মনুষ্যত্বের ছিন্ন মস্তক

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 1417 বার পঠিত

মানুষ ও মনুষ্যত্ব শব্দ দুটি একে অপরের সাথে দেহ ও আত্মার মত সম্পর্কযুক্ত। আমরা প্রায়শ বলি ‘আগে মানুষ হও’ অথবা বলি ‘আমাদের মানুষের মত মানুষ হতে হবে।’ সমাজে প্রচলিত এই উপদেশ বাণীর অর্থ কী? আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে শুরু করে যুগ যুগ ধরে আমরা যে শারীরিক অবয়ব বহন করছি এবং তা নিয়েই কবরে যাচ্ছি; সেটা কি আমাদের মানুষ হওয়ার পরিচয় বহন করে না? গভীরভাবে চিন্তা করলে বিবেক নামক আদালত আমাদেরকে বিপরীত জবাবটাই দিবে। কারণ মানুষের পরিচয় রক্ত মাংসে গড়া দৈহিক কাঠামোতে নয় বরং মানুষের প্রকৃত পরিচয় তার মনুষ্যত্বে। স্যুট বুট কিংবা আলখেল্লা পরিহিত পরিপাটি প্রত্যেক আদমের দেহ এই পৃথিবীতে মানুষ নামক জীবের অস্তিত্বের আলামত মাত্র। জীবসত্ত্বা থেকে আত্মা বেরিয়ে গেলে যেমন দেহের মূল্য থাকে না তদ্রুপ মানুষের মনুষ্যত্ব লোপ পেলে তাকে আর মানুষ বলা যায় না। তাহলে এখন প্রশ্ন হ’ল মনুষ্যত্ব কী?

মনুষ্যত্বের ইংরেজী শব্দ যেটি লাতিন শব্দ Humanitas থেকে এসেছে, যার অর্থ মানুষের প্রকৃতি, দয়া। ইংরেজী অভিধানের পরিভাষায় ‘The quality or state of being kind to other people or to animals’ অর্থাৎ মনুষ্যত্ব মানুষ অথবা প্রাণীর প্রতি সদয় হওয়ার গুণ। অনুরূপভাবে বাংলা অভিধানে অর্থ করা হয়েছে মানবোচিত গুণ বা বৈশিষ্ট্য, মানুষের থাকা উচিত এমন সদগুণ, মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি।[1]

শব্দটির অর্থের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে মনুষ্যত্ব বলতে ধরা-বাধা নির্দিষ্ট কিছু গুণাবলীকে বুঝায় না। বরং মনুষ্যত্ব এমন কতক প্রকৃতি বা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের সমাহার, যা মানুষের মধ্যে পূর্ব থেকে বিদ্যমান।

যেমন হাদীছে এসেছে, إِنَّ لِلَّهِ مِائَةَ رَحْمَةٍ أَنْزَلَ مِنْهَا رَحْمَةً وَاحِدَةً بَيْنَ الْجِنِّ وَالإِنْسِ وَالْبَهَائِمِ وَالْهَوَامِّ فَبِهَا يَتَعَاطَفُونَ وَبِهَا يَتَرَاحَمُونَ وَبِهَا تَعْطِفُ الْوَحْشُ عَلَى وَلَدِهَا ‘আল্লাহর একশত রহমত রয়েছে, তন্মধ্যে মাত্র একটি তিনি জিন, মানুষ, পশু ও কীট-পতঙ্গের মধ্যে অবতীর্ণ করেছেন। এই একটি রহমত দ্বারাই তারা পরস্পরকে সেণহ করে, এর মাধ্যমেই একে অন্যকে দয়া করে এবং এর মাধ্যমেই বন্য প্রাণীরা তাদের সন্তানদেরকে ভালোবাসে।[2] দয়া-মমতার স্বভাবজাত এই গুণটি আল্লাহ মানুষ ও পশুর মধ্যে জন্মলগ্ন থেকেই দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মানুষ ও পশুর মধ্যে তেমন কোন ফারাক থাকছে না। কিন্তু বিবেক নামক আরো একটি গুণ মানুষকে জন্মলগ্ন থেকেই দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, ন্যায়-অন্যায় বুঝার বোধশক্তি জাগ্রত করতে সক্ষম। এখানে এসে মানুষ ও পশুর মধ্যে মানবোচিত গুণের বিস্তর ফারাক হওয়ায় মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যখন মানুষের মধ্য হতে স্রষ্টা প্রদত্ত স্বভাবজাত মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ তথা বিবেকবোধ নষ্ট হয়ে যায়, ঠিক তখনই মানুষ ও পশুর মধ্যে থাকা পার্থক্যের সীমানা প্রাচীরটি ভেঙ্গে পড়ে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব তখন পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়। আসুন নিম্নে তার কয়েকটি উদাহরণ দেখি।

