ইসমাঈলী শী‘আদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস (শেষ কিস্তি)

মুখতারুল ইসলাম 443 বার পঠিত

পর্ব ১। পর্ব ২

(চ) পরকাল ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা :

ইসমাঈলীদের পরকাল বিষয়ক আক্বীদাগুলো নিম্নরূপ-

১. মৃত্যুর পর মানুষের গন্তব্য :

ইসমাইলীদের বিশ্বাসানুযায়ী মানুষ দুইভাগে বিভক্ত। মুমিন-আউলিয়া এবং বিভ্রান্ত চরমপন্থী। মুমিন আউলিয়াগণ সমসাময়িক ইমামগণের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী হবেন এবং তার বেলায়েতের একনিষ্ঠ বাস্তবায়নকারী হবেন। অপরদিকে বিভ্রান্ত চরমপন্থীরা সমসাময়িক ইমামগণের বিরোধী হবে এবং তার বেলায়েতের ব্যাপারে হিংসুটে ও চরমপন্থী হবে। ইমামের বেলায়েত ও দাওয়াতের পরিপন্থী কাজে সে জড়িত থাকবে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মুমিন আউলিয়াগণের আত্মাগুলো মৃত্যুর পরও সুন্দর অবয়বে ও আকৃতিতে অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং তাদের দেহগুলো বিশেষভাবে সংরক্ষিত থাকবে। অপরপক্ষে বিভ্রান্ত চরমপন্থীগণের আত্মাগুলো নোংরা ও কদর্য অবস্থায় পড়ে থাকবে এবং অন্য কোন আকৃতিতে দুনিয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।[1]

তাদের ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদাসমূহ নিম্নরূপ

১. আল্লাহ তা‘আলা অবাধ্যদের সাতটি চেহারায় সৃষ্টি করেছেন। তারা সে সমস্ত চেহারায় পরিবর্তিত হবে। অবশেষে দুনিয়ায় অন্যভাবে ফিরে আসবে।[2]

২. তোমাদের সাথে তাদের দেখা হবে। তুমি মনে করবে আদম সন্তান। কিন্তু তারা বানর, কুকুর, শুকর, ভল্লুক পরিণত হয়ে মানুষের মাঝে আসবে।[3]

২. ক্বিয়ামত

ইসমাঈলীদের নিকট ক্বিয়ামত হ’ল ছাহেবুয যামান বা ইমামের আর্বিভাব। ইসলামে ঘোষিত কিয়ামতকে তারা বিশ্বাস করে না।

তাদের ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদাসমূহ নিম্নরূপ :

১. তাদের মতে, ক্বিয়ামত হ’ল আত্মার আংশিক জাগরণ ও দেহযন্ত্র থেকে সংবেদনশীলতার পৃথকীকরণ। আর ছাহেবুয যামান তথা ইমামের মাধ্যমে শরী‘আত ও দ্বীন ধর্মকে সমুন্নত করণের নাম।[4]

২. জা‘ফর ইবন মানছূরুল ইয়ামান তার তাফসীরে লিখেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيقَاتًا-يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا ‘নিশ্চয়ই বিচার দিবস সুনির্ধারিত। যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, অতঃপর তোমরা দলে দলে সমাগত হবে।[5] (يَوْمَ الْفَصْلِ) ফায়ছালার দিনে ইমাম মাহদী আসবেন। তিনি হক-বাতিলের মাঝে ফায়ছালা করবেন এবং মানুষের মাঝে মুমিন, কাফেরকে পৃথক করবেন। مِيقَاتً)) অর্থাৎ নির্ধারিত স্থান, যা দ্বারা আল্লাহর আদেশের সর্বশেষ সীমা এবং সাতজন নাতেক বা কথককে বুঝানো হয়েছে। (يُنْفَخُ) অর্থাৎ ফুৎকার দেওয়া বা ইমামের পক্ষ থেকে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়া। তাঁর আদেশ প্রকাশ পাওয়ার পর মানুষেরা তার দাওয়াতে স্বেচ্ছায় দলে দলে ইমামতে প্রবেশ করবে।[6]

