রিযিক

শাকির আহসানুল্লাহ 536 বার পঠিত

অফিসের এক কলিগকে দশ হাযার টাকা দিতে হবে এক প্রয়োজনে। তো তিনি দুপুরে টাকাটা চাইলেন। অফিসের কাছেই বুথ আছে। তাই আমি উনাকে টাকা দেয়ার জন্য ব্যাংকের বুথে গেলাম।

বুথে কার্ড ঢুকিয়ে সব কাজ সম্পন্ন করলাম। কার্ড বেরিয়ে এলো। টাকা এলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ট্রাই করতে গেলাম। কার্ড আটকে গেলো। সিকিউরিটি বলল, বিকাল ৪-টার পরে এসে কার্ড নিতে হবে আপনার। টাকা ছাড়াই অফিসে গেলাম।

উনাকে ঘটনা বলার পর উনি বললেন যে, ঠিক আছে। আপনি পরে টাকা উঠিয়ে বিকাশ করে দিয়েন। উনি চলে গেলেন। টাকাটা দেয়া হ’ল না।

তারপর বিকাল ৪টায় ব্যাংকে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় কার্ড বের করতে সক্ষম হলাম। ১০ হাযার টাকাও তুললাম বুথ থেকে। বুথের আশপাশে কোনো বিকাশের দোকান নেই। তাই টাকা নিয়ে আবার অফিসে যেতে হ’ল। ভাবলাম, অফিস থেকে যাওয়ার পথে বসুন্ধরা গেইট থেকে বিকাশ করব।

অফিস থেকে বের হওয়ার সময় আমার সাথে আরেক কলিগ বের হ’লেন। দু’জনই হেঁটে হেঁটে বসুন্ধরার গেইটের দিকে যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে উনি বল্লেন যে, উনার খুব যরূরী এক হাযার টাকা লাগবে। বললাম, সমস্যা নাই, ব্যাংক এশিয়ার সামনে দিয়েই তো যাব। বুথ থেকে তুলে দিব, কেমন। তখনও আশপাশে বিকাশের দোকান না থাকায় বিকাশ করা হ’ল না।

ব্যাংক এশিয়ার বুথের সামনে গিয়ে দেখি বিশাল লাইন। বললাম, সামনে আরও বুথ আছে সমস্যা নেই। হেঁটে হেঁটে ইস্টার্ন ব্যাকের বুথের সামনে এলাম। ভাবলাম এখান থেকে এক হাযার টাকা তুলে উনাকে দিয়ে দেই। কিন্তু উনি ফোনে কথা বলতে বলতে সামনেই হাঁটছেন। ডাক দিলাম, শুনলেন না। ব্যাপার, নাহ! সামনে আরও বুথ আছে। হাঁটতে শুরু করলাম। বিকাশটা তখনও করা হয়নি।

বসুন্ধরার গেইটের কাছাকাছি এসে ডাঁচবাংলার বুথ পেলাম। ভেতরে ঢুকতে যাওয়ার আগেই দেখলাম আরেকজন হতাশ হয়ে বের হচ্ছে। জানতে পারলাম, বুথ নষ্ট। এদিকে আমি ঢুকব যমুনায়। আর উনি যাবেন অন্যদিকে। তাই শেষে আরেক জনের জন্য রাখা ১০ হাযার থেকে এক হাযার টাকা উনাকে দিয়ে আমি ঢুকে গেলাম যমুনায়। ফলে ১০ হাযার টাকার রাউন্ড ফিগার নষ্ট হয়ে গেল। আর তাই চোখের সামনে বিকাশের দোকান থাকা সত্ত্বেও টাকাটা পাঠানো সম্ভব হ’ল না।

যমুনায় জিপি সেন্টারে একটা কাজ ছিল। সেটা শেষ করে যমুনা থেকে বের হওয়ার সময় ভাবলাম ভেতরের বুথ থেকে আর এক হাযার টাকা তুলে নেই। তারপর বাইরে বেরিয়ে বিকাশে পাঠিয়ে দিব। কিন্তু যমুনার গ্রাউন্ড ফ্লোরে ব্রাক ব্যাংকের বুথে গিয়ে দেখলাম দরজায় সাইনবোর্ড ঝুলানো। যান্ত্রিক সমস্যার কারণের সাময়িকভাবে বন্ধ। যমুনা থেকে বেরিয়ে গেলাম। সামনে অসংখ্য বিকাশের দোকান। কিন্তু পকেটে ৯ হাযার টাকা। তাই বিকাশ করতে পারলাম না।

কুড়িলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। এদিকে আমার কাজিন উত্তরা থেকে একটু পরে বাইকে বিশ্বরোড আসবে। তার সাথে মিরপুর যাবো। তার আসতে দেরি হওয়ায় আমি বুথ খুঁজতে খুঁজতে বিশ্বরোডের দিকে হাঁটছি। পথিমধ্যে একজনের সাথে দেখা হ’ল।

