গুনাহ মাফের আমলসমূহ

আসাদ বিন আব্দুল আযীয 586 বার পঠিত

উপস্থাপনা : পাপকর্ম মানুষের একটি মন্দ দিক। শয়তান তার লালসার মোহে ফেলে মানুষকে পাপকর্মের দিকে ঠেলে দেয়। ধীরে ধীরে সে শয়তানের অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যায়। ফলে এক সময় সে সৎপথ থেকে বহু দূরে চলে যায়। সেই পথ ভোলা মানুষগুলোর সৎপথে আসার সমস্ত পথ আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা সর্বদাই উন্মুক্ত রেখেছেন। মানুষ তার বিশুদ্ধ সৎআমল দিয়ে বিগত পাপগুলোকে মাফ করিয়ে নিতে পারে। আলোচ্য প্রবন্ধে বিগত সকল গুনাহ মাফের আমলগুলো তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

ক. বিগত সকল পাপ মোচনের আমল :

১. আযান শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লে :

আযানের শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লে বিগত সকল গুনাহ মাফ হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِاللهِ رَبًّا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً، وَبِالإِِسْلاَمِ دِينًا ‘মুওয়ায্যিনের আযান শুনে যে ব্যক্তি বলে, ‘আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়াহদাহু, লা- শারীকা লাহু, ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু, ওয়া রাসূলুহু, রাযীতু বিল্লা-হি রববান ওয়াবি মুহাম্মাদিন রাসূলান ওয়াবিল ইসলামী দীনা’। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি সন্তুষ্ট আল্লাহকে রব হিসেবে পেয়ে এবং মুহাম্মাদ কে রাসূল হিসেবে পেয়ে এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে। তার গুনাহ মাফ করা হবে’।[1]

২. নির্ভুলভাবে ২ রাক‘আত ছালাত আদায় করলে :

সর্বোত্তমভাবে ওযূ করে নির্ভুলভাবে ২ রাক‘আত ছালাত আদায় করলে বিগত সকল গুনাহ মাফ হয়। উছমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা তিনি এরূপে ওযূ করলেন, তিনবার নিজের দু’হাতের কব্জি পর্যন্ত ধুলেন, তারপর এবার কুলি করলেন, নাকে পানি দিয়ে তা ঝেড়ে পরিষ্কার করলেন, তিনবার মুখমন্ডল ধুলেন, তারপর কনুই পর্যন্ত তিনবার ডান হাত ধুলেন, এভাবে বাম হাতও কনুই পর্যন্ত ধুলেন। এরপর মাথা মাসাহ করলেন, তারপর ডান পা তিনবার ও বাম পা তিনবার করে ধুলেন। এরপর তিনি বললেন, আমি যেভাবে ওযূ করলাম এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ওযূ করতে দেখেছি। তারপর তিনি (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার ন্যায় ওযূ করবে ও মনোযোগ সহকারে দুই রাক‘আত (নফল) ছালাত আদায় করবে, তার পূর্বেকার সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’।[2]

অপর হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ صَلَّى سَجْدَتَيْنِ لاَ يَسْهُو فِيهِمَا غَفَرَ اللهُ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেছে, আর এতে ভুল করেনি, আল্লাহ তার অতীত জীবনের সব (ছগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন’।[3]

৩. উত্তমভাবে ওযূ, ছালাত ও রুকূকারীর পাপ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنِ امْرِئٍ مُسْلِمٍ تَحْضُرُهُ صَلاَةٌ مَكْتُوبَةٌ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهَا وَخُشُوعَهَا وَرُكُوعَهَا إِلاَّ كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا قَبْلَهَا مِنَ الذُّنُوبِ مَا لَمْ يُؤْتِ كَبِيرَةً وَذَلِكَ الدَّهْرَ كُلَّهُ ‘কোন মুসলিম ব্যক্তির যখন কোন ফরয ছালাতের ওয়াক্ত হয় আর সে ছালাতের ওযূকে উত্তমরূপে আদায় করে, ছালাতের বিনয় ও রুকূকে উত্তমরূপে আদায় করে তা হলে যতক্ষণ না সে কোন কবীরা গোনাহে লিপ্ত হবে, তার এই ছালাত তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহের জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আর এ অবস্থা সর্বযুগেই বিদ্যমান’।[4]

৪. ফেরেশতার আমীনের সাথে আমীন মিলে গেলে :