ইসমাঈলীদের বিশ্বাস সপ্তম ইমাম ও কথক মুহাম্মাদ ইবন ইসমাঈলের মাধ্যমে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শরী‘আত রহিত হয়ে গেছে। কেননা তিনি ইমামদের সিলসিলায় সপ্তম কথক এবং তার ক্ষমতা বা ইমামতে সমাসীন বা কায়েম হওয়ার মধ্যে দিয়ে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আনীত শরী‘আত বাতিল ও তাদের শরী‘আত বলবৎ হয়েছে। এভাবেই অনেক ইসমাঈলী ইমাম ও দাঈরা ক্বিয়ামতের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন।[7]

ইসমাঈলীরা সপ্তম ইমামের ইমামত কায়েম হওয়াকে ক্বিয়ামত ব্যাখ্যা দেন। তারা মনে করে তার নিকটেই হিসাব ও বিচার হবে এবং শাস্তিদানে তিনি অত্যন্ত কঠোর। যেমন তার সত্যায়নে মহান আল্লাহ বলেন, يَوْمَ هُمْ بَارِزُونَ لَا يَخْفَى عَلَى اللهِ مِنْهُمْ شَيْءٌ لِمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ ‘যেদিন তারা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। আল্লাহর কাছে তাদের কোন কিছুই গোপন থাকবে না। (সেদিন তিনি বলবেন) আজ রাজত্ব কার? কেবলমাত্র আল্লাহর, যিনি এক ও মহাপরাক্রান্ত।[8]

৩. শাস্তি ও পুরস্কার

এর প্রমাণে তারা মহান আল্লাহর বাণী উল্লেখ করে বলেন, كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوبُونَ-ثُمَّ إِنَّهُمْ لَصَالُو الْجَحِيمِ-ثُمَّ يُقَالُ هَذَا الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تُكَذِّبُونَ ‘কখনই না। তারা সেদিন তাদের প্রতিপালকের দর্শন হ’তে বঞ্চিত থাকবে। অতঃপর তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর তাদের বলা হবে, এটাই তো সেই স্থান, যাকে তোমরা মিথ্যারোপ করতে।[9] তাদের মতে, পুরস্কারের ব্যাখ্যা হ’ল মাওলার দিকে নযর দেয়া ও প্রাণ খুলে দেখা আর শাস্তির ব্যাখ্যা হ’ল তা থেকে ঠেকিয়ে দেওয়া।[10]

তারা আরো বলে, পুরস্কার বলতে ক্বিয়ামত তথা ইমামের ক্ষমতায়ন ও তার অনুসরণ করাকে বুঝায়। আর শাস্তি হ’ল এর অবাধ্য হওয়া। কেননা প্রত্যেক নবী-রাসূলকে তার উম্মত দেরকে এই সংবাদ দেওয়ার জন্য আদেশ করা হয়েছে।[11]

৪. মুনকার-নাকীর

তাদের জ্ঞানী সম্প্রদায়ের নিকট এ কথা পরিস্কার যে, ভাল মানুষদের জন্য কবরের ফেরেশতা মুনকার এবং হতভাগ্যদের জন্য নাকীর। প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক ইমাম তাদের স্বজাতিকে এই দুই ফেরেশতার খবর দিয়েছে। প্রত্যেক যুগে ইমাম হ’ল হুজ্জত ও সুসংবাদদাতা। ফলে তাকে মান্যকারীদের জন্য মুনকার আর তার অবাধ্যদের জন্য নাকীরকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ কথা চিরন্তন সবার জন্য, সব সময়।[12]

তারা আরো বলে, প্রত্যেক নাতেক বা ইমামের জন্য মুনকার-নাকীর অছি স্বরুপ। আউলিয়াদের জন্য মুনকার সুসংবাদ এবং হতভাগ্যদের জন্য নাকীর দুঃসংবাদ।[13]

