আহলেহাদীছ আন্দোলন : বিদ‘আতীদের উত্থান যুগে
ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 542 বার পঠিত
আধুনিক যুগ : ৩য় পর্যায় (খ)
নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী
নওয়াব ছাহেবের ‘মাসলাক’ সম্পর্কে কিছু কথা ঃ
নওয়াব ছাহেব নিজ যবানীতেই নিজেকে ‘মশহুর আহলেহাদীছ’ বলা সত্ত্বেও হিংসুকেরা তাঁর প্রসিদ্ধিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে মোটেই চেষ্টার ত্রুটি করেনি। দুর্ভাগ্যজনক সত্য এই যে, একাজে স্বয়ং তাঁর ছেলে নওয়াব আলী হাসান খানকে ব্যবহার করা হয়েছে। নিজ নওয়াবী স্বার্থে হৌক বা সভাসদ ও প্রজাদের মনরক্ষার জন্যই হৌক তিনি তাঁর পিতার জীবনীতে বহু বে-দলীল ও অসংলগ্ন কথার অবতারণা করেছেন বলে কথিত আছে- যা পরীক্ষায় ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। যেমন স্বীয় পিতা সম্পর্কে একস্থানে বলছেন- ‘তিনি খালেছ সুন্নী, মুহাম্মাদী, মুওয়াহ্হিদ, কিতাব ও সুন্নাতের অনুসারী, হানাফী ও নকশা্বন্দী ছিলেন। সর্বদা হানাফী মাযহাবের দিকে নিজেকে সম্পর্কিত করতেন। কিন্তু আমল ও আক্বীদায় সর্বদা ইত্তেবায়ে সুন্নাতকে অগ্রাধিকার দিতেন’।[1]
অন্যত্র তিনি বলেন- ‘মাননীয় ওয়ালাজাহ মরহুম পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত সর্বদা হানাফী তরীকায় আদায় করতেন। অবশ্য ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ এবং আউয়াল ওয়াক্তের প্রতি তিনি সর্বদা নযর রাখতেন’।[2]
উপরোক্ত অভিযোগ দু’টির মধ্যে প্রথমটির জওয়াব ইতিপূর্বে নওয়াব ছাহেবের আত্মজীবনীতে আমরা দেখে এসেছি। যেখানে তিনি নিজেকে একজন ‘মশহুর আহলেহাদীছ’ বলে অভিহিত করেছেন।[3] দ্বিতীয় প্রশ্নের জওয়াবের জন্য নওয়াব ছাহেব লিখিত ‘ছালাত শিক্ষা’ (ةعليم الصلوة) বইটিই যথেষ্ট। ২০ পৃষ্ঠার এই ছোট্ট পুস্তিকাটি তিনি মৃত্যুর মাত্র দু’বছর পূর্বে ১৩০৫ হিজরীর ৪ঠা জমাদিউছ ছানী তারিখে কয়েক ঘন্টায় লেখেন। নওয়াব ছাহেবের প্রণীত বইয়ের তালিকার মধ্যে পুত্র ও জীবনীকার নওয়াব আলী হাসান খান উক্ত বইটির নাম ও উল্লেখ করেছেন। উক্ত পুস্তিকায় ‘ছালাতের পদ্ধতি’(نماز کي ترکيب)
শীর্ষক আলোচনায় নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান বলেন-[4]
‘নিয়ত ছাড়া ছালাত শুদ্ধ হয়না। ছালাতের সকল হুকুম ফরয। কিন্তু মধ্যখানের তাশাহ্হুদ, জালাসায়ে ইস্তিরাহাত এবং ছালাতের মধ্যকার যিক্র ও দো‘আ সমূহের কোনটাই ওয়াজিব নয়। অবশ্য তাকবীরে তাহরীমা, মুক্তাদী হলেও সকল রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ, শেষের তাশাহ্হুদ ও সালাম ফিরানো- এই চারটি যিক্র ফরয। এতদ্বতীত আর যা কিছু আছে, সবই সুন্নাত। যেমন তাকবীরে তাহরীমার সময়ে, রুকুতে যাওয়াকালীন রুকু হ’তে উঠাকালীন ও তৃতীয় রাক‘আতে দন্ডায়মান হওয়াকালীন সময়ে মোট চার জায়গায় হস্ত উত্তোলন (রাফঊল ইয়াদায়েন) করা, ছালাতে দাঁড়াবার সময়ে হাত বাঁধা, তাকবীরে তাহরীমার পরে ছানা পড়া ইত্যাদি। ছানার জন্য সর্বাপেক্ষা ছহীহ ও মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ দো‘আ হল- ‘আল্লাহুমা বাইদ বায়নী ..................’