আহলেহাদীছ আন্দোলন : তাকলীদী যুগে

ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম 903 বার পঠিত

ভূমিকা : আহলেহাদীছ আন্দোলন একটি নিরন্তর দাওয়াতী কাফেলার নাম। যুগে যুগে এ আন্দোলনের উপর শত বাধা-বিপত্তি, হাযারো প্রতিকূলতা, সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এ আন্দোলনের দাওয়াতী তৎপরতা অব্যাহত থেকেছে। ভবিষ্যতেও থাকবে মাযহাবীরা ও ভ্রান্ত আক্বীদার লোকেরা যুগে যুগে আহলেহাদীছদের  উপর বহু অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। তথাপি তারা এদের গলায় তাকলীদে শাখছীর কণ্ঠহার পরাতে সক্ষম হয়নি, পারেনি কোন ভ্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী করতে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত পারবেও না ইনশাআল্লাহ। বরং এদের আলোক প্রদর্শনে তাদের অনেকে নিজ গলা থেকে তাকলীদে শাখছীর হার ছিঁড়ে ফেলেছে এবং ভবিষ্যতেও ছিড়তে বাধ্য হবে ইনশাআল্লাহ। আববাসীয় খলীফাদের সময় যখন তাকলীদের জয়জয়কার তখনও আহলেহাদীছ আন্দোলন তার দাওয়াতী মিশনকে অব্যাহত রেখেছিল। এ বিষয়েই নিম্নে আলোচিত হয়েছে।-

এযুগে মু‘তাযিলারা রাজনৈতিক ক্ষমতা হারালেও উছূলী বিতর্ক শেষ হয়নি। ইসলামী খেলাফতের সীমানা বৃদ্ধির ফলে নও-মুসলিমদের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আববাসীয় খলীফা আল-মামূনের যুগ (১৯৮-২১৮) হ’তে শুরু হওয়া গ্রীক দর্শনের আরবী অনুবাদ এযুগে আরো প্রসারিত হয়ে ইহুদী, খৃষ্টানী, মজূসী, যরদশ্তী, হিন্দুস্তানী (সামানী), তুর্কী, ইরানী ও অন্যান্য অনৈসলামী দর্শনের বইপত্র আরবীতে অনূদিত হয়ে ইসলামী বিশ্বের চিন্তা-চেতনায় এক ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কুরআন-হাদীছের বাহ্যিক অর্থের অনুসরণে ও ছাহাবা যুগের গৃহীত পথ ছেড়ে দিয়ে বিদ্বানগণ নিজেদের মস্তিষ্কপ্রসূত জ্ঞানের মাধ্যমে সব কিছুর সমাধান অনুসন্ধান করতে আরম্ভ করেন। কালাম ও দর্শন শাস্ত্রের কূটতর্ক, বিভিন্ন মুজতাহিদ ইমামের ফিক্হী মতপার্থক্য, ছূফীবাদের প্রসার ইত্যাদির কারণে মুসলমানদের সামাজিক ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়। ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) বলেন, এই সময় আববাসীয় খলীফাগণ বিশেষ করে হানাফী-শাফেঈ বিতর্কে ইন্ধন যোগাতে থাকেন। ফলে উভয়পক্ষে বহু ঝগড়া-বিবাদ ও লেখনী পরিচালিত হয়। এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬/১৭০৩-১৭৬২) ‘৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী লোকদের অবস্থা’ শিরোনামে বলেন, ‘৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বেকার লোকেরা কেউ কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের উপরে নির্দিষ্টভাবে মুকাল্লিদ ছিলেন না।.. কোন বিষয় সামনে এলে মাযহাব নির্বিশেষে যেকোন বিদ্বানের নিকট হ’তে  লোকেরা ফৎওয়া জিজ্ঞেস করে নিতেন।.. আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত তারা আর কারোরই অনুসরণ করতেন না। .. কিন্তু পরবর্তীতে ঘটে গেল অনেক কিছু। যেমন (১) ফিক্হ বিষয়ে মতবিরোধ (২) বিচারকদের অন্যায় বিচার (৩) সমাজ নেতাদের মূর্খতা (৪) হাদীছ শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ ‘মুহাদ্দিছ’ ও ‘ফক্বীহ’ নামধারী লোকদের নিকটে ফৎওয়া তলব ইত্যাদি কারণে হকপন্থী কিছু লোক বাদে অধিকাংশ লোক হক-বাতিল যাচাই করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে এবং প্রচলিত যেকোন একটি মাযহাবের তাকলীদ করেই ক্ষান্ত হয়। ... বর্তমানে লোকদের অন্তরে তাকলীদ এমনভাবে আসন গেড়ে বসেছে, যেমনভাবে পিঁপড়া সবার অলক্ষ্যে দেহে ঢুকে কামড়ে ধরে থাকে’।

