সাংবাদিকতায় আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদান (২য় কিস্তি)

ড. নূরুল ইসলাম 740 বার পঠিত

আহলেহাদীছ জামাআতের পত্র-পত্রিকা সমূহ (পুরাতন) :

আমার জানা মতে আহলেহাদীছ জামা‘আতের (পুরাতন) পত্র-পত্রিকা সমূহের সংখ্যা সর্বমোট ৯৯টি। যেগুলিকে প্রবন্ধের বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে ৬ ভাগে বিভক্ত করা যায়।

প্রথম প্রকার ভ্রান্ত ধর্মগুলোর খন্ডনে, যার সংখ্যা ১১টি :

১. ইশাআতুস সুন্নাহ (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল বাটালা, গুরুদাসপুর (পাঞ্জাব), সম্পাদক মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী, প্রকাশকাল ১৮৭৮ খৃঃ।

এটি আহলেহাদীছ জামাআতের প্রথম পত্রিকা। যেটি বহু বছর যাবৎ ইলমে দ্বীনের খিদমত করেছে, খ্রিষ্টানদের অভিযোগ সমূহের জবাব দিয়েছে এবং মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর কুফরী বক্তব্যগুলির মূলোৎপাটন করেছে। এটি মুক্বাল্লিদ এবং প্রকৃতিবাদীদের বাড়াবাড়ি ও ভুল-ত্রুটি সংশোধন করত। এই পত্রিকাটি প্রথমে ‘সাফীরে হিন্দ’ (অমৃতসর) পত্রিকার পরিশিষ্ট ছিল। অতঃপর ১৮৭৮ সালে পৃথকভাবে ‘ইশা‘আতুস সুন্নাহ’ নামে প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং ১৮৮১ সালের শুরু থেকে এ পত্রিকাটির সাথে চার পৃষ্ঠার একটি পরিশিষ্টও শামিল করে দেয়া হয়েছিল। এতে শুধুমাত্র কুরআন ও সুন্নাহর অনুকূলে মূলনীতি, শাখা-প্রশাখা, আক্বীদা ও আমল সংক্রান্ত বিষয় সমূহ দলীলসহ লিপিবদ্ধ করা হত।

২. আখবারে জাফর যেটলী (উর্দূ) সাপ্তাহিক, প্রকাশস্থল লাহোর, সম্পাদক মোল্লা মুহাম্মাদ বখশ লাহোরী, প্রকাশকাল মার্চ ১৮৮৭ খৃঃ। এ পত্রিকাটি স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁন এবং প্রকৃতিবাদীদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার জন্য উৎসর্গিত ছিল।

৩. ইমাম (উর্দূ) সাপ্তাহিক, প্রকাশস্থল ফয়যাবাদ, সম্পাদক মুহাম্মাদ মুহসিন, প্রকাশকাল ১৩৪৫ হিঃ/১৯২৬ খৃঃ।

এ পত্রিকাটি সাধারণভাবে সকল ভ্রান্ত মতাদর্শ বিশেষ করে বাহাঈ মতবাদের নিন্দা করত। উপরন্তু এতে ইসলামী প্রবন্ধমালা, মজাদার গল্প, সুন্দর সুন্দর কবিতা এবং দেশীয় খবরাখবর প্রকাশিত হত।

৪. আহলেহাদীছ (উর্দূ) সাপ্তাহিক, প্রকাশস্থল অমৃতসর (পাঞ্জাব), সম্পাদক মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, প্রকাশকাল ১৩ই নভেম্বর ১৯০৩ খৃঃ।

এ পত্রিকাটি অত্যন্ত উপকারী, বহুল প্রচারিত এবং সব জামা‘আত, মাযহাব ও জাতির মাঝে সকলের প্রিয় ছিল। এতে ধর্মীয় ও নৈতিক প্রবন্ধ সমূহ, ফৎওয়া, বিরোধীদের সমালোচনাসমূহ ও তার জবাব এবং দুই পৃষ্ঠাব্যাপী সারা দুনিয়ার নির্বাচিত সংবাদসমূহ প্রকাশিত হত। এই পত্রিকাটি প্রত্যেক শুক্রবারে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত। অত্যন্ত প্রতিকূল ও দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেও ১৯৪৭ সালের ১লা আগস্ট শুক্রবার এর সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এরপর এই প্রদীপ চিরদিনের জন্য নিভে যায়।