। এতদ্ব্যতীত আ‘ঊযুবিল্লাহ, তারপর বিস্মিল্লাহ তারপর সূরায়ে ফাতিহা এবং শেষে সশব্দে ‘আমীন’ বলা সুন্নাত। ‘আমীন’ ইমাম ও মুক্তাদী ও উভয়েরই বলা চাই। সশব্দে ‘আমীন’ বলার রেওয়ায়াত নিঃশব্দে ‘আমীন’ বলার রেওয়ায়াতের মুকাবিলায় অধিকতর ছহীহ ও শক্তিশালী। অমনিভাবে সুন্নাত হ’ল সূরায়ে ফাতিহার সংগে অন্য একটি সূরা পাঠ করা, ...... মধ্যবর্তী তাশাহ্হুদ ..... এবং ঐ সকল দো‘আ যা প্রত্যেক রুকন-এর মধ্যে রয়েছে। যেমন রুকূ‘, সিজদা, ক্বওমা ও বৈঠকের দো‘আসমূহ। অতঃর শেষ তাশাহ্হুদের পরে দো‘আয়ে মাছূরাহ্ বা তার বাইরের যে কোন দো‘আর মাধ্যমে প্রার্থনা করবে। উক্ত বর্ণনার পরে ‘ফায়েদা’ শিরোনামে নওয়াব ছাহেব ঐ সকল হাদীছের প্রতিটি রুকন ধীরে ধীরে আদায় করা, তাওয়াররুক অর্থাৎ শেষ বৈঠকে বাম পা ডান পায়ের নীচে দিয়ে বের করে নিতম্বের উপরে ভর দিয়ে বসা ইত্যাতাদির উল্লেখ রয়েছে। অতঃপর তিনি বলেন- ‘এখন উচিত যে কোন ছালাত আদায়কারী যেন উপরোক্ত পদ্ধতি অতিক্রম না করে। তা করলে তার ছালাত ত্রুটি থেকে যাবে’।[5]
উপরের বক্তব্য থেকে নওয়াব ছাহেবের মুকাল্লিদ হওয়ার কোন যুক্তি দাঁড় করানো যায় না, বরং তিনি একজন খাঁটি আহলেহাদীছ ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রমাণিত হন।
আল্লামা সৈয়দ ছিদ্দীক হাসান খান প্রথমদিকে আশ‘আরী মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত তাফসীর ‘ফাৎহুল বায়ান’-কে এ ব্যাপারে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপনা করা যেতে পারে। কিন্তু ১২৮৫/১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে হজ্জ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলে সেখানকার খ্যাতনামা আলেমদের সঙ্গে তাঁর মতবিনিময় হয়। বিশেষ করে আল্লামা হামাদ বিন আতীক্ব (মৃঃ ১৩০১/১৮৮৩ খৃঃ) তাঁকে নছীহত করে মূল্যবান একটি পত্র লিখেন। যেখানে তিনি তাঁকে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮/১২৬২-১৩২৮) ও হাফেয ইবনুল কাইয়িম (৬৯১-৭৫১ হিঃ/ ১২৮৯-১৩৫০ খৃঃ)-এর আকীদা সংক্রান্ত কিতাবসমূহ অধ্যয়নের অনুরোধ করেন। দেখা গেল চার বছর পরে ১২৮৯/১৮৭২ সালে আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান তাঁর পূর্বের আক্বীদা পরিবর্তন করে এতদ সংক্রান্ত তাঁর জীবনের শেষ রচনা ‘ক্বাৎফুছ ছামার’ (قطف الثمر في عقيدة أهل الاثر) নামক বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশ করেন।[6] আহলেহদীছের আক্বীদার উপরে গ্রন্থটিকে একটি প্রামাণ্য দলীল হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে।
