তাক্বলীদের কুফল

আব্দুল হালীম বিন ইলিয়াস 715 বার পঠিত

তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণ মুসলিম সমাজের একটি জলজ্যান্ত অভিশাপ। মুসলিম জাতির দলে দলে বিভক্ত হওয়া এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ পরিত্যাগ করে নানা ধর্মীয় মতবাদের সাথে যুক্ত হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তাক্বলীদে শাখছী বা অন্ধ ব্যক্তি পূজা। বিরুদ্ধবাদীরা যত যুক্তিই পেশ করুক না কেন, এমন একটি জাহেলী মতবাদকে ইসলাম কখনই সমর্থন করতে পারে না। ইসলাম দলীলের ধর্ম, কোন দলের ধর্ম নয়। ইসলাম জাগ্রত জ্ঞানের ধর্ম, অন্ধত্বের ধর্ম নয়। ইসলাম অভ্রান্ত সত্যের উৎস ও মানদন্ড হিসাবে ঘোষণা করেছে কেবলমাত্র পবিত্র কুরআন ও হাদীছকে, কোন ইমাম বা পীরকে নয়। অথচ তাক্বলীদ মানুষকে স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ জ্ঞানের পরিবর্তে মূর্খতা ও অন্ধত্বের দিকে আহবান জানায়, দলীলের পরিবর্তে দলের আনুগত্য করতে শেখায়, আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে ধর্মনেতাদের বিধান অনুসরণে বাধ্য করে। সুতরাং তাক্বলীদ যে একটি সুস্পষ্ট জাহেলী মতবাদ এবং খাঁটি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে অন্যতম মূল বাধা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিম্নে তাক্বলীদের কিছু কুফল উল্লেখ করা হল।

১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান অমান্য করা :

মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদতের উদ্দেশ্যে মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করে (যারিয়াত ৫৬) তাদের সার্বিক জীবন পরিচালনার জন্য ইসলামকে একমাত্র মনোনীত জীবন বিধান হিসাবে নির্ধারণ করেছেন (আলে-ইমরান ৩/১৯)। ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান অহি দ্বারা সাব্যস্ত। আর পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিধানই মূলতঃ অহির বিধান। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) দুনিয়ার যাবতীয় বিধি-বিধানের অন্ধ অনুসরণ মুক্ত থেকে নিঃশর্তে ও নির্বিঘ্নে অহি অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

(1) اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ .

(১) ‘তুমি অনুসরণ কর তাই, যা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে তোমার প্রতি অহি করা হয়েছে। তিনি ব্যতীত কোন প্রকৃত ইলাহ নেই। আর মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও’ (আন‘আম ৬/১০৬)

(2) وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا.

(২) ‘তোমাদের নিকট রাসূল যা নিয়ে আসেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)

(3) وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا.

(৩) ‘যখন আল্লাহ বা তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দেন, তখন কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর জন্য সেখানে তাদের নিজস্ব কোন ফায়ছালা পেশ করার অধিকার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল সে স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হল’ (আহযাব ৩৩/৩৬)

এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, (4) عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ مَعْدِيكَرِبَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ-

(৪) মিক্বদাদ ইবনু মা‘আদী কারিব (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি কুরআন ও তারই মত আরেকটি বস্ত্ত (সুন্নাহ) প্রাপ্ত হয়েছি’ (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৬৩)

(5) عَنْ مَالِك أَنَّهُ بَلَغَهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ. رواه في الموطأ

(৫) মালেক ইবনু আনাস (রাঃ) বলেন,  রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমি তোমাদের নিকটে দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্ত্ত মযবুতভাবে ধরে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না; সে দু’টি বস্ত্ত হল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত (মুওয়াত্তা, মিশকাত হা/১৮৬)। আলোচ্য আয়াত ও হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুসরণের মাধ্যমেই মানুষ ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি অর্জন করতে পারে। এ দু’টিকে বাদ দিয়ে কারো মনগড়া কথা চোখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য করে তাক্বলীদ, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