এই পত্রিকাটি দু’বার বন্ধ হয়। প্রথমবার ১৯১৯ সালে ‘আহলেহাদীছ’-এর ১৬তম বর্ষের ১৪ ও ১৫ সংখ্যা দু’টি প্রকাশিত হয়নি। এর কারণ ছিল যে, প্রেস পরিবর্তনের কারণে নতুন ডিক্লারেশন দাখিল করা হয়েছিল। অমৃতসরের ডেপুটি কোন কারণে দেরী করে যার আদেশ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার ১৯২৩ সালের আগস্টে ‘আহলেহাদীছ’-এর ২০তম বর্ষের ৪১ ও ৪২ সংখ্যা দু’টি প্রকাশিত হয়নি। এর কারণ ছিল যে, প্রেস সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাওলানা ‘গুলদাস্তায়ে ছানাঈ’ নামে এই অভাব পূরণ করেছিলেন।

৫. তাবলীগ (উর্দূ) পাক্ষিক, প্রকাশস্থল জাবালপুর, সম্পাদক মাওলানা আব্দুল জববার ওমরপুরী, প্রকাশকাল মে ১৮৯৩ খৃঃ। এই পত্রিকাটি আঞ্জুমানে ইসলামিয়া, জাবালপুর-এর মুখপত্র ছিল। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন হাজী আব্দুল গফূর। ১৮৯৪ সালের জানুয়ারী থেকে এটি সাপ্তাহিক হয়ে গিয়েছিল। ভারতে ক্রমবর্ধমান পশ্চিমা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এটি একটি অনন্য মুসলিম কৃতিত্ব ছিল।

৬. যিয়াউস সুন্নাহ (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল কলকাতা, সম্পাদক মাওলানা যিয়াউর রহমান, প্রকাশকাল যিলক্বদ ১৩১৯ হিজরী মোতাবেক ফেব্রুয়ারী ১৯০২ খৃঃ।

এই পত্রিকাটি প্রত্যেক আরবী মাসের ১ তারিখে বের হত। এর কভারপেজে وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)আয়াতটি লিখিত থাকত। এতে সম্পাদকের স্বরচিত উপদেশপূর্ণ কবিতা সমূহ থাকত। এতে তাওহীদ ও সুন্নাতের সৌন্দর্য এবং শিরক ও বিদ‘আতের অনিষ্টকারিতা বিবৃত করা ছাড়াও ইসলাম বিরোধীদের জবাব দেয়া হত। উপরন্তু ইসলামের খলীফাদের জীবনী এবং উপন্যাসধর্মী প্রবন্ধমালা প্রকাশিত হত। তাছাড়া এতে ইংরেজী ও আরবী পত্র-পত্রিকা থেকে বাছাইকৃত খবরও প্রকাশিত হত।

৭. কার্জন গেজেট (উর্দূ) সাপ্তাহিক, প্রকাশস্থল দিল্লী, সম্পাদক মির্যা হায়রাত বেগ দেহলভী, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী ১৮৯৯ খৃঃ।

এ পত্রিকায় গবেষণাধর্মী, ঐতিহাসিক ও সমালোচনাধর্মী প্রবন্ধ এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক খবর সমূহ প্রকাশিত হত। এর চতুর্থ পৃষ্ঠায় ‘ইয়াদে রাফতেগাঁ’ শিরোনামে বাহাদুর শাহ জাফরের ‘সিরাজুল আখবার’ গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত অংশ ছাপা হত। এটি ব্রিটিশ সরকারের চেলা-চামুন্ডাদের খোলাখুলি সমালোচনা করত, সরকারের ভুল কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতে পিছপা হত না। এতে খৃষ্টান মিশনারীদের বিপজ্জনক পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে জানানো হ’ত।

৮. মুরাককা কাদিয়ানী (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল অমৃতসর (পাঞ্জাব), সম্পাদক মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, প্রকাশকাল জুন ১৯০৭ মোতাবেক রবীঊল আখের ১৩২৫ হিঃ।