আহলেহাদীছ আন্দোলনে তাঁর অবদান :
আল্লামা ছিদ্দীক হাসান যখন তাঁর ইলমের জ্যোতি বিকীরণ শরু করেন, তখন তাঁর সময়কার ভারতবর্ষে মুসলমানদের ধর্মীয় অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হিন্দুস্থানে দুই মাযহাবের মুসলমান ছিল- শী‘আ ও হানাফী। শী‘আদের রাজত্বকালে দুনিয়ার লোভে বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি শী‘আ হয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা আমার পিতাকে খালেছ সুন্নী ও মুহাম্মাদী বানিয়েছেন। এই দেশে আহলেহাদীছ খুব কম হয়েছেন। কিছু সংখ্যক বিদ্বান যারা সুন্নাতের পাবন্দ ছিলেন... তাঁরা অবস্থার প্রেক্ষিতে ফিক্হের আড়ালে (متستر بالفقه) মুখ লুকিয়েছেন। শায়খ আব্দুল হক দেহলভী (৯৫৮-১০৫২/১৫৫১-১৬৪২) মুহাদ্দিছ হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু হানাফী মাযহাবের সমর্থনে লিখেছেন (محرر مذهب أبي حنيفه) ।... শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) স্বীয় কিতাবসমূহে রায় ও তাকলীদ হ’তে নিষেধ করেন এবং ইত্তেবায়ে সুন্নাতের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন। .... তাঁর পরে শাহ ইসমাঈল (রহঃ)-এর সময়ে লোকদের মধ্যে তাকলীদের ঝগড়া শরু হয়। ঝগড়া শেষ না হ’তেই শাহ শহীদের সৌভাগ্যমন্ডিত যামানা অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এই সময়ের পরে যখন আর কোন যোগ্য আলেম নেই, যারা ফিক্হের উপরে পূর্ণ আয়ত্ত রাখেন’।[7]
নওয়াব ছিদ্দীক হাসানের সময়ে (১৮৩২-৯০ খৃঃ) ভারতবর্ষে হাদীছের রেওয়াজ ছিল খুব কম। রায়, কিয়াস ও মাযহাবী ফিক্হের রেওয়াজ ছিল বেশী। রাজ দরবার হ’তে পর্ণ কুটীর পর্যন্ত সর্বত্র ছিল একই অবস্থা। এমনকি ভারতগুরু শাহ আব্দুল আযীযের (১১৫৯-১২৩৯ হিঃ/ ১৭৪৬-১৮২৪ খৃঃ) দরসগাহে মাত্র দু’খানা বুখারী শরীফ ছিল। যার বিভিন্ন পারা খন্ড খন্ড করে ছাত্রদের মধ্যে বিলি করা হ’ত এবং পাঠশেষে ফিরিয়ে নেওয়া হ’ত।[8]
তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ হাদীছ শিক্ষাকেন্দ্রের অবস্থা যদি এই হয়, তাহ’লে ভারতের অন্যান্য স্থানের অবস্থা সহজইে অনুমান করা চলে।
সর্বত্র মাযহাবী ফিক্হের রেওয়াজ থাকার কারণে মুসলমানগণ স্বাভাবিকভাবেই নির্দিষ্ট একটি মাযহাবের অনুসারী মুকাল্লিদ হিসাবে পরিগণিত হন। ফলে মাযহাববিরোধী কোন বক্তব্য তা যতই ছহীহ দলীলভিত্তিক হৌক না কেন, তা মেনে নিতে সমাজ প্রস্ত্তত ছিল না। তাই সেই সময়কার মুললিম সমাজকে এক কথায় ‘তাকলীদী সমাজ’ বলা চলে।