২. দলীল বিমুখতা :

তাক্বলীদের সর্বাপেক্ষা বড় কুফল হল দলীল বিমুখতা। মুক্বাল্লিদ ব্যক্তি আলেম হউক বা জাহিল হউক, কুরআন ও হাদীছ হতে সরাসরি জ্ঞান আহরণ বা ফৎওয়া গ্রহণের অধিকার তার থাকেনা। তাকে স্বীয় ইমাম বা মাযহাবী ফৎওয়া অনুসারে কথা বলতে হয়। ফলে ইমামের নামে প্রচলিত অসংখ্য শিরক বিদ‘আতে সে জড়িয়ে পড়ে। এই দলীল বিমুখতার ফলে প্রায় হাযার বছর পূর্বেকার বিভিন্ন কিয়াসী সিদ্ধান্ত, যার কোন কোনটি কুরআন ও হাদীছের সরাসরি বিরোধী, ইসলামের নামে মুসলমানদের উপর চাফিয়ে দেওয়া হয় এবং যা আজও চলছে (তিনটি মতবাদ, পৃঃ ১২)। মানুষ ভাল মনে করেই তা করছে অথচ প্রকৃত অর্থে তা ব্যর্থ আমল। মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا ‘আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দিব? দুনিয়ার জীবনে যাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়েছে, অথচ তারা ভাবে যে, তারা সুন্দর আমল করে যাচ্ছে’ (কাহাফ ১০৪-১০৪)

৩. মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে বিভক্তি :

মুসলিম উম্মাহকে সর্বদা জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের নির্দেশ দান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

(1) وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا  

‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা’ (আলে ইমরান ১০৩)

হাদীছে এসেছে-

(2) عَنِ الْحَارِثِ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ بِالْجَمَاعَةِ وَالسَّمْعِ وَالطَاعَةِ وَالْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ فِى سَبِيلِ اللَّهِ فَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الإِسْلاَمِ مِنْ عُنُقِهِ إِلاَّ أَنْ يَرْجِعَ وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَي جَهَنَّمَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنْ صَامَ وَإِنْ صَلَّى قَالَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ . رواه أحمد والترمذي

(১) ‘হারিছ আল-আশ‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি (১) জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা (২) আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করা (৩) তাঁর আনুগত্য করা (৪) প্রয়োজনে হিজরত করা এবং (৫) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। যে ব্যক্তি জামা‘আত হতে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়ে গেল তার গর্দান হতে ইসলামের গন্ডি ছিন্ন হল যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দাওয়াত দ্বারা আহবান জানালো সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত হল। যদিও সে ছিয়াম পালন কওে, ছালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন মুসলিম’ (আহমাদ-তিরমিযী, মিশকাত হা/৩৬৯৪)

(3) عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ يَرْضَى لَكُمْ ثَلاَثًا وَيَكْرَهُ لَكُمْ ثَلاَثًا فَيَرْضَى لَكُمْ أَنْ تَعْبُدُوهُ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَأَنْ تَعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلاَ تَفَرَّقُوا وَأَنْ تَنْصَحُوا لِمَنْ وَلاَّهُ اللَّهُ أَمْرَكُمْ وَيَكْرَهُ لَكُمْ قِيلَ وَقَالَ وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ-

