দ্বীনী জ্ঞানের মর্যাদা

লিলবর আল-বারাদী 1308 বার পঠিত

সুশিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। সুশিক্ষা ব্যতীত বৈধ পন্থায় কোন জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারেনা। শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক জাতির জন্যে বাধ্যতামূলক। কারণ আল্লাহ তা‘আলা আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির পরে সর্বপ্রথম বিশেষ পন্থায় শিক্ষা দেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ. ‘অনন্তর আল্লাহ আদমকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিলেন। অতঃপর সেগুলিকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এগুলির নাম বলে দাও, যদি তোমরা (তোমাদের কথায়) সত্যবাদী হও’ (বাক্বারাহ ২/৩১)। এই আয়াত থেকে পরিস্কারভাবে বুঝা যায়, প্রথম মানব আদি পিতা আদম (আঃ)-কে আল্লাহ সকল বস্ত্ত সম্পর্কিত জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেন এবং বিশ্বে আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি হিসাবে দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পরিচালনার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। সাথে সাথে সকল সৃষ্ট বস্ত্তকে করে দেন মানুষের অনুগত (লোকমান ৩১/২০) ও সবকিছুর উপরে দেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব (ইসরা ১৭/৭০)। আর সেকারণেই জিন-ফিরিশতা সবাইকে মানুষের মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আদমকে সিজদা করার আদেশ দেন। সবাই সে নির্দেশ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইবলীস অহংকারবশে সে নির্দেশ অমান্য করায় চিরকালের মত অভিশপ্ত হয়ে যায় (বাক্বারাহ ২/৩৪)

আদম (আঃ) যখন জ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব পেলেন তখন অপর জ্ঞানী ইবলীস হিংসার বর্শবতী হয়ে অহংকার করল এবং শয়তানে পরিণত হ’ল। জ্ঞানীর মর্যাদা অবিসংবাদিত, তবে ঐ সমস্ত জ্ঞানী ব্যক্তিরা নয়, যারা দম্ভভরে সত্যকে উপেক্ষা করে থাকে। ইসলামের নবজাগরণের প্রথম বাণী বা ‘অহি’ হ’ল اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ‘তুমি পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক্ব ৯৬/১)। শিক্ষা ব্যতীত জ্ঞানী হয় না। হোক তা প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা হোক সে নিরক্ষর ব্যক্তি। তবে সার্টিফিকেট জ্ঞানীর মানদন্ড নয়। জ্ঞানীর মানদন্ড হলো আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া। আর তাক্বওয়াশীল ব্যক্তি ইহকালে যেমন শ্রদ্ধার পাত্র হিসাবে বরিত এবং পরকালেও তেমনি সম্মানিত। সুতরাং জ্ঞানী হতে হবে, তবে অহংকারী নয়। নিমেণ জ্ঞানীদের পরিচয় ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।

ইলম বা জ্ঞানের পরিচয়

‘ইলম’ আরবী শব্দ العلم মাছদার থেকে উৎকলিত। যার অর্থ বুঝা, উপলব্ধি করা, অবহিত হওয়া, আহরণ করা ইত্যাদি। ইলমের আভিধানিক ও পারিভাষিক এই সংজ্ঞায় ইলমের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং পরিচয় ফুটে ওঠে। দ্বীনের সঠিক বুঝ হ’ল প্রকৃত ইলম। যাকে অহির জ্ঞান বলা হয়। অর্থাৎ যে ইলম তার প্রভুর নৈকট্য এনে দেয়, তা-ই প্রকৃত ইলম।

পক্ষান্তরে যে ইলম তার প্রভুর সন্ধান থেকে গাফেল করে দেয়, তাই শয়তানের পদাঙ্ক অনুকরণীয় ইলম। এই জ্ঞান মানুষের জন্য ক্ষতিকর এবং পরিণাম জাহান্নাম। মোদ্দাকথা যে ইলম আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন থেকে বিমুখ রেখে দুনিয়ামুখী করে এবং আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয়, তাই শয়তানী ইলম।