জামা‘আতে ফরয ছালাত আদায়কালে সূরা ফাতিহা শেষে ইমামের সাথে আমীন বলার মাধ্যমে বিগত পাপ মোচন হওয়া সম্ভব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا أَمَّنَ الْإِمَامُ فَأَمِّنُوا فَإِنَّهُ مَنْ وَافَقَ تَأْمِينُهُ تَأْمِينَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تقدم من ذَنبه ‘ইমাম যখন আমীন বলবে, তোমরাও আমীন বলবে। কারণ যে ব্যক্তির আমীন ফেরেশতাগণের আমীনের সাথে মিলে যায়, আল্লাহ তার অতীতের সব গুনাহগুলো মাফ করে দেন’।[5]

৫. ক্বওমার দো‘আ ফেরেশতার সাথে মিলে গেলে :

হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا قَالَ الإِمَامُ سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ. فَقُولُوا اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ. فَإِنَّهُ مَنْ وَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ الْمَلاَئِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘ইমাম যখন সামিআল্লা-হু লিমান হামিদাহ বলবে, তখন তোমরা আল্লা-হুম্মা রববানা লাকাল হামদ বলবে। কেননা যার কথা ফেরেশতার কথার সাথে মিলে যাবে, তার পূর্বের (ছগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’।[6]

৬-৭. রামাযানে ছিয়াম পালন ও লায়লাতুল ক্বদর জাগরণ করলে : পবিত্র মাহে রামাযানের ছিয়াম পালন ও এ মাসের শেষ দশকের বেজড় রাত্রিতে জেগে ছালাত আদায় করলেও বিগত সকল গুনাহ মাফ হয়। হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ، وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি রামাযানে ঈমানের সাথে ও ছওয়াব লাভের আশায় ছিয়াম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, ছওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[7]

৮. রামাযান মাসে তারাবীহর ছালাত আদায় করলে :

নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ قَامَ شَهْرَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখে ছওয়াব লাভের আশায় তারাবীহর ছালাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[8]

৯. খাবার শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লে :

মুআয ইবনু আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি খাবার খাওয়ার পর এ দো‘আ পড়ে, مَنْ أَكَلَ طَعَامًا ثُمَّ قَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَطْعَمَنِى هَذَا الطَّعَامَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّى وَلاَ قُوَّةٍ ‘আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত্বআমানী হা-যা ওয়ারাযাকানীহি মিন গয়রি হাওলিম মিন্নী ওয়ালা-ক্যুওয়াহ’ অর্থাৎ- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাকে খাদ্য খাইয়েছেন এবং আমার শক্তি সামর্থ্য ব্যতিরিকেই তিনি তা আমাকে দান করেছেন, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়’।[9]

১০. নতুন পোষাক পরিধানের সময় নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লে :

যে ব্যক্তি নতুন কাপড় পরিধান করে এ দো‘আ পড়ে, الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى كَسَانِى هَذَا وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّى وَلاَ قُوَّةٍ আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী কাসা-নী হা-যা- ওয়ারাযাকানীহি মিন গয়রি হাওলিম মিন্নী ওয়ালা- ক্যুওয়াহ। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমার কৌশল ও ক্ষমতা প্রয়োগ ব্যতীতই আমাকে এই কাপড়ের ব্যবস্থা করলেন, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়’।[10]

১১. যে ব্যক্তি ১২ বছর আযান দিবেন :

ইবনু উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَذَّنَ ثِنْتَىْ عَشْرَةَ سَنَةً وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ وَكُتِبَ لَهُ بِتَأْذِينِهِ فِى كُلِّ يَوْمٍ سِتُّونَ حَسَنَةً وَلِكُلِّ إِقَامَةٍ ثَلاَثُونَ حَسَنَةً ‘যে ব্যক্তি ১২ বছর আযান দেয় তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়। আর প্রতিদিনের আযানের বিনিময়ে তার জন্য ষাট নেকী এবং প্রতি ইকামতের জন্য তিরিশ নেকী লেখা হয়’।[11]

১২. সূরা ইখলাছকে ভালবাসলে :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে আসছিলাম। তখন তিনি শুনতে পেলেন এক ব্যক্তি ‘কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ আল্লা-হুছ ছমাদ’ পড়ছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, وَجَبَتْ ‘সে ওয়াজিব করে নিল’। আমি বললাম, কি ওয়াজিব করে নিল? তিনি বললেন, الْجَنَّةُ ‘জান্নাত’।[12] 

