নিভে গেল সুন্নাতের বাতিঘর (ড. মুহাম্মাদ যিয়াউর রহমান আল-আ‘যমী)

আব্দুল হাকীম 1129 বার পঠিত

[অভিজাত হিন্দু ব্রাহ্মণ থেকে মুসলিম, অতঃপর অবিশ্বাস্যভাবে উম্মাহর খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর, ‘আল-জামি‘ আল-কামিল ফিল হাদীছ আছ-ছহীহ আশ-শামিল’-এর সংকলক ড. যিয়াউর রহমান আল-আ‘যমী ৯ই যিলহজ্জ্ব ১৪৪১ হিজরী মোতাবেক রোজ ৩০শে জুলাই ২০২০ যোহরের আযানের সময় আরাফার পবিত্র দিনে মদীনা মুনাওয়ারায় মৃত্যুবরণ করেন। বৈচিত্র্যময় দুনিয়ায় মহান আল্লাহর দূরদর্শী সৃষ্টিকৌশল বুঝার সাধ্য কার! ভারতে কট্টর হিন্দু বাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়া আল্লাহর সৃষ্টি বৈচিত্র্যের অনন্য নযীর প্রখ্যাত ও প্রতিথযশা মুহাদ্দিছ ড. যিয়াউর রহমান আ‘যমী। উচ্চ বংশীয় হওয়ায় তার জীবন খুব সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেই কাটছিল। একদিকে হিন্দু ধর্ম শতধাবিভক্ত, ছোট জাত-বড় জাত বাছবিচার ও নিজ ধর্মেই সুবিধা বঞ্চিত নিগৃহীত জনতার হাহাকার; অপরদিকে মুসলিম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ পড়শী, বন্ধু-বান্ধবের জীবনাচার ও পারিপার্শ্বিকতা সুবোধ যুবক বংঙ্কীরামকে অনেকটা ভাবিয়ে তুলেছিল। তাঁর জীবনে বাধ সাধলো পাহাড়সম এই জাতপাত ধর্ম ও বর্ণ বৈষম্যের। কিভাবে তিনি সুন্নাতের বাতিঘরে পরিণত হলেন? কিভাবে তার জীবনের এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হল? পরিণত হলেন উপমহাদেশের আহলেহাদীছ কৃতী সন্তান মুসলিম উম্মাহর একজন খ্যাতিমান মুহাদ্দিছে? কিইবা ছিল তার জীবনের পিছনের গল্প? এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই পাঠক সমীপে তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল]

নাম ও বংশপরিচয় :

হিন্দু পারিবারিক ঐতিহ্যানুযায়ী তার বাল্য নাম ছিল বঙ্কীরাম অথবা বঙ্কে লাল। হিন্দুদের অভিজাত বাহ্মণ বংশে ১৯৪৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আযমগড় যেলার বিলারাগঞ্জ নামক গ্রামে বঙ্গে লাল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ আর্য হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিল। তাঁর পিতা সমাজের একজন নেতৃপর্যায়ের ব্যক্তি ছিলেন এবং কলকাতায় তাদের বড় ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল।

শিক্ষা ও ধর্মান্তর :

তিনি হিন্দু পরিবারের সদস্য হিসাবেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত নিজ গ্রামে শিক্ষা অর্জন করার পর আযমগড় শিবলী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে এই কলেজের হাইস্কুল শাখা থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। কলেজ পড়ুয়া মেধাবী বঙ্কে লালের মাথায় ধর্মীয় বৈষম্য ও মানুষে মানুষে ভেদনীতি দারুনভাবে ঘুরপাক খেতে থাকে, যা তাঁর মাঝে আত্মজিজ্ঞাসা ও মহাবিপ্লবের জন্ম দেয়। ফলে তিনি প্রধান প্রধান বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় কৃষ্টিকালচার নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা শুরু করেন। বাড়ির পাশের হাকিম আইয়ূব নামের এক আলেমের সাহচর্যে তিনি ইসলামের সাম্য, সৌন্দর্য ও যুগোপযোগিতায় মুগ্ধ হন। এরপর দীর্ঘ গবেষণা ও পড়াশোনার পর ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্তে উপনীত হন। ১৮ বছর বয়সে প্রথমে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ইমামুদ্দীন নাম গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে ১৬ বছর বয়সে মাধ্যমিক পাশ করেন। দেড় বছর পর তিনি এখান থেকে মাদ্রাজের উদ্দ্যেশ্যে নিজের একডেমিক ইলমী সফর শুরু করেন। তামিল নাড়ুর বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দারুস সালাম, ওমারাবাদ এ ভর্তি হন। এখানে তিনি পাঁচ বছর পড়াশোনা করেন এবং ১৯৬৬ সালে আলিম ও দাওরায়ে হাদীছ সম্পন্ন করেন।