(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তিনটি কাজে সন্তুষ্ট হন এবং তিনটি কাজে অসন্তুষ্ট হন। যে তিনটি কাজে তিনি সন্তুষ্ট হন তা হল (১) তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না (২) তোমরা এক্যবদ্ধভাবে আল্লাহ রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না (৩) তোমরা মুসলিম শাসককে সহায়তা করবে। আর যে তিনটি কাজ আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ তা হল (১) বাজে কথা বলা (২) অত্যধিক প্রশ্ন করা (৩) সম্পদ নষ্ট করা (ছহীহ মুসলিম হা/১৭১৫, আহমাদ হা/৮৭৮৫)। তাই মুসলিম উম্মাহকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন যাপন করতে হবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। আর ঐক্যের একমাত্র মানদন্ড হচ্ছে তাক্বলীদমুক্ত ভাবে অহির বিধানের সামনে মাথা নত করা। কিন্তু তাক্বলীদের ফলে অনুসরণীয় ব্যক্তির প্রতি যেমন সৃষ্টি হয় অন্ধভক্তি, তেমনি বিরোধী মতের প্রতি সৃষ্টি হয় অন্ধ বিদ্বেষ। ফলে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও দলাদলি। এক ও অখন্ড মুসলিম মিল্লাত বিভিন্ন মাযহাবী দল ও উপদলে বিভক্ত হওয়ার মূল কারণ হল তাক্বলীদ। ৬৫৬ হিজরীতে বাগদাদের ইসলামী খেলাফতের নির্মম পরিণতি, ৮০১ হিজরীতে সৃষ্ট কা‘বা শরীফে চার মাযহাবের জন্য চার মুছাল্লা কায়েমের বিদ‘আত যা ১৩৪৩ হিজরীতে উৎখাত হয় এবং আজও মুসলিম সমাজের বিভিন্ন ও সামাজিক বিষয় যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, ফিৎরা, কুরবাণী, জানাযা, বিবাহ ও তালাক পদ্ধতি, অযু, তাহারাত, নির্বাচন ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক অনৈক্য বিরাজ করছে তার অধিকাংশরই মূল কারণ হল তাক্বলীদী অসহিষ্ণুতা। এক্ষণে আমরা যদি সত্যিকার অর্থে মুসলিম ঐক্য কামনা করি তাহলে প্রত্যেককে যিদ ও অহমিকা ছেড়ে দিয়ে শরী‘আতের আওতাধীন থেকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে নিঃশর্তভাবে মেনে নিতে হবে। আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদেশ-নিষেধকে বিনাশর্তে গ্রহণ করতে হবে এই একটি মাত্র শর্ত যদি আমরা পূরণ করতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ শতধা বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ পুনরায় একটি অখন্ড মহাজাতিতে পরিণত হবে। বলা বাহুল্য যুগে যুগে আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সেটাই (তিনটি মতবাদ পৃঃ ১৩)

৪. মুকাল্লিদ প্রকৃত মুমিন হতে পারে না :

মুকাল্লিদ ব্যক্তি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও তা মানতে পারেনা এ কারণে যে, ঐ বিষয়টি তার মাযহাবের অনুকূলে নয়। অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ-নিষেধের উপর কোন বিদ্বানের সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দানকারী ব্যক্তি কখনোই প্রকৃত মুমিন হতে পারে না (নিসা ৬৫, আহযাব ৩৬)।

৫. শিরক ও বিদ‘আতের উৎপত্তি :

মুকাল্লিদ এক ইমামের তাক্বলীদ করতে গিয়ে বাস্তবে অসংখ্য বিদ্বানের মুক্বাল্লিদ হয়ে পড়ে। ফলে বিনা দলীলে ফৎওয়া গ্রহণের সুযোগে ধর্মের নামে সৃষ্টি হয় রকমারি শিরক-বিদ‘আত। অথচ যার নামে মাযহাবী ফৎওয়া প্রদান করা হচ্ছে, গবেষণায় দেখা গেছে যে, তিনি এসবের নাড়ী-নক্ষত্র কিছুই খবর রাখেন না। যেমন মুহাম্মাদ মুঈন সিন্ধী বলেন, وليس كل ما بنسب اليهم (أي الأئمة الأربعة) من القياسات البعيدة التي تشبه التشريع الجديد وينقل في كتب مذهبهم فهو ثابت النسبة اليهم بل أكثر ذلك او كله مما ارتكبه من غلب عليه الرأي من أتباعهم الخ ‘চার ইমামের দিকে সম্বন্ধ করে মাযহাবী কিতাবসমূহে যে সকল দূরতম ক্বিয়াসী মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে, যা নতুন শরী‘আত রচনার শামিল তা প্রমাণিত নয়। বরং তার অধিকাংশ কিংবা সবটুকুই তাঁদের অনুসারীদের নিজস্ব রায় মাত্র’। ইবনু দাক্বীকুল ঈদ (মৃ. ৭০২ হিঃ) বলেন, نسبة هذه المسائل الي الأئمة المجتهدين حرام  ‘এই মাসআলাগুলি মুজতাহিদ ইমামগণের প্রতি সম্বন্ধ করা হারাম’ (তিনটি মতবাদ পৃঃ ১৩)