মাযহাবী ফিক্হভিত্তিক যা ছিল তা-ও ছিল বিকৃত। ফিক্হগ্রন্থে নেই এমন বহু কিছু মাযহাবের নামে চালু হয় এবং শিরক ও বিদ‘আত ব্যাপকভাবে মুসলিম সমাজকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। নওয়াব ছাহেবের ভাষায় ‘হিন্দুস্থানী মুসলমানদের মধ্যে শিরক ও বিদ‘আতের প্রচলন ছিল। আর যারা সুন্নী ছিল তারা ছিল গোরপূজারী ও পীরপূজারী’।[9]
শী‘আ দাদা ও মুহাম্মাদ পিতার ঘরে লালিত পালিত হয়ে আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান কর্মজীবনে চরম বিদ‘আত অধ্যুষিত ভূপাল শহরে দীর্ঘ ৩৭ বৎসরের জীবনে অত্যন্ত কঠিন বিরোধী ও শক্রতামূলক পরিবেশ অতিক্রম করেন। প্রচলিত মাযহাবী ইসলামের তিনি বিরোধিতা করেন। শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাকলীদের বন্ধনমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছের অনুসরণে ব্রতী হন ও লেখনী ধারণ করেন। সকল অবস্থাতেই তিনি নিজস্ব ইল্মের আলোকে স্বাধীনভাবে পথ চলেছেন। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণের পথে সকল বাধাকে তিনি হাসিমুখে বরণ করেছেন। কোন বাধাই তাঁকে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর মানদন্ড হতে বিচ্যুত করতে পারেনি।
যেহেতু সমাজ তাঁর সম্পূর্ণ বিরোধী, তাই তিনি শাহ অলিউল্লাহ (১১১৪-১১৭৬/১৭০৩-১৭৬২)-এর মত লেখনীর মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের পথ বেছে নেন। যদিও এপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। অতঃপর এভাবেই ভারতবর্ষে ‘ফিক্হুল মাযহাব’ -এর বদলে ‘ফিক্হুল হাদীছ’-এর প্রচলন হয়, যদিও শাহ অলিউল্লাহ্ ও শাহ ইসমাঈল শহীদের হাতে আগেই এর প্রবর্তন ঘটেছিল। আল্লামা ছিদ্দীক হাসান স্বীয় আত্মজীবনীতে বলেন, আমার হাতে ‘ফিক্হে সুন্নাত’-এর কিতাবসমূহের রেওয়াজ ঘটে এবং আরবী, ফারসী উর্দূ তিন ভাষায় আরব-আজমের সর্বত্র পৌছে যায়’।[10]
(চলবে)
[বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ.ডি থিসিস) শীর্ষক গ্রন্থ পৃঃ ৩৪৮-৩৫২)]
[1]. মাওলানা নাযীর আহমাদ আমলুবী রহমানী, ‘আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত’ (বেনারসঃ জামে‘আ সালাফিইয়াহ ২য় সংস্করণ, ১৯৮৬ খৃঃ) পৃঃ ১৬৯; গৃহীতঃ সীরাতে ওয়ালাজাহী ৪র্থ খন্ড পৃঃ ১।
[2]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৯; গৃহীতঃ পূর্বোক্ত ৪র্থ খন্ড পৃঃ ৬৩।
[3]. ‘ইবকাউল মিনার’ পৃঃ ২৯০; ‘আহলেহাদীছ আওর সিয়াসাত’ পৃঃ ১৮২।
[4]. ‘আহলেহাদীছ আওর সিরাসাত’ পৃঃ ১৭৯-১৮৯; গৃহীতঃ তা‘লীমুছ ছালাত পৃঃ ৯-১১।
[5]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮১; গৃহীতঃ তা‘লীমুছ ছালাত পৃঃ ১১।
[6]. ডঃ আছেম বিন আবদুল্লাহ, ‘ক্বাৎফুছ ছামার’-এর ভূমিকা (মদীনাঃ জামে‘আ ইসলাময়িাহ্ ১ম সংস্করণ, ১৮০৪/১৯৮৪) পৃঃ ১২, ২৬, ৮।
[7]. ‘মিনার’ পৃঃ ১৫২।
[8]. ‘তারাজিম’ পৃঃ ২৪৩-৪৪।
[9]. ‘মিনার’ পৃঃ ২০১।
[10]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৯।