কিন্তু হিন্দু পিতামাতা, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে তিনি নামে কিছুটা পরিবর্তন করে হয়ে যান যিয়াউর রহমান আল-আ‘যমী। তাঁর সহায় সম্বল সব কেড়ে নেওয়া হয়। বাড়ি থেকে তাঁর সাথে সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অবশেষে তাঁকে জানে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়। সর্বশেষ তিনি কোন দিশা না পেয়ে নিজ পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও মাতৃভূমি ভারত ছেড়ে পাকিস্থানে হিজরত করেন। জ্ঞান পিপাসু যিয়াউর রহমান আল-আ‘যমী জামা‘আতে ইসলামী পাকিস্থানের একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়। তিনি জামা‘আতে ইসলামীর আমীর আবুল আ‘লা মওদূদী (রহঃ)-এর নিকট হানাফী মাযহাবের ফিক্বহী চিন্তাধারায় দীক্ষিত হন। প্রবল আগ্রহের কারণে ধর্মীয় বিভিনণ বিষয়াদিতে নিজেই পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করেন এবং দালীলিক সমাধানের সকল দরজা তার কাছে উন্মোচিত হয়।

মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন :

জীবনযুদ্ধে তাঁর এই পাঠযাত্রা কখনোই স্তিমিত হয়ে যায়নি। এরপরে তাঁর উচ্চশিক্ষা অর্জনের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। বিধায় আরবীর প্রতি তাঁর ভালোবাসাটা আরো দৃঢ় হয়। তাই তিনি আরবে গিয়ে আরবী ভাষা রপ্ত করে ইলমে হাদীছ অধ্যয়নের দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করেন। তখন তাঁর নিকটে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ পৌঁছে। তিনি অবহিত হন যে, সেখানে আবেদনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য মনোনীত হলে তিনি সেখানে আরবী ভাষা সুন্দরভাবে শিখতে পারবেন এবং তিনি ইলমে হাদীছ অধ্যয়ন করতে পারবেন। শুধু ইসলাম গ্রহণ করেই থেমে থাকেননি, ধর্মীয় জ্ঞানের প্রগাঢ় তৃষ্ণা মেটাতে এবং উচ্চতর শিক্ষা নিতে তিনি ছুটে যান প্রিয় নবীর শহর মদীনা মুনাওয়ারায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি নব মুসলিম হিসাবে আবেদন করেন এবং মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে ১৯৬৬ সালে সেখানে অধ্যয়নের সুযোগ পান। আর তিনিই প্রথম হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম ছাত্র, যিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। সেখানে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীছ অনুষদে ভর্তি হন এবং হাদীছ শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি তৎকালীন মহান বিদ্বানদের সাহচর্য লাভ করেন। তন্মধ্যে শায়খ আব্দুল আযীয ইবনু বায, শায়খ আশ-শানক্বিতী (রহঃ) প্রমুখ অন্যতম। তিনি তাঁর শ্রেণীতে সর্বোচ্চ রেজাল্ট করে অনার্স ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ)-এর পরামর্শে আরো উচ্চতর শিক্ষার জন্য আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা করেন। তিনি মদীনা ইউনিভার্সিটির প্রথম স্নাতকদের অন্যতম যারা আল আযহার থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি শায়খ মোস্তফা আ'যমী-এর তত্ত্বাবধানে মাস্টার্স গবেষণা কর্ম সমাপ্ত করেন। মাস্টার্সে তাঁর গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘আবূ হুরায়রা: তাঁর বর্ণনার আলোকে’ [أبو هريرة: في ضوؤ مروياته]। তৎকালীন সময়ে যা মডারেট মুসলিম ও পাশ্চাত্যবাদীদের অভিযোগের বিরুদ্ধে এবং ছাহাবীদের সমর্থনে একটি সফল কর্ম হিসেবে সফলতা ও প্রসিদ্ধি অর্জন করে। আর তাঁর পিএইচডি গবেষণা কর্মের বিষয় ছিল ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিচারকার্য’ اقضية رسول الله صلى الله عليه وسلم لابن الطلاع القرطبي : تحقيق تعليق واستدراك। ১৯৭৩/৭৪ সেশনে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীছ বিভাগ খোলা হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীছ বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। কিছু সময় তিনি হাদীছ বিভাগের প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান হিসাবে নিয়োগের জন্য তাঁর সঊদী আরবের নাগরিক হওয়ার প্রয়োজন হ’লে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইলমী সম্মাননা স্বরুপ ‘রাবেতা আল-আলাম আল-ইসলামী’র প্রধান শায়খ মুহাম্মাদ বিন আলী হিরকানের সুফারিশক্রমে তাকে সঊদী সরকার সে দেশের সম্মানজনক নাগরিকত্ব প্রদান করেন, যা আসলেও খুবই সৌভাগ্যের! এছাড়াও তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে মক্কার মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগসহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক এবং প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত ছিলেন। অতঃপর মসজিদে নববীর প্রধানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি মসজিদে নববীতে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি সেখানে ছহীহ বুখারী, ছহীহ মুসলিম ও সুনান আবূ দাঊদ-এর দারস প্রদান করেন। ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার পরিমন্ডলে এ দায়িত্ব অত্যন্ত সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ।

