হায়াতুন্নবী : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আহমাদুল্লাহ 10801 বার পঠিত

ভূমিকা : মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে বহুল প্রচলিত অন্যতম ভুল আক্বীদা হ’ল তিনি জীবিত আছেন। তিনি এখনো দুনিয়াতে ইচ্ছামত আগমণ ও প্রস্থান করেন। এটা একেবারেই ভুল ও শিরকী আক্বীদা। মূলত তিনি বারযাখী জীবনে জীবিত। এ দুনিয়ার সাথে তাঁর কোন যোগাযোগ নেই। তিনি এ  দুনিয়াতে আগমন করেন মর্মে আক্বীদা রাখা শিরক। কুরআন ও হাদীছের কোথাও তাঁকে ‘হায়াতুন নবী’ বলা হয়নি। কিন্তু তিনি যে মারা গিয়েছেন এ সম্পর্কে অসংখ্য দলীল  কুরআন ও  হাদীছে  বিদ্যমান।  যেমন-

দলীল-১ : কুরআনে এরশাদ হয়েছে- (১) إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ  ‘আপনি অবশ্যই মৃত্যুবরণকারী এবং তারাও অবশ্যই মারা যাবে’ (যুমার ৩৯/৩০)। (২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ‘প্রত্যেক  প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’ (আলে ইমরান ৩/১৮৫; আম্বিয়া ২১/৩৫)। 

(৩) আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘হে নবী! আপনি  বলে  দিন। আমার  ছালাত,  আমার  হজ্জ, আমার জীবন আমার মৃত্যু সবই আল্লাহর জন্য। যিনি  বিশ্বজগতের  প্রতিপালক’ (আন‘আম ৬/১৬২)। 

দলীল-২ : আবূ বকর (রাঃ) বলেন, فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ ‘নিশ্চয় মুহাম্মাদ মারা গিয়েছেন’।[1]

দলীল-৩ : আয়েশা (রাঃ) বলেন, مَاتَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নবী  (ছাঃ) মারা গিয়েছেন’।[2]

দলীল-৪ : রাসূল (ছাঃ)-এর এ দুনিয়া হ’তে চলে যাওয়ার পর তার পরিত্যক্ত সম্পদের মীরাছ বন্টনের জন্য তার আদরের কন্যা ফাত্বেমা (রাঃ) আবূ বকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ)-কে বলেছিলেন’।[3]

যদি নবী হায়াতুন্নবী হ’তেন তবে ফাত্বেমা (রাঃ) তার পিতাকে না  বলে  আবূ বকরকে বললেন কেন?

এর পরের হাদীছে আছে যে, আবূ বকর ফাত্বিমাকে সম্পদ বন্টন করে দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। ফলে ফাত্বিমা রেগে যান ও তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত  আর আবূ বকরের সাথে কথা বলেননি’।[4]  

এতকিছু হওয়ার পরও তিনি কেন তার শ্রদ্ধেয় পিতাজান, সাইয়েদুল মুরসালীন-কে (ব্রেলভীদের ভাষায় হায়াতুন্নবী) এই  সমস্যা সমাধানের জন্য  বললেন না? উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ফাত্বেমা (রাঃ) ছয় মাস জীবিত  ছিলেন। এ ছয় মাসে নবী করীম (ছাঃ) অন্তত একবার আসতে পারতেন।

দলীল-৬ : আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন, أَنَّهُ مَرَّ بِقَوْمٍ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ شَاةٌ مَصْلِيَّةٌ، فَدَعَوْهُ، فَأَبَى أَنْ يَأْكُلَ، وَقَالَ: خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الدُّنْيَا وَلَمْ يَشْبَعْ مِنْ خُبْزِ الشَّعِيرِ ‘তিনি একদল লোকের নিকট দিয়ে  যাচ্ছিলেন। যাদের সামনে ছিল একটি ভুনা বকরী। তারা তাকে  (খেতে) ডাকলেন। তিনি খেতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন, রাসূলু (ছাঃ) দুনিয়া হ’তে চলে গিয়েছেন। অথচ তিনি যবের রুটিও তৃপ্তি সহকারে খাননি’।[5] 

এটাই হ’ল ছাহাবীদের ভালবাসার নমুনা। আজকে যারা আমরা  ‘নবীর  প্রেম’  ‘নবীর  প্রেম’  বলে  অহরহ  চিৎকার  করতে  থাকি  তারা আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর  ন্যায়  আচরণ  করতে পারবেন  কি?