তাকলীদের মোহমায়ায় আবদ্ধ হয়ে মানুষ ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কে কত বড় ইমাম বা কে কত বড় দলের অনুসারী, এটাই তখন প্রধান বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাকলীদী গোঁড়ামির কারণে মুসলিম মিল্লাতের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হ’ল।- (১) মাযহাবী তাকলীদের বাড়াবাড়ির পরিণামে হানাফী-শাফেঈ দ্বন্দ্বে ও শী‘আ মন্ত্রীর ষড়যন্ত্রে অবশেষে ৬৫৬ হিজরীতে হালাকু খাঁর আক্রমণে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায়। (২) পরবর্তীতে মিসরের বাহরী মামলূক সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বারাসের আমলে (৬৫৮-৬৭৬/১২৬০-১২৭৭ খৃঃ) মিসরীয় রাজধানীতে সর্বপ্রথম চার মাযহাবের লোকদের জন্য পৃথক পৃথক কাযী নিয়োগ করা হয়, যা ৬৬৫ হিজরী থেকে ইসলাম জগতের সর্বত্র চালু হয়ে যায় এবং চার মাযহাবের বহির্ভূত কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হ’লেও তা অনুসরণ করা নিষিদ্ধ বলে গণ্য হয়। (৩) বুরজী মামলূক সুলতান ফারজ বিন বারকূক-এর আমলে (৭৯১-৮১৫হিঃ) ৮০১ হিজরী সনে মুকাল্লিদ আলেম ও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মুসলিম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র কা‘বাগৃহের চারপাশে চার মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক চার মুছাল্লা কায়েম করা হয়। এইভাবে তাকলীদের কু-প্রভাবে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি স্থায়ী রূপ ধারণ করে।

১৩৪৩ হিজরীতে বর্তমান সঊদী শাসকপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আযীয আলে-সঊদ উক্ত চার মুছাল্লা উৎখাত করেন। ফলে সকল মুসলমান বর্তমানে কুরআন-হাদীছে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী একই ইব্রাহীমী মুছাল্লায় এক ইমামের পিছনে এক সাথে ছালাত আদায় করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।