ঘটনা- ১ : ইয়াসিন মোল্লা মারা গেছেন দুপুরে। দুপুর গড়িয়ে রাত পেরিয়ে পরদিন দুপুর তবুও নিথর দেহটা ঠায় পড়ে আছে। বাবার লাশ ফেলে রেখে ৬০ শতক জমি নিয়ে ঝগড়া করছে ইয়াসীন মোল্লার ছেলেরা। পাঁচ সন্তানের জনক প্রায় নববই বছর বয়সী এই বৃদ্ধ জমি-জমার বিরোধের কারণে মৃত্যুর পূর্বেও সন্তানদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। রক্ত-ঘাম এক করে বড় আদরে যাদের লালন পালন করলেন, মৃত্যুর পরেও তাদের কাছ থেকে পেলেন না ন্যূনতম সহমর্মিতা।

ঘটনা-২ : মেয়ে-জামাই বাড়ি আসলে খুশি হয় না কোন বাবা-মা? সানন্দে সক্ষমতা অনুযায়ী প্রত্যেক পরিবারই মেয়ে জামাইয়ের জন্য সর্বোত্তম মেহমানদারি করেন। কিন্তু সে মেয়ে জামাই মাসুদ রানার জীবনের জন্য কাল হল। নিজের মেয়েই ঘুমের ওষধ দিয়ে অচেতন করে বাবা, মা ও ছোট বোনকে শ^াসরোধ করে হত্যা করে। হত্যার পর পুলিশকে ফোন করে বলে ‘তিনটা খুন করেছি, তাড়াতাড়ি আসেন নাহলে আরো ২ জনকে খুন করবো!’

ঘটনা- ৩ : ঢাকার বংশালের স্থানীয় বাসিন্দা সুলতান। যেমন নাম তেমন তার প্রভাব। ফেইসবুকে ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা যায়, বাবার বয়সি এক রিকশাচালক বৃদ্ধকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে এবং উপর্যুপরি থাপ্পড় মারছে। থাপ্পড়ের আঘাত সহ্য করতে না পেরে বৃদ্ধ তৎক্ষনাৎ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তবুও এ নরপশুর পাশবিক আচরণ থামে নি।

ঘটনা- ৪ : তিন সন্তানের জননী শাহনাজ লুকিয়ে পরকীয়া করেন। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয় না তার। পরকীয়া প্রেমিকও একাধিক সম্পর্কে জড়িত। সেটা নিয়েই ঝগড়ার জেরে এক পর্যায়ে প্রেমিককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। পাটার উপর হাত-পা রেখে ছুরিতে শিল পাথর দিয়ে আঘাত করে বিচ্ছিন্ন করে অঙ্গ। অতঃপর পাঁচ টুকরো সেই লাশকে থরে থরে সাজিয়ে ভাবলেশহীন হৃদয়ে বসে আছেন। আহ কী বিভৎস সে দৃশ্য!