দলীল-৭ : ইমাম আবূ ইউসূফ (রহঃ) তাঁর উস্তাদ ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর সূত্রে লিখেছেন, مَا شَبِعَ آلُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ خُبْزِ بُرٍّ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ مُتَتَابِعَاتٍ حَتَّى مَاتَ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم  ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত তার পরিবারের সদস্যরা টানা তিন দিন গমের রুটি তৃপ্তি ভরে খেতে পারেননি’।[6]

যদি নবী (ছাঃ) ‘হায়াতুন্নবী’ হ’তেন তবে এখানে মৃত্যু শব্দটা এল কেন? আর ছাহাবীরাই বা এত কষ্ট পেলেন কেন? 

দলীল-৮ : لَقَدْ مَاتَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ছাঃ) মারা গিয়েছেন’।[7]  

কতিপয় দলীলের পর্যালোচনা :

দলীল-১ : وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِنْ لَا تَشْعُرُونَ ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত বল না। বরং  তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা অনুধাবন করতে পার না’ (বাক্বারাহ ২/১৫৪)। 

জবাব : এখানে মূলত তাদের জন্য কোন দলীল নেই। বরং নিহত হওয়ার বিষয়টি এখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। আল্লাহর রাস্তায় যারা জিহাদ করেন তাদেরকে মুজাহিদ বলা হয়। তারা মারা গেলে শহীদ হন। আর যদি ফেরত আসেন তবে তাদেরকে গাযী বলা হয়। শহীদ তখনই বলা হবে যখন তাদের শরীর হ’তে রূহ বেরিয়ে যাবে। অন্যথায় তাদেরকে শহীদ বলা হবে না। জীবিত কোন ব্যক্তিকে কখনোই শহীদ বলা হয় না। আয়াতে তাদেরকে কোন ভাবেই জীবিত বলা হয়নি। বরং তারা মারা যাওয়ার পর তথা শহীদ হবার পর বারযাখী জীবিত থাকেন। কিন্তু কিভাবে থাকেন তা দুনিয়া থেকে বুঝার কোন উপায় নেই। এখানে এটাই বলা হয়েছে। সুতরাং অত্র আয়াত দ্বারা নবীকে ‘হায়াতুন্নবী’ বলে দলীল গ্রহণ করা হাস্যকর ও ভুল। নবী (ছাঃ) বলেছেন,  وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ  ‘যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার ক্বসম! আমার ইচ্ছা হয় আমি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হই। অতঃপর আবার জীবিত হই। তারপর আবার নিহত হই। তারপর আবার জীবিত হই। অতঃপর আবার নিহত এরপর আবার জীবিত হই তারপর আবার নিহত হই’।[8]

দলীল-২ :  وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ  ‘আর তোমরা  তাদেরকে মৃত বল না যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে। বরং তারা  জীবিত। তাদের  প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে তাদের জন্য রিযক্ব রয়েছে (আলে-ইমরান ৩/১৬৯)। 

জবাব : এর জবাবও সেটাই যা উপরে আলোচিত হয়েছে। বাকি রইল রিযক্বের  বিষয়টি। তো এটা সাধারণ মুমিনদের জন্যও  বলা  হয়েছে। আল্লাহ্ বলেছেন,  وَالَّذِينَ هَاجَرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ قُتِلُوا أَوْ مَاتُوا لَيَرْزُقَنَّهُمُ اللَّهُ رِزْقًا حَسَنًا وَإِنَّ اللَّهَ لَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِين ‘যারা আল্লাহর পথে গৃহ ত্যাগ করেছে, অতঃপর নিহত হয়েছে বা মারা গিয়েছে; আল্লাহ তাদেরকে  অবশ্যই অবশ্যই উৎকৃষ্ট জীবিকা দান করবেন। আর আল্লাহই  হ’লেন  সর্বোৎকৃষ্ট জীবিকা দাতা’ (হাজ্জ ২২/৫৮)। 

দলীল-৩ : রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন, الأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ فِي قُبُورِهِمْ يُصَلُّونَ ‘নবীগণ তাদের কবরে জীবিত, (সেখানে) তারা ছালাত  আদায় করেন’।[9]