রচনাবলী :

এক সময়ের হিনদু যুবক বঙ্কে লাল আজকের শায়খ যিয়াউর রহমান আল-আ‘যমী গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ অনেক কাজ করেছেন। তিনি কয়েক ডজন বই লিখেছেন এবং অসংখ্য বই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ইলমে হাদীছে তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি الجامع الكامل في الحديث الصحيح الشامل এটি বারো খন্ডে রিয়াদের দারুস সালাম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এতে তিনি  বিভিন্ন বিষয়ে ছহীহ হাদীছগুলোকে ফিক্বহী অধ্যায় ভিত্তিক বিন্যস্ত করেছেন। এ বৃহৎ কর্মযজ্ঞে তিনি ২০০টিরও বেশী হাদীছ গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছেন এবং সম্ভবতঃ তিনিই পুরো দুনিয়ায় একক ব্যক্তি, যাকে দিয়ে মহান আল্লাহ এমন একটি মহৎ কাজ করিয়ে নিয়েছেন। তার অন্যতম আরেকটি বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে হিন্দি ভাষায় Encyclopedia of the Glorious Qur’an ‘মহিমান্বিত কুরআন বিশ্বকোষ’। এছাড়াও তিনি কম্প্যারেটিভ স্টাডি অব জুদাইজম, ক্রিশ্চিয়ানিটি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান রিলিজিওন্স বিষয়েও বই লেখেন। ইসলাম গ্রহণের অভিজ্ঞতা নিয়ে খুবই সুখপাঠ্য ও মুগ্ধতা ছড়ানো আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখেছেন ‘ফ্রম গঙ্গা টু যমযম’।

তাঁর লিখিত অন্যান্য গ্রন্থ :

১. আল জামি'ঊল কামিল ফিল হাদীছিছ ছহীহিশ শামিল।

২. ফুছূলুন ফি আদইয়ানিল হিন্দ [গ্রন্থটি আরবী ভাষায় রচিত। যাতে তিনি ভারতে প্রচলিত চারটি ধর্ম হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ এদের পরিচয় তুলে ধরেন]।

৩. দিরাসাতুন ফিল জারহি ওয়াত তা'দীল।

৪. আল মাদখাল ইলাস সুনানীল কুবরা লিল ইমাম বায়হাক্বী।

৫. আল মিন্নাতুল কুবরা শারহুস সুনানিস সুগরা লিল হাফিয বায়হাক্বী।

৬. মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধী কর্তৃক রচিত 'ফাতহুল গাফুর ফি ওয়াযঈল আয়দী আলাস সুদূর' গ্রন্থের তাহকীক এবং ভূমিকা লিপিবদ্ধ করেন।

৭. আত তামাসসুকু বিন সুন্নাহ ফিল আকাঈদি ওয়াল আহকাম।

৮. মু'জামু মুসত্বলাহিল হাদীছ ওয়া লাতায়িফিল আসানীদ।

৯. তুহফাতুল মুত্তাক্বীন ফীমা ছহহা মিনাল আদঈয়াতি ওয়াল আযকারি ওয়ার রুকা ওয়াত তিবিব আন সায়্যিদিল মুরসালীন।

১০. আমালী ইবনু মারদুওয়ায়হ (তাহকীক কর্ম)।

১১. আল ইয়াহুদীয়্যাত ওয়ান নাসরানিয়্যাত।

১২. আর-রাযী ওয়া তাফসীরুহু।

১৩. কুরআন কে সায়ে মে।

১৪. তলোয়ারো কে সায়ে মে।

১৫. গঙ্গা সে যমযম তক।

১৬. লুগাতুল কুরআন।

আল জামি'ঊল কামিল ফিল হাদীছিছ ছহীহিশ শামিল পরিচিতি :

