ বিষয়ে কুরআনে যা বর্ণিত হয়েছে তা জীবনে বাস্তবায়ন করা, ওয়াদা পূরণ করা, খিয়ানত না করা (ইবনু কাছীর ৫/৮)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ-

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নাবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে তার কোন একটি স্বভাব থাকবে তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকীর এটি স্বভাব থেকে যায়। ১. আমানত রাখা হলে তার খিয়ানত করে ২. যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে। ৩. অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করে। ৪. বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে গালিগালাজ করে’।[2] এ বিষয়ে অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ،وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ،وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَان -

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি (১) যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে (২) যখন সে অঙ্গীকার করে তখন ভঙ্গ করে (৩) তার নিকট আমানত রাখলে তা খিয়ানত করে’। [3]

(৩০) মানত পূর্ণ করা : মানত একটি ইবাদত। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে মানত করা যাবে না। অন্যের নামে মানত করলে শিরক হবে। তাই মানত কেবল আল্লাহর জন্যই করতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,

يُوْفُوْنَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُوْنَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيْرًا-  ‘তারা মানত পূর্ণ করে এবং সেদিনের ভয় করে, যেদিনের অনিষ্টতা হবে ব্যাপক’ (দাহর ৭৬/৭)।এ আয়াতটিতে আল্লাহ তা‘আলা মানত পূর্ণকারীদের প্রশংসা করেছেন। আর যেহেতু মানত ইবাদত, সেহেতু কেউ অন্যের নৈকট্য অর্জনের জন্য তা করলে সেটা শিরক হবে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ أَوْ نَذَرْتُمْ مِنْ نَذْرٍ فَإِنَّ اللهَ يَعْلَمُهُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ ‘আর যে কোন বস্ত্ত তোমরা ব্যয় কর না কেন, অথবা যে কোন নযর তোমরা গ্রহণ কর না কেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই তা অবগত হন। আর অত্যাচারীদের কোনই সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/২৭০)

আমরা যে সমস্ত টাকা-পয়সা ব্যয় করি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য যে কোন মানত করি সবই তিনি জানেন ও এর প্রতিদান দেন। সুতরাং মানত কেবল তাঁর জন্যই হ’তে হবে। অন্যের জন্য করাই শিরক। আর আল্লাহর জন্য নযর করলে তা পূরণ করতে হবে এবং অন্যের জন্য করলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,

 مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيْعَ اللهَ فَلْيُطِعْهُ، وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِيَهُ فَلاَ يَعْصِه

‘যে লোক আল্লাহর আনুগত্য করার মানত করে সে যেন তাঁর আনুগত্য করে। আর যে লোক আল্লাহর অবাধ্যতা করার মানত করে সে যেন তাঁর অবাধ্যতা না করে’।[4] উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানত হচ্ছে ইবাদত। আর ইবাদত শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে। কোন সৎকাজের মানত করলে তা পূরণ করতে হবে এবং অন্যায় কাজে ও আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে মানত করলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। আর মানত ভঙ্গের জন্য কাফফারা আদায় করতে হবে।

এরূপ শপথ ভঙ্গের কাফফারা হ’ল, দশজন অভাবগ্রস্তকে মধ্যম মানের খাদ্য প্রদান করবে যা তোমরা সাধারণতঃ খেয়ে থাক, অথবা তাদেরকে অনুরূপ মানের পোষাক প্রদান করবে অথবা একটি ক্রীতদাস বা দাসী মুক্ত করে দিবে। এগুলির কোনটা না পারলে একটানা তিনদিন ছিয়াম পালন করবে। এটাই তোমাদের কসম সমূহের কাফফারা যখন তোমরা তা করবে’ (মায়েদাহ ৫/৮৯)

(৩১) মহান আল্লাহর শুকরিয়া করা ওয়াজিব :

আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য নে‘মত রয়েছে এগুলির গণনা করে শেষ করা যাবে না। এই জন্য মহান আল্লাহ বলেন, وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ   ‘বল, সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহরই জন্য’ ( বনী ইস্রাঈল ১৭/১১১)। তিনি আরো বলেন, وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ‘যদি তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা কর, তবে তা গুণে শেষ করতে পারবে না’ (নাহল ১৬/১৮)। মহান আল্লাহ বলেন, فَاذْکُرُوْنِیْٓ اَذْکُرْکُمْ وَاشْکُرُوْا لِیْ وَلَا تَکْفُرُوْنِ ‘অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমি তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, অকৃতজ্ঞ হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/১৫২)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ

‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বেশী বেশী করে দেয়। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহ’লে (মনে রেখ) নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (ইবরাহীম ১৪/৭)

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার সম্পর্কে আমার বান্দার যেরূপ ধারণা পোষণ করে আমি অনুরূপ এবং সে যখন আমাকে স্মরণ করে আমি (ইলম, হিফয, সাহায্যের মাধ্যমে) তার সাথে থাকি। যখন সে আমাকে মনে মনে স্মরণ করে আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জামা‘আত বদ্ধভাবে আমাকে স্মরণ করে তাহ’লে আমি এর চেয়েও উত্তম জামা‘আত (ফিরিশতাদের মাঝে) স্মরণ করে থাকি যা তার জামা‘আত থেকে উত্তম। আর সে যদি আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে তাহ’লে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই। আর যদি সে আমার দিকে এক হাত এগিয়ে আসে তাহ’লে আমি তার দিকে এক গজ পরিমাণ অগ্রসর হই। আর বান্দা যদি আমার দিকে হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হয় তাহ’লে আমি তার দিকে দেঁŠড়ে অগ্রসর হই’।[5] সুতরাং সদা সর্বদা আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে।

(৩২) জিহবাকে হিফাযত করা : মিথ্যা কথা, গীবত, অপবাদ, অপ্রয়োজনীয় কথা ও সকল অশ্লীল কথা-বার্তা থেকে নিজের জিহবাকে হিফাযত করা। সত্যবাদী হওয়া ও সত্য কথা বলা। মহান আল্লাহ বলেন,

 إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا-

‘নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনীত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, ছিয়াম পালনকারী পুরুষ ও নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, এদের জন্য আল্লাহ প্রস্ত্তত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কার’ (আহযাব ৩৩/৩৫)। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবাহ ৯/১১৯)

আল্লাহ অন্যত্র বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’ (আহযাব ৩৩/৭০)

(ক) যে বিষয়ে মানবজাতির জ্ঞান নেই সি বিষয়ে কথা না বলা : মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ  ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছে পড়ো না’ (বনী ইস্রাইল ১৭/৩৬)

(খ) সত্য বিষয়কে গ্রহণ করতে হবে মিথ্যা বিষয়কে বর্জন করতে হবে : মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَبَ عَلَى اللَّهِ وَكَذَّبَ بِالصِّدْقِ إِذْ جَاءَهُ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ-۫ ‘অতঃপর তার চাইতে বড় যালেম আর কে আছে যে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে এবং সত্যকে (কুরআনকে) মিথ্যা সাব্যস্ত করে যখন সেটি তাদের কাছে আগমন করে? (যুমার ৩৯ /৩২)। তিনি আরো বলেন, وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি সত্যসহ আগমন করেছে ও যে ব্যক্তি তাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই তো আল্লাহভীরু’ (যুমার ৩৯ /৩৩)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ-

‘তোমরা তোমাদের যবানে যেভাবে মিথ্যা বলে থাক, সেভাবে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে বলো না যে, এটি হালাল ও এটি হারাম। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে, তারা সফলকাম হয় না’ (নাহল ১৬ /১১৬)।হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِى إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِى إِلَى الْجَنَّةِ ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يَكُونَ صِدِّيقًا، وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِى إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِى إِلَى النَّارِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ، حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ كَذَّابًا-   

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় সত্যবাদিতা (মানুষকে) কল্যাণের পথে নিয়ে যায় এবং কল্যাণ (মানব জাতিকে) জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর মানুষ সত্য কথা বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত ছিদ্দীক (সত্যাবাদী) হিসাবে গন্য হয়। পক্ষান্তরে মিথ্যা কথা (মানুষকে) পাপের দিকে ধাবিত করে এবং পাপ তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট জঘন্য মিথ্যাবাদী হিসাবে তার নাম লিখা হয়’।[6] অন্যত্র এসেছে,

عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ رضى الله عنه قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُ رَجُلَيْنِ أَتَيَانِى قَالاَ الَّذِى رَأَيْتَهُ يُشَقُّ شِدْقُهُ فَكَذَّابٌ يَكْذِبُ بِالْكَذْبَةِ تُحْمَلُ عَنْهُ حَتَّى تَبْلُغَ الآفَاقَ فَيُصْنَعُ بِهِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَة-ِ