পর্যালোচনা : হাসান বিন কুতায়বা নামক একজন রাবী এখানে রয়েছেন। যিনি দুর্বল। হাফেয যাহাবী (রহঃ) বলেছেন, قلت : بل هو هالك ‘আমি বলেছি, বরং তিনি  ধ্বংসপ্রাপ্ত’।[10]

তবে শায়খ হুসাইন সালীম আসাদ এর সনদকে ছহীহ বলেছেন’।[11]  শায়খ আলবানী বলেছেন, أخرجه أبو يعلى باسناد جيد এটা আবূ ইয়ালা জাইয়েদ সনদে বর্ণনা করেছেন’।[12]

সনদ যা-ই হোক না কেন, এর দ্বারা নবী (ছাঃ)-এর দুনিয়ায় জীবিত থাকা প্রমাণিত হয়না। সুতরাং এটা উত্তম সনদে বর্ণিত হ’লেও তাতে দাবী প্রমাণিত হয়না।

দলীল-৪ : من صلى علي عند قبري سمعته، ومن صلى علي نائيا وكل بها ملك يبلغني، وكفي بها أمر دنياه وآخرته، وكنت له شهيدا أو شفيعا  ‘যে ব্যক্তি আমার কবরের নিকটে আমার প্রতি দুরূদ পাঠ করবে; আমি তা শ্রবণ করি ও যে ব্যক্তি আমার প্রতি দূর থেকে দুরূদ পাঠ করবে; একজন ফেরেশতাকে তা আমার  নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হবে এবং তা তার দুনিয়া ও আখেরাতের কর্মের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। আর আমি তার জন্য সাক্ষী বা সুপারিশকারী হয়ে যাব’।[13]

পর্যালোচনা : শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ)-এর পর্যালোচনায় লিখেছেন,  من صلى علي عند قبري سمعته ‘যে ব্যক্তি আমার উপর কবরের নিকটে দরূদ পড়ে; তো সেটা আমি শ্রবণ করি। আর যে ব্যক্তি আমার উপর দূর থেকে দরূদ পাঠ করে তা আমাকে পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়’।[14]  উক্বায়লী বলেছেন, لَا أَصْلَ لَهُ مِنْ حَدِيثِ الْأَعْمَشِ ‘আমাশের হাদীছ থেকে এর কোন ভিত্তি  নেই’ (৪/১৩৭)। 

ইবনুল জাওযী বলেছেন,  هَذَا حَدِيثٌ لَا يَصِحُّ ‘এ হাদীছটি ছহীহ নয়’।[15]

এর রাবী হ’লেন আবূ আব্দুর রহমান মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান আস-সুদ্দী। যার সম্পর্কে ইবনে নুমাইর বলেছেন, ‘তিনি মহামিথ্যুক’।[16]

ইমাম বুখারী ও আবূ হাতেম বলেছেন, ‘তার হাদীছ একেবারেই লেখা হয় না’।[17]

ইবনে হিববান বলেছেন, ‘ইনি ছিক্বাহ রাবীদের থেকে মিথ্যা হাদীছসমূহ বর্ণনা  করতেন’।[18] 

প্রতীয়মান হয়েছে যে, এ সনদটি বানোয়াট। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম ‘আবূশ শায়খ’-এর প্রতি সম্বন্ধিত গ্রন্থ ‘আল-ছালাতু আলান নবী (ছাঃ)’ হ’তে এর  অন্য  আরেকটি  সনদ  সংগ্রহ  করেছেন’।[19]

এই সনদে আব্দুর রহমান বিন আহমাদ আ‘রাজ নামক মাজহূলুল হাল রাবী রয়েছেন। সুতরাং এ সনদটি আবূ মু‘আবিয়া আয-যারীর পর্যন্তও প্রমাণিত নেই। সুলায়মান বিন মিহরান আ‘মাশ প্রসিদ্ধ মুদাল্লিস রাবী ছিলেন। আর আবূ ছালেহ হ’তে হোক বা অন্য কারো হতে, তার ‘আন’ শব্দ যোগে বর্ণনা ছহীহায়ন ব্যতীত যঈফ হয়ে থাকে’।[20]

হাফেয যাহাবীর আ‘মাশের আবূ ছালেহ ইত্যাদি হ’তে রেওয়ায়াতকে ইত্তিছালের উপর গণ্য  করা  ভুল।