এ পত্রিকায় মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর নবুঅত এবং তার প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবী খন্ডন করা হত। এর কভারপেজে লিখিত থাকত وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِى أُمَّتِى كَذَّابُونَ ثَلاَثُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِىٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ‘আমার উম্মতের মধ্যে অচিরেই ৩০ জন মিথ্যুকের আবির্ভাব ঘটবে। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী ধারণা করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী। আমার পরে কোন নবী নেই’।[1]

এতে ‘গুলদাস্তায়ে কাদিয়ানী’ শিরোনামে একটি কলাম থাকত, যেখানে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর পুরা মাসের বিশেষ বিশেষ ইলহামের উল্লেখ থাকত। মির্যার মৃত্যুর পর ‘গুলদাস্তায়ে আখবার’ নামে যার নামকরণ করা হয়। এতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক খবরসমূহও প্রকাশিত হত। এ পত্রিকাটি প্রত্যেক ইংরেজী মাসের ১লা তারিখে প্রকাশিত হত। ১৯০৭ সালের ১৫ই এপ্রিল মির্যা কাদিয়ানী মাওলানা অমৃতসরীর মৃত্যুর জন্য দো‘আ করে বিজ্ঞাপন ছেড়েছিল যে, আমাদের দু’জনের মধ্যে যে মিথ্যুক সে যেন সত্যবাদীর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করে। মাওলানা অমৃতসরী মির্যার উক্ত ইশতেহারের পর্দা উন্মোচন করে এ পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন। যেটি মির্যার মৃত্যু ২৬শে মে ১৯০৮-এর পরেও অক্টোবর ১৯০৮ সাল ২য় বর্ষ  ৫ম সংখ্যা পর্যন্ত নিয়মিত চালু ছিল। অতঃপর ১৯৩১ সালের এপ্রিলে এটি পুনরায় চালু হয় এবং ১লা এপ্রিল ১৯৩৩ পর্যন্ত জারী থাকে।

৯. মুসলমান (উর্দূ) সাপ্তাহিক, প্রকাশস্থল অমৃতসর (পাঞ্জাব), সম্পাদক মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, প্রকাশকাল মে ১৯০৮ খৃঃ।

এ পত্রিকাটি প্রতি ইংরেজী মাসের পনের তারিখে প্রকাশিত হত। মে ১৯১০ পর্যন্ত এটি মাসিক ছিল এবং ৭ই জুন ১৯১০ সাল থেকে সাপ্তাহিক হয় ও প্রত্যেক মঙ্গলবারে প্রকাশিত হতে শুরু করে। মাওলানা নিজেই লিখেছেন, ‘এপ্রিল সংখ্যায় ‘মুসলমান’ পত্রিকার ভবিষ্যৎ কর্মসূচী লিখিত ছিল যে, হয় এটি বন্ধ করে দেয়া হবে, নয় এটি সাপ্তাহিক হিসাবে বের হবে। যদিও প্রবল চিন্তা ছিল যে, এটা বন্ধ হয়ে যাবে। কেননা সাপ্তাহিকের যে শর্ত দেয়া হয়েছিল সেটা কিছুটা কঠিন ছিল। ... কিন্তু আল্লাহর ইলমে যেহেতু এটির সাপ্তাহিক হওয়া নির্ধারিত ছিল... সেজন্য আল্লাহর উপর ভরসা করে সাপ্তাহিক ‘মুসলমান’-এর প্রথম সংখ্যা পাঠকবৃন্দের সামনে পেশ করা হ’ল’।

প্রথম থেকে মাওলানা অমৃতসরীই এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু ৩রা জুলাই ১৯১৩ থেকে এর মালিকানা ও সম্পাদনার ভার মুন্সী আলীমুদ্দীনকে ন্যস্ত করা হয়েছিল। যিনি প্রথম থেকেই এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন।[2]