ইলম প্রধানত দু’প্রকার। এক. বৈষয়িক জ্ঞান; দুই. অহির জ্ঞান।

এক. বৈষয়িক জ্ঞান : মানুষ ও সকল প্রাণীর মধ্যে যে ইন্দ্রিয়গুলো রয়েছে তা থেকে লব্ধ জ্ঞান। যেমন- অন্যের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, দয়া এবং দুনিয়াতে চলাফেরা করার জন্য শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকে বৈষয়িক জ্ঞান বলে।

দুই. অহির জ্ঞান : কুরআন-সুন্নাহ হ’ল অভ্রান্ত সত্যের চিরন্তন উৎস, যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রেরিত জ্ঞান। কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান ব্যতীত মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে না। আর এই জ্ঞানের আলোকে মানুষ অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা বিবেকবান মানুষে পরিণত হয়। অহি তথা কুরআন-সুন্নাহ হ’ল জ্ঞানের প্রকৃত আধার। সালাফে ছালেহীন অহির জ্ঞানকে সর্বদা প্রাধান্য দিতেন। কেননা অহির জ্ঞানের সাথে বৈষয়িক জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটলে তবেই মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের পথে পরিচালিত হয়। আর দুনিয়ার জীবনের চেয়ে আখিরাতকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য অহির জ্ঞান অর্জন করা ফরয। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর দ্বীনী ইলম (অহির জ্ঞান) শিক্ষা করা ফরয’।[1]

নিম্নে প্রকৃত ইলমের পরিচয় উল্লেখ করা হ’ল।-

১. তাক্বওয়া জ্ঞানের মূল :

তাক্বওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষ ও অমানুষের মর্যাদার মানদন্ড হ’ল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো সত্যিকারের ভয়’ (আলে ইমরান ৩/১০২)। অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পনণ যে অধিক মুত্তাক্বী’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। একদিন জনৈক ব্যক্তি আবূ হুরায়রা (রাঃ)-কে তাক্বওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, أَخَذْتَ طَرِيْقًا ذَا شَوْكٍ؟ ‘তুমি কি কখনো কাঁটাযুক্ত পথে চলেছ? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, কীভাবে চলেছ? লোকটি বলল, إِذَا رَأَيْتُ الشَّوْكَ عَدَلْتُ عَنْهُ أَوْ جَاوَزْتُهُ أَوْ قَصُرْتُ عَنْهُ ‘আমি কাঁটা দেখলে তা এড়িয়ে চলি। অথবা ডিঙিয়ে যাই অথবা দূরে থাকি’। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ذَاكَ التَّقْوَى ‘এটাই হ’ল তাক্বওয়া’।[2] অর্থাৎ, অন্যায় ও মন্দ পথগুলো থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখে সাবধানে হকের পথ চলাই আল্লাহকে ভয় করে চলা। ইবনু কাছীর বলেন, তাক্বওয়ার মূল অর্থ হ’ল ‘অপসন্দনীয় বিষয় থেকে বেঁচে থাকা’।

তাক্বওয়াই হ’ল প্রকৃত ইলম। হযরত আয়িশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতে শুনেছি, وَمِلَاكُ الدِّينِ الْوَرَعُ ‘দ্বীনের মূল হ’ল তাক্বওয়া’।[3] তাক্বওয়া ব্যতীত অহির জ্ঞানেরও কোন মূল্য নেই। জনৈক আরবী কবি বলেন,لو كان للعلم شرف من دون التقي* لكان أشرف خلق الله إبليس ‘যদি তাক্বওয়াবিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত, তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হ’ত।[4] আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন,لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ ‘অধিক হাদীছ জানাই প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়। বরং প্রকৃত জ্ঞানার্জন হ’ল আল্লাহভীতি অর্জন করা।[5] সুতরাং দ্বীনের সঠিক বুঝের মাধ্যমে যে তাক্বওয়া অর্জিত হয়, তাকেই প্রকৃত ইলম বলা হয়। আর এটা সবাই অর্জন করতে পারেন না। আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের বুঝ দান করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে উক্ত প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। বস্ত্ততঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ ব্যতীত কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)। আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করেন। হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতে শুনেছি, مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ، وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللَّهُ يُعْطِى، ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’। আমি তো বিতরণকারী মাত্র, আল্লাহ (জ্ঞান) দাতা’।[6]