উপরোক্ত ঘটনাগুলি আজকের সভ্য সমাজের সাধারণ চিত্র। দিন যায় দিন আসে ঘটনার ঘনঘটা চলতে থাকে। এক ঘটনার নিচে চাপা পড়ে ডুকরে কাঁদে আরেক ঘটনা। করোনায় মৃত স্বজনকে ফেলে রেখে পালানোর ঘটনা এখন আর আমাদের বিস্মিত করছে না। ধর্ষণের খবরবিহীন একদিনও সূর্য হয়ত সকালে উঠে না। প্রেমে ব্যর্থ, সংসারে টানাপোড়ন কিংবা ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায় আত্মহত্যাই যেন একমাত্র মুক্তি। নিজ স্ত্রীকে খুন করে মরদেহ নিয়ে ফেইসবুক লাইভে স্বামীর উচ্ছ্বাস, কুপিয়ে যখম করে অস্ত্র হাতে হিন্দী গানের সাথে ফেইসবুকে লুঙ্গি ড্যান্সের ভিডিও প্রকাশ মনুষ্যত্বের কোন প্রকারের মধ্যে পড়ে? খবরের কাগজের শিরোনামে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রীর আত্মহত্যার নেপথ্যে বেরিয়ে আসছে আপত্তিকর টিকটক ভিডিও। টিকটক, লাইকি প্রভৃতি এ্যাপসের মাধ্যমে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা সস্তা জনপ্রিয়তা পেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে। টিকটকার ‘অপু ভাই’ কিংবা ‘হৃদয় বাবু’ গ্রেফতার না হ’লে এ অন্ধকার জগতের কথা হয়ত অজানাই থেকে যেত। মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, নারী পাচারসহ কোন অপরাধ করে নি তারা? অপরদিকে ফ্রী ফায়ার, পাবজিসহ বিভিন্ন কিসিমের অনলাইন গেমসের নেশা কোমলমতি শিশুদের পর্যন্ত খুন করতে উদ্যত করছে। সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সামাজিক অবক্ষয় কিশোর গ্যাং। নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য চালাতে গিয়ে চুন থেকে পান খসলেই খুন করা যেন তাদের নেশা। কখনো সিগারেট খাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে, কখনো কথিত বড় ভাইকে সালাম না দেওয়ায়, কখনো রাস্তায় জমে থাকা পানির ছিটা গায়ে লাগায় আবার কখনোবা মাদকের টাকা ভাগাভাগির জেরে খোদ গ্যাং লিডারই খুন হচ্ছে সহযাত্রীর হাতে। শুধু রাজধানীতে এ ধরনের ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৭৮টি, যার সদস্য সংখ্যা ২ হাজারের বেশী। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পালিত এ সমস্ত গ্যাং গ্রুপের রয়েছে কিম্ভুতকিমাকার নাম। যেমন- মাইরা-লা, কানা জসিম গ্রুপ, লাড়া-দে, চিনে ল, কোপাইয়া দে, বাঁধন গ্রুপ, পলক গ্রুপ, গাংচিল, চেতাইলেই ভেজাল, দ্যা কিং অব গাইরালা, বগা হৃদয়, জলন্ত মিলন গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ ইত্যাদি।[3] কথায় আছে বৃক্ষ তোমার নাম কি- ফলে পরিচয়। উপরোক্ত নামগুলোই বলে দিচ্ছে এসব বিষবৃক্ষ কি ফল দিতে পারে! প্রাত্যহিক জীবনে লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, উগ্রতা, স্বার্থপরতা, ক্রোধ মানুষের বিবেকের উজ্জীবনী ক্ষমতাকে ধ্বংস করছে। হতাশার চাদরে আবৃত অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে নিজ পরিবারই মানুষের কাছে আশার প্রদীপ ও নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু পরিবার নামক বটবৃক্ষের ছায়াকে পৃথিবীর একমাত্র নিরাপদস্থল মনে করা হলেও সেখানে আজ বিদ্রোহের আগুন জ্বলজ্বল করছে। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব কিংবা প্রতিবেশী কেউ কারো কাছে নিরাপদ নয়। সমাজে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হতে থাকা রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, গুম-খুন, সুদ-ঘুষ, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি অর্থ লোপাট, ইভটিজিং, অপহরণ, প্রতারণা মানুষের অন্তরাত্মা থেকে আদব-আখলাক, শৃঙ্খলাবোধ, স্নেহ-ভালোবাসা, সততা-বিনয়, উদারতা, সহযোগিতা বা সহমর্মিতার গুণাবলী কেড়ে নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে আজ ভাগাড়ে পড়ে থাকা মানবাকৃতির রক্তাক্ত ছিন্ন মস্তকটা প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্বের ছিন্ন মস্তক। জন্মদাতা পিতার হাতে খুন হওয়া ছিন্নভিন্ন নিষ্পাপ শিশুর নিস্তব্ধ দেহটা যেন সেই শিশুর নয় বরং মনুষ্যত্বের মৃতদেহ! তাইতো নৈতিক কবি শেখ সা‘দী কবিতায় লিখেছেন-

تن آدمی شریف است بہ جان آدمیت

نہ ہمین لباس زیباست نشان آدمیت

حقیقت آدمی باش وگرنہ مرغ باشد

کہ ہمین سخن بگوید بہ زبان آدمیت

মনুষ্যত্বের আত্মা বহনকারী হে মানবজাতি 

পোশাকের উজ্জ্বলতায় মেলে না মহত্ত্ব বা খ্যাতি

প্রকৃত মানুষ হও নতুবা এ দেহ পাখির মত

 যার কথামালাও ফুটে উঠে মানবের মত।

প্রিয় পাঠক, স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রীক বর্বর মানুষগুলোর এহেন অমানবিক নিষ্ঠুরতা একদিনে গড়ে উঠেনি। দিনে দিনে ইসলামের নীতি-আদর্শ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসানোর দরুন আমাদের হৃদয় থেকে মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত হয়ে পশু প্রবৃত্তি স্থান করে নিচ্ছে।

সেজন্য মহান আল্লাহ তা‘আলা আশরাফুল মাখলুকাত খেতাব কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পশুর সাথে তুলনা করে বলেনأَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا- أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا- ‘আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন? নাকি আপনি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বোঝে? তারা তো পশুর মতই; বরং তারা আরও অধিক পথভ্রষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩-৪৪)