৫. জান্নাত-জাহান্নাম

১. দাঈ সাহরাবুল ফারেসী বলেন, জান্নাত হ’ল সত্যবাদী ও সত্যসেবীদের; যারা আল্লাহর বাস্তবতাকে চেনে তাদের জন্য। জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। জ্ঞানী সম্প্রদায় একমাত্র এর মালিক হবেন। এর পাঁচটি উপাদান রয়েছে যথা- খেয়াল, সন্দেহ, জ্ঞান, জান্নাতের পাহারাদার এবং সেই ব্যক্তি যিনি তার জ্ঞানের প্রকৃত অনুসারী।[14]

২. তিনি আরো বলেন, জাহীম বা জাহান্নাম ধ্বংস, কষ্টের জায়গা। জাহান্নামবাসী হ’ল ধ্বংসশীল, বাতিলপন্থী। জাহান্নামের সাতটি দরজা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, لَهَا سَبْعَةُ أَبْوَابٍ لِكُلِّ بَابٍ مِنْهُمْ جُزْءٌ مَقْسُومٌ ‘যার সাতটি দরজা রয়েছে। প্রত্যেক দরজার জন্য এক একটি নির্দিষ্ট দল রয়েছে।[15][16]

৩. আবু ইসহাক কুহুস্তামানী বলে, ঐ ব্যক্তি জান্নাতী যে সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টিকর্তার দিকে ডাকে। আর জাহান্নামী ঐ ব্যক্তি যে মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর উলূহিয়্যাত থেকে ভাগিয়ে নিয়ে যায়। জান্নাতীরা আল্লাহর একত্ববাদকে অাঁকড়ে ধরে। আর জাহান্নামীরা আল্লাহর একত্ববাদ ছেড়ে পালায়।[17]

উল্লেখ্য যে, তাদের নিকট জান্নাতের ব্যাখ্যা বিভিন্ন ধরণের। তবে মূল ব্যাখ্যায় তারা বলে, জান্নাত হ’ল জ্ঞান। আর জান্নাতের সাতটি দরজার ব্যাখ্যা হ’ল সাতটি অক্ষর এবং সাতজন ইমাম। জাহান্নামের সাতটি দরজার ব্যাখ্যা হ’ল সাতজন ইমামের বিরোধীরা।[18]

পর্যালোচনা ও জবাব

ইসমাঈলীদের পরকাল সংক্রান্ত আক্বীদাগুলো কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শিক্ষার পুরোপুরি বিরোধী এবং হিন্দু, অগ্নি উপাসক মাজূসী, ইহুদী ধর্মসমূহ ও দর্শন শাস্ত্র থেকে ধার করা। এতদ্ব্যতীত তারা তাদের প্রকাশ্য কিতাবাদির বক্তব্য অস্বীকার করে ও বাতেনী বলে নিজেদের যাহির করে।[19]

(ছ) শরী‘আত রহিতকরণ ও দায়িত্ব অর্পণ

ইসমাঈলীদের বিশ্বাস হ’ল মুহাম্মাদ ইবন ইসমাঈল আসার পর মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দ্বীন ইসলাম রহিত হয়ে গেছে। যেমনভাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ) আসার পর ঈসা (আঃ)-এর রহিত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় শরী‘আত এখন বাতেনী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।[20]

তাদের ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদাসমূহ নিম্নরূপ

১. জা‘ফর ইবন মানছূর ইয়ামন বলেন, মাহদী আমলবিহীন ইলমের অধিকারী। মাহদী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ফলাফলের জগৎ শুরু হবে। দুনিয়া শেষ হয়ে যাবে; আখেরাতের দরজা খুলে যাবে; সমস্ত শরী‘আত বাতিল বলে গণ্য হবে।[21]

২. তিনি আরো বলেন, তার আর্বিভাবের পর কোন শরী‘আত থাকবে না। সমস্ত শরী‘আত বিদূরিত হবে। শুধুমাত্র ব্যাখ্যা রয়ে যাবে।[22]