১৬৫৪৬টি ছহীহ হাদীছ দ্বারা সমৃদ্ধ বিখ্যাত গ্রন্থটি মোট ১৯ খন্ডে সমাপ্ত। যার পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় ১৪৭৩৬। যা শায়েখের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কর্ম হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ। ২০০১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১২ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি ছহীহ হাদীছ সংকলনের কাজ সম্পূর্ণ করেন। ২০১৬ সালে মাকতাবা দারুর রিসালা থেকে ১২খন্ডে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। অতঃপর ২০১৯ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় পাকিস্তানের দার ইবনু বাশীর থেকে। বর্তমানে প্রথম খন্ডে শুধু সূচিপত্র সংযোজিত হয়েছে। প্রথম সংস্করণে উছূলে হাদীছ, আসমাউর রিজাল, জারহ ওয়া তা‘দীল-এর আলোচনা সংক্ষিপ্ত আকারে থাকলেও দ্বিতীয় সংস্করণে তা সবিস্তারে সংযোজন করা হয়েছে।

আল জামিঊল কামিল গ্রন্থে হাদীছ সংকলনের মানহাজ : লেখক রাহিমাহুল্লাহ হাদীছ সংকলনকালে ছহীহ, হাসান, যঈফ, জাল ও মুনকার ইত্যাদি সাব্যস্ত করণের ক্ষেত্রে মুতাআখখিরীন মুহাদ্দিছগণের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি তাঁর সংকলন ফিক্বহী তারতীবে সাজিয়েছেন। গ্রন্থটি তিনি ছহীহ বুখারীর ন্যায় কিতাবুল অহী দিয়ে শুরু করেছেন। এরপর কিতাবুল ঈমান ও অন্যান্য অধ্যায় ফিক্বহী বিন্যাসানুযায়ী সাজিয়েছেন। হাদীছটি বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে বর্ণিত হলে মুত্তাফাক্বুন আলাইহ, শুধু বুখারী বা মুসলিম গ্রন্থে হলে তাঁদের নাম ও ছহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এখানে কুতুবে সিত্তাহ ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক থেকে ছহীহ হাদীছগুলো একত্রিত করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ছহীহ বুখারীর তা‘লীকাত বা বালাগাত কিংবা মুয়াত্ত্বা ইমাম মালিক-এর মারাসিল সংযোজন করেননি। মূলতঃ তিনি এই সংকলনের ক্ষেত্রে হাদীছের মৌলিক গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছেন; কুতুবুয যাওয়ায়েদ-এর উপর নির্ভর করেননি। যেমন হুমায়দী-এর ‘আল জামিঊ বায়নাছ ছহীহাইন’ কিংবা ইবনুল আছীর-এর ‘জামিঊল উছূল’ থেকে হাদীছ সংকলন করেননি। এরপর তিনি কুতুবে সিত্তাহ ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক-এর বাইরে ছহীহ হাদীছ সংকলনের জন্য হায়ছামীর মাজমাঊয যাওয়ায়েদ, ইবনু হাজারের মাতালিবুল ‘আলিয়া, মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, সুনান সাঈদ ইবনু মানছূর, সুনান দারিমী, মুনতাকা ইবনুল জারূদ, ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ, ছহীহ ইবনু হিববান, দারাকুৎনী, মুসতাদরাক আল হাকিম, বায়হাক্বী থেকে ছহীহ হাদীছগুলো একত্রিত করেছেন। এছাড়াও তিনি হাদীছের নির্দিষ্ট একটি অধ্যায়; যেমন তাফসীর, আকীদাহ, আহকাম, যুহদ, দো‘আ, আখলাক ইত্যাদির উপর রচিত একক মুসনাদ গ্রন্থ থেকে ছহীহ হাদীছগুলো একত্রিত করেছেন।

লেখক আল জামিঊল কামিল গ্রন্থের ভূমিকায় প্রথমেই তাঁর স্বীয় ছহীহ বুখারী, ছহীহ মুসলিম, সুনান আবুদাঊদ-এর একাধিক সনদ এবং যুগ শ্রেষ্ঠ গ্রহণযোগ্য ৬জন মুহাদ্দিছ থেকে তার হাদীছ বর্ণনার ইজাযাহ উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি গ্রন্থের ভূমিকায় ইলমে হাদীছের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস সংক্ষিপ্তকারে খুব চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন। সাথে সাথে তিনি উছূলে হাদীছ ও হাদীছ সংকলনের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিছগণের মানহাজ বর্ণনা করেছেন। লেখক রাহিমাহুল্লাহ তাঁর এই ছহীহ হাদীছের সংকলনের জন্য ৭টি কারণ উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হ’ল-