সুতরাং মনুষ্যত্ব জাগ্রত করার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই ইসলামের কাছে ফিরে আসতে হবে। সে ইসলামের কাছে, যে ইসলাম পিপাসিত চতুষ্পদ জন্তু বিড়ালের প্রতি দয়া দেখানোর জন্য পতিতাকে জান্নাতী ঘোষণা করে। শুধুমাত্র অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হওয়ার দরুণ অনুতপ্ত ১০০ খুনের আসামীকে ক্ষমা করে। হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.)- এর বুক ফেড়ে কলিজা চিবানোর মত ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য বর্বর মনুষ্যত্বহীনতার পরিচয়দানকারী মহিলাকেও ক্ষমা করে। সে ইসলামের নবী মনুষ্যত্বের মূর্ত প্রতীক মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেন, الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ ‘মুসলমান সে ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ হতে অন্যরা নিরাপদ থাকে।[4]

তিনি আরো বলেন, الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِى حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। তার উপর যুলুম করবে না এবং তাকে যালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দুর করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন’।[5]

ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে আসোনি। আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে খাবার দাওনি। তোমার কাছে আমি পানি পান করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে পান করাও নি। মানুষ বলবে, হে প্রভু! কিভাবে আমি আপনাকে দেখতে যাব, খাবার দিব, পানি পান করাবো; আপনি তো সারা জাহানের প্রভু? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ, পিপাসার্ত, ক্ষুধার্ত ছিল? তাদের যদি দেখতে যেতে, খাবার, পানি দিতে তাহলে সেখানে আমাকেই পেতে’।[6]

যদি উপরোক্ত হাদীছগুলোর প্রকৃত মর্মার্থ আমরা উপলব্ধি করতে পারি তাহলে আমরা মরে গেলেও আমাদের মনুষ্যত্ব বেঁচে থাকবে। দ্বিতীয়ত প্রকৃত শিক্ষা ও সুশৃঙ্খল সমাজ মনুষ্যত্ব বিকাশের অন্যতম মাধ্যম। সমাজের অরাজকতা ও মানুষের নৈতিকতা ধ্বংসের একমাত্র কারণ প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া। আজ হয়ত শিক্ষিত মানুষের হার বেড়েছে কিন্তু শিক্ষিত মানুষ বাড়ে নি। তাইতো প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, ‘কোনো ভারী জিনিসকে ওপরে তুলতে হলে তাকে নিচের থেকে ঠেলতে হয়, আবার ওপর থেকে টানতেও হয়; শুধু নিচের থেকে ঠেললে তাকে আশানুরূপ ওপরে ওঠানো যায় না। মানব উন্নয়নের ব্যাপারে শিক্ষা সেই ওপর থেকে টানা, আর সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা নিচের থেকে ঠেলা। অনেকে মিলে খুব জোরে ওপরের থেকে টানলে নিচের ঠেলা ছাড়াও কোনো জিনিস ওপরে ওঠানো যায় কিন্তু শুধু নিচের ঠেলায় বেশীদূর ওঠানো যায় না। তেমনি আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার দ্বারাই জীবনের উন্নয়ন সম্ভব, কিন্তু শুধু সমাজ ব্যবস্থার সুশৃঙ্খলতার দ্বারা তা সম্ভব নয়’[7]

সুতরাং পরিশেষে বলবো, বর্তমান যান্ত্রিক প্রযুক্তির যুগে আমাদের অনুজরা প্রযুক্তির ব্যবহারে হয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে কিন্তু চারিত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। ফলে মনুষ্যত্ব বিবর্জিত এমন এক জাতি আমরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি যাদের দ্বারা কখনো সোনালী অতীত ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই সমাজ, মানুষ ও মনুষ্যত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় ওহীর আলোয় আলোকিত হয়ে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। নিজের মধ্যে দ্বীনী মূল্যোবোধকে জাগ্রত রাখা, মূল্যোবোধের চর্চাকে নিজের জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া। আল্লাহ আমাদের সকলকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন। 

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ, সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


[1]. সংসদ বাংলা অভিধান, চতুর্থ সংস্করণ, পৃ : ৫৫৮; সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমি), জানুয়ারী ২০১০ পুনর্মূদ্রণ, পৃ : ৪৪৮; আধুনিক বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমি), এপ্রিল ২০১৬ সংস্করণ, পৃ : ১০৭৭

[2]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৩৬৫

[3]. দৈনিক যুগান্তর, ২০ জুন ২০২১, পৃঃ ১০, কলাম ৫।

[4]. বুখারী হা/ ১০।

[5]. বুখারী হা/ ২৪৪২।

[6]. মুসলিম হা/ ২৫৬৯, আহমাদ হা/ ৮৯৮৯।

[7]. মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য, নবম-দশম শ্রেণী, সংস্করণ- ২০১৮, পৃঃ ৮৮।



আরও