দ্বীনের জ্ঞানই প্রকৃত ইলম। আর প্রকৃত ইলমের স্বরূপ তাক্বওয়া। আর অধিক ইলম অর্জনকারী তাক্বওয়াশীল বান্দায় রূপান্তর হয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতে শুনেছি, রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَفَضْلٌ فِي عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ فَضْلٍ فِي عِبَادَةٍ ‘অধিক ইবাদত করার চেয়ে অধিক ইলম অর্জন করা উত্তম’।[7]

২. সালাফে ছালেহীনদের পরিভাষায় জ্ঞানের প্রকৃত অর্থ :

(১) ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, সালাফে ছালেহীন ‘ইলম’ বলতে কুরআন ও সুন্নাহর ইলম বুঝতেন এবং এই ইলম শিক্ষা করা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘ফরয’ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ ‘নিশ্চয় তাঁর বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমগণই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (ফাত্বের ৩৫/২৮)

(২) ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, وما العلم إلا العمل به والعمل به ترك العاجل للآجل ‘ইলম হচ্ছে আমলের নাম। আর আমল হ’ল স্থায়ী জগতের স্বার্থে ক্ষণস্থায়ী জগৎ পরিহার করা।’ অন্যত্র বলেন, ‘ফরয বিষয়াবলী সম্পাদনের পর ইলম অর্জনের চেয়ে সর্বোত্তম আর কোন বিষয় নেই’।[8]

(৩) ইমাম মালেক (রহঃ) বলতেন, الحكمة والعمل نور يهدي به الله من يشاء وليس بكثرة المسائل ، ولكن عليه علامة ظاهرة وهو التجافي عن دار الغرور والإنابة إلي دار الخلود ‘হিকমত ও আমল হচ্ছে একটি নূর। যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তাকে পথ দেখান। আর বেশী বেশী মাসআলা জানার নাম ইলম নয়। এর একটি আলামত আছে। তা হচ্ছে ইলমের বদৌলতে প্রতারণার এই জগত থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং চিরস্থায়ী জগতের দিকে ধাবিত হওয়া’।

(৪) সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, ‘ইলমের প্রথম ধাপ হ’ল চুপ থাকা। দ্বিতীয় ধাপ হ’ল মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা এবং তা মুখস্ত রাখা। তৃতীয় ধাপ হ’ল ইলম অনুযায়ী আমল করা। চতুর্থ ধাপ হ’ল ইলম অন্যকে শিক্ষা দেয়া এবং তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা’।[9] আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ ‘অতএব তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং ফিরে এসে নিজ কওমকে (আল্লাহর নাফরমানী হ’তে) ভয় প্রদর্শন করে যাতে তারা সতর্ক হয়’ (তওবা ৯/১২২)

৩. সুশিক্ষাই জাতির মানদন্ড :

