দ্বীনের পথে আমূল পরিবর্তিত এক পথিক আলী বানাত

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 9953 বার পঠিত

দ্বীনের পথে আমূল পরিবর্তিত এক পথিক আলী বানাত

অষ্ট্রেলিয়ার এক ফিলিস্তিনী বংশোদ্ভূত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী আলী বানাত (১৯৮২-২০১৮খ্রি.) ছিলেন সমসাময়িক পৃথিবীর আর দশজন বিত্তশালীর মতই ভোগবিলাসী জীবনে গা ভাসানো যুবক। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ইসলামের কোন প্রভাব ছিল না তাঁর জীবনে। পেশায় ছিলেন ইলেক্ট্রিশিয়ান। মাত্র ২১ বছর বয়স থেকেই সিডনীতে দুটি সফল ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ফলে স্বল্প বয়সে বিপুল বিত্ত-বৈভব তাকে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত করে তোলে। প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ফেরারী স্পাইডার কার, ৪৮ লক্ষ টাকা মূল্যের ব্রেসলেট, দামী ব্র্যান্ডের অসংখ্য জুতা ও সানগ্লাস ছিল তাঁর জীবনের নিত্যসঙ্গী।

কিন্তু হঠাৎই ২০১৫ সালের মাঝামাঝি তাঁর শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ল। চিকিৎসকরা জানালেন ক্যান্সার যে পর্যায়ে ধরা পড়েছে, তাতে আরোগ্যের কোন সম্ভাবনা নেই। উপরন্তু তাঁর আয়ু রয়েছে বড় জোর সাত মাস। আলী বানাতের জীবনে এই ঘটনা এক বিরাট ধাক্কা হয়ে এল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আলী বানাতের পরিবর্তিত জীবনের শুরু হল এখান থেকেই। তিনি সহসাই উপলব্ধি করলেন, তাঁর এতদিনের যাপিত জীবন ছিল পুরোটাই মিছে মায়ার পিছনে ছোটা। জীবনের প্রকৃত মর্ম তাঁর চোখে বড় স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। তিনি মৃত্যুর প্রস্ত্ততিস্বরূপ গোরস্থানে গোরস্থানে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ সহযাত্রীদের একান্ত সান্নিধ্যে সময় কাটাতে লাগলেন। নিজের সমস্ত সম্পদ অসহায় মানুষের সেবায় দান করতে মনস্থ করলেন। মৃত্যুর পূর্বে প্রতিটি সময় ও ক্ষণ তাঁর নিকট পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদে পরিণত হল।

তিনি তাঁর সমস্ত ব্যবসা গুটিয়ে নিলেন এবং আফ্রিকার দারিদ্রপীড়িত দেশসমূহে বিতরণের জন্য তাঁর যাবতীয় সম্পদ প্রেরণ করলেন। গঠন করলেন দাতব্য সংস্থা মুসলিমস্ এ্যারাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড। নিজে সশরীরে উপস্থিত থেকে টোগো, ঘানা ও বুর্কিনা ফাসোসহ আফ্রিকার অন্যান্য দেশসমূহে দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করলেন। চিকিৎসকগণ তাঁকে ৭ মাস সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে আরও ৩টি বছর জীবন দিলেন।

তিনি বলেন, একবন্ধুর পরামর্শে আমি ব্যথা উপশমের জন্য একটি উচ্চমাত্রার ঔষধ গ্রহণ করি। ঔষধটির ধাক্কা এত অধিক ছিল যে, আমি মৃত্যুর মুখোমুখি উপনীত হলাম। আমি অনুভব করতে লাগলাম আমি সম্পূর্ণ এক ভিন্ন অচিন জগতে রয়েছি। আল্লাহর কসম আমি এমন কিছু দেখেছিলাম, যা পূর্বে কখনও দেখিনি। আমার পরিবার আমার পাশে ছিল, আর আমি বলছিলাম, হে আল্লাহ! আমাকে তুলে নাও। আমি খুব সুন্দর কিছু দৃশ্য দেখছিলাম। আমি কেবলই চাচ্ছিলাম সেখানে যেতে। কিন্তু পরদিন যখন আমি জাগ্রত হলাম, তখন খুব হতাশ হলাম যে আল্লাহ আমাকে নেননি। অশ্রুসজল চোখে বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ক্যান্সার আমার জীবনে ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার। কেননা ক্যান্সারের মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে পরিবর্তনের সুযোগ দিয়েছেন। ক্যান্সারের কারণেই আমি পরকালের প্রস্ত্ততি নিতে পেরেছি। তিনি সবকিছুই একে একে দান করে দেন। এমনকি বিদেশে গেলে নিজের পরণের পোষাকটুকু ছাড়া সবকিছু বিলিয়ে দিতেন। কেননা তিনি চেষ্টা করতেন এমন অবস্থায় পৃথিবী ছাড়তে যখন তাঁর নিকট আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। দাতব্য সংস্থা গঠনের পিছনে তাঁর এই উদ্দেশ্যই ক্রিয়াশীল ছিল। তিনি বলতেন, তোমার অর্জিত অর্থ তোমার সাথে কবরে যাবে না। কেবল সেটুকুই যাবে যা তুমি ছাদাক্বা করবে। এটিই একমাত্র বস্ত্ত যা তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছানোর পূর্বে কবরে অবস্থানরত সময়ে তোমাকে সাহায্য করবে। তোমার বাবা-মা, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ সেখানে থাকবে না, থাকবে কেবল তোমার কর্ম।