মোদ্দাকথা, এই বর্ণনাটি দু’টি সনদের সাথেই যঈফ অর্থাৎ প্রত্যাখ্যাত’।[21]

একটি বর্ণনার মধ্যে এসেছে যে, নবী (ছাঃ)-এর কবরের নিকটে একজন ফেরেশতা নিয়োগ রয়েছে। যিনি তাকে উম্মতের সালাম পৌঁছে দিয়ে থাকেন’।[22]

এই বর্ণনাটির দু’টি সনদই যঈফ ও  প্রত্যাখ্যাত। প্রথম সনদে বকর বিন খিদাশ মাজহূলুল হাল এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ আল-মারওয়াযী মাজহূল রাবী  রয়েছেন। অন্য সনদের মধ্যে নু‘আইম বিন যমযম মাজহূল রাবী এবং  ইমরান বিন হিমইয়ারী মাজহূলুল হাল রাবী রয়েছেন। সুতরাং একে  হাসান  বলা  ভুল।

ছহীহ  বর্ণনার মধ্যে  এসেছে  যে, যমীনের  মধ্যে  আল্লাহর ফেরেশতাগণ ভ্রমণ করেন এবং  নবী (ছাঃ)-কে তার উম্মতের  পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছিয়ে থাকেন’।[23] 

মোটকথা, নবীর সাথে ইহজগতের কোন প্রকার সম্পর্ক  নেই। তিনি দুনিয়াতে আসেন না। এমনকি  দুনিয়া থেকে তিনি কোন কিছু  শ্রবণ করতে  বা  শুনাতেও  পারেন  না। এ মর্মে কোন বিশুদ্ধ বর্ণনা নেই।

দলীল-৫ : قَالَ عَطَاءٌ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ لَمَّا أُسْرِيَ بِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى بَعَثَ اللَّهُ لَهُ آدَمَ وَجَمِيعَ الْمُرْسَلِينَ مِنْ وَلَدِهِ، فَأَذَّنَ جِبْرِيلُ ثُمَّ أَقَامَ فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ تَقَدَّمْ فَصَلِّ  আত্বা ইবনে আববাস হ’তে বর্ণনা করে বলেছেন, মসজিদে আক্বছা থেকে যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিয়ে যাওয়া হ’ল; তখন আল্লাহ আদম ও তার সন্তানদের মধ্য হ’তে সকল রাসূলদেরকে প্রেরণ করলেন। এরপর জিবরীল আযান দিলেন এবং ইক্বামত দিলেন। তারপর তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি অগ্রসর হৌন এবং ছালাত পড়িয়ে দিন’।[24]

তাহক্বীক্ব : ভিত্তিহীন। এর কোন সনদ আমাদের জানা নেই। আর এর দ্বারা নবী (ছাঃ)-এর দুনিয়াতে জীবিত থাকার কোন প্রমাণ মেলেনা।

দলীল-৬ : مَرَرْتُ عَلَى مُوسَى وَهُوَ يُصَلِّي فِي قَبْرِهِ ‘আমি মূসার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম এমতাবস্থায় যে, তিনি তখন তার ক্ববরে ছালাত পড়ছিলেন’।[25]

তাহক্বীক্ব : এর দ্বারা বারযাখী জীবনে হায়াত থাকা প্রমাণিত হয়। এখানে ছালাত আদায় করা বলতে দুনিয়াবী ছালাতের মত কোন বিষয়কে বুঝানো হয়নি। এর দ্বারা নবীকে ইহকালে জীবিত থাকার দলীল প্রদান করা ভুল ও প্রত্যাখ্যাত।

দলীল-৭ : وعن الزّهري: لّما أسري بالنّبيّ عليه السّلام صلّى خلفه كلّ نبيّ كان أرسل ‘যুহরী হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে যখন মিরাজে নিয়ে যাওয়া হল তখন প্রত্যেকটি নবী-রাসূল তার পিছে ছালাত আদায় করেছিলেন’।[26]

তাহক্বীক্ব :  ভিত্তিহীন। এখানে কোন সনদ প্রদান করা হয়নি। অতএব এর দ্বারা দলীল প্রদান করা প্রত্যাখ্যাত।