একজন মানুষের শরীরের প্রধান অঙ্গ হ’ল মেরুদন্ড। মেরুদন্ড ছাড়া মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে বা চলাফেরা করতে পারে না। আর অহির জ্ঞান হ’ল সকল জ্ঞানের মূল। তাই অহি ভিত্তিক দ্বীনী ইলম শিক্ষাকেই সুশিক্ষা বলা হয়। আর এই সুশিক্ষাকে মানবদেহের মেরুদন্ডের সাথে তুলনা করা যায়। কেননা মেরুদন্ডহীন মানুষ যেমন অক্ষম, অপদার্থ, তেমনই ইলমহীন মানুষ নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণে মূর্খতার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। দ্বীনী শিক্ষা মানুষকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, হক-বাতিল প্রভৃতি বিষয়ে সঠিক বুঝার ক্ষমতা দান করে, তেমনি ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে কল্যাণ এনে দেয়। সুশিক্ষার অভাবে জাতি পদে পদে পিছিয়ে পড়তে থাকে। পশ্চাৎপদ জাতি পঙ্গু বা পরাশ্রয়ী হয়ে একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সেই জাতির শিক্ষা ব্যবস্থাগুলো ধ্বংস করে দেয়াই যথেষ্ট।

আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত অহিভিত্তিক শিক্ষাকে ‘ইসলামী শিক্ষা’ বলা হয়। যার ভিত্তি হ’ল তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাসের উপরে। যার ফলে একজন ব্যক্তি উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন, নির্লোভ, সৎ ও যোগ্য জনশক্তিতে পরিণত হয়।

প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা ফরযে আইন। সেগুলি হ’ল, ঈমান ও তা বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ, বিশুদ্ধ ও বাতিল আক্বীদা, তাওহীদ-শিরক, হালাল-হারাম, ছালাত-ছিয়াম, হজ্জ-যাকাত ইত্যাদি যাবতীয় ফরয ইবাদত পালনের নিয়ম-পদ্ধতি সমূহ’।[10]

উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘কল্যাণের পথ বহু রয়েছে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে আল্লাহ কর্তৃক ফরযকৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরয হ’ল শারঈ ইলম অর্জন করা।[11] আর এই জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সুশিক্ষা বা অহির জ্ঞান অর্জন করা ফরয। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা ফরয’।[12] ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, কোনো বিষয়ে কিছু বলা এবং আমল করার পূর্বে সে বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ‘সুতরাং জেনে রাখো, আল্লাহ ছাড়া (সত্য) কোন ইলাহ নেই’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। ‘জেনে রাখো’ বাক্য দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা ‘ইলম শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের’ কথা বলেছেন।

জীবন মানেই শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোন উপায় নেই। যে শিক্ষাগ্রহণ করে না সে হয় মূর্খ নতুবা পাগল। সুশিক্ষার গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য অপরিসীম। শিক্ষা দ্বারা বিদ্যা অর্জিত হয়। বিদ্যা জ্ঞানকে পরিপক্ক করে। আর জ্ঞান বিবেককে জাগ্রত রাখে এবং অর্জিত জ্ঞান ও শিক্ষার মাধ্যমে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে পরিপুষ্ট হয় বিবেক। মানুষকে প্রদত্ত আল্লাহর সর্বোত্তম নে‘মত হ’ল বিবেক। আল্লাহ বলেন, يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ‘তিনি যাকে ইচ্ছা বিশেষ জ্ঞান দান করেন এবং যাকে বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়, সে প্রভূত কল্যাণকর বস্ত্ত প্রাপ্ত হয়। উপদেশ তারাই গ্রহণ করে, যারা জ্ঞানবান’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)

১৪০০ বছর পূর্বের সেই আইয়্যামে জাহিলিয়াতের তমসাচ্ছন্ন ঘোর অন্ধকার থেকে উত্তরণ ঘটেছিল একমাত্র দ্বীনী ইলম তথা কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ও তাক্বওয়ার মজবুতির ফলে, যা আজও সারা পৃথিবীতে চিরন্তন ও সার্বজনীন। ইসলামের অনুশীলনের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ) অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহেলী যুগকে প্রগতিশীল স্বর্ণযুগে পরিণত করেছিলেন। সে যুগের মানুষই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। কারণ তারা ইসলামের বিধি-বিধান তথা দ্বীনী ইলম অর্জন ও অনুসরণের মাধ্যমেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ ‘তোমরাই হ’লে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। দ্বীনের অনুশাসনের ফলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল এবং সর্বোত্তম জাতিতে পরিণত হয়েছিল। নবী করীম (ছাঃ) বলেন,خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ‘আমার যুগের মানুষই সর্বোত্তম মানুষ। অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ, অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ’।[13] অর্থাৎ ছাহাবী, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈগণকে এখানে সর্বোত্তম মানুষ বুঝানো হয়েছে।

