পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের করণীয় (৩য় কিস্তি)

আব্দুর রহীম 9133 বার পঠিত

পিতা-মাতার প্রতিদান :

বাবা-মা যে কষ্ট করে সন্তান লালন-পালন করেন তার প্রতিদান কেউ দিতে পারেনা। এমনকি মায়ের এক ফোটা দুধের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনা। কিন্তু ভালোর প্রতিদান ভালো কাজ দিয়ে হওয়া উচিৎ। আল্লাহ বলেন, هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ ‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কি হ’তে পারে? (আর-রহমান ৫৫/৬০)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: لاَ يَجْزِى وَلَدٌ وَالِدَهُ إِلاَّ أَنْ يَجِدَهُ مَمْلُوكًا فَيَشْتَرِيَهُ فَيُعْتِقَهُ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, সন্তানের পক্ষে তার পিতার প্রতিদান শোধ করা সম্ভব নয়। তবে সে তাকে দাসরূপে পেয়ে ক্রয় করে দাসত্বমুক্ত করে দিলে তার প্রতিদান হতে পারে’।[1] অন্য হাদীছে এসেছে,

وَعَنْ أَبِي بُرْدة قَالَ: شَهِدْتُ ابْنَ عُمَرَ رضي الله عنهما  وَرَجُلٌ يَمَانِيٌّ يَطُوفُ بِالْبَيْتِ قَدْ حَمَلَ أُمَّهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ، يَقُولُ: إِنِّي لَهَا بَعِيرُهَا الْمُذَلَّل ... إِنْ أُذْعِرَتْ رِكَابُهَا  لَمْ أُذْعَرْ ثُمَّ قَالَ: يَا ابْنَ عُمَرَ  أَتَرَانِي جَزَيْتُهَا؟ قَالَ: لاَ، وَلاَ بِزَفْرَةٍ وَاحِدَةٍ-

আবু বুরদা (রহঃ) বলেন, তিনি ইবনে ওমর (রাঃ)-এর সাথে ছিলেন। ইয়ামনের এক ব্যক্তি তার মাকে তার পিঠে বহন করে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করছিল আর বলছিল, ‘আমি তার জন্য তার অনুগত উটতুল্য। আমি তার পাদানিতে আঘাতপ্রাপ্ত হলেও নিরুদ্বেগে তা সহ্য করি’। অতঃপর সে ইবনে ওমর (রাঃ)-কে বলল, আমি কি আমার মাতার প্রতিদান দিতে পেরেছি বলে আপনি মনে করেন? তিনি বলেন, না, তার একটি দীর্ঘশ্বাসের প্রতিদানও হয়নি’।[2]  আর যদি পিতামাতার সাথে খারাপ আচরণ করা হয়। তাহ’লে তার প্রতিদান অনুরূপ অথবা তার চেয়ে খারাপ হয়ে থাকে। নিম্নে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হ’ল- (ক) عَنْ ثَابِتٍ الْبُنَانِيُّ رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَى قَالَ : رُوِيَ أَنَّ رَجُلًا كَانَ يَضْرِبُ أَبَاهُ فِي مَوْضِعٍ، فَقِيلَ لَهُ مَا هَذَا ؟ فَقَالَ الْأَبُ خَلُّوا عَنْهُ ، فَإِنِّي كُنْتُ أَضْرِبُ أَبِي فِي هَذَا الْمَوْضِعِ، فَابْتُلِيتُ بِابْنِي يَضْرِبُنِي فِي هَذَا الْمَوْضِعِ ، هَذَا بِذَاكَ وَلَا لَوْمَ عَلَيْهِ- ছাবেত আল-বুনানী (রহঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, বর্ণিত আছে যে, জনৈক ব্যক্তি তার পিতাকে এক স্থানে মারছিল। তখন তাকে বলা হ’ল এটি তুমি কি করছ? তখন পিতা বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। কারণ এই স্থানেই আমি আমার বাবাকে মেরে ছিলাম। ফলে আমার ছেলের দ্বারা আমি এই স্থানে এরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। এটি তারই বিনিময়। তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই’।[3]