তিনি জাগতিক সুখের পিছনে ছুটে চলা মানুষদের লক্ষ্য করে বলেন, যখন কেউ জানবে যে, পৃথিবীতে তাঁর অবস্থানকাল আর বেশী দিন নয়, তখন আল্লাহর কসম পার্থিব কোন বস্ত্তর প্রতি আকর্ষণবোধ করা তাঁর জীবনের সবচেয়ে অগুরুত্বপূর্ণ কাজে পরিণত হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দৈনন্দিন জীবন এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই পরিচালনা করা উচিৎ। যারা জাগতিক লক্ষ্যে জীবন পরিচালনা করে, তারা নিঃসন্দেহে ভুল লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। যখন কেউ অসুস্থ হয়, কিংবা নিশ্চিত হয় যে, সে আর বেশীদিন বাঁচবে না, তখনই সে উপলব্ধি করতে পারে যে প্রকৃতই এসব জাগতিক বস্ত্তর কোন মূল্য নেই।

তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, দয়া করে প্রত্যেকেই জীবনের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। জীবনের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। মানুষের উপকারার্থে কোন প্রকল্প হাতে নিন। যদি নিজে না পারেন তবে অন্য কারও প্রকল্পে অংশগ্রহণ করুন। কেবল কিছু একটা করার চেষ্টা করুন। কেননা আল্লাহর কসম, কিয়ামতের দিন আপনি ভীষণভাবে এগুলোর প্রয়োজন বোধ করবেন।

গত ২৯শে মে ২০১৮ বৃহস্পতিবার সিডনীর একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থায় তাঁর রেখে যাওয়া ভিডিওবার্তা সারাবিশ্বের মানুষকে আলোড়িত করেছে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দিয়ে সম্মানিত করুন। আমীন!

এই তরতাজা আধুনিক যুবকের পরিবর্তনের মর্মস্পর্শী গল্প আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান শিক্ষা রেখে গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা রাখা এবং জীবনের কঠিন প্রতিকূল মুহূর্তেও ধৈর্যহারা না হওয়া। কেননা তিনি যা করেন, বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। কঠিন রোগাক্রান্ত অবস্থাও হয়ত আলী বানাতের মত মহান প্রভুর প্রতি প্রত্যাবর্তনের এক অনন্য গল্প হতে পারে। এছাড়া আলী বানাতের জীবন আমাদেরকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে। যেমন- আমরা কি আলী বানাতের মত পরকালীন জীবনকে নিরাপদ করার জন্য বিশেষ কোন উদ্যোগ নিয়েছি, অথচ আমাদের মৃত্যুক্ষণ যে কোন সময় উপস্থিত হতে পারে?

দ্বিতীয়ত, আমরা যখন নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত এবং ভবিষ্যৎ ভাবনায় উদ্বিগন, তখন তাতে পরকালীন প্রাপ্তির ভাবনা যুক্ত থাকছে তো? জীবনের মৌলিক উদ্দেশ্য গৌণ হয়ে পড়ছে না তো? তৃতীয়ত, মৃত্যুর পর আমরা কী রেখে যাচ্ছি? মানুষ আমাকে নিয়ে কি ভাবছে? মানুষের কল্যাণে আমি কতটুকু করে যেতে পারলাম? মানুষের জীবনে কতটুকু ইতিবাচক প্রভাব রেখে যেতে পারলাম? বিশেষ করে আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে কিছু না কিছু করার ক্ষমতা দিয়েছেন, সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে আমরা পৃথিবীবাসীকে কতটুকু দিতে পারলাম? এই ভাবনাগুলো যদি নিজেদের জীবনে জাগ্রত করতে পারি, তবে আমাদের জীবন মহান প্রভুর প্রতি আত্মসমর্পিত এবং একক লক্ষ্যে নিবেদিত এক আলোকিত ও মনুষ্যত্বপূর্ণ জীবনের অধিকারী হতে পারব। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!



বিষয়সমূহ: সম্পাদকীয়
আরও