ইলম তথা দ্বীনের বুঝের মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জিত হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত নাযিল হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ. ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনয়ন করে এবং আল্লাহভীতি অর্জন করে, তবে তাদের প্রতি আসমান-যমীনের যাবতীয় বরকতের রাস্তা উন্মূক্ত করে দিব’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)

জ্ঞানের মানদন্ডে প্রকৃত মানুষ ও ইতর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য করা যায়। কারণ মানুষ যা শিখে তা-ই তার ব্যক্তিগত জীবনে ও সমাজে বাস্তবায়ন করতে চায়। যে জাতি যত বেশী শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশী উন্নত ও সফলতার শিখরে অবস্থানকারী। সুশিক্ষা মানুষের শৈশব থেকে পরিপক্কতার স্তর অবধি বিকাশের একটি পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে ধীরে ধীরে শারীরিক, মানসিক, আধ্মাতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।

শিক্ষা যখন বিনিময়ের মাধ্যমে প্রদান করা হয়, তখন সে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ বিনিময় অর্জনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তা গ্রহণ করে। আর তা বাণিজ্যিক শিক্ষায় পরিণত হয়। পক্ষান্তরে যে শিক্ষা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণে দেয়া ও নেয়া হয়, সে শিক্ষা সুশিক্ষায় রূপ নেয়। তাই বাধ্য হয়ে বলতে হয়, সুশিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড।

আবার ইলম অর্জন করলেই সুশিক্ষিত হওয়া যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহভীতি অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে বিবেক জাগ্রত হয়। তাই বলা হয়, ‘বিবেক যেখানে উপস্থিত, সুখ সেখানে তিরোহিত। আর সুখ যেখানে উপস্থিত বিবেক সেখানে তিরোহিত’। সুতরাং সর্বদা বিবেকবান মানুষই জাতির কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। আর বৈষয়িক ও অহি-র জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত সুশিক্ষাই মানুষকে প্রকৃত বিবেকবান মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে।

৪. জ্ঞানের গুরুত্ব ও প্রভাব :

প্রকৃত জ্ঞানই মানবজীবন ও সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যাবলীর স্থায়ী সমাধান দিতে পারে। জ্ঞান চর্চা প্রতিটি মানুষকে অপার মহিমায় আলোকিত করে তোলে। সুতরাং জ্ঞান হ’ল নূর বা আলো। জ্ঞানহীন দেহ আঁধার ঘরের মতন বিদঘুটে। আলোকিত তারাই যারা ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি আনুগত্যশীল মুমিন। আর মুমিন হতে গেলে ইলম বা জ্ঞানার্জন অতীব যরূরী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সর্বপ্রথম জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছিল। এ বিষয়ে হাদীছে এসেছে- ‘আল্লাহ কর্তৃক রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট জিবরীল মারফত সর্বপ্রথম প্রত্যাদেশকৃত শব্দ হল, اِقْرَأْ ‘আপনি পড়ুন!। রাসূল (ছাঃ) তখন বলেছিলেন, ‘আমি পড়তে জানি না’। তখন জিবরীল (আঃ) তাকে জাপটে ধরেছিলেন। এই একই দৃশ্য তিনবার হওয়ার পর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট সূরা ‘আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়’।[14] আল্লাহ বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ- خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট বাঁধা রক্তপিন্ড থেকে। পড় এবং তোমার প্রতিপালক বড়ই অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন। মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না’ (আলাক্ব ৯৬/১-৫)। ইলম আল্লাহর দেয়া মহান নেআমত, যা তিনি যাকে খুশী দান করেন। ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,بَيْنَا أَنَا نَائِمٌ أُتِيتُ بِقَدَحِ لَبَنٍ، فَشَرِبْتُ حَتَّى إِنِّى لأَرَى الرِّىَّ يَخْرُجُ فِى أَظْفَارِى، ثُمَّ أَعْطَيْتُ فَضْلِى عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ. ‘একবার আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। তখন স্বপ্নে দেখলাম আমার কাছে এক পেয়ালা দুধ আনা হ’ল। আমি তা তৃপ্তি সহকারে পান করলাম। এমনকি আমার মনে হ’ল যে, সে তৃপ্তি আমার নখ দিয়ে বের হচ্ছে। এরপর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা আমি উমর ইবনুল খাত্তাবকে দিলাম’। ছাহাবীগণ জানতে চাইলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এ স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা করেন? জওয়াবে তিনি বলেন, الْعِلْمَ ‘তা হ’ল ইলম বা জ্ঞান’।[15]