(খ) عَنْ أَبِي حَفْصٍ الْيَسْكَنْدِيِّ، أَنَّهُ أَتَاهُ رَجُلٌ فَقَالَ: إِنَّ ابْنِي ضَرَبَنِي وَأَوْجَعَنِي. قَالَ: سُبْحَانَ اللهِ الابْنُ يَضْرِبُ أَبَاهُ؟ ! قَالَ: نَعَمْ ضَرَبَنِي وَأَوْجَعَنِي.فَقَالَ: هَلْ عَلَّمْتَهُ الْأَدَبَ وَالْعِلْمَ؟ قَالَ: لَا، فَهَلْ عَلَّمْتَهُ الْقُرْآنَ؟ قَالَ: لَا، قَالَ: فَأَيَّ عَمَلٍ يَعْمَلُ؟ قَالَ الزِّرَاعَةَ.قَالَ: هَلْ عَلِمْتَ لِأَيِّ شَيْءٍ ضَرَبَكَ؟ قَالَ: لَا.قَالَ: فَلَعَلَّهُ حِينَ أَصْبَحَ وَتَوَجَّهَ إِلَى الزَّرْعِ وَهُوَ رَاكِبٌ الْحِمَارَ، وَالثِّيرَانُ بَيْنَ يَدَيْهِ وَالْكَلْبُ مِنْ خَلْفِهِ، وَهُوَ لَا يُحْسِنُ الْقُرْآنَ فَتَغَنَّى وَتَعَرَّضْتَ لَهُ فِي ذَلِكَ الْوَقْتِ، فَظَنَّ أَنَّكَ بَقَرَةٌ، فَاحْمَدِ اللَّهَ حَيْثُ لَمْ يَكْسِرْ رَأْسَكَ- আবু হাফছ ইয়াসকান্দী বলেন, তার নিকট জনৈক লোক এসে বলল, আমার ছেলে আমাকে মেরে ব্যথিত করেছে। তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! ছেলে তার পিতাকে মেরেছে? সে বলল, হ্যাঁ, আমাকে মেরে ব্যথিত করেছে। তিনি বললেন, তুমি কি তাকে জ্ঞান ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছ? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি তাকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহলে সে কোন কাজ করে? সে বলল, কৃষি কাজ। আচ্ছা তুমি কি জান যে, সে কেন তোমাকে মেরেছিল? সে বলল, না। তাহলে হতে পারে যে, সে যখন সকালে গাধার উপর আরোহন করে কৃষিকাজে যাচ্ছিল আর তার সামনে ছিল বলদ, পিছনে ছিল কুকুর এবং সে কুরআন তেলাওয়াত করতে জানত না। ফলে সে গান গাইছিল আর এ অবস্থায় তুমি তার মুখোমুখি হয়েছিলে। তখন সে তোমাকে গরু মনে করেছিল (এবং তোমাকে মেরে ছিল)। তুমি বরং আল্লাহর প্রশংসা কর যে, সে তোমার ঘাড় মটকিয়ে দেয়নি’।[4]

(গ) قَالَ الْمَدَائِنِي: أن جريرا كان أعق الناس بأبيه. وكان ابنه بلال عاقا له، فتشاتما يوما، وقد أغلظ بلال لأبيه فقالت له أمه: يا عدوّ الله، أتقول هذا لأبيك؟ فقال جرير: دعيه، فكأنه سمعها مني وأنا أقولها لأبي- মাদায়েনী বলেন, কবি জারীর সবচেয়ে বড় পিতার অবাধ্য ব্যক্তি ছিলেন। আর তার ছেলে বেলালও তার অবাধ্য ছিল। সে একদিন পিতার সাথে গালাগালিতে লিপ্ত হয় এবং এতে কষ্টদায়ক ভাষা ব্যবহার করে। শুনে তার মা তাকে বলল, হে আল্লাহর শত্রু! তুমি বাবাকে এসব কথা বলছ? তখন জারীর বলল, তাকে বলতে দাও। হয়ত সে এসব কথা আমাকে বলতে শুনেছে যখন আমি আমার পিতাকে বলেছিলাম’।[5]