৩. আধুনিক ইসমাঈলী আলেম মুছত্বাফা গালিব বলেন, মুহাম্মাদ ইবন ইসমাঈল বাতেনী প্রথম ইমাম এবং সপ্তম কথকের পূর্ণতা দানকারী। কেননা তার আমলেই ইসমাঈলী দাওয়াতের ইতিহাসের সূচনা হয়। ফলে পূর্ববর্তী সমস্ত শরী‘আত রহিত হয়ে যায়। তিনি তাবীল বা ব্যাখ্যার সূচনা করেন এবং বাতেনী বা গূঢ়তত্ত্বকে গুরুত্বারোপ করেন।[23]

পর্যালোচনা ও জবাব

১. মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম’।[24]

২. মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।[25]

৩. মহান আল্লাহ বলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম।[26]

৪. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَثَلِي وَمَثَلُ الْأَنْبِيَاءِ كَمَثَلِ قَصْرٍ أُحْسِنَ بُنْيَانُهُ تُرِكَ فِيهِ مَوْضِعُ لَبِنَةٍ، فَطَافَ بِهِ النُّظَّارُ، يَتَعَجَّبُونَ مِنْ حُسْنِ بِنَائِهِ، إِلَّا مَوْضِعَ تِلْكَ اللَّبِنَةِ، فَكُنْتُ أَنَا سَدَدْتُ مَوْضِعَ اللَّبِنَةِ، خُتِمَ بِيَ الْبُنْيَانُ وَخُتِمَ بِي الرُّسُلُ وَفِي رِوَايَةٍ: فَأَنَا اللَّبِنَةُ، وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ-

‘আমার এবং অপর নবীগনের দৃষ্টান্ত এক প্রাসাদের মত যাকে খুব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু উহাতে একটি ইটের জায়গা খালি রাখা হয়। দর্শকরা এটা প্রত্যক্ষ করে এবং এর সুন্দর নির্মাণশৈলীতে অত্যন্ত মুগ্ধ হত। তবে একটি ইটের জায়গা খালি থাকার কারণে আশ্চর্যবোধ করে। আমার দ্বারা দালানের নির্মাণ কাজ শেষ হ’ল এবং রাসূলগণের আগমনও আমার দ্বারা সমাপ্ত হ’ল। অন্য বর্ণনায় আছে- আমিই সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী। আর এক বর্ণনায় রয়েছে- ‘আমি শেষ নবী এবং তোমরা শেষ উম্মত।[27]

৫. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوسُهُمُ الأَنْبِيَاءُ، كُلَّمَا هَلَكَ نَبِىٌّ خَلَفَهُ نَبِىٌّ ، وَإِنَّهُ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ، وَسَيَكُونُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُونَ ‘বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাদের উম্মাতদের শাসন করতেন। যখন কোন একজন নবী মারা যেতেন, তখন অন্য একজন নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী নেই। বরং খলীফাগণ হবেন এবং তারা সংখ্যায় প্রচুর হবেন।[28]

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছে সুস্পষ্ট দলীল থাকা সত্ত্বেও ইসমাঈলীরা মুসলিম নাম ধারণ করে বিপরীত কথাবার্তা বলে।[29] বর্তমান ইসমাঈলীরা পূর্ববর্তীদের পদাংঙ্ক অনুসরণ করে। তারা ছালাত পড়ে না, যাকাত দেয় না, ছিয়াম রাখে না, মসজিদ বানায় না, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শরী‘আতের কোন কিছুই তারা মানে না। তারা নিজেদেরকে ‘আগাখানিয়াহ’ নামে নামাংকিত করে। জুয়া খেলে, মদ পান করে, রাতদিন প্রকাশ্যে আনন্দ-ফূর্তিতে মত্ত থাকে।[30]

এজন্য শায়খ ইহসান এলাহী যহীর বলেন, ইসমাঈলীরা তিনটি কারণে কাফের। তাদের বিশ্বাস শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরেও আরো নবী-রাসূল আসবে, ইসলাম রহিত হয়ে গেছে, শরী‘আতের দরকার নেই এবং শুধুমাত্র বাতেনী জ্ঞান যথেষ্ট। তারা এ কথাগুলোর মাধ্যমে কুফুরীর উপর কুফুরী করেছে। এরপরেও কি কেউ মুসলমান থাকতে পারে? তাদের সমস্ত আলেম, ফকীহ ও ঐতিহাসিকরা নির্গুনবাদী কাফের, যিন্দীক।[31] হাদীছে এসেছে, 