১৩. সাইয়েদুল ইস্তিগফার সকাল-সন্ধ্যা পড়লে :

শাদ্দাদ ইবনু আউস (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (ছাঃ) বলেছেন, সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার হ’ল বান্দার এ দো‘আ পড়া- اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّى، لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، خَلَقْتَنِى وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِى، اغْفِرْ لِى، فَإِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ ‘হে আল্লাহ তুমিই আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। কারন তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না।

যে ব্যক্তি দিনের (সকাল) বেলায় দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এ ইস্তিগফার পড়বে আর সন্ধা হওয়ার আগেই সে মারা যাবে, সে জান্নাতী হবে। আর যে ব্যক্তি রাতের (প্রথম) বেলায় দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এ দো‘আ পড়ে নেবে আর সে ভোর হওয়ার আগেই মারা যাবে সে জান্নাতী হবে।[13]

অপর এক হাদীছে এসেছে, শাদ্দাদ ইবন আওস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, নবী করীম (ছাঃ) একদিন তাকে বললেন, ...لاَ يَقُولُهَا أَحَدُكُمْ حِينَ يُمْسِى فَيَأْتِى عَلَيْهِ قَدَرٌ قَبْلَ أَنْ يُصْبِحَ إِلاَّ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ ..‘তোমাদের কেউ যদি সন্ধ্যা এটি পাঠ করে আর ভোরের আগেই যদি তাকদীর অনুসারে তার মৃত্যু এসে যায়, তবে জান্নাত তার জন্য ওয়াজিব’।[14]

১৪. যে ব্যক্তি ৩টি কন্যা সন্তান লালন-পালন করবে :

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ كَانَ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ يُؤْوِيهِنَّ وَيَكْفِيهِنَّ وَيَرْحَمُهُنَّ، فَقَدْ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ الْبَتَّةَ فَقَالَ رَجُلٌ مِنْ بَعْضِ الْقَوْمِ وَثِنْتَيْنِ، يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ وَثِنْتَيْنِ ‘যার তিনটি কন্যা সন্তান আছে এবং সে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে তাদের ব্যয়ভার বহন করে এবং তাদের সাথে দয়ার্দ্র ব্যবহার করে, তার জন্য বেহেশত অবধারিত হয়ে যায়। লোকজনের মধ্য থেকে একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কারো যদি দুটি কন্যা সন্তান থাকে? তিনি বলেন, দুইটি কন্যা সন্তান হ’লেও’।[15]

১৫. যে ব্যক্তি ইয়াতীম প্রতিপালন করল :

আমর বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَنْ ضَمَّ يَتِيماً بَيْنَ أَبَوَيْنِ مُسْلِمَيْنِ إِلَى طَعَامِهِ وَشَرَابِهِ حَتَّى يَسْتَغْنِىَ عَنْهُ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ الْبَتَّةَ ‘যে ব্যক্তি মাতা-পিতা মারা যাওয়া কোন মুসলিম এতিমকে তাকে আল্লাহ তা‘আলা স্বাবলম্বী করা অবধি নিজ পানাহারে শামিল করে, ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়’।[16]

১৬. যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ :

হযরত সালেম বিন আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবু বকর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তুমি মানুষদের নিকট ঘোষণা দাও ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। অতঃপর আমি বের হলাম তখন ওমর (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হ’ল। সে বলল, আপনি কি বলতে চান হে আবু বকর! আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তুমি মানুষদের নিকট ঘোষণা দাও ‘ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, আপনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ফিরে যান। কেননা আমি ভয় করি মানুষ এর উপরই ভরসা করবে। অতঃপর আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ফিরে আসলাম। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, কিসে তোমাকে ফিরিয়েছে? তখন আমি ওমরের কথা বললাম। তিনি বললেন, সে সত্য বলেছে’।[17] 

অপর হাদীছে এসেছে, হুনাইফ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মানুষকে সুসংবাদ দাও যে ব্যক্তি বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে’।[18]

খ. নিষ্পাপ শিশুর মত হওয়ার আমল :

১. হজ্জ পালনকারী ব্যক্তির গোনাহ : আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ ‘যে ব্যক্তি এই ঘরের হজ্জ আদায় করল, অশ্লীলতায় লিপ্ত হ’ল না এবং আল্লাহর নাফরমানী করল না, সে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য প্রসূত শিশুর মত হয়ে (হজ্জ থেকে) প্রত্যাবর্তন করবে’।[19]