(ঘ) আছমাঈ বলেন, জনৈক আরব আমার নিকট বর্ণনা করেন যে, আমি পিতামাতার সর্বাধিক অবাধ্য ও সর্বাধিক সুন্দর আচরণকারীকে খোঁজার জন্য মহল্লা থেকে বের হলাম। বিভিন্ন পাড়ায় পরিভ্রমন করে এক বৃদ্ধকে পেলাম। যার গলায় রশি বাধা ছিল। আর তা দ্বারা সে পানির বালতি বহন করছে। যেখানে প্রচন্ড রোদের কারণে উটও তা করতে পারেনা। কঠিন গরম পড়ছিল। তার পিছনে একজন যুবক ছিল। আর তার হাতে একটি চাবুক ছিল যা দিয়ে সে তাকে পিটাচ্ছিল। এতে তার পিঠ ফেটে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল। আমি বললাম, তুমি কি এই দুর্বল বৃদ্ধের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবেনা? তার জন্য কি গলায় রশি নিয়ে পানি বহন করাই যথেষ্ট ছিলনা? আবার তুমি তাকে পিটাচ্ছ? সে বলল, আরে সেতো একই সাথে আমার পিতাও। আমি বললাম, আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করুন। সে বলল, চুপ করুন! সেও এরূপ আচরণ করত তার পিতার সাথে। আর তার পিতা তার দাদার সাথে। আমি বললাম, এই লোকই পিতার সর্বাধিক অবাধ্য। এরপর কিছুদূর না যেতেই জনৈক যুবকের নিকট পৌঁছলাম। তার কাঁধে একটি ঝুড়ি রয়েছে। তাতে রয়েছে এক বৃদ্ধ। যেন একটি পাখির বাচ্চা। প্রতি এক ঘন্টা চলার পর সে ঝুড়ি তার সামনে রেখে তাকে খাবার দিচ্ছে যেমন পাখিরা করে থাকে। আমি বললাম, এটি কে? সে বলল, আমার আববা। তিনি অচল হয়ে পড়েছেন। আর আমি তাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি’। তখন আমি বললাম, এই লোকই পিতার প্রতি সবচেয়ে বড় সদাচারণকারী আরব।[6]

পিতা-মাতার প্রতি অসদ্ব্যবহারের শাস্তি :

দুনিয়াবী শাস্তি : পিতামাতার সাথে খারাপ আচরণ করলে বা কোনভাবে তাদের কষ্ট দিলে আল্লাহ তাকে পরকালে শাস্তি দিবেন। পাশাপাশি দুনিয়াতেও দ্রুত শাস্তি নেমে আসবে। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تُدْرِكَا دَخَلْتُ الْجَنَّةَ أَنَا وَهُوَ كَهَاتَيْنِ  وَأَشَارَ بِإِصْبَعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوسْطَى، وَبَابَانِ مُعَجَّلَانِ عُقُوبَتُهُمَا فِي الدُّنْيَا الْبَغْيُ وَالْعُقُوقُ - আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,  ‘যে লোক দু’টি মেয়ে সন্তানকে লালন-পালন করবে, আমি এবং সে এভাবে একসাথে পাশাপাশি জান্নাতে অবস্থান করব। এই বলে তিনি নিজের হাতের মধ্যমা ও তর্জনী আঙ্গুল একত্র করে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন। আর পাপের দু’টি স্তর যার শাস্তি দুনিয়াতে দ্রুত প্রদান করা হয়। আর তা হ’ল ব্যাভিচার ও পিতামাতার অবাধ্যতা’।[7]

বদনাম ছড়িয়ে পড়া :

পিতামাতার খেদমত করা আবশ্যক। আল্লাহর নির্দেশ পালনের পরপরই পিতামাতার গুরুত্ব রয়েছে। প্রয়োজনে নফল ইবাদত ছেড়ে পিতামাতার ডাকে সাড়া দিতে হবে। তারা মনের কষ্ট একবার ‘উহ’& শব্দ করে বদদো‘আ করলে আল্লাহ কবুল করে নিবেন। পূর্ব যুগে জনৈক ব্যক্তি মায়ের ডাকে সাড়া না দেওয়ার কারণে লাঞ্চিত হয়েছিলেন। রাসূল (ছাঃ) সে ঘটনা বর্ণনা করার মাধ্যমে আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন যে, মাকে কোনভাবেই অসন্তুষ্ট রাখা যাবে না। যেমন এক হাদীছে এসেছে-