وَعَنْ جَابِرٍ عَنِ النَّبِيِّ r حِينَ أَتَاهُ عُمَرُ فَقَالَ إِنَّا نَسْمَعُ أَحَادِيثَ مِنْ يَهُودَ تُعْجِبُنَا أَفْتَرَى أَنْ نَكْتُبَ بَعْضَهَا؟ فَقَال أَمُتَهَوِّكُونَ أَنْتُمْ كَمَا تَهَوَّكَتِ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى؟ لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً وَلَوْ كَانَ مُوسَى حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلاَّ إِتِّبَاعِيْ.

জাবের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, একদিন যখন ওমর (রাঃ) তাঁর কাছে এসে বললেন, আমরা ইহুদীদের নিকটে তাদের অনেক পুরানো ধর্মীয় কাহিনীগুলো শুনি, যা আমাদের নিকটে চমৎকার লাগে। এসব কিছু কিছু লিখে রাখার জন্য আপনি আমাদের অনুমতি দিবেন কি? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা কি দিকভ্রান্ত হয়েছ, যেমন ইহুদী-নাছারারা দিকভ্রান্ত হয়েছে? অথচ আমি তোমাদের কাছে এসেছি উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে। যদি আজকে মূসাও বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাঁর পক্ষেও আমার অনুসরণ ব্যতীত গত্যন্তর থাকতো না।[32]

(জ) যাহেরী-বাতেনী প্রসঙ্গ

ইসমাঈলীদের আক্বীদা হ’ল প্রতিটি জিনিসের যাহের বা প্রকাশ্য, বাতেন বা অপ্রকাশ্য বিষয় রয়েছে। আর তারা বাতেনী ব্যাখ্যার আড়ালে ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা করে।

মহান আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ-‘তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন। যার মধ্যে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট অর্থবোধক। আর এগুলোই হল কিতাবের মূল অংশ। আর কিছু রয়েছে অস্পষ্ট। অতঃপর যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, তারা অস্পষ্ট আয়াতগুলোর পিছে পড়ে ফিৎনা সৃষ্টির জন্য এবং তাদের মনমত ব্যাখ্যা দেবার জন্য। অথচ এগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর গভীর জ্ঞানী ব্যক্তিগণ বলে, আমরা এগুলোতে বিশ্বাস স্থাপন করলাম। সবকিছুই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে এসেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে জ্ঞানীরা ব্যতীত কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না’।[33] 

তারা রাসূল (ছাঃ)-এর উপর মিথ্যারোপ করে আল্লাহর উক্ত বাণী উল্লেখ করে বলে, আমার নিকট কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে যাহের, বাতেন রয়েছে।[34]

উল্লেখ্য যে, প্রকৃতার্থে বাতেন বলতে তারা অছি হযরত আলীকে বুঝিয়ে থাকে। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শরী‘আতের নামে হযরত আলী কেন্দ্রীক যাবতীয় মিথ্যাচারকে তারা বাতেন বলে।

তাদের ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদাসমূহ নিম্নরূপ :

১. তাদের মতে, শরী‘আত হ’ল যাহের এবং বাতেন তার বাস্তবতা। মুহাম্মাদ (ছাঃ) শরী‘আত প্রণেতা এবং বাতেন বা বাস্তব ব্যক্তিত্ব হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অছি আলী ইবন আবী তালিব (রাঃ)। [35]

২. তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নামে মিথ্যারোপ করে বলে, আমি ছাহেবুত তানযীল বা অবতীর্ণকারী, আর আলী (রাঃ) ছাহেবুত তা’বীল বা ব্যাখ্যাদানকারী।[36]

৩. তারা বলে, যাহের-বাতেন দ্বীনের যাহের ভিত্তিক তাবলীগের কাজ করেন রাসূল (ছাঃ) এবং দ্বীনের বাকী অর্ধেক বাতেনের দায়িত্ব পালন করেন তার অছি বা আলী (রাঃ)।[37]