২. বিপদের সময় আল্লাহর প্রশংসা করলে :

আবুল আশআছ ছান‘আনী হ’তে বর্ণিত, তিনি দামেস্কের মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ‘রাওয়াহ’ নামক স্থানে দুপুরে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি শাদ্দাদ ইবনু আউসের সাথে সাক্ষাৎ করেন। (তার সাথী) ‘সুনাবিহি’ তার সাথেই ছিল। আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছেন? আল্লাহ আপনাদের ওপর রহম করুন। তারা বলল, এখানে আমাদের এক অসুস্থ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা করছি, আমরা তাকে দেখতে যাব। আমি তাদের সাথে চললাম, অবশেষে তারা ঐ ব্যক্তির নিকট গেল। তারা তাকে বলল, কিরূপ সকাল করলেন? সে বলল, আল্লাহর নিয়ামতসহ। শাদ্দাদ তাকে বলল, গুনাহের কাফফারা ও পাপ মোচনের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমি যখন আমার কোন মুমিন বান্দাকে পরীক্ষা করি, অতঃপর সে আমার মুছীবতের উপর আমার প্রশংসা করে, নিশ্চয় সে ঐ বিছানা থেকে উঠে সেদিনের মত, যেদিন তার মা তাকে নিষ্পাপ শিশুর মত জন্ম দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি আমার বান্দাকে আটকে রেখেছি, আমি তাকে মুছীবত দিয়েছি, অতএব তোমরা তার জন্য ছওয়াব লিখতে থাক, যেমন তার ছওয়াব লিখতে তার সুস্থ অবস্থায়’।[20] 

৩. ছালাতের পর মসজিদে অপেক্ষাকারী, পায়ে হেঁটে জামা‘আতে যাওয়া ব্যক্তি ও পরিপূর্ণভাবে ওযূকারী :

ইবন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, একদা রাতে সুমহান ও বরকতময় আমার রব আমার কাছে সুন্দরতম রূপে এসেছিলেন। (রাবী বলেন, যতদূর মনে পড়ে রাসূল (ছাঃ) স্বপ্নে কথাটি বলেছিলেন) তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি কি জানেন, কি নিয়ে সর্বোচ্চ ফেরেশতা পরিষদ এ বিতর্ক করছে? আমি বললাম, না।

রাসূল বলেন, তখন তিনি আমার কাঁধের মাঝে তার হাত রাখলেন। এমনকি এর স্নিগ্ধতা আমি আমার বুকেও অনুভব করলাম। এতে আসমান ও যমীনের যা কিছু আছে সব আমি জানতে পারলাম। তিনি বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনি কি জানেন, কি নিয়ে মালা-এ আ‘লায় আলোচনা হচ্ছে? আমি বললাম, হ্যাঁ, গুনাহের কাফফারা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। ছালাতের পর মসজিদে অবস্থান করাও কাফফারা, জামা‘আতে পায়ে হেঁটে যাওয়া, কষ্টের সময় পরিপূর্ণভাবে ওযূ করাও কাফফারা। যে ব্যক্তি এই কাজ করবে তার জীবন হবে কল্যাণময়, আর মৃত্যুও হবে কল্যাণময়। যেদিন তাঁর মা তাকে ভূমিষ্ঠ করলেন গুনাহর ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থা হবে সেই দিনের মত।[21]

৪. বায়তুল মুকাদ্দাসে একনিষ্ঠ অন্তর নিয়ে ছালাত আদায় :

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, সুলায়মান ইবনু দাঊদ (আঃ) বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ কাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে তিনটি বিষয় প্রার্থনা করেন, (১) আল্লাহর হুকুমত সুবিচার (২) এমন রাজত্ব যা তার পরে আর কাউকে দেয়া হবে না (৩) এবং যে ব্যক্তি বাইতুল মুকাদ্দাসে কেবলমাত্র ছালাত পড়ার জন্য আসবে, তার গুনাহ যেন তার থেকে বের হয়ে যায় তার মা তাকে প্রসব করার দিনের মত। এরপর নবী (ছাঃ) বলেন, প্রথম দু’টি তাঁকে দান করা হয়েছে এবং আমি আশা করি তৃতীয়টিও তাঁকে দান করা হবে’।[22]

গ. সমূদ্রের ফেনা সমতূল্য পাপ মোচনের আমল :

১. ছালাত শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লে :