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّهُ قَالَ كَانَ جُرَيْجٌ يَتَعَبَّدُ فِى صَوْمَعَةٍ فَجَاءَتْ أُمُّهُ. قَالَ حُمَيْدٌ فَوَصَفَ لَنَا أَبُو رَافِعٍ صِفَةَ أَبِى هُرَيْرَةَ لِصِفَةِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أُمَّهُ حِينَ دَعَتْهُ كَيْفَ جَعَلَتْ كَفَّهَا فَوْقَ حَاجِبِهَا ثُمَّ رَفَعَتْ رَأْسَهَا إِلَيْهِ تَدْعُوهُ فَقَالَتْ يَا جُرَيْجُ أَنَا أُمُّكَ كَلِّمْنِى. فَصَادَفَتْهُ يُصَلِّى فَقَالَ اللَّهُمَّ أُمِّى وَصَلاَتِى. فَاخْتَارَ صَلاَتَهُ فَرَجَعَتْ ثُمَّ عَادَتْ فِى الثَّانِيَةِ فَقَالَتْ يَا جُرَيْجُ أَنَا أُمُّكَ فَكَلِّمْنِى. قَالَ اللَّهُمَّ أُمِّى وَصَلاَتِى. فَاخْتَارَ صَلاَتَهُ فَقَالَتِ اللَّهُمَّ إِنَّ هَذَا جُرَيْجٌ وَهُوَ ابْنِى وَإِنِّى كَلَّمْتُهُ فَأَبَى أَنْ يُكَلِّمَنِى اللَّهُمَّ فَلاَ تُمِتْهُ حَتَّى تُرِيَهُ الْمُومِسَاتِ. قَالَ وَلَوْ دَعَتْ عَلَيْهِ أَنْ يُفْتَنَ لَفُتِنَ. قَالَ وَكَانَ رَاعِى ضَأْنٍ يَأْوِى إِلَى دَيْرِهِ قَالَ: فَخَرَجَتِ امْرَأَةٌ مِنَ الْقَرْيَةِ فَوَقَعَ عَلَيْهَا الرَّاعِى فَحَمَلَتْ فَوَلَدَتْ غُلاَمًا فَقِيلَ لَهَا مَا هَذَا قَالَتْ مِنْ صَاحِبِ هَذَا الدَّيْرِ. قَالَ فَجَاءُوا بِفُئُوسِهِمْ وَمَسَاحِيهِمْ فَنَادَوْهُ فَصَادَفُوهُ يُصَلِّى فَلَمْ يُكَلِّمْهُمْ- قَالَ فَأَخَذُوا يَهْدِمُونَ دَيْرَهُ فَلَمَّا رَأَى ذَلِكَ نَزَلَ إِلَيْهِمْ فَقَالُوا لَهُ سَلْ هَذِهِ  قَالَ  فَتَبَسَّمَ ثُمَّ مَسَحَ رَأْسَ الصَّبِىِّ فَقَالَ مَنْ أَبُوكَ قَالَ أَبِى رَاعِى الضَّأْنِ.فَلَمَّا سَمِعُوا ذَلِكَ مِنْهُ قَالُوا نَبْنِى مَا هَدَمْنَا مِنْ دَيْرِكَ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ. قَالَ لاَ وَلَكِنْ أَعِيدُوهُ تُرَابًا كَمَا كَانَ ثُمَّ عَلاَهُ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, জুরায়জ (বনী ইসরাঈলের এক আবিদ) তার ইবাদতখানায় ইবাদতে মশন্ডল থাকতেন। (একবার) তাঁর মাতা তাঁর কাছে এলেন। হুমাইদ (রহঃ) বলেন, আমাদের কাছে আবু রাফে‘ এমন আকারে ব্যক্ত করেন, যেমনভাবে রাসূল (ছাঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ) এর কাছে ব্যক্ত করেছিলেন সেই মায়ের ডাকার পদ্ধতি এবং যেভাবে তাঁর হাত তাঁর ভ্রুর উপর রাখছিলেন এবং তাঁর দিকে মাথা উচু করে তাকে ডাকছিলেন। তিনি বলছিলেন, হে জুরায়জ! আমি তোমার মা, আমার সাথে কথা বল। এই কথা এমন অবস্থায় বলছিলেন, যখন জুরায়জ ছালাতে মশগুল ছিলেন। তখন তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! (একদিকে) আমার মা আর (অপর দিকে) আমার ছালাত (আমি কী করি?)