এ পত্রিকাটি ১৯১৪ সাল পর্যন্ত চালু ছিল এবং দু’দফা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রথমবার ৩রা জুন ১৯১৩ থেকে ৩রা জুলাই ১৯১৩ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়বার অক্টোবর ১৯১৩ থেকে ৩১শে ডিসেম্বর ১৯১৩ পর্যন্ত। এতে আর্য সমাজের অনুসারীদের গোস্তাখী, প্রগলভতা এবং তাদের অহেতুক সমালোচনাগুলির যুক্তিগ্রাহ্য ও দলীলভিত্তিক জবাব দেয়া হত।

১০. আন-নাযীর (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল মিরাঠ, সম্পাদক মুন্সী নাযীর হুসাইন, প্রকাশকাল মুহাররম ১৩২১ হিজরী মোতাবেক এপ্রিল ১৯০৩। এ পত্রিকাটি প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩ তারিখে প্রকাশিত হত। এতে ইসলাম বিরোধীদের বিশেষ করে আর্য সমাজীদের উত্তর দেওয়া হ’ত এবং বেদের স্বরূপ বর্ণনা করে আর্য সমাজীদের প্রকৃত চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরা হ’ত। আর্যদের পত্রিকা ‘আ-রয়া মুসাফির’-এর প্রবন্ধগুলির সমালোচনা ও পর্যালোচনা করত। শেষে ‘আম খবরেঁ’ শিরোনামে সারা দুনিয়ার নির্বাচিত খবরসমূহ প্রকাশ করা হ’ত।

১১. আল-হাদী (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল শিয়ালকোট (পাঞ্জাব), সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী।

এ পত্রিকাটি ঐ সময় চালু করা হয়েছিল, যখন খ্রিষ্টবাদের প্রচার-প্রসারের জোয়ার ছিল। যার ভিত্তি নতুন মাসীহ (মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী) মযবূত করে দিয়েছিল। এর মূলোৎপাটনের জন্য এই পত্রিকাটি উৎসর্গিত ছিল। এতে আর্য সমাজীদের সমালোচনাগুলির জবাবেও কিছু প্রবন্ধ থাকত। এতে অন্যদের কোন প্রবন্ধ থাকত না। শুধু মাওলানা শিয়ালকোটীর প্রবন্ধ থাকত। পরবর্তীতে এই প্রবন্ধগুলিকে গ্রন্থাকারে রূপান্তরিত করা হত।

দ্বিতীয় প্রকার শিরক, বিদআত ও তাক্বলীদে শাখছীর খন্ডনে, যার সংখ্যা ১৩টি :

১. আছারুস সুনান (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল পাটনা, সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মাদ, প্রকাশকাল মুহাররম ১৩১৭ হিঃ।

এ পত্রিকাটি মাওলানা আব্দুস সালামের ব্যবস্থাপনায় বের হত। মুহাররমের ১ম সংখ্যা বের হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর জুমাদাল আখেরাহ ও রজব সংখ্যা একসাথে বের হয় এবং চালু থাকে। অতঃপর বন্ধ হয়ে যায়। এটি তাওহীদের প্রচার এবং শিরক ও বিদ‘আতের খন্ডন করত। হাদীছ বিরোধী ও তাক্বলীদপন্থীদের জন্য এটা ঘাতক বিষের মতো ছিল।

২. আখবারে মুহাম্মাদী (উর্দূ) পাক্ষিক, প্রকাশস্থল দিল্লী, সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, প্রকাশকাল ১৩৪০ হিঃ।

এ পত্রিকাটি প্রথমে ‘গুলদাস্তায়ে মুহাম্মাদিয়া’ নামে চালু করা হয়েছিল। অতঃপর ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ রূপে প্রকাশ হতে শুরু করে। এই পত্রিকাটি কুরআন ও সুন্নাহর দাঈ এবং তাওহীদের রক্ষক ছিল। শিরক ও বিদ‘আতের নিন্দা করত এবং শেষ পৃষ্ঠাগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় সংবাদসমূহ প্রকাশ করত। এই পত্রিকাটি দু’বার বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমবার মাওলানা জুনাগড়ীর মৃত্যুর কারণে ১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪১ সালের সংখ্যা বের হওয়ার পর বন্ধ হয়ে পুনরায় ১৫ই জুন ১৯৪১ সাল থেকে মাওলানা সাইয়িদ তাকরীয আহমাদ সাহসোয়ানীর সম্পাদনায় বের হওয়া শুরু হয়। দ্বিতীয়বার ১৯৪৬ সালে কাগজ না পাওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ফেব্রুয়ারী ১৯৪৭ সালে চালু হয়। কয়েক মাস চালু থাকার পর এটি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।