দলীল-৮ :  وَمَا يَأْتِي وَقْتُ صَلَاةٍ إِلَّا سَمِعْتُ الْأَذَانَ مِنَ الْقَبْر  ‘সাইদ ইবনুল মুসাইয়িব বলেছেন, এমন কোন সময় আসেনি যখন আমি নবীর ক্ববর থেকে আযান শুনিনি’।[27]

তাহক্বীক্ব : সনদবিহীন বিধায় প্রত্যাখ্যাত।

দলীল-৯ : فَكُنْتُ إِذَا حَانَتِ الصَّلَاةُ أَسْمَعُ أَذَانًا يَخْرُجُ مِنْ قِبَلِ الْقَبْرِ الشَّرِيفِ  ‘যখন ছালাতের সময় হত তখন আমি নবীর কবর শরীফ হতে আযান শ্রবণ করতাম’।[28]

তাহক্বীক্ব : সনদবিহীন। ইমাম সুয়ূত্বী (রহঃ) কোন সনদ উল্লেখ করেন নি। তিনি ইবনে সাদের ত্বাবাক্বাত গ্রন্থের বরাত দিয়েছেন। সনদটি হ’ল-قَالَ: أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عُمَرَ قَالَ: حَدَّثَنِي طَلْحَةُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ سَعِيدٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ: كَانَ سَعِيدُ بْنُ الْمُسَيِّبِ ।[29]

পর্যালোচনা : অত্র সনদে মুহাম্মাদ বিন ওমর রয়েছেন।

(১) হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেছেন, متروك مع سعة علمه ‘গভীর ইলম থাকার পরও মাতরূক রাবী ছিলেন’।[30]

(২) ইমাম মুসলিম (রহঃ) বলেছেন, أبو عبد الله محمد بن عمر بن واقد الواقدي قاضي بغداد متروك الحديث  ‘বাগদাদের বিচারপতি আবূ আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ওমর বিন ওয়াক্বিদ আল-ওয়াক্বিদী মাতরূকুর হাদীছ’।[31]

(৩) ইবনে হিববান (রহঃ) তাকে সমালোচিত রাবীদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন’।[32]

(৪) ইবনে আদী (রহঃ) তার সম্পর্কে অনেক সমালোচনামূলক উক্তি উল্লেখ করেছেন’।[33]

(৫) ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেছেন,قَالَ أَحْمد بن حَنْبَل هُوَ كَذَّاب كَانَ يقلب الْأَحَادِيث ...وَقَالَ يحيى لَيْسَ بِثِقَة وَقَالَ مرّة لَيْسَ بِشَيْء لَا يكْتب حَدِيثه وَقَالَ البُخَارِيّ والرازي وَالنَّسَائِيّ مَتْرُوك الحَدِيث وَذكر الرَّازِيّ وَالنَّسَائِيّ أَنه كَانَ يضع الحَدِيث وَقَالَ الدراقطني فِيهِ ضعف আহমাদ বিন হাম্বল বলেছেন, তিনি মহামিথ্যুক। তিনি হাদীছসমূহ উলট-পালট করতেন। ইয়াহইয়া (বিন মাঈন) বলেছেন, তিনি ছিক্বাহ নন। আরেকবার তিনি বলেছেন, তিনি কিছুই নন। তার হাদীছ লেখা যাবে না। বুখারী, রাযী, নাসাঈ তাকে মাতরূকুল হাদীছ বলেছেন। রাযী ও নাসাঈ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি হাদীছ জাল করতেন। দারাকুৎনী বলেছেন, তার মাঝে দুর্বলতা আছে’।[34]

(৬) হাফেয যাহাবী (রহঃ) তার সম্পর্কে একাধিক সমালোচমূলক উক্তি উল্লেখ করেছেন’।[35]

(৭) আলবানী (রহঃ) বলেছেন, وهو متروك متهم بالكذب তিনি মাতরূক রাবী। মিথ্যার দোষে অভিযুক্ত’।[36]

দলীল-১০ : আবূ দারদা হ’তে বর্ণিত যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,  فَنَبِيُّ اللَّهِ حَيٌّ يُرْزَقُ  আর আল্লাহর নবীরা জীবিত। তাদেরকে রিযক্ব দেওয়া হয়’।[37]