তারা রাসূল ও অছির মাঝে যাহের ও বাতেনের নামে দ্বীনকে ভাগ করেছে। অতঃপর অর্ধেক দ্বীনের প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেছে রাসূল (ছাঃ)-এর উপর এবং বাকী অর্ধেকের দায়িত্ব অর্পন করেছে তাদের দ্বীনের ভিত্তি আলী (রাঃ)-এর উপরে।[38]

যাহেরী-বাতেনী আক্বীদাসমূহের গুরুত্ব

১. যাহেরপন্থীরা শুধুমাত্র আমল করবে। আর বাতেনপন্থীরা জ্ঞানভিত্তিক কাজে জড়িত থাকবে।[39]

২. তারা বলে, ছাহেবুত তা’বীলকে অস্বীকারকারী কাফের।[40]

৩. তারা বলে, যে ব্যক্তি যাহের-বাতেনের উপরে আমল করে, সে আমাদের দলভুক্ত। যে ব্যক্তি বাতেন ব্যতীত শুধু যাহেরের উপর আমল করে, তার চেয়ে কুকুর ভাল। সে আমাদের দলভুক্ত নয়।[41]

৪. নাতেক হ’ল শরী‘আত প্রণেতা, ছামেত হ’ল শরী‘আতের ভিত্তি। আর নাতেক শরী‘আত ব্যাখ্যাকারী। রাসূল (ছাঃ) যাহেরী কথাবার্তা বলেন। আর ছামেত বাতেনী বিষয় দেখভাল করেন। নাতেক কলমের পাশে এবং ছামেত লাওহ বা ফলকের পাশে।[42]

পর্যালোচনা ও জবাব

ইসমাঈলীরা রাসূল (ছাঃ)-এর রিসালাতে আলী (রাঃ)-কে ভাগীদার বানিয়েছে এবং মানমার্যাদাতে সমান গণ্য করেছে। যদি বিষয়টা এমনই হ’ত, তবে রাসূল (ছাঃ)-কে কেন আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত মানবজাতির নিকট পাঠালেন সকলের রাসূল ঘোষণা করে? [43]

১. মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ ‘আর আমরা তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য (জান্নাতের) সুসংবাদদাতা ও (জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।[44]

২. মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ) তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী।[45]

৩. মহান আল্লাহ আরো বলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ‘আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে পূর্ণ করে দিয়েছি। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে ধর্ম হিসাবে মনোনীত করেছি।[46]

৪. মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا ‘তুমি বল, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।[47]

৫. মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘তুমি বল এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই।[48]

(চলবে)

[লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’]

[1]. আল-ইসমাঈলিয়াহ : তারীখ ওয়া আক্বাইদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১৯।

[2]. তদেব, পৃ. ৪৩৯; গৃহীত : মুফাযযাল জু‘ফী, ওয়াল হাফতুশ শরীফ, পৃ. ২৬।

[3]. তদেব; গৃহীত : মুফাযযাল জু‘ফী, ওয়াল হাফতুশ শরীফ, পৃ. ৩৬।

[4]. তদেব, পৃ. ৪৪১।

[5]. আল-কুরআন, সূরা নাবা, আয়াত-৭৮/১৭-১৮।

[6]. আল-ইসমাঈলিয়াহ : তারীখ ওয়া আক্বাইদ, প্রাগুক্ত পৃ. ৪৪২; গৃহীত : জা‘ফর ইবন মানছূরুল ইয়ামান, কিতাবুল কাশফ, পৃ. ১৭০।

[7]. তদেব, পৃ. ৪৪৭।

[8].আল-কুরআন, সূরা মুমিন, আয়াত-৪০/১৬।

[9]. আল-কুরআন, সূরা মুত্বাফফেফীন, আয়াত-৮৩/১৫-১৭।

[10]. আল-ইসমাঈলিয়াহ : তারীখ ওয়া আক্বাইদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৪।