৩. আহলুয যিকর (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল ফয়যাবাদ, সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ শামস ফয়যাবাদী, প্রকাশকাল ১৯০৮ খৃঃ।

এ পত্রিকাটি প্রায় দু’বছর লাক্ষ্ণৌ থেকে প্রকাশিত হয়। অতঃপর কিছু কারণে এর প্রকাশনা বন্ধ থাকে। দ্বিতীয়বার রজব ১৩৩৯ হিঃ মোতাবেক মার্চ ১৯২১ সালে চালু হয়। সে সময় তার সামনে তিনটি উদ্দেশ্য ছিল : (১) কুরআন ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠা করা। (২) পাঠদান ও দ্বীনী ইলম চর্চার জন্য বিভিন্ন জায়গায় মক্তব ও মাদরাসা চালু করা। (৩) গ্রন্থ রচনার জন্য লেখকদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা। যার মাধ্যমে  সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রন্থাবলী রচনা করিয়ে ছাপানোর ব্যবস্থা করা যায়।

১৯২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই পত্রিকাটি মাসিক ছিল। অতঃপর ৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯২২ থেকে পাক্ষিক হয়। পরে আবার মাসিক হয়ে যায়। এই পত্রিকায় প্রথমে সম্পাদক ছাহেবের স্বরচিত কবিতা থাকত। কখনো কখনো অন্য কবিদের কবিতাও প্রকাশিত হত। এরপর ‘শাযারাত’ শিরোনামে গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা-মাসায়েলের উপর আলোকপাত করা হত। তারপর ধর্মীয় সংস্কারমূলক এবং শিরক ও বিদ‘আতের নিন্দায় প্রবন্ধমালা থাকত।

৪. তাবলীগুস সুন্নাহ (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল দিল্লী, সম্পাদক মাওলানা আহমাদুল্লাহ, প্রকাশকাল ১৯২২ খৃঃ।

এ পত্রিকায় সাধারণভাবে ধর্মীয় ও সংস্কারধর্মী এবং শিরক-বিদ‘আতের খন্ডনে প্রবন্ধমালা প্রকাশিত হত এবং কখনো কখনো কাদিয়ানী মতবাদ এবং তাদের দাবীগুলিকে দলীল সহ খন্ডন করা হ’ত।

৫. তানযীমে আহলেহাদীছ (উর্দূ) সাপ্তাহিক, প্রকাশস্থল আম্বালা (পাঞ্জাব), সম্পাদক মাওলানা হাফেয আব্দুল্লাহ রৌপড়ী, প্রকাশকাল ২৬শে রামাযান ১৩৫০ হিঃ মোতাবেক ১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৩২ খৃঃ।

এ পত্রিকাটি শিরক ও বিদ‘আতের নিন্দা এবং কাদিয়ানী মতবাদের খন্ডন করত। এর শেষ পৃষ্ঠাগুলিতে দেশীয় খবরাখবর প্রকাশিত হত। এটি আহলেহাদীছ সংগঠন ও তার কর্মকান্ডকে জোরদার করার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এতে সম্পাদক ছাহেবের ফৎওয়া নিয়মিত প্রকাশিত হত। যেগুলি বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার ছিল। এই পত্রিকাটি চালুর পর থেকেই হাফেয মুহাম্মাদ ইসমাঈল এবং তার ভাই হাফেয আব্দুল কাদের রৌপড়ী সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করছিলেন। এর প্রথম সংখ্যা মার্চ ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। শুরুতে প্রায় দু’বছর পর্যন্ত এ পত্রিকাটি পাক্ষিক হিসাবে প্রকাশিত হতে থাকে। পরে সাপ্তাহিক করা হয়।