এক দোকানে বসে চা খেলাম। তাকে বিদায় দেয়ার পরেই আরেকটা VISA এক্সেপ্টেড বুথ চোখে পড়লো। বুথের আশপাশে বিকাশের দোকানও আছে। দেখে খুশি হয়ে গেলাম। ভাবলাম বুথ থেকে এক হাযার টাকা তুলে ১০ হাযার মিলিয়ে এখনই বিকাশ করে দিব। কিন্তু বুথে ঢুকে কয়েকবার ট্রাই করেও টাকা তুলতে পারলাম না। অবাক হওয়ার কিছু নেই। যান্তিক ব্যাপার, এমন হতেই পারে। তাই বিকাশও করা হ’ল না।

আবার সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু সামনে গিয়েই আরেক ব্যাংকের বুথ পেলাম। মনে মনে হতাশা নিয়ে ঢুকলাম। বের হলাম সফল হয়ে। ১ হাযার টাকা তুলে এখন ১০ হাযার টাকা হ’ল। কিন্তু আশপাশে বিকাশের দোকান নেই। তাই টাকাটা পাঠাতে পারলাম না। বিরক্ত হচ্ছি না। কারণ, কোনো না কোনোভাবে টাকাটা তো পাঠানো যাবেই।

এবার বিশ্বরোডের কাছাকাছি এসে রাস্তার বিপরীতে বিকাশের দোকান চোখে পড়ল। ভাবলাম, কাজিন জুয়েল যেহেতু এখনও আসেনি, তাহ’লে এই ফাঁকে এখান থেকে বিকাশটা করেই যাই। রাস্তা পার হতে যাব, তখনি জুয়েলের ফোন আসল।

বলল- শাকীর! আমি বিশ্বরোডে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। পুলিশবক্সের সামনে আছি। জুয়েলের ফোন পেয়ে ভাবলাম, মিরপুর যেয়েই বিকাশটা করব। তাই বিকাশের দোকানে আর গেলাম না। টাকাটাও পাঠানো হ’ল না।

বাইকে উঠে জুয়েলকে বললাম, আমার যরূরী একটা বিকাশ করতে হবে। কোথাও বিকাশের দোকান দেখলে বাইক যেনো থামায়। বাইকে কালশি পার হয়ে মিরপুর ১১ এর দিকে এক গলিতে ঢুকলাম। একটা বিকাশের দোকান দেখে জুয়েল বাইক থামাল। বাইক থেকে নামতে গিয়ে খেয়াল করলাম, দোকানটায় অনেক ভীড়। বললাম, চল অন্য দোকানে যাই। এখানে দেরি হবে। ফলে এখানেও বিকাশ করা হ’ল না।

আবার বাইকে আরেকটু সামনে গেলাম। তখন প্রায় রাত ৮টা বাজে। আরেকটা বিকাশের দোকানে থামলাম। দোকানটা অনেক ছোট। অল্পবয়স্ক একটা ছেলে বসা দোকানে। বেশ স্মার্ট। চুলের স্টাইলও যথেষ্ট অদ্ভুত। সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, টাকা পাঠানো যাবে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, কত? বললাম, ১০ হাযার। শুনেই ছেলেটা আনন্দে লাফ দিয়ে উঠল। হাসতে হাসতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ভাই চা খাবেন?

আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম, ঘটনা কী ভাই? এত খুশি হ’লেন যে? ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল, আরে ভাই! আপনাকেই তো খুঁজছি বিকাল থেকে। আমার ১০ হাযার টাকা ক্যাশ খুব দরকার, খুব। বিকাল থেকে আল্লাহ আল্লাহ করছি আর ভাবছি, কেউ যেন আমার দোকান থেকে আজকে ১০ হাযার টাকা পাঠায়।

আমি তার কথা শুনে প্রচন্ড শকড! এতক্ষণ টাকাটা পাঠাতে যত বাধার সামনে পড়েছি, সবই স্বাভাবিক লাগছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সবকিছু কেমন জানি অস্বাভাবিক লাগতে শুরু করল। ছোট ছোট বাধাগুলি বড়বড় মনে হতে শুরু করল।

ছেলেটাকে শুধু বললাম, আপনার জন্যই আজকে আমাকে এত বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কী করলাম ভাই! বললাম, তেমন কিছু না, আসলে যেটা আপনার কপালে ছিল, সেটা কপালেই এসেছে। যাই হোক, টাকাটা সেন্ড করেন এবার।

শেষে ১০ হাযার টাকা বিকাশ করে বাসায় গেলাম। সারাটা রাত আমার মাথায় শুধু এই সবই ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভাবছিলাম, এই ১০ হাযার টাকা বিকাশ করাতে নিশ্চয় তার একটা লভ্যাংশ ছিল। আর এটাই হ’ল তার রিযিক্ব।

এমন অনেক ব্যাপারেই বিভিন্ন ঝামেলা হয়ে আমাদের এক দোকানের খরচ আরেক দোকানে চলে যায়। আমরা সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে নেই। মূলত এর ভেতরে অস্বাভাবিক অনেক কিছুই থাকে। আসলে যে যেটার প্রাপ্য, সে সেটা পাবেই এবং তা যে কোনভাবে, যে কোন মূল্যেই।

-শাকির আহসানুল্লাহ, ঢাকা



আরও