সামুরা ইবনু জুন্দুব (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, আমি (স্বপ্নে) দেখলাম,  দু’জন লোক আমার নিকট এসে বলতে লাগলো, আপনি (মি‘রাজের রাতে) যে লোকটি দেখতে পেয়েছিলেন, তার মুখ চিরে ফেলা হচ্ছিল, সে জঘন্য

মিথ্যাবাদী ছিল। আর সে এমনভাবে মিথ্যা রটাতো যে দুনিয়ার প্রতি কোণে কোণে তা ছড়িয়ে যেত। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ মিথ্যাবাদীর অনুরূপ শাস্তি হ’তে থাকবে’।[7]

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ يَضْمَنْ لِى مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ- 

সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তার দু’চোয়ালের মাঝের বস্ত্ত (জিহবা) এবং দু’রানের মাঝখানের বস্ত্ত (লজ্জাস্থান)-এর যামানত আমাকে দিবে, আমি তার জান্নাতের যিম্মাদার’।[8] 

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا، أَوْ لِيَصْمُتْ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন ভাল কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে’।[9]

(৩৩) আমানত কৃত বস্ত্ত তার হক্বদার ব্যক্তির নিকট ঠিকভাবে পেঁŠছে দেওয়া :

মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا-  ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার যথার্থ হকদারগণের নিকট পৌঁছে দাও’  (নিসা ৪/৫৮)। মহান আল্লাহ বলেন, فَإِنْ أَمِنَ بَعْضُكُمْ بَعْضًا فَلْيُؤَدِّ الَّذِي اؤْتُمِنَ أَمَانَتَهُ- ُ ‘আর যদি তোমরা একে অপরকে বিশ্বাস কর, তবে যাকে বিশ্বাস করা হয়েছে, তার উচিৎ আমানত (যথাযথভাবে) আদায় করা’ (বাক্বারাহ ২/২৮৩)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَدِّ الأَمَانَةَ إِلَى مَنِ ائْتَمَنَكَ وَلاَ تَخُنْ مَنْ خَانَكَ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমার নিকট কোন ব্যক্তি (কোন কিছু কথা-বার্তা বা ধন সম্পদ) আমানত রাখলে সে আমানত ঠিকভাবে বুঝিয়ে দিও’। আর কোন ব্যক্তি তোমার আমানতের খিয়ানত করলে তুমি (তার মত) খিয়ানত কর না’।[10]

(৩৪) কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হারাম :

মহান আল্লাহ বলেন,

 وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا-

‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হ’ল জাহান্নাম। সেখানেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাৎ করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্ত্তত রেখেছেন’ (নিসা ৪/৯৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ-

‘দরিদ্রতার ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না। আমরাই তোমাদেরকে ও তাদেরকে  জীবিকা প্রদান করে থাকি। প্রকাশ্য বা গোপন কোন অশ্লীলতার নিকটবর্তী হবে না। ন্যায্য কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা অনুধাবন করো’ (আনআম ৬/১৫১)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا فَلَا يُسْرِفْ فِي الْقَتْلِ إِنَّهُ كَانَ مَنْصُورًا-

‘আর আল্লাহ যাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন, তাকে তোমরা অন্যায়ভাবে হত্যা করো না। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমরা তার উত্তরাধিকারীকে (ক্বিছাছ অথবা ক্ষমা করার) অধিকার দিয়েছি। অতএব সে যেন হত্যার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে (অর্থাৎ হত্যার পর তার অঙ্গছেদন না করে কিংবা হত্যাকারী ব্যতীত অন্যকে হত্যা না করে)। আর সে (আইনগতভাবে প্রতিশোধ গ্রহণে) সাহায্য প্রাপ্ত হবে’(বনী ইস্রাঈল ১৭/৩৩)

হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ فِى الدِّمَاء-ِ

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন ‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্ব প্রথম হত্যার বিচার করা হবে’ [11]

عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَنْ يَزَالَ الْمُؤْمِنُ فِى فُسْحَةٍ مِنْ دِينِهِ ، مَا لَمْ يُصِبْ دَمًا حَرَامًا-

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘একজন মুমিন ব্যক্তি তার দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণভাবে আজাদীর মধ্যে থাকে। যদি না সে কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে হত্যা করে’।[12]

(৩৫) লজ্জা স্থানকে হারাম কাজ থেকে হিফাযত করা :

মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ- وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ  ‘তুমি মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতর। নিশ্চয়ই তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর তুমি মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাযত করে’ (নূর ২৪/৩০-৩১)। মহান আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ ‘যারা তাদের যৌনাঙ্গ ব্যবহারে সংযত’ (মুমিনূন ২৩/৫)। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا-  ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ’ (বনী ইস্রাইল ১৭/৩২)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ يَزْنِى الزَّانِى حِينَ يَزْنِى وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيهَا أَبْصَارَهُمْ حِينَ يَنْتَهِبُهَا وَهْوَ مُؤْمِنٌ- 

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘কোন ব্যভিচারী মুমিন অবস্থায় ব্যভিচার করে না। কোন মদ্যপায়ী মুমিন অবস্থায় মদ্যপান করে না। কোন চোর মুমিন অবস্থায় চুরি করে না। কোন লুটতরাজকারী মুমিন অবস্থায় এরূপ লুটতরাজ করে না যে যখন সে লুটতরাজ করে তখন তার প্রতি লোকজন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে’।[13]

(৩৬) অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকা :

মুমিনের কর্তব্য হ’ল কারা কারো সম্পদ চুরি করবে না; লুটতরাজ, ছিনতাই-ডাকাতি করবে না, সূদ-ঘুষ খাওয়া এবং দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ-

‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না এবং অন্যের সম্পদ গর্হিত পন্থায় গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তোমরা জেনেশুনে তা বিচারকদের নিকট পেশ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৮)। মহান আল্লাহ বলেন, وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ- وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ- ‘দুর্ভোগ মাপে কম দানকারীদের জন্যম যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয় বা ওযন করে দেয়, তখন কম দেয়’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১)। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا-  ‘তোমরা মাপের সময় পূর্ণভাবে মেপে দিবে এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওযন করবে। এটাই উত্তম ও পরিণামে শুভ’ (বানী ইসরাইল ১৭/৩৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম’।[14]

(৩৭) হারাম খাদ্য ও পানীয় পানাহার করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক :

হারাম খাদ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ-

‘তোমাদের উপর হারাম করা হ’ল মৃত, রক্ত, শূকরের মাংস, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গীত পশু, শ্বাসরোধে হত্যা করা পশু, প্রহারে মৃত পশু, পতনে মৃত পশু, শিংয়ের আঘাতে মৃত পশু, হিংস্র জন্তুতে খাওয়া পশু, তবে যা তোমরা যবেহ দ্বারা হালাল করেছ, তা ব্যতীত এবং যে পশু পুজার বেদীতে বলি দেওয়া হয়েছে। আর জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে। কেননা এসবই পাপের কাজ’ (মায়েদাহ ৫/৩)। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ- ‘তুমি  বলে দাও, আমার নিকট যে সকল বিধান অহী করা হয়েছে, সেখানে ভক্ষণকারীর জন্য আমি কোন খাদ্য হারাম পাইনি যা সে ভক্ষণ করে, কেবল মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোশত ব্যতীত। কেননা এগুলি নাপাক বস্ত্ত এবং ঐ প্রাণী ব্যতীত, যা অবাধ্যতাবশে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি ক্ষুধায় কাতর হয়ে বাধ্যগত অবস্থায় (জীবন রক্ষার্থে) তা খায় কোনরূপ আকাংখা ও সীমালংঘন ছাড়াই, (তার ব্যাপারে) আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আনআম ৬/১৪৫)। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ-  إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, বেদী ও শুভাশুভ নির্ণয়ের তীর সমূহ নাপাক ও শয়তানী কাজ। অতএব তোমরা এসব থেকে বিরত থাকো যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো কেবল চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত হ’তে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব এক্ষণে তোমরা নিবৃত্ত হবে কি? (মায়েদাহ ৫/৯০-৯১)। মহান আল্লাহ বলেন, يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ- ‘লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে। তুমি বল যে, এ দু’য়ের মধ্যে বড় পাপ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু উপকার রয়েছে। তবে এ দু’টির পাপ তার উপকার অপেক্ষা গুরুতর। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে কি পরিমাণ ব্যয় করবে? তুমি বল, উদ্বৃত্ত থেকে ব্যয় কর। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াত সমূহ ব্যাখ্যা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা-গবেষণা করতে পার’ (বাক্বারাহ ২/২১৯)। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