৬. আস-সাঈদ[3] (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল দারানগর, বেনারস, সম্পাদক মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী, প্রকাশকাল ১৩২৪ হিঃ। এ পত্রিকাটি তাওহীদের প্রচার-প্রসার, শিরক-বিদ‘আত ও তাক্বলীদে শাখছীর খন্ডন করত এবং কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণের দাওয়াত দিত।

৭. শাহনায়ে হিন্দ (উর্দূ) সাপ্তাহিক, প্রকাশস্থল মহল্লা আন্দার গেট, মীরাঠ, প্রকাশকাল ২০শে জানুয়ারী ১৮৮৩ খৃঃ। এই পত্রিকাটি দ্বীনী ও সংস্কারধর্মী প্রবন্ধের সাথে সাথে দেশীয় সংবাদ প্রকাশ করত। উপরন্তু তাওহীদ ও সুন্নাতের প্রতিরক্ষা এবং শিরক ও বিদ‘আতের নিন্দা করত।

৮. ছহীফায়ে আহলেহাদীছ (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল দিল্লী, সম্পাদক মাওলানা আব্দুল জলীল খাঁ, প্রকাশকাল মুহাররম ১৩৪০ হিঃ।

এই পত্রিকাটি ‘জামা‘আতে গোরাবায়ে আহলেহাদীছ’-এর মুখপত্র ছিল। এর কভার পেজে رَسُولٌ مِنَ اللهِ يَتْلُو صُحُفًا مُطَهَّرَةً ‘তিনি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত একজন রাসূল, যিনি আবৃত্তি করেন পবিত্র পত্র সমূহ’ (বাইয়েনাহ ৯৮/২)। উল্লেখ থাকত। এর উদ্দেশ্য ছিল তাওহীদ ও সুন্নাতের প্রচার, শিরক ও বিদ‘আতের মূলোৎপাটন এবং মুসলমানদেরকে ঐক্যের দিকে আহবান জানানো। উপরন্তু এতে ফৎওয়া সমূহের জবাব এবং দেশের ও দেশের বাইরের সংগঠন সংবাদ প্রকাশিত হত। মাওলানা আব্দুল জলীল খান ছাহেবের পর এর সম্পাদক হন মাওলানা আব্দুস সাত্তার।

৯. মুসলিম আহলেহাদীছ গেজেট (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল দিল্লী, সম্পাদক আবুল ফযল আব্দুল হান্নান, প্রকাশকাল জুন ১৯৩৩ মোতাবেক ছফর ১৩৫৩ হিঃ।

এই পত্রিকায় ধর্মীয়, মাসলাকগত এবং সংস্কারধর্মী প্রবন্ধ ছাড়াও শিরক ও বিদ‘আতের নিন্দায় প্রবন্ধমালা প্রকাশিত হত। এর কভার পেজে ইসলামী কবিতা থাকত। অতঃপর দিল্লীর রাজকীয় লাইব্রেরীর (শাহী কুতুবখানা) বইয়ের তালিকা থাকত। যার ধারাবাহিকতা প্রায় দু’বছর যাবৎ অব্যাহত ছিল। কতিপয় পৃষ্ঠা এশিয়া ইউনানী দাওয়াখানা দিল্লীর ঔষধ সমূহের তালিকার জন্য নির্দিষ্ট থাকত। এর উদ্দেশ্য ছিল : (১) জামা‘আত হিসাবে আহলেহাদীছ জামা‘আতকে জামা‘আতী বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে অবগত করা। (২) তৎকালীন সরকারের নিকট আহলেহাদীছ-এর প্রয়োজনীয়তা সঠিকভাবে তুলে ধরা। (৩) মুসলিম দেশসমূহ বিশেষতঃ সঊদী আরবের প্রকৃত অবস্থা আহলেহাদীছদেরকে অবগত করা। এর শেষ দুই পৃষ্ঠায় নির্বাচিত দেশীয় খবর থাকত।

১০. আল-মুশীর (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল এলাহাবাদ, সম্পাদক মাওলানা যিয়াউদ্দীন ফানী, প্রকাশকাল অজ্ঞাত। এ পত্রিকায় তাওহীদের প্রচার এবং শিরক, বিদ‘আত ও তাক্বলীদের খন্ডন করা হত এবং কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করার দাওয়াত দেয়া হত।