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ওয়াক্ত ছালাতের শেষে ৩৩ বার আল্লাহর তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করবে, ৩৩ বার আল্লাহর তাহমীদ বা আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং ৩৩ বার তাকবীর বা আল্লাহর মহত্ব বর্ণনা করবে আর এভাবে নিরানববই বার হওয়ার পর শততম পূর্ণ করার জন্য বলবে, لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়াহদাহু লা- শারীকা-লাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুওয়া আলা- কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’ অর্থান আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। তিনি একক ও তার কোন অংশীদার নেই। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র তিনিই। সব প্রশংসা তারই প্রাপ্য। তিনি সবকিছু করতে সক্ষম।- তার গুনাহসমূহ সমুদ্রের ফেনারাশির মত অসংখ্য হলেও ক্ষমা করে দেয়া হয়’।[23] 

২. ছালাত শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লে :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ ‘সুবাহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহ’ বলবে, তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমপরিমাণ হয়।[24]

৩. নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লে :

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, পৃথিবীর বক্ষে যে লোকই বলে, لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ ‘আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোন মাবূদ নেই, আল্লাহ সুমহান, খারাপকে রোধ করা এবং কল্যাণকে লাভ করার শক্তি আল্লাহ তাআ‘লা ছাড়া অন্য কারো নেই, তার অপরাধগুলো মাফ করা হয়, যদিও তা সাগরের ফেনারাশির ন্যায় (বেশি) হয়।[25]

৪. যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত দো‘আ পড়বে :

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের ছালাতের পর ১০০ বার ‘সুবহা-নাল্লাহ’ এবং ১০০ বার ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। যদিও তা সাগরের ফেনা সম হয়।

[ক্রমশ]

-আসাদ বিন আব্দুল আযীয

[লেখক : পিয়ারপুর, ধুরইল, মোনহনপুর, রাজশাহী ]

[1]. ছহীহ ইবনু খুযাইমাহ হা/৪২১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৬৯৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪২২।

[2]. বুখারী ১৯৩৪, মুসলিম ২২৬; মিশকাত হা/২৮৭।

[3]. আহমাদ হা/২১৭৩৭; মিশকাত হা/৫৭৭

[4]. মুসলিম হা/২২৮; আহমাদ হা/২২২৯১; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৬৮৬; মিশকাত হা/২৮৬।

[5]. বুখারী হা/৭৮০; মুসলিম হা/৪১০; মিশকাত হা/৮২৫।

[6]. বুখারী হা/৭৯৬; মুসলিম হা/৪০৯; মিশকাত হা/৮৭৪।

[7]. বুখারী হা/২০১৪; মুসিলম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।

[8]. নাসাঈ হা/২২০২।

[9]. আবু দাঊদ হা/৪০২৩; আহমাদ হা/১৫৬৭০; মিশকাত হা/৪৩৪৩।

[10]. আবু দাঊদ হা/৪০২৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬০৮৬; মিশকাত হা/৪৩৪৩।

[11]. ইবনু মাজাহ হা/৭১৮; মিশকাত হা/৬৭৮।

[12]. তিরমিযী হা/২৮৯৭; নাসাঈ হা/৯৯৪; মিশকাত হা/২১৬৭০।

[13]. বুখারী হা/৬৩০৬।

[14]. তিরমিযী হা/৩৩৯৩; ছহীহাহ হা/১৭৪৭।

[15]. আদাবুল মুফরাদ হা/৭৮; মিশকাত হা/৪৯৭৫।

[16]. আহমাদ হা/১৯০৪৭; ছহীহাহ হা/২৮৮২।

[17]. ছহীহাহ হা/১১৩৫।

[18]. ছহীহুল জামে‘ হা/৫১৩৫।।

[19]. বুখারী হা/১৮২০; মুসিলম হা/১৩৫০; মিশকাত হা/২৫০৭।

[20]. আহমাদ হা/১৭১৫৯; ছহীহাহ হা/১৬১১; মিশকাত হা/১৫৭৯।

[21]. তিরমিযী হা/৩২৩৩; ছহীহুত তারগীব হা/৪০৮।

[22]. ইবনু মাজাহ হা/১৪০৮; নাসাঈ হা/৬৯৩; আহমাদ হা/২৭৭৬২।

[23]. মুসলিম হা/৫৯৭; মিশকাত হা/৯৬৭।

[24]. মুসলিম হা/৫৯৭; মিশকাত হা/৯৬৭।

[25]. তিরমিযী হা/৩৪৬০; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৬৩৬।



বিষয়সমূহ: পাপ
আরও