‘তুমি বল, নিশ্চয়ই আমার প্রভু প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার অশ্লীলতা হারাম করেছেন এবং হারাম করেছেন সকল প্রকার পাপ ও অন্যায় বাড়াবাড়ি। আর তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না যে বিষয়ে তিনি কোন প্রমাণ নাযিল করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কথা বলো না যে বিষয়ে তোমরা কিছু জানো না’ (রাফ ৭/৩৩)। মহান আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘যারা এই রাসূলের আনুগত্য করে যিনি নিরক্ষর নবী, যার বিষয়ে তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত পেয়েছে। যিনি তাদেরকে ন্যায়ের আদেশ দেন ও অন্যায় থেকে নিষেধ করেন। যিনি তাদের জন্য পবিত্র বিষয় সমূহ হালাল করেন ও নাপাক বিষয় সমূহ নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের উপর থেকে বোঝা ও বন্ধন সমূহ নামিয়ে দেন যা তাদের উপরে ছিল। অতএব যারা তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাকে শত্রু থেকে প্রতিরোধ করেছে ও সাহায্য করেছে এবং সেই জ্যোতির (কুরআনের) অনুসরণ করেছে যা তার সাথে নাযিল হয়েছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (রাফ ৭/১৫৭)। মহান আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির জন্য যে সমস্ত বস্ত্ত হালাল করেছেন সেগুলো তার ইহলেŠকিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্য কল্যাণকর। অনুরূপভাবে তিনি যে সমস্ত বস্ত্ত হারাম করেছেন সেগুলো তার উভয় জীবনে ক্ষতির কারণ (ইবনে কাছীর ৬/৪১৫)

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘বিতা’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেন, সর্বপ্রকার নেশা জাতীয় পানীয় হারাম’।[15] আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘বিতা’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। বিতা হ’ল মধু হ’তে তৈর নাবীয। ইয়ামনের লোকেরা তা পান করত। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে সকল পানীয় যা নেশা সৃষ্টি করে তা হারাম’।[16] ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘সমস্ত নেশা জাতীয় দ্রব্যই মদ। অতএব সমস্ত মদই হারাম’। [17] আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে ব্যক্তি দুনিয়ায় মদ পান করেছে অতঃপর তা থেকে তাওবাহ করেনি, সে আখিরাতে তা থেকে বঞ্চিত থাকবে’। [18]

 আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিন বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে রাতে আমর মি‘রাজ হয়েছিল সে রাতে আমার সম্মুখে দু’টি পেয়ালা আনা হ’ল। তার একটিতে ছিল দুধ আর অপরটিতে ছিল শরাব। তখন জিবরাইল (আঃ) বললেন, এ দু’টির মধ্যে যেটি চান আপনি পান করতে পারেন। আমি দুধের পেয়ালাটি নিলাম এবং তা পান করলাম। তখন বলা হ’ল আপনি-স্বভাব প্রকৃতিকে বেঁছে নিয়েছেন। দেখুন আপনি যদি শরাব নিয়ে নিতেন, তাহ’লে আপনার উম্মতগণ পথভ্রষ্ট হয়ে যেত’।[19] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কোন মদ্যপায়ী মুমিন অবস্থায় মদপান করে না’ [20] 

মানুষের উচিত হবে পবিত্র ও হালাল জিনিস ভক্ষণ করা অপবিত্র ও হারাম জিনিস ভক্ষণ করা থেকে দূরে থাকা। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘হে মানব জাতি! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পবিত্র। তাই তিনি পবিত্র জিনিস ছাড়া (অপবিত্র) গ্রহণ করেন না। আর মহান আল্লাহ সমস্ত মুমিন ব্যক্তিদের (পবিত্র জিনিস ভক্ষণেরই) আদশে করেন যে আদেশটি সমস্ত নবী-রাসূলগণকে করেছিলেন। এ মর্মে আল্লাহর বাণী يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ- ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত হ’তে আহার কর এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, সব বিষয়ে আমি অবগত’ (মুমিনূন ২৩/৫১)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্ত্ত সমূহ ভক্ষণ কর। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তাঁরই দাসত্ব করে থাক’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)। অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন। যে ব্যক্তি দূরে সফরের কারণে তার (কেশ) ধুলায় ধূসরিত, এলোমলো হয়ে আছে এমতাবস্থায় সে তার উভয় হস্তদয় আসমানের দিকে উত্তোলন করে বলছে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপারক! আমার দো‘আ কবুল কর! অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম তার পরিধানের পোষাকটিও হারাম,  সে হারামই খেয়ে থাকে। তাহ’লে এমন ব্যক্তির দো‘আ আল্লাহর নিকট কেমন করে কবূল হবে?’ [21]

 নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, হালাল স্পষ্ট এবং হারাম স্পষ্ট। আর দু’য়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয় যা অনেকেই জানে না। যে ব্যক্তি সেই সন্দেহজনক বিষয় সমূহ হ’তে বেঁচে থাকবে সে তার দ্বীন ও  মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়সমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে তার উদাহরণ সে রাখালের ন্যায় যে তার পশু বাদশাহর সংরক্ষিত চারণভূমির আশেপাশে চরায়, অচিরেই সে পশু গুলি সেখানে ঢুকে পড়ার আশংকা রয়েছে। আরো জেনে রেখ যে আল্লাহর যমীনে তার সংরক্ষিত এলাকা হ’ল তার নিষিদ্ধ কাজসমূহ’।[22] আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নাবী (ছাঃ) বলেন, ‘আমি আমার ঘরে ফিরে যাই আমার বিছানায় খেজুর পড়ে থাকতে দেখি। খাওয়ার জন্য আমি তা তুলে নেই। পরে আমার ভয় হয় যে, হয়ত তা ছাদাক্বার খেজুর হবে তাই আমি তা রেখে দেই’।[23] ইবরাহীম বিন হুশাইম তার সাথীকে বিদায়ের সময় উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘তুমি সৎ আমল কর এবং পবিত্র বস্ত্ত ভক্ষণ কর’ [24]  (ক্রমশঃ)

[লেখক :  লিসান্স ও এম.এ, মদীনা ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, সউদী আরব ]


. আহমাদ হা/১২৪০৬; মিশকাত হা/৩৫।

. বুখারী হা/৩৪; আহমাদ হা/ ৬৭৬৮; মুসলিম হা/৫৮।

. আহমাদ হা/ ৮৬৮৫; বুখারী হা/৩৩; মুসলিম হা/৫৯।

. বুখারী হা/৬৬৯৬; মিশকাত হা/৩৪২৭।

. বুখারী হা/৭৪০৫; আহমাদ হা/৭৪২২; মুসলিম হা/২৬৭৫।

. বুখারী হা/৬০৯৪; আহমাদ হা/৩৭২৭; মুসলিম হা/২৬০৭।

. বুখারী হা/৬০৯৬।

. বুখারী হা/৬৪৭৪; আহমাদ হা/২২৮২৩।

. বুখারী হা/৬৪৭৫; মুসলিম হা/৪৭; আহমাদ হা/৭৬২৬।

১০. আবু দাউদ হা/৩৫৩৫; তিরমিযী হা/১২৬৪; সনদ ছহীহ।

১১. তিরমিযী হা/১৩৯৭; ইবনু মাজাহ হা/২৬১৫; তাফসীর কুরতুবী ৫/৩১৫।

১২. আহমাদ হা/৫৬৮১; বুখারী হা/৬৮৬২।

১৩. বুখারী হা/২৪৭৫; আহমাদ হা/৯০০; মুসলিম হা/৫৭।

১৪. বুখারী হা/৬৭; আহমাদ হা/২০৩৮৭; মুসলিম হা/১৬৭৯।

১৫. বুখারী হা/৫৫৮৫; মুসলিম হা/২০০১।

১৬. আহমাদ হা/২৪৬৫২; বুখারী হা/৫৫৮৬; মুসলিম হা/২০০১।

১৭. আহমাদ হা/৪৮৩০; মুসলিম হা/২০০৩।

১৮. আহমাদ হা/৪৬৯০; বুখারী হা/৫৫৭৫; মুসলিম হা/ ২০০৩।

১৯. আহমাদ হা/৭৭৮৯; বুখারী হা/৩৩৯৪; মুসলিম হা/২০০৯।

২০. আহমাদ হা/৯০০৭; বুখারী হা/২৪৭৫; মুসলিম হা/ ৫৭।

২১. আহমাদ হা/৮৩৪৮; মুসলিম হা/১০১৫ ।

২২. আহমাদ হা/১৮৩৭৪; বুখারী হা/৫২; মুসলিম হা/১৫৯৯।

২৩. আহমাদ হা/৮২০৬; বুখারী হা/২৪৩২; মুসলিম হা/১০৭০।

২৪. ইমাম আব্দুর রহমান গাযবীনী ইমাম বায়হাক্বী মুখতাছার শুআবিল ঈমান পৃঃ ৬৫; বায়হাক্বী শুআবিল ঈমান ৭/৩৯১।

 



বিষয়সমূহ: আমল
আরও