১১. নুছরাতুস সুন্নাহ (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল দারানগর, বেনারস, সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মাদ সাঈদ মুহাদ্দিছ বেনারসী, প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ খৃঃ মোতাবেক যিলক্বদ ১৩০২ হিঃ। এই পত্রিকাটি আহলেহাদীছ জামা‘আতের মুখপত্র ছিল। যেটি মুক্বাল্লিদদের হাদীছের খেলাফে লিখিত প্রত্যেকটি বইয়ের পরিষ্কারভাবে জবাব দেয়ার চেষ্টা করত। সাথে সাথে শিরক ও বিদ‘আতের খন্ডন করত। এতে সময়ের প্রয়োজন অনুপাতে একটি পরিশিষ্টও প্রকাশিত হত। যেখানে উন্নত প্রবন্ধমালা, সমকালীন গোঁড়া মাযহাবী পত্রিকাগুলির জবাব বা অন্য কোন প্রবন্ধ থাকত।

১২. হামদর্দে আহলেহাদীছ (উর্দূ) মাসিক, প্রকাশস্থল দিল্লী, সম্পাদক মাওলানা আব্দুস সাত্তার কিলানূরী, প্রকাশকাল শা‘বান ১৩৩৮ হিঃ মোতাবেক মে ১৯২০ খৃঃ। এ পত্রিকাটি প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১লা তারিখে প্রকাশিত হত। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল : (১) আল্লাহর বিধান সমূহকে মানুষের নিকট পৌঁছানো (২) নৈতিক ও তাওহীদ সম্পর্কিত প্রবন্ধসমূহ প্রকাশ করা। এতে কাদিয়ানী মতবাদের খন্ডনেও প্রবন্ধমালা প্রকাশিত হত। নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানের ‘আদ-দ্বীনুল খালেছ’ গ্রন্থের উর্দূ অনুবাদ দুই পৃষ্ঠাব্যাপী একটা সময় পর্যন্ত এতে প্রকাশিত হতে থাকে এবং শেষ পৃষ্ঠাগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় সংবাদও প্রকাশ করা হত।

জ্ঞাতব্য : এই পত্রিকাটি মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব দেহলভী (১৮৬৪-১৯৩২ খৃঃ) ১৩৩৮ হিজরীতে ‘আহলেহাদীছ’ নামে প্রকাশ করেন। পরে এর নামকরণ করা হয় ‘হামদর্দে আহলেহাদীছ’। অতঃপর ‘ছহীফায়ে আহলেহাদীছ’ নামে চালু থাকে এবং সময়ের পরিক্রমায় সম্পাদক বদলাতে থাকে।[4]

১৩. মাজাল্লায়ে হাতেফ, প্রকাশস্থল সামার্রা (বাস্তী), সম্পাদক মাওলানা আব্দুর রায্যাক সামার্রাবী, প্রকাশকাল অজ্ঞাত। এই পত্রিকায় ধর্মীয় ও সংস্কারমূলক এবং শিরক ও বিদ‘আত সম্পর্কে প্রবন্ধমালা থাকত। কয়েকটি সংখ্যা বের হওয়ার পর চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় (ওলামায়ে গোন্ডা ওয়া বাস্তী) (ক্রমশঃ)

মূল (উর্দূ) : মাওলানা মুহাম্মাদ মুস্তাকীম সালাফী

[লেখক : সাবেক শায়খুল জামে‘আহ, জামে‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস, ভারত।

অনুবাদক  : ড. নূরুল  ইসলাম

গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এবং ভাইস প্রিন্সিপাল, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী]

[1]. আবুদাঊদ হা/৪২৫৪; তিরমিযী হা/২৩৮০।

[2]. মুসলমান, ৩রা জুলাই ১৯১৩, ৬/১ সংখ্যা।

[3]. পত্রিকাটি প্রায় ১ বছর জারী ছিল (আব্দুর রশীদ ইরাকী, তাযকিরাতুল মুহাম্মাদিইয়ীন (সারগোধা : মাকতাবা ছানাইয়াহ, ২০১২), পৃঃ ১১২।- অনুবাদক।

[4]. সা‘আতে বাদল, পৃঃ ৫৯।




আরও