বর্তমানে আমরা তাকলীদী যুগেই বাস করছি। যদিও প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত তাকলীদের বিরুদ্ধে আহলেহাদীছ বিদ্বানদের প্রতিবাদী কণ্ঠ ও লেখনী সোচ্চার আছে এবং তার ফলে অনেকেই তাকলীদের মায়াবন্ধন ছিন্ন করে ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণে ব্রতী হয়েছেন বা হচ্ছেন। তাকলীদী যুগেও আহলেহাদীছ আন্দোলনের ক্রমবিকাশ ও গতিধারা পূর্বের ন্যায় ‘প্রচার ও প্রতিরোধ’ কৌশলের উপরে ভিত্তিশীল ছিল বা আছে। বিদ‘আতী ফেরকাগুলির নেতৃবৃন্দের সাথে তাদেরকে মুখোমুখি তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হ’তে হয়েছে। যেমন ক্বাদারিয়া নেতা গায়লান দামেষ্কীর বিরুদ্ধে খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয ও পরে ইমাম আওযাঈর বিতর্ক অনুষ্ঠান; মু‘তাযিলা খলীফা মু‘তাছিম বিল্লাহর দরবারে তার সাথে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের বিতর্ক অনুষ্ঠান ও নির্যাতন বরণ; খ্যাতনামা আহলেহাদীছ মুফাস্সির ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হিঃ) জনৈক জনপ্রিয় বক্তার ভুল তাফসীরের প্রতিবাদ নিজ ঘরের দরজায় লেখার অপরাধে ভক্ত জনতার অজস্র প্রস্তর বর্ষণে ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া; সুলতানের পক্ষ হ’তে আয়োজিত মিসরীয় আদালত কক্ষে যুগের সেরা ছূফী আলেমদের ভুল আক্বীদার বিরুদ্ধে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ্ (৬৬১-৭২৮)-এর মুখোমুখি তর্কযুদ্ধে জয়লাভ, বিরোধী কুচক্রী আলেমদের ষড়যন্ত্রে ৮ বারে মোট সাত বছর কারা যন্ত্রণা ভোগ ও সেখানেই মৃত্যুবরণ, শিরক ও বিদ‘আতী আকীদা ও রস্ম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে ছোট-বড় তিন শতাধিক গ্রন্থ প্রণয়ন; তাঁর প্রিয় ছাত্র হাফেয ইবনুল কাইয়িম (৬৯১-৭৫১)-এর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে হক প্রচার, কারাবরণ ও নির্যাতন ভোগ;  প্রচলিত তাকলীদী প্রথার বিরুদ্ধে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ)-এর লেখনীযুদ্ধ ও কুরআনের ফারসী তরজমা প্রকাশ করায় দিল্লীর আলিমগণ কর্তৃক তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র; ব্যাপক ধর্মীয় অনাচার, শিখ সন্ত্রাস ও বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে আপোষহীন জিহাদ ঘোষণাকারী পবিত্র কুরআন ও ত্রিশ হাযার হাদীছের স্বনামধন্য হাফেয মুজাহিদ নেতা আল্লামা ইসমাঈল শহীদ (১১৯৩-১২৪৬ হিঃ)-এর বিরুদ্ধে আলিমদের পক্ষ হ’তে ‘কুফরী’ ফৎওয়া প্রদান, তাদের চক্রান্তে প্রশাসন কর্তৃক তাঁর ওয়ায-নছীহতের উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও অবশেষে এক অসম যুদ্ধে বালাকোট প্রান্তরে শত্রুসৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ এবং এ খবর পেয়ে দিল্লীর কিছু আলিমের খুশীতে শিরনী বিতরণ; হাদীছ, তাফসীর, ফিক্হ, আকায়েদ সহ ২২২ খানা গ্রন্থের রচয়িতা, অনুবাদক ও প্রকাশক ভূপালের খ্যাতিমান আলেম, আহলেহাদীছ আন্দোলনের বীর সিপাহসালার নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান (১২৪৮-১৩০৭ হিঃ/১৮৩৩-৯০ খৃঃ)-এর অতুলনীয় ইল্মী খিদমত;  সুদীর্ঘ ৭৫ বৎসরে প্রায় সোয়া লক্ষ ছাত্রের স্বনামধন্য শিক্ষক শায়খুল কুল ফিল কুল মিঁয়া নাযীর হুসাইন দেহলভীর (১২২০-১৩২০হিঃ/১৮০৫-১৯০২খৃঃ) নীরব শিক্ষা বিপ্লব ও কুচক্রী আলিমদের ষড়যন্ত্রে রাওয়ালপিন্ডির জেলখানায় এক বছর কারা যন্ত্রণা ভোগ, হজ্জের ময়দান থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার বরণ ও বাদশাহর দরবারে দ্ব্যর্থহীনভাবে নিজের স্বপক্ষে বক্তব্য পেশ ও মুক্তি লাভ; বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামে-গঞ্জে আহলেহাদীছ আলিমদের ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিকভাবে শিরক ও বিদ‘আত বিরোধী নিরন্তর মৌখিক, লৈখিক ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা ও নির্যাতন ভোগ- সবকিছুই উক্ত আন্দোলনের অব্যাহত ক্রমবিকাশ ও অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার প্রমাণ বহন করে।