[11]. তদেব, পৃ. ৪৫৬।

[12]. তদেব, পৃ. ৪৫৭-৪৫৮।

[13]. তদেব, পৃ. ৪৫৮।

[14]. তদেব, পৃ. ৪৬০।

[15]. সূরা হিজর ১৫/৪৪।

[16]. আল-ইসমাঈলিয়াহ : তারীখ ওয়া আক্বাইদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬১।

[17]. তদেব, পৃ. ৪৬১; গৃহীত : আবু ইসহাক, ওয়াহফাত, পৃ. ৪৭, ৪৮।

[18]. তদেব, পৃ. ৪৬১।

[19]. তদেব, পৃ. ৪১৮।

[20]. তদেব, পৃ. ৫৫১।

[21]. তদেব, পৃ. ৫৬১; গৃহীত : জা‘ফর ইবন মানছূর ইয়ামন, তা’বীলুয যাকাত, ৬০ পৃ.।

[22]. তদেব, পৃ. ৫৬১।

[23]. তদেব, পৃ. ৫৬৮; গৃহীত : মুছত্বাফা গালিব, তারীখু দা‘ওয়াতুল ইসমাঈলিয়াহ, ৩৪ পৃ.।

[24]. সূরা আলে-ইমরান ৩/১৯

[25]. সূরা আলে-ইমরান ৩/৮৫।

[26]. মায়েদাহ, ৫/৩।

[27]. বুখারী হা/৩৫৩৫, ৬৪, ৬৫; মুসলিম হা/২২ (২২৮৬)

[28]. বুখারী হা/ ৩৪৫৫, ১৬০৪।

[29]. আল-ইসমাঈলিয়াহ : তারীখ ওয়া আক্বাইদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫৮।

[30]. তদেব, পৃ. ৫৬৯।

[31]. তদেব, পৃ. ৫৭০।

[32]. আহমাদ, বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত হা/১৭৭।

[33]. আলে-ইমরান ৩/৭।

[34]. আল-ইসমাঈলিয়াহ : তারীখ ওয়া আক্বাইদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭৩; গৃহীত : নু‘মান কাযী, আসাসুত তা‘বীল, (বৈরূত: দারুছ ছাক্বাফাহ) পৃ. ২৯-৩০; শীরাজী, মাজালিসুল মুওয়াইইদ (বৈরূত : দারুল আন্দালুস) পৃ. ১/৩৪৯।

[35]. তদেব, পৃ. ৪৭৪; গৃহীত : ইয়াকুব সিজিস্তানী, ওয়াল ইফতিখার, পৃ. ৭১।

[36]. তদেব, পৃ. ৪৭৪; গৃহীত : কামেল হুসাইন, সিরাতু মুওয়াইইদ ফিদ্দীন, দারুল কিতাব মিছরী, পৃ. ১৭; জা‘ফর ইবন মানছূও ইয়ামন (কায়রো : দারুল ফিকরুল আরাবী, প্রকাশক, নাশর শাতুরজান, ১৯৪৯ খ্রি.), পৃ. ৬৫।

[37]. তদেব, পৃ. ৪৭৪-৪৭৫।

[38]. তদেব, পৃ. ৪৭৪।

[39]. তদেব, পৃ. ৪৭৭; গৃহীত : রাহাতুল আকল, ২৭৫।

[40]. তদেব, পৃ. ৪৭৭; গৃহীত : কিতাবুল কাশফ, ৬৭।

[41]. তদেব, পৃ. ৪৭৭।

[42]. তদেব, পৃ. ৫৭৯; গৃহীত : নু‘মান, আসাসুত তা’বীল, পৃ. ৪০-৪১।

[43]. তদেব, পৃ. ৪৮০।

[44]. সাবা ৩৪/২৭।

[45]. আহযাব ৩৩/৪০।

[46]. মায়েদা ৫/০৩।

[47]. আ‘রাফ, ৭/১৫৮।

[48]. ইউসুফ, ১২/১০৮।



বিষয়সমূহ: আক্বীদা
আরও