তাহক্বীক্ব : (১) শুআইব আরনাঊত্ব (রহঃ) বলেছেন, إسناده ضعيف لانقطاعه وجهالة زيد بن أيمن وهو لم يسمع من عبادة بن نسي، وعبادة لم يسمع من أبي الدرداء  এর সনদ যঈফ। ইনক্বিতা ও যায়দ বিন আয়মানের পরিচয় অজ্ঞাত থাকার কারণে। তিনি উবাদাহ বিন নুসাঈ হ’তে শ্রবণ করেননি। আর উবাদাহ হাদীছ শ্রবণ করেননি আবূ দারদাহ থেকে। (২) যুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ)-এর সনদকে যঈফ বলেছেন’।[38]  (৩)  ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেছেন, زيد بْن أيمن، عَنْ عبادة بْن نسي، مرسل  উবাদাহ বিন নুসাঈ থেকে যায়দ বিন আয়মানের বর্ণনা মুরসাল হয়ে থাকে’।[39]

দলীল-১১ : محمد، حدثنا محمد بن محمد، حدثنا محمد بن مقاتل، حدثنا جعفر بن هارون، سمعان بن المهدي، عن أنس قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من زارني ميتاً فكأنما زارني حياً ومن زار قبري وجبت له شفاعتي يوم القيامة وما من أحد من أمتي له سعة ثم لم يزرني وليس له عذر  ‘আনাস হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে আমাকে মৃত অবস্থায় যিয়ারত করল সে যেন আমাকে জীবিত অবস্থায় যিয়ারত করল। আর যে আমার ক্বরব যিয়ারত করল তার উপর শাফা‘আত ওয়াজিব হয়ে গেল। আর উম্মতের মধ্যে কারো সামর্থ থাকা সত্ত্বেও আমার আমাকে যিয়ারত করল না; তার কোন ওযর গ্রহণ করা হবে না’।[40]

তাহক্বীক্ব : ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন,  وهو حديث موضوع مكذوب مختلف مفتعل مصنوع من النسخة الموضوعة المكذوبة الملصقة بسمعان المهدي قبح الله واضعها، وإسنادها إلى سمعان ظلمات بعضها فوق بعض ‘এটা বানোয়াট, মিথ্যা হাদীছ, বিভিন্নভাবে বর্ণিত, কৃত্রিম যা সুমআন আল-মাহদী রচিত একটি বানোয়াট, মিথ্যায় পূর্ণ প্রচার পত্র থেকে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহ্ এর তৈরীকারীকে অপদস্ত করুন। আর এর সনদ সুম‘আন পর্যন্ত অন্ধকারের উপর অন্ধাকারাচ্ছন্ন’ (ঐ)।

দলীল-১২ :  من حج فزار قبرى بعد وفاتى فكأنما زارنى فى حياتى   ‘যে হজ্জ করল এবং আমার মৃত্যুর পরে আমার কবর যিয়ারত করল সে যেন আমাকে জীবিত অবস্থায় যিয়ারত করল’।[41]

তাহক্বীক্ব : আলবানী (রহঃ) একে মুনকার বলেছেন’।[42]

উপসংহার : আলোচনার সারকথা হ’ল, নবী (ছাঃ) জীবিত আছেন বারযাখী জীবনে। দুনিয়ার সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। যারা তাকে হায়াতুন নবী প্রমাণের চেষ্টায় দলীলসমূহ পেশ করেছেন তাদের দলীলগুলি দু’ প্রকারের- (১) অগ্রহণযোগ্য তথা জাল, যঈফ ইত্যাদি। (২) ছহীহ হাদীছের বিকৃত উপস্থাপনা। উপরে আমরা দু’ প্রকারের দলীলেরই পর্যালোচনা করেছি। যদ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে,  হায়াতুন নবীর পক্ষে কোন স্পষ্ট, ছহীহ দলীল নেই। আল্লাহ আমাদেরকে এই বিভ্রান্ত আক্বীদা হ’তে মুক্ত থেকে জীবন-যাপনের তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!

[লেখক : প্রশিক্ষণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, উপযেলা সৈয়দপুর, নীলফামারী]


[1]. বুখারী হা/৩৬৬৮।

[2]. বুখারী  হা/৪৪৪৬।

[3]. বুখারী হা/৩০৯২।

[4]. বুখারী  হা/৩০৯৩।

[5]. বুখারী হা/৫৪১৪।

[6]. ইমাম আবূ ইউসুফ, আল-আছার হা/৯৩৬।

[7]. মুসলিম হা/২৯৭৪।

[8]. বুখারী হা/২৭৯৭।

[9]. মুসনাদুল বাযযার হা/৬৮৮৮।

[10]. মীযানুল ই‘তিদাল, জীবনী নং ১৯৩৩; মুসনাদু আবী ইয়ালা হা/৩৪২৫।

[11]. মুসনাদু আবী ইয়ালা হা/৩৪২৫।

[12].আহকামুল জানায়েয পৃঃ ২১৩; ছহীহাহ হা/৬২১।

[13]. যঈফা হা/২০৩।

[14]. উক্বায়লী, কিতাবুয যু‘আফা ৪/১৩৬, ১৩৭; মুছান্নাফাতে আবূ জাফর বিন আল-বাখতারী হা/৭৩৫; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১৫৮৩; ইবনুল জাওযী, কিতাবুল মাওযূ‘আত হা/৫৬২, ১/৩০৩; ইবনে শাম‘ঊন অন্য শব্দে হা/২৫৫; ইবনে আসাকির, তারীখে দিমাশক্ব ৫৯/২২০।

[15]. আল-মাওযূ‘আত ১/৩০৩।

[16]. উক্বায়লী,  আয-যু‘আফা ১/১৩৬, সনদ হাসান; আল-হাদীছ : ২৪, পৃঃ ৫২।

[17]. আয-যু‘আফাউছ ছগীর, ক্রমিক ৩৫০; আল-জারহু ওয়াত-তা‘দীল ৮/৮৬।

[18]. আল-মাজরূহীন ২/২৮৬; আল-হাদীছ : ২৪, পৃঃ ৫২।

[19]. জালাউল আফহাম পৃঃ ৫৪।

[20]. দেখুন :  মাসিক  আল-হাদীছ : ৩৩, পৃঃ ৩৮-৪৩।

[21]. আরো দেখুন : আলবানী,  যঈফা হা/২০৩।

[22]. আলবানী, ছহীহা  হা/১৫৩৯, দায়লামী এবং সাখাবীর বরাতে।

[23]. সুনানে নাসাঈ হা/১২৮৩, ৩/৪৩; ইসমাইল বিন আবূ ইসহাক্ব আল-ক্বাযী, ফাযলুছ ছালাত আলান নবী (ছাঃ) হা/২১, সনদ ছহীহ, সুফিয়ান ছাওরী এখানে সামার স্পষ্টতা উল্লেখ করেছেন; ফাতাওয়া ইলমিইয়া ওরফে তাওযীহুল আহকাম ১/৮২, ৮৩।

[24]. তাফসীরুল বাগাবী ৪/১৬৩; তাফসীরে রাযী ২৭/৬৩৫; কুরতুবী ১৬/৯৫; আল-লুবাব ফী উলূমিল কিতাব ১৭/২৭০।

[25]. মুসলিম হা/২৩৭৫।

[26]. দারজুদ দুরার ৪/১৫২৩।

[27]. সুয়ূত্বী, আল-হাবী লিল-ফাতাওয়া ২/১৭৯।

[28]. আল-হাবী লিল-ফাতাওয়া ২/১৭৯।

[29]. ইবনে সা‘দ ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৫/১০০।

[30]. লিসানুল মীযান, ক্রমিক ৫৮৬৯।

[31]. আল-কুনা ওয়াল-আসমা ক্রমিক ১৯০২।

[32]. আল-মাজরূহীন, ক্রমিক ৯৯০।

[33]. আল-কামিল,ক্রমিক ১৭১৯।

[34]. আয-যু‘আফা ওয়াল মাতরূকীন, ক্রমিক ৩১৩৭।

[35]. আল-মুগনী ক্রমিক ৫৮৬১, (ক্বাফ); সিয়ারু আলামিন নুবালা ক্রমিক ১৪৮৫।

[36]. যঈফা হা/৩৫৪৩।

[37]. ইবনে মাজাহ হা/১৬৩৭।

[38]. তাহক্বীক্ব ইবনে মাজাহ ২/৫৫৬; আনওয়ারুছ ছহীফা পৃঃ ৪৩৮।

[39]. আত-তারীখুল কাবীর, ক্রমিক ১২৮৮।

[40]. আছ-ছারিমুল মানকী ১/১৭৭।

[41]. আল-ইরওয়া হা/১১২৮।

[42]. আল-ইরওয়া হা/১১২৮।



আরও