৬. পারস্পারিক সম্পর্কের অবনতি :

মুসলিম-অমুসলিম সকলের সাথে দেখা হলে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করা, পরস্পর সালাম বিনিময় করা এবং মুছাফাহা করা সুন্নাত যা পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করে এবং যার মাধ্যমে প্রচুর ছওয়াব অর্জিত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلاَّ غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا. বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘যখন দুইজন মুসলমান পরস্পর একত্রিত হয়ে মুছাফাহা করেন, তখন তাদের দুইজনের পৃথক হওয়ার পূর্বেই উভয়কে ক্ষমা করে দেওয়া হয়’ (আহমাদ, তিরমিযী ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪৬৭৯)। অথচ মাযহাবপন্থী মুক্বাল্লিদ ব্যক্তিদের মধ্যে এমনও স্বভাব দেখা যায় যে, তারা অন্য আলেম ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সাথে সালাম, মুছাফাহা পর্যন্ত করে না এবং পরস্পর গীবত, তোহমতে সর্বদা লিপ্ত থাকে।

৭. শরী‘আত গবেষণার দুয়ার বন্ধ হওয়া :

তাক্বলীদের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক পরিণতি হল ইজতিহাদ বা শরী‘আত গবেষণার দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া। যেমন বাহরুল উলূম আব্দুল আলী লাক্ষ্ণৌবী (মৃ ১২২৫ হিঃ/ ১৮১০ খৃঃ) বলেন, واما الاجتهاد المطلق فقالوا اختتم بالائمة الاربعة حتي اوجبوا تقليد واحد من هولاء علي الامة وهذا كله هوس من هو هوساتهم لم يأتوا بدليل ولا يعبأ بكلامهم- ‘তারা বলেন, মুৎলাক্ব ইজতিহাদ ইমাম চতুষ্টয় পর্যন্ত শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন এদের যেকোন একজনের তাক্বলীদ করা উম্মতের উপর ওয়াজিব। অথচ এসব কথা লোকদের খোশখেয়াল মাত্র। এসবের কোন দলীল তারা পেশ করেনি এবং তাদের কথার কোন তোয়াক্কা করা যাবে না (তিনটি মতবাদ পৃঃ ১৪)। অতএব অনাগত ভবিষ্যতের অসংখ্য সমাধান হিসাবে ইসলামকে পেশ করতে হলে ইজতিহাদ (অর্থাৎ যুগ জিজ্ঞাসার জওয়াব পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ হতে বের করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো) অবশ্যই যরূরী। কিন্তু তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণ হল এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।

সুতরাং কোন বিশুদ্ধতাবাদী মুসলিমের পক্ষে তাক্বলীদের মত জাহেলী পন্থার অনুসরণ করা কখনই সমীচীন নয়। এটা সুস্থ বিবেক-বিবেচনা পরিপন্থী এবং ইসলামী শরীআতের মূল চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এমনকি এক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মানুষকে শিরকের পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাই ফিরকা নাজিয়া তথা ‘মুক্তিপ্রাপ্ত দলে’র অন্তর্ভূক্ত হতে হলে অবশ্যই তাক্বলীদের অন্ধকারাচ্ছন্ন মায়াবন্ধনকে ছিন্ন করতে হবে এবং নিঃশর্তভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশকে অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!

আব্দুল হালীম বিন ইলিয়াস

লেখক : কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ



বিষয়সমূহ: শিরক
আরও