। রাবী বলেন, অবশেষে তিনি তাঁর ছালাতকে অগ্রাধিকার দিলেন এবং তার মা ফিরে গেলেন। পরে তিনি দ্বিতীয়বার এসে বললেন, হে জুরাইজ! আমি তোমার মা, তুমি আমার সঙ্গে কথা বল। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমার মা, আমার ছালাত। তখন তিনি তাঁর ছালাতেই মশগুল রইলেন। তখন তাঁর মা বললেন, হে আল্লাহ! এই জুরায়জ আমারই ছেলে। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। সে আমার সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করল। হে আল্লাহ! তার মৃত্যু দিয়ো না, যে পর্যন্ত না তাকে ব্যভিচারিণীদের দেখাও। তখন নবী (ছাঃ) বলেন, যদি তার মাতা তার বিরুদ্ধে অন্য কোন বিপদের জন্য বদদো‘আ করতেন তাহ’লে সে অবশ্যই সেই বিপদে পতিত হ’ত। নবী (ছাঃ) বলেন, এক মেষ রাখাল জুরাইজের ইবাদতখানায় (মাঝে মাঝে) আশ্রয় নিত। তিনি বলেন, এরপর গ্রাম থেকে এক মহিলা বের হয়েছিল। উক্ত রাখাল তার সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়। এতে মহিলাটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। তখন লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করল, এই (সন্তান) কোথা থেকে? সে উত্তর দিল, এই ইবাদতখানায় যে বাস করে, তার থেকে। তিনি বলেন, এরপর তারা শাবল-কোদাল ইত্যাদি নিয়ে এল এবং চিৎকার করে ডাক দিল। তখন জুরাইজ ছালাতে মশগুল ছিলেন। কাজেই তিনি তাদের সাথে কথা বললেন না। তিনি বলেন, এরপর তারা তার ইবাদতখানা ধ্বংস করতে লাগল। তিনি এ অবস্থা দেখে নীচে নেমে এলেন। এরপর তারা বলল, এই মহিলাকে জিজ্ঞাসা কর (সে কি বলছে)। তিনি বলেন, তখন জুরাইজ মুচকী হেসে শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার পিতা কে? তখন শিশুটি বলল, আমার পিতা সেই মেষ রাখাল। যখন তারা সে শিশুটির মুখে একথা শুনতে পেল তখন তারা বলল, আমরা তোমার ইবাদতখানার যেটুকু ভেঙ্গে ফেলেছি তা সোনা-রূপা দিয়ে পুর্ননির্মাণ করে দেব। তিনি বললেন, না; বরং তোমরা মাটি দ্বারাই পূর্বের ন্যায় তা নির্মাণ করে দাও। এরপর তিনি তার ইবাদতগাহে উঠে গেলেন’।[8]

পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে জিব্রাঈলের বদদো‘আ :

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : رَغِمَ أَنْفُ ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ ثُمَّ رَغِمَ أَنْفُ. قِيلَ مَنْ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: مَنْ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَيْهِمَا فَلَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, তার নাক ধূলি ধূসরিত হৌক (৩ বার)। বলা হ’ল, তিনি কে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে কিংবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না’।[9]

হাদীছে এসেছে, عَنْ كَعْبِ بْنِ عُجْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: احْضُرُوا الْمِنْبَرَ فَحَضَرْنَا، فَلَمَّا ارْتَقَى دَرَجَةً قَالَ: آمِينَ، فَلَمَّا ارْتَقَى الدَّرَجَةَ الثَّانِيَةَ قَالَ: آمِينَ، فَلَمَّا ارْتَقَى الدَّرَجَةَ الثَّالِثَةَ قَالَ: آمِينَ، فَلَمَّا فَرَغَ نَزَلَ مِنَ الْمِنْبَرِ قَالَ: فَقُلْنَا له يَا رَسُولَ اللهِ لَقَدْ سَمِعْنَا الْيَوْمَ مِنْكَ شَيْئًا لَمْ نَكُنْ نَسْمَعُهُ قَالَ: إِنَّ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَامِ عَرْضَ لِي فَقَالَ: بَعُدَ مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ فَقُلْتُ: آمِينَ فَلَمَّا رَقِيتُ الثَّانِيَةَ قَالَ: بَعُدَ مَنْ ذُكِرْتَ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ فَقُلْتُ: آمِينَ، فَلَمَّا رَقِيتُ الثَّالِثَةَ قَالَ: بَعُدَ مَنْ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ الْكِبَرَ عِنْدَهُ أَوْ أَحَدُهُمَا، فلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ  أَظُنُّهُ قَالَ :فَقُلْتُ: آمِينَ-  কা‘ব বিন ঊজরা হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বার উপস্থিত করতে বললেন। আমরা তা উপস্থিত করলাম। তিনি মিম্বরে আরোহণ করলেন। অতঃপর ১ম সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। ২য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। এরপর ৩য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন। বক্তব্য শেষে মেম্বার থেকে নামলে আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে এমন কিছু বলতে শুনলাম যা ইতিপূর্বে শুনেনি। তিনি বললেন, আমি যখন ১ম সিঁড়িতে উঠলাম, তখন জিব্রীল (আঃ) আমাকে এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রামাযান মাস পেল। অতঃপর মাস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হ’ল না। (পরে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন)। তুমি বল, আমীন। তখন আমি বললাম, আমীন’। অতঃপর ২য় সিঁড়িতে পা দিলে তিনি বললেন, যার নিকটে তোমার কথা বর্ণনা করা হ’ল, অথচ সে তোমার উপরে দরূদ পাঠ করলো না। অতঃপর মারা গেল ও জাহান্নামে প্রবেশ করলো। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তুমি বল, আমীন। তখন আমি বললাম, আমীন। ২য় সিঁড়িতে উঠলে জিব্রীল (আঃ) বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে বা তাদের একজনকে পেল। অতঃপর সে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করলো না (ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল, আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন)’।[10]     (ক্রমশ:)

[1]. মুসলিম হা/১৫১০; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১০; মিশকাত হা/৩৩৯১।

[2]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১১; আল-আছারুছ ছহীহাহ হা/১৯৯।

[3]. আবুল লায়ছ সামারকান্দী, তানবীহুল গাফেলীন হা/১৫২, ১/১৩১; মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ সাফারেনী, গেযাউল আলবাব ১/৩৭৩।

[4]. তানবীহুল গাফেলীন হা/১৫২, ১/১৩০-১৩১।

[5]. আহমাদ মুছতফা দরবীশ, ই‘রাবুল কুরআন ৫/৪২১; আব্দুল কাদের বাগদাদী, খাযানাতুল আদাব ১/৭৬।

[6]. বায়হাকী, আল-মাহাসিন ওয়াল মাসাঈ ১/২৩৫, ১/৬১৪; নাযরাতুন নাঈম ১০/৫০১৬; মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম, ঊকুকুল ওয়ালিদায়েন ১/৬২।

[7]. হাকেম হা/৭৩৫০; ছহীহাহ হা/১১২০; ছহীহুল জামে‘ হা/২০১০।

[8]. বুখারী হা/৩৪৩৬; মুসলিম হা/২৫৫০; আহমাদ হা/৮০৭১; আল আদাবুল মুফরাদ হা/৩৩।

[9]. মুসলিম হা/২৫৫১; মিশকাত হা/৪৯১২।

[10]. হাকেম হা/ ৭২৫৬; আহমাদ হা/৭৪৪৪; ইবনু হিববান হা/৪০৯; শু‘আবুল ঈমান হা/১৪৭১; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬৭৭, ৯৯৫; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪০৯, ছহীহ লেগায়রিহী; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪৬।




আরও