ক. মুসলিম উম্মাহর প্রাথমিক উৎস দুইটি। আল-কুরআন এবং সুন্নাহ। আমাদের সাথে আল-কুরআন রয়েছে। কিন্তু সুন্নাহ শতাধিক গ্রন্থে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে। ছহীহাইন ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থে অনেক ছহীহ হাদীছ রয়েছে। যা অসংখ্য জাল ও মুনকার হাদীছের সাথে একত্রিত অবস্থায় রয়েছে। কাজেই লেখক মনে করেছেন এগুলো সংগ্রহ করে ছহীহ হাদীছগুলোকে যাচাই বাছাই করণের মাধ্যমে এক মলাটে একত্রিত করা। আবার লেখক রাহিমাহুল্লাহ বিভিন্ন সময়ে সকল ছহীহ হাদীছের কোন একক সংকলন আছে কিনা এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি এর সন্তোষজনক কোন উত্তর কিংবা সংকলন না পেয়ে তিনি নিজেই এই মহান কাজের খিদমত করার জন্য এগিয়ে আসেন।

খ. বিদ‘আতী ও অন্যান্য ভ্রান্ত লোক যারা হাদীছের নামে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীছ প্রচার করে তাদের বিরুদ্ধে এই ছহীহ হাদীছের বিশাল সংগ্রহশালা ঢাল হিসাবে কাজ করবে।

গ. মুসলিম উম্মাহর উছূল হলো পরস্পরের মাঝে মতপার্থক্যের সময় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। এক মলাটে সকল ছহীহ হাদীছ হাতের নাগালে পাওয়ার দরুণ উম্মাহর মধ্যকার মতপার্থক্যগুলো খুব সহজেই সমাধানের পথ দেখাতে সহযোগিতা করবে। বিশেষতঃ উম্মাহ মনগড়া ও ভিত্তিহীন হাদীছের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাবে। সাথে পরস্পরের মধ্যকার মত পার্থক্য হ্রাস পাবে।

ঘ. এই ছহীহ হাদীছের বিশাল সংগ্রহশালা হাদীছের যথাযথ বুঝ ও ফিক্বহুল হাদীছ অনুধাবন করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। যেমনটি ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, একটি হাদীছ অপর একটি হাদীছের ব্যাখ্যাস্বরূপ।

ঙ. ইলমে হাদীছের ছাত্রদের জন্য এই ছহীহ হাদীছের সংকলন অপরিসীম উপকার প্রদান করবে। বিশেষ করে এর মাধ্যমে খুব সহজেই জাল ও মুনকার হাদীছ থেকে ছহীহ হাদীছগুলো পার্থক্য করতে সক্ষম হবে। এছাড়া হাদীছের হুকুম সহজেই বুঝতে পারবে। হাদীছটি তারগীব নাকি তারহীব কিংবা হাদীছের প্রদত্ত ফায়েদা খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারবে। ইলমে হাদীছের এই মহান বিদ্বান যে খিদমাত করেছেন তা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।

মৃত্যু :

ইলমে হাদীছের এই মহান ব্যক্তিত্ব ও মহীরুহ গত ৩০ জুলাই মোতাবেক ৯ জিলহজ আরাফার দিনে মদীনা মুনাওয়ারাতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। বাদ মাগরিব মসজিদে নববীতে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর বাক্বীউল আল-গারক্বাদ কবরস্থানে নবী পরিবারের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

বছরের সর্বোত্তম (ذلك اليوم المشهود) দিন আরাফার মোবারক দিনে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। অমুসলিম পরিবারে জন্ম লাভ করেও যে সকল মনীষী ইসলাম গ্রহণ করে ইলমের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছেন তাদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মত একটি নাম ড. মুহাম্মদ যিয়াউর রহমান আল-আ‘যমী। মানুষ তার কর্মে বেঁচে থাকে, বংশ পরিচয়ে নয়। তিনি প্রকৃতপক্ষেই ‘ইমামুদ্দীন’ বা দ্বীনের নেতা হিসাবে যুগ যুগ ধরে বরিত হতে থাকবেন। আল্লাহ তাঁকে  জানণাতুল ফেরদাঊস নছীব করুন- আমীন!

[লেখক : অধ্যায়নরত, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব]



আরও