সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা

ড. নূরুল ইসলাম 7620 বার পঠিত

একজন সভ্য মানুষের জীবন মানে বিশ্বাস ও মূল্যবোধের থাকে সুসমন্বয়। মানুষ যা বিশ্বাস করে, যা অন্তরের গহীনে লালন করে, তা-ই মূল্যবোধ আকারে প্রকাশ পায়। ইসলাম যেমন স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করেছে, ঠিক তেমনি মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্যও নির্ধারণ করে দিয়েছে। মানবসত্তার অন্তর্নিহিত মর্যাদাকে যথাযথ মূল্য দেয়ার মাধ্যমেই এই সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মূল্যবোধের জন্ম হয়। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে অধিনস্ত কর্মচারী, প্রতিবেশী, মেহমান, পথচারী, গরীব-দুখী প্রভৃতি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রতি আলাদাভাবে কর্তব্য নির্ধারণ করেছে ইসলাম। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সদ্ব্যবহার কর তোমাদের পিতা-মাতা, আত্মীয়-পরিজন, ইয়াতীম, মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির ও দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী ও গর্বিতজনকে ভালবাসেন না’ (নিসা ৪/৩৬)। এই আয়াতে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি সামাজিক সম্পর্কের কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করে তার প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্য যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, ইসলামে সামাজিক দায়িত্ববোধের স্থান অতীব প্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ।

একটি সমাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যেমন আইন-আদালত ও প্রশাসনের নিত্য প্রয়োজন পড়ে; তেমনি প্রয়োজন হয় ব্যক্তিমানুষের মূল্যবোধের চর্চার। সামাজিক রীতিনীতি ও আচরণবিধির জন্ম হয় এই মূল্যবোধের জায়গা থেকেই। উত্তম আচরণ, সৌজন্যবোধ, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, ক্ষমাপরায়ণতা, সহানুভূতি, পরোপকার, ভাল-মন্দ বাছবিচার, দানশীলতা, মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসা, নিজের এবং অপরের অধিকারের প্রতি সচেতনতা, শৃংখলাবোধ, কারো কোন প্রকার ক্ষতি না করা, মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি লক্ষ্য রাখা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা ইত্যাদি মানবজাতির এমন অত্যাবশ্যক কিছু আচরণবিধি, যার উপস্থিতি একটি সমাজকে কল্যাণময় মানবীয় সমাজে পরিণত করে। বিনির্মাণ করে সভ্যতার সুরম্য প্রাসাদ। অপরদিকে এর অনুপস্থিতিতে সৃষ্টি হয় সামাজিক অবক্ষয়ের। 

একটি সমাজ সুরক্ষায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও প্রশাসন নিয়ামক শক্তি হলেও জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া তা কখনই সফল হয় না। যে সকল দেশকে উন্নত দেশ হিসাবে দেখা হয়, সেসব দেশে সরকারের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতাই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আধুনিক মুসলিম সমাজের দিকে তাকালে মোটাদাগে যে সমস্যাগুলো চোখে ধরা পড়ে, তার একটা বড় অংশেরই উদ্ভব ঘটেছে সামাজিক মূল্যবোধ চর্চার ঘাটতি থেকে। বিশ্বাসে ও সংস্কৃতিতে শ্রেষ্ঠ উম্মত হলেও, সেই বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটানোয় আমাদের যে বিরাট গাফলতি ও ঘাটতি রয়েছে, তা স্বতঃসিদ্ধ এবং প্রমাণিত। পাশ্চাত্য বিশ্ব এবং মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আজ সভ্যতার সূচকে যে আনুপাতিক ব্যবধান তৈরী হয়েছে, তার জন্য বহুলাংশে দায়ী হল বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রবল অভাব। ১৮৮১ সালে প্যারিস সম্মেলন থেকে ফিরে মুফতী মুহাম্মাদ আবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫ খৃ.) মুসলিম জাতির এই দুর্দশার দিকে ইঙ্গিত করে বেদনার্ত কণ্ঠে যথার্থই বলেছিলেন, ذهبت للغرب، فوجدت إسلاما، ولم أجد مسلمين، ولما عدت للشرق، وجدت مسلمين، ولكن لم أجد إسلاما  ‘আমি পশ্চিমে গেলাম, সেখানে পেলাম ইসলাম, কিন্তু মুসলমান পেলাম না; আবার যখন প্রাচ্যে ফিরলাম, তখন মুসলমান পেলাম কিন্তু ইসলাম পেলাম না’। পাশ্চাত্য বিশ্ব তাদের সমাজে অভ্যন্তরীণ শৃংখলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে সভ্যতার মাপকাঠিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অপরপক্ষে মুসলিম বিশ্ব ধর্মীয় চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব ও চেতনাবোধের প্রকট দুর্বলতার কারণে প্রায় সর্বত্রই বিশৃংখলা ও পশ্চাদগামিতার স্রোতে খাবি খাচ্ছে। আমরা আদর্শের কথা বলি, কিন্তু তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করি না। সততার দাবী করি, কিন্তু নিজেকে অসততা থেকে বের করে আনতে পারি না। মানুষের কাছে বিশ্বস্ততা কামনা করি, অথচ নিজে বিশ্বস্ত হ’তে পারি না। অপরের কাছ থেকে ন্যায়ের প্রত্যাশা করি, কিন্তু নিজে ন্যায়পরায়ণ হ’তে পারি না। অপরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নছীহত করি, অথচ নিজে ঘর কিংবা গাড়ির জানালা থেকে টুপ করে ময়লা নিক্ষেপ করতে কিংবা যত্রতত্র থুথু ও সিগারেট নিক্ষেপ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করি না। কি অশিক্ষিত, কি শিক্ষিত, প্রত্যেকেই আমরা কমবেশী এই দ্বিচারিতার মধ্যে ডুবে আছি। ফলে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শবাদী সমাজ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম সমাজ আধুনিক বিশ্বে পশ্চাৎপদ সমাজ হিসাবেই পরিগণিত।

আশার কথা হ’ল, আধুনিক মুসলিম যুবসমাজ এখন বেশ সচেতন হয়ে উঠছে। তারা এই পশ্চাৎপদতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম সমাজকে কথায়-কাজে, চলনে-বলনে একটি সুসভ্য সমাজ হিসাবে গড়ে তোলার তাকীদ অনুভব করছে। তারা চেষ্টা করছে একটু একটু করে মানুষের মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে। নিঃসন্দেহে এ কাজ কঠিন। তবুও শক্ত হাতে সকল বাধা পেরিয়ে যাবার হিম্মত নিয়ে যদি এগিয়ে যাওয়া যায়, তবে এই প্রয়াস অবশ্যই একদিন সফলতার মুখ দেখবে ইনশাআল্লাহ। তরুণ সমাজের প্রতি তাই আমাদের আহবান, আসুন! সামাজিক মূল্যবোধ চর্চায় আমরা নিজেরা যত্নবান হই এবং মানুষের মাঝে সততা, কল্যাণ ও ন্যায়ের বার্তাগুলো সাধ্যমত ছড়িয়ে দেই। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সাহায্যার্থে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। নিদেনপক্ষে কেবল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং পরিবেশ রক্ষার মত অতি সাধারণ বিষয়গুলোতেও যদি গণজাগরণ তৈরী করা যায়, তবুও সমাজে কার্যকর ও টেকসই পরিবর্তন আসতে খুব বেশী সময় লাগার কথা নয়। সর্বোপরি এর মাধ্যমে আল্লাহ রববুল আলামীন দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের অবস্থানকে অনেক উঁচু করবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!



বিষয়সমূহ: সম্পাদকীয়
আরও