বিভিন্ন যুগে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ‘প্রচার ও প্রতিরোধ’ এই উভয় প্রকার গতিধারা ও ক্রমবিকাশ অব্যাহত ছিল। সেই সাথে আরো উল্লেখ্য যে, ছাহাবা ও তাবেঈন কর্তৃক বিজিত তৎকালীন পৃথিবীর সকল ইসলামী এলাকায় কেবলমাত্র ক্বালাল্লাহ ও ক্বালার রাসূল-এরই গুঞ্জরণ ছিল। বিজিত এলাকায় বিজয়ী সেনাদলের সাথে অথবা বিজয়ের পরপরই সেখানে গমন করতেন দাঈ ও শিক্ষকদের একটি বিরাট দল, যারা সেখানকার অধিবাসীদেরকে কুরআন ও হাদীছ শিক্ষা দিতেন, যা ছিল নবীযুগের নির্ভেজাল অহিভিত্তিক শিক্ষা। যেখানে ছিল না পরবর্তী যুগের সৃষ্ট কোন দার্শনিক বা ফিক্হী দলাদলির সামান্যতম অবকাশ। সে কারণে বলা চলে যে, বিজেতা ছাহাবী, তাবেঈ ও তাঁদের অনুসারী মুসলিম জনসাধারণ ছিলেন হাদীছপন্থী বা আহলুল হাদীছ। নিঃসন্দেহে এটি ছিল আহলেহাদীছ আন্দোলনের রাজনৈতিক দিক।

এ পর্যায়ে আমরা উক্ত আন্দোলনের বিকাশধারায় নতুন দিক ও পদ্ধতির সংযোজন লক্ষ্য করব। এই পদ্ধতিটি ছিল হাদীছ সংকলন, গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশনার মাধ্যমে পরিচালিত বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পদ্ধতি। এক্ষেত্রেও পূর্বের ন্যায় ‘প্রচার ও প্রতিরোধ’ কৌশল অব্যাহত রাখা হয়। রাসূলের নির্দেশক্রমে লেখক ছাহাবী আবদুল্লাহ বিন আমর বিনুল আছ (মৃঃ ৬৫ হিঃ)-এর মাধ্যমে প্রথম হাদীছ সংকলনের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয (৯৯-১০১) কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে হাদীছ সংকলনের সূচনা হয়। এই যুগে বিদ‘আতী ফেরকা সমূহের উত্থান ঘটায় কেবলমাত্র আহ্লুস সুন্নাহ বা আহ্লুল হাদীছ বিদ্বানদের নিকট থেকেই হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত। ছহীহ ও জাল হাদীছ যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে গিয়ে স্বর্ণযুগের সূত্রপাত করে এবং এসময়ে বিশ্ববিশ্রুত কুতুবে সিত্তাহ সংকলিত হয়। রাজনৈতিক বিরোধের সূত্র ধরে যে উছূলী বিতর্কের সূচনা হয় এবং সাথে সাথে ক্বাদারিয়া, জাহ্মিয়া, মুরজিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি মতবাদসমূহের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে আকীদাগত বিভ্রান্তি শুরু হয় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করায় শেষোক্ত মতবাদটি যখন ব্যাপকভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তখন আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের একটি বিরাট অংশ এসবের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে কলমী যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাঁরা কুরআন ও হাদীছের প্রকাশ্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের যুক্তিসমূহ খন্ডন করেন এবং ইসলামের নির্ভেজাল আকীদা জনগণের নিকটে তুলে ধরেন, যা ঐসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নব উদ্ভূত বিদ‘আতী দল সমূহের ভ্রান্ত আকীদার প্রতিবাদে এই যুগে কয়েকজন আহলেহাদীছ বিদ্বানের লিখিত বিশেষ কয়েকটি গ্রন্থের নাম পেশ করা হ’ল।  যেমন ১- আবু ওবায়েদ কাসেম বিন সাল্লাম (মৃঃ ২২৪ হিঃ) প্রণীত ‘কিতাবুল ঈমান’ ২- আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ জু‘ফী (মৃঃ ২১৯ হিঃ)-এর ‘আর-রাদ্দু আলায্ যানাদিক্বাহ ওয়াল জাহ্মিয়াহ’। ৩- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ)-এর ‘আর-রাদ্দু আলায্ যানাদিক্বাহ ওয়াল-জাহ্মিয়াহ’। ৪- আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল ওরফে ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬)-এর ‘আর-রাদ্দু আলাল জাহ্মিয়াহ’। ৫- আবদুল্লাহ বিন মুসলিম ওরফে ইমাম ইবনু কুতায়বাহ দীনাওয়ারী (২১৩-২৭৬)-এর ‘আল-ইখতিলাফু ফিল-লাফ্যি ওয়ার রাদ্দু আলাল জাহ্মিয়াহ’ ও ‘তাবীলু মুখ্তালাফিল হাদীছ’। শেষোক্ত যুগান্তকারী গ্রন্থে লেখক তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের প্রায় সকল বিদ‘আতী ফের্কার ভ্রান্ত আকীদাসমূহ খন্ডন করেছেন এবং বাহ্যত বিরোধী হাদীছসমূহের চমৎকার সমন্বয় সাধন করেছেন। সাথে সাথে আহলেহাদীছগণের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের সারগর্ভ জওয়াব দান করেছেন। ৬- ওছমান বিন সাঈদ দারেমী (২০০-২৮০)-এর ‘আর-রাদ্দু আলা বিশ্র আল-মুরায়সী’। ৭- আবদুর রহমান বিন আবু হাতিম (মৃঃ ৩২৭ হিঃ)-এর ‘আর-রাদ্দু আলাল জাহ্মিয়াহ’ প্রভৃতি।

৪র্থ শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত প্রণীত উপরোক্ত শ্রেষ্ঠ কেতাবগুলির নাম লক্ষ্য করলে অনুমিত হয় যে, কেবল জাহ্মিয়াদের বিরুদ্ধেই এযুগে লেখনী পরিচালিত হয়েছিল। মূলতঃ মতবাদের দিক দিয়ে জাহ্মিয়া, ক্বাদারিয়া, জাব্রিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি ফের্কাগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান বিষয়ে পরস্পরে সুন্দর মিল রয়েছে। সেকারণ মূল ফের্কাটির শিরোনাম দিয়ে আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ সে সময়ের অন্য সকল বিদ‘আতী ফের্কার ভ্রান্ত আকীদাসমূহের প্রতিবাদ করেছেন।

অতঃপর ঐসকল গ্রন্থের নাম করা যেতে পারে, যেখানে কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে ইসলামের সঠিক আকীদা পেশ করা হয়েছে।- যেমন ১- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১) প্রণীত ‘আস্-সুন্নাহ’। অতঃপর একই নামে প্রণীত নিম্নোক্ত বিদ্বানমন্ডলীর গ্রন্থসমূহ। যেমন ২- ইমাম আবুবকর বিন আছরাম (মৃঃ ২৭২ হিঃ) ৩- আবদুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল (২১৩-৯০) ৪- মুহাম্মাদ বিন নাছর আল-মারওয়াযী (২০২-২৯৪) ৫- আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হারূণ আল-খালাল (মৃঃ ৩১১ হিঃ) প্রমুখ। এতদ্ব্যতীত ৬- আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ইসহাক ওরফে ইমাম ইবনু খুযায়মাহ (২২৩-৩১১) প্রণীত ‘আত-তাওহীদ’ ৭- আলী বিন ইসমাঈল ওরফে ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী (২৬০-৩২৪) প্রণীত ‘আল-ইবানাহ আন উছূলিদ দিয়ানাহ্’। আশ‘আরী মতবাদের উদ্ভাবক ইমাম আশ‘আরী জীবনের শেষদিকে এসে উক্ত মতবাদ পরিত্যাগ করে আহলে সুন্নাত-এর পথে ফিরে আসেন এবং ছহীহ আকীদা সম্বলিত উক্ত কিতাব প্রণয়ন করেন। এই কিতাবে ‘প্রচার ও প্রতিরোধ’ দু’টি পদ্ধতিই অবলম্বিত হয়েছে। ৮- ওবায়দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন বাত্তাহ (৩৮৭) প্রণীত ‘আল-ইবানাহ’। ৯- মুহাম্মাদ বিন ইসহাক ওরফে ইমাম ইবনু মান্দাহ (৩১০-৩৯৫) প্রণীত ‘কিতাবুল ঈমান’ ১০- আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ বিন আবী যামনীন (-৩৯৯) প্রণীত ‘উছূলুস্ সুন্নাহ’ প্রভৃতি। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পরবর্তীকালের সেরা গ্রন্থকার হিসাবে সেই সকল আহলেহাদীছ বিদ্বানদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য যাঁরা তাঁদের গ্রন্থসমূহে ‘প্রচার ও প্রতিরোধ’-এর দ্বিবিধ ধারা অবলম্বনে আহলে সুন্নাতের আকীদা ও আমলকে জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন এবং আহলেহাদীছ আন্দোলনের ক্রমবিকাশ ধারায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তন্মধ্যে কয়েকজন হ’লেন- ১- ইমাম হিবাতুল্লাহ ইবনুল হাসান লালকাঈ (মৃঃ ৪১৮ হিঃ)। তাঁর রচিত ‘শারহু উছূলিল ই‘তিক্বাদ’ গ্রন্থটি তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। ২- আবদুর রহমান বিন ইসমাঈল ছাবূনী (৩৭২-৪৪৯) প্রণীত ‘আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ’ আকীদা বিষয়ে রচিত তাঁর অন্যতম সেরা গ্রন্থ। ৩- আবু মুহাম্মাদ আলী ইবনে আহমাদ ওরফে ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী (-৪৫৬) প্রণীত ‘কিতাবুল ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহ্ওয়া আন নিহাল’ তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ। ৪- আবুবকর আহমাদ বিন হুসাইন ওরফে ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮) রচিত ‘আল-ই‘তিক্বাদ’ আকীদা বিষয়ে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। ৫- আহমাদ বিন আবদুল হালীম ওরফে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮) রচিত ‘মিনহাজুস্ সুন্নাহ’-এর মাধ্যমে আহলেহাদীছের আকীদা সুন্দরভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি কুরআন ও সুন্না্হর অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে বিদ‘আতী ফির্কাসমূহের যুক্তিসমূহ খন্ডন করে অন্যান্য প্রায় তিন শতাধিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। তাঁর লিখিত কিতাবগুলি যুগ যুগ ধরে কুরআন ও সুন্নাহর পথে আলোকস্তম্ভ হিসাবে কাজ করবে। ৬- আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আবুবকর ওরফে ইমাম ইবনুল কাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ (৬৯১-৭৫১) প্রণীত ‘মুখ্তাছার ছাওয়াইকুল মুরসালাহ’ ৭- আবুল ফিদা ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল বিন ওমর ওরফে হাফেয ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪) প্রণীত হাদীছ ভিত্তিক তাফসীর ‘তাফসীরুল কুরআনিল আযীম’ ও বৃহদায়তন ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ’ তাফসীর ও ইতিহাস শাস্ত্রের অনন্য গ্রন্থ। কুরআনের তাফসীরের নামে বিদ‘আতীদের অপতৎপরতার প্রতিরোধে ‘তাফসীরে ইবনে কাছীর’-এর অবদান অতুলনীয়। ৮- আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাকদেসী (৭০৫-৭৭৪) প্রণীত ‘আছ-ছারিমুল মুন্কি ফির-রাদ্দি আলাস সুবকী’ সহ শতাধিক খন্ডে বিভক্ত প্রায় ৭০টি গ্রন্থ শিরক ও বিদ‘আতী আকীদা ও রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে দু’ধারী তরবারি স্বরূপ। ৯- শিহাবুদ্দীন আবুল ফযল আহমাদ ইবনু আলী ওরফে হাফেয ইবনু হাজার আস্ক্বালানী (৭৭৩-৮৫২) প্রণীত বুখারী শরীফের সর্বশেষ বিশ্বস্ত ও বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ ‘ফাৎহুল বারী’ প্রভৃতি অমূল্য গ্রন্থাবলী যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহ্কে যাবতীয় বিদ‘আতী আকীদা ও মাযহাবী তাকলীদের বেড়াজাল ছিন্ন করে পবিত্র কুরআন  ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার আন্দোলনে আলোকবর্তিকা হিসাবে পথ দেখাবে। উপরোক্ত কেতাবগুলি বিভিন্ন যুগে আলেহাদীছ বিদ্বানদের রচিত অগণিত কিতাবসমূহের একটি ভগ্নাংশ মাত্র। আরও বহু কিতাব ছিল, যা হয়তবা হারিয়ে গেছে। নয়তবা আজও ছাপার মুখ দেখেনি কিংবা এখনও কোন প্রাচীন লাইব্রেরীর অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী হয়ে প্রকাশের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে।

উপরোক্ত কিতাব সমূহের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল একটিই-মুসলিম উম্মাহ্কে কিতাব ও সুন্না্হর মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা এবং ঐ দুই উৎসের সঠিক বুঝ হাছিলের জন্য সালাফে ছালেহীনের গৃহীত পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং নবোদ্ভূত মতবাদ ও কল্পিত মাযহাবসমূহ হ’তে বিরত রাখা। আর এটাই হ’ল আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।       

মুসলমানদের মধ্যে আহলেহাদীছ আন্দোলনই চিরকাল শিরক ও বিদ‘আত সহ সকল প্রকার ভ্রান্ত আক্বীদা ও ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন বিজাতীয় রসম-রেওয়াজের বিরোধিতা করে এসেছে এবং কুরআন ও হাদীছের নির্ভেজাল সত্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে। কোন বাধা-বিপত্তিকে তারা তোয়াক্কা করেনি; বরং সদা সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছে। তাই আমরা বলতে পারি যে, নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় আহলেহাদীছ আন্দোলন এক অপ্রতিরোধ্য কাফেলার নাম। এ কাফেলা লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দাওয়াতকে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। এ দাওয়াতকে গ্রন্থাবদ্ধ করে আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ একে স্থায়ীত্ব ও অমরত্ব দান করেছেন। সুতরাং রাসূলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ক্বিয়ামত পর্যন্ত হকের এ দাওয়াতী কাফেলা টিকে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

অতএব আসুন, আমরা এ হকের দাওয়াতী কাফেলায় শরীক হয়ে দ্বীনে হকের দাওয়াতকে বুলন্দ করি এবং এর মাধ্যমে নিজেদের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ হাছিলে ব্রতী হই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!



বিষয়সমূহ: সংগঠন
আরও