সুতরাং আমাদের সমাজ ও দেশ থেকে শিরক-বিদ‘আত সহ সকল প্রকার যুলুম অত্যাচার দূর করতে ইলম অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল (ছাঃ) যেমন প্রত্যেক মুসলিমের উপরে জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরয করেছেন[16], তেমনি আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানীদের নিকটে অজানা বিষয় জেনে নিতে বলেছেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো যদি তোমরা না জান’ (নাহল ১৬/৪৩)। মানুষেন দেহের রোগের চেয়ে আত্মার ব্যাধি অতীব মারাত্মক হয়। আর এর চিকিৎসা প্রকৃত জ্ঞানীদের নিকটে মিলে, যখন তাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَإِنَّمَا شِفَاءُ الْعِىِّ السُّؤَالُ ‘নিশ্চয়ই অজ্ঞতার চিকিৎসা হ’ল জিজ্ঞাসা’।[17] এজন্য জেনে-বুঝে সঠিকটা আমল করতে হয়, যাতে আত্মার প্রশান্তি অনুভব করে।

(ক্রমশঃ)


লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী

[1]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৩৯১৩; ছহীহ হাদীছ; মিশকাত হা/২১৮।

[2]. বায়হাক্বী, যুহদুল কাবীর ১/৩৫০, হা/৯৭৩; সনদে হিশাম বিন যিয়াদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে।

[3]. ছহীহুল জামি‘ হা/১৭২৭; সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/২৫৫।

[4]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী-১, পৃঃ-১৩।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, ১৪৭ পৃঃ।

[6]. বুখারী হা/৭১, ৩১১৬ ও ৭৩১২; মুসলিম হা/১০৩৭।

[7]. ছহীহুল জামি‘ হা/১৭২৭; সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/২৫৫।

[8]. আল-মাদখাল লিল বায়হাক্বী, হা/৪৭৫।

[9]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৬২।

[10]. আল-ফাক্বীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ হা/১৬৩।

[11]. শারহু রিয়াযুছ ছালেহীন ২/১৫০ পৃঃ।

[12]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৩৯১৩; মিশকাত হা/২১৮।

[13]. বুখারী হা/২৬৫২; মুসলিম হা/২৫৩৩; মিশকাত হা/৩৭৬৭।

[14]. বুখারী হা/৪৯৫৩।

[15]. বুখারী হা/৮২; ৭০০৬; তিরমিযী হা/২২৮৪; আহমাদ হা/৫৮৬৮।

[16]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮, সনদ হাসান।

[17]. আবু দাঊদ হা/৩৩৬; দারাকুৎনী হা/৭৪৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৪৩৬২; হাসান ছহীহ ; মিশকাত হা/৫৩১;।



বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও