হারামে জর্জরিত জীবন

সারোয়ার মেছবাহ 328 বার পঠিত

ভূমিকা : আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সাথে এমন অনেক হারাম কাজ জড়িত হয়ে গেছে এবং নিজেদেরকে আমরা তার সাথে মানিয়ে নিয়েছি যে, তা থেকে দূরে থাকা আমাদের সম্ভব নয়। এমনকি আমরা বিষয়গুলোকে হারামের স্তর থেকে উন্নীত করে এক রকম হালালের স্তরেই ভাবতে শুরু করেছি। অথচ এমন নয় যে, সেগুলো পরিত্যাগ করলে আমরা মারা যাব বা আমাদের জীবন-যাপন খুব বেশী বিপন্ন হবে অথবা আমরা খুব বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হব। চাইলেই পরিত্যাগ করা যেত বা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা যেত। কিন্তু এ সমস্ত হারামের ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে সীমাহীন আগ্রহ। বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ, যুক্তি, অজুহাত দিয়ে সেগুলোকে বৈধ করার ব্যাপারে রয়েছে আমাদের অক্লান্ত প্রয়াস। নিম্নে এমন কয়েকটি হারাম সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

১. সূদ : সূদ একটি মারাত্মক ধরনের অপরাধ। কিন্তু সেটাই বর্তমানে আমাদের উৎকৃষ্ট জীবন-যাপনের সোপান। কেউ অসহায় মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে সূদে টাকা ধার দিয়ে রাতারাতি বড়লোক হচ্ছে, কেউ একই অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে উদ্ধারের নাম করে বিভিন্ন ছোট-বড় ব্যাংক, এনজিও তৈরী করে শোষণ করছে, কেউ আবার ইসলামী ব্যাংক নাম দিয়ে ধর্মীয় আবেগপুষ্ট মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে। আবার কেউ বিলাস বহুল বাড়ী-গাড়ি, রেফ্রিজারেটর কিংবা দামী সৌখিন আসবাব কিনতে লোন নিচ্ছে ব্যাংকগুলো থেকে। ব্যাংকের চাকুরীতে আকর্ষণীয় বেতন। তাই বিসিএসের পরে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় চয়েজ ব্যাংকের চাকুরী। ঘরের সিন্দুক থেকে টাকা বের করে যতটা হেফাযতের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছি; তার চেয়ে বেশী টাকা বর্ধনের জন্য ব্যাংকে গচ্ছিত রাখছি। সূদের টাকায় হজ্জ করে হাজী আর ছাদাক্বা করে হচ্ছি দানবীর। দিনশেষে বলছি, সারা বিশ্ব সূদী অর্থনীতিতে চলছে। আমরা তো অপারগ! মহান আল্লাহ তাদেরকে সতর্ক করে বলছেন, وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا- অর্থাৎ ‘অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)

সূদখোরের পরিণতি সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছ বর্ণিত হয়েছে,

عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤْكِلَهُ وَشَاهِدَهُ وَكَاتِبَهُ-

আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে তাঁর পিতার সূত্রে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূদখোর, সূদদাতা, সূদের সাক্ষী ও এর দলীল লেখক সবাইকে অভিসম্পাত করেছেন’।[1]

অপর হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : الرِّبَا سَبْعُونَ حُوبًا، أَيْسَرُهَا أَنْ يَنْكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সূদের গুনাহের সত্তরটি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র স্তর হ’ল আপন মাকে বিবাহ (যেনা) করা’।[2] অন্যত্র তিনি বলেন,دِرْهَمٌ رِبًا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَثَلَاثِينَ زِنْيَةً- ‘জেনেশুনে কোন ব্যক্তি সূদের এক দিরহাম ভক্ষণ করা ৩৬ বার যেনা করা থেকেও বড়’।[3]

২. ঘুষ আদান-প্রদান : সূদকে বলা হয় ‘ইন্টারেস্ট’ আর ঘুষের অপর নাম ‘স্পিড মানি’। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার ধাপে ধাপে স্পিড মানি ছাড়া কোন ফাইলই হস্তান্তর হয় না। তাই আজ অসহায় সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, কোথায় ঘুষ নেই? সামান্য বাসের সামনের সিট পাওয়ার জন্যও আমরা অবলীলায় ঘুষ দেই! মানুষের জীবনের সাথে ঘুষ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকার কারণে ঘুষের বলে অযোগ্য ব্যক্তিরা যোগ্যস্থানে আসীন হচ্ছে। দেশের ভঙ্গুর এই অবস্থা দূরীভূত করার লক্ষ্যে দুদক গঠন করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, যারা দুর্নীতি বন্ধ করবে তারা নিজেরাই দুর্নীতিতে সর্বাধিক জড়িত! তাই তো কবি বলেছেন,

রক্ষক যদি ভক্ষক হয় কে করিবে রক্ষা,

ধার্মিক যদি চুরি করে কে দেবে তারে শিক্ষা?

ফুক্বাহায়ে কেরাম যুলুম থেকে বাঁচা বা নিজ অধিকার আদায়ের জন্য ঘুষ প্রদানের বৈধতা দিয়েছেন। তবুও সেক্ষেত্রে আমরা ঠিক কতটুকু অপারগ সে প্রশণ থেকেই যায়। ঘুষ ছাড়া চাকুরী যদি জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট হয় তবে শুধুমাত্র কয়েক হাযার টাকা বেশী বেতনের জন্য ঘুষ প্রদান করে চাকুরী নেওয়া কখনোই শরীয়তসম্মত নয়। অথচ আমরা ঘুষ দিচ্ছি, সিস্টেমকে দোষারোপ করছি আর বলছি আমরা অপারগ! আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না এবং অন্যের সম্পদ গর্হিত পন্থায় গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তোমরা জেনেশুনে তা বিচারকদের নিকট পেশ করো না’ ( বাক্বারাহ ২/১৮৮)

হাদীছে এসেছে,عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي- আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতাকে অভিসম্পাত করেছেন’।[4] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ رِجَالاً يَتَخَوَّضُونَ فِى مَالِ اللهِ بِغَيْرِ حَقٍّ، فَلَهُمُ النَّارُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘কিছু লোক আল্লাহর দেয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত’।[5]

৩. বিবাহ অনুষ্ঠান : বিবাহ নারী-পুরুষের মধ্যে একটি পবিত্র বন্ধন। এটি নিছক কোন সামাজিক অনুষ্ঠান নয় বরং একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ধর্মীয় অনুষ্ঠান ধর্মীয় নির্দেশনা মেনে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিবাহ অনুষ্ঠানকে আমরা সামাজিক সংস্কৃতি মনে করার কারণে কবুল বলার সময় ছাড়া এর মধ্যে কোন ধর্মীয় লেশমাত্র নেই। বেশীরভাগ বিবাহ অনুষ্ঠানে পর্দা-পুশিদার কোন বালাই নেই। গান-বাজনা, নাচানাচি আর গায়ে হলুদের নামে অবাধ বেহায়াপনায় ভরপুর। তবুও আমরা সেখানে যাচ্ছি। সরাসরি বেহায়াপনায় অংশগ্রহণ না করলেও পাশে চেয়ার পেতে বসে সবকিছু উপভোগ করছি। দিনশেষে অপারগতা দেখিয়ে সামাজিকতা আর সম্পর্ক রক্ষার দোহাই দিচ্ছি। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي مَالِكٍ الْأَشْعَرِيِّ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْخَزَّ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ- আবু মালেক আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার উম্মতের মধ্যে কতিপয় সম্প্রদায় জন্মাবে যারা রেশমী কাতান এবং রেশমী কাপড় ব্যবহার করা, মদ্যপান করা এবং গান-বাজনা করা হালাল মনে করবে’।[6]

অন্য হাদীছে এসেছে, ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’।[7]

ছাহাবায়ে কেরাম গান-বাজনাকে প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করতেন। সেজন্য গানের আওয়াজ শুনলে তাঁরা কানে আঙ্গুল দিয়ে কান বন্ধ করে এলাকা ত্যাগ করতেন’।[8] একদিন আলী (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বাড়ীতে দাওয়াত দিলেন। রাসূল (ছাঃ) আলী (রাঃ)-এর বাড়ীর পর্দায় ছবি দেখে দাওয়াত না খেয়ে ফিরে গেলেন’।[9] এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আওযাঈ (রহঃ) বলেন, لا ندخل وليمة فيها طبل ولا معزاف ‘আমরা ঐ ওয়ালীমাতে যাই না, যাতে তবলা ও বাদ্যযন্ত্র থাকে’।[10] সুতরাং যে সমস্ত বিবাহ অনুষ্ঠানে বেহায়াপনা হয় সে অনুষ্ঠান আমাদের সামাজিকভাবে বর্জন করা উচিত।

৪. ছবি-মূর্তি : ইসলামে মানুষ কিংবা প্রাণীর ছবি অঙ্কন, বিভিন্ন মূর্তির রূপদান ও স্থাপন করা হারাম। ছবি-মূর্তির বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে কঠোর হুঁশিয়ারী এসেছে। ছবি-মূর্তি বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলো বিশ্লেষণ পূর্বক ওলামায়ে কেরাম ছবি তোলা ও সংরক্ষণ করাকে হারাম বলেছেন। তবে বাধ্যগত কারণে, জনগুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে, রেকর্ড রাখার স্বার্থে তোলা চলে। সে হিসাবে পাসপোর্ট, ভিসা, আইডেন্টিটি কার্ড, লাইসেন্স, পলাতক আসামী ধরার জন্য, গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড রাখার জন্য ইত্যাদি বাধ্যগত ও যরূরী কারণে ছবি তোলা জায়েয’।[11]

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় যরূরী কারণ পরিবর্তন হয়ে নিত্য প্রয়োজনে রূপলাভ করেছে। এমনকি মুর্দা দাফন করতে গিয়েও মানুষ মৃত ব্যক্তির সাথে সেলফি উঠায়! সেকারণে রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে সতর্ক করে বলছেন,إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُونَ-‏‏ ‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সব থেকে শক্ত শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি তৈরী করে’।[12] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, প্রত্যেক ছবি প্রস্ত্ততকারী জাহান্নামী। সে যতগুলো ছবি তৈরী করেছে (ক্বিয়ামতের দিন) সে গুলোর মধ্যে প্রাণ দান করা হবে এবং জাহান্নামের শাস্তি দেয়া হবে। ইবনু আববাস বলেন, যদি তোমাকে একান্তই ছবি তৈরী করতে হয়, তাহ’লে গাছ-গাছড়া এবং এমন জিনিসের ছবি তৈরী কর যার মধ্যে প্রাণ নেই’।[13]

৫. মিথ্যা বলা : মিথ্যা বলা বর্তমান সময়ে একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যেভাবে হরহামেশা মিথ্যা বলে তাতে বুঝা যায় না যে, মিথ্যা একটি মারাত্মক ধরনের পাপ। অথচ একটু চেষ্টা করলেই এ পাপ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের নিকট এ বিষয়টি গুরুত্বহীন। বরং এই মিথ্যাকে কেউ হাতিয়ার বানিয়েছে নিজেকে আত্মরক্ষার জন্য। কেউবা কিছু ফায়দা হাছিলের জন্য। আবার এটা কারও স্বভাবে পরিণত হয়েছে। অথচ ন্যায় বলার বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর দ্ব্যর্থহীন বানী, قُلِ الْحَقَّ وَإِنْ كَانَ مُرًّا ‘তিক্ত হলেও ন্যায় কথা বলবে’।[14]

তথাপি মিথ্যা এমন এক পাপ যা উপহাসচ্ছলেও বলা বৈধ নয়। এমনকি কাউকে হাসানোর উদ্দেশ্যে কৌতুক করে বলাও বৈধ নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَيْلٌ لِلَّذِي يُحَدِّثُ بِالحَدِيثِ لِيُضْحِكَ بِهِ القَوْمَ فَيَكْذِبُ، وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ- ‘সেই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস নিশ্চিত যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধবংস’।[15]

এমনকি শিশুদের ভোলাবার জন্য মিথ্যা বলাও বৈধ নয়। অথচ এভাবেই আমরা শিশুদেরকে মিথ্যায় অভ্যস্ত করে তুলি এবং মিথ্যার প্রতি তাদের ঘৃণার অনুভূতি নষ্ট করে দেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের ঘরে বসা অবস্থায় আমার মা আমাকে ডেকে বললেন, এই যে, এসো! তোমাকে একটা জিনিস দিব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে প্রশ্ন করলেন, তাকে কি দেয়ার ইচ্ছা করছ? আমার মা বললেন, খেজুর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে তাহ’লে এ কারণে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যার পাপ লিপিবদ্ধ হ’ত’।[16] 

মনে রাখা আবশ্যক যে, মিথ্যা দ্বারা কখনই সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং এর পরিণতি ভয়াবহ। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না’ (মুমিন ৪০/২৮)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا- ‘তোমরা মিথ্যা বলা থেকে সাবধান থাক। মিথ্যা অনাচারের পথ দেখায় এবং অনাচার জাহান্নামের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাকে আল্লাহর খাতায় মিথ্যুক বলে লিখে নেয়া হয়’।[17]

৬. গীবত : গীবত একটি নীরব ঘাতক পাপ, যা ছওয়াবকে নিঃশেষ করে দেয়। অথচ সমাজে এই পাপের প্রচলন সবচাইতে বেশী। বর্তমানে এটি জনপ্রিয় টেবিলটকের বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। চায়ের আসর থেকে শুরু করে সর্বত্র স্বাভাবিক আলাপচারিতায় এটি স্বভাবসুলভ আচরণ। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদে বসেও আমরা এই গর্হিত পাপ করতে কুণ্ঠিত হই না। সমাজের পরিচিত নেককার বান্দাদের মধ্যেও খুব কম মানুষই গীবতের এই পাপ থেকে বাঁচতে পারে। গীবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ، ‘পরস্পরের পিছনে গীবত করোনা। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পসন্দ করে? বস্ত্ততঃ তোমরা সেটি অপসন্দ করে থাক’ (হুজুরাত ৪৯/১২)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إنَّ ‌الدِّرْهَم ‌يصيبُه ‌الرجلُ ‌مِنَ ‌الرِّبا أعْظَمُ عندَ الله في الخَطيئَةِ مِنْ ستٍّ وثَلاثينَ زَنْيَةً يَزْنيها الرجُلُ، وإنَّ أَرْبى الرِّبى عِرْضُ الرجُلِ المسْلِمِ- ‘কোন ব্যক্তির জন্য ছত্রিশবার ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ হ’ল এক দিরহাম সূদ গ্রহণ করা। আর সবচেয়ে বড় সূদ হ’ল মুসলিম ভাইয়ের সম্মানে আঘাত দেওয়া বা গীবত করা’।[18] সুতরাং মানুষ কথা-বার্তায় একটু সচেতন হ’লে খুব সহজেই গীবত নামক এই ভয়াবহ পাপ থেকে বাঁচতে সক্ষম।

শেষ কথা : নিজেদের আমলের বিষয়ে অনুশোচনা আসলেও অপারগতার অজুহাত দিয়ে অনুশোচনাকে দাবিয়ে রাখি। আল্লাহর আযাবের কথা না ভেবে অসীম ক্ষমা ও রহমতের কথা ভেবে তাঁর নিকট তওবা করি। অথচ মনে রাখা দরকার যে, কোন কাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকা সম্ভব না হ’লেও তাতে স্বেচ্ছাচারীভাবে লিপ্ত হওয়া বৈধ হয়ে যায় না। তাই কষ্টের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে হ’লেও আমাদেরকে হারাম থেকে বেঁচে থাকতে সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে হবে, যদি আমরা নিজেদের পরিপূর্ণ ঈমানদার বলে বিশ্বাস করি এবং পরকালের চিরস্থায়ী অনাবিল সুখের আবাস জান্নাতে নিজেদেরকে কল্পনা করি। আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় হারাম থেকে আত্মরক্ষার তাওফীক দান করুন-আমীন!


সারোয়ার মেছবাহ

লেখক : শিক্ষার্থী, দাওরায়ে হাদীছ, ৩য় বর্ষ,
আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।


১. আবুদাঊদ হা/৩৩৩৩; ইবনে মাজাহ হা/২২৭৭।

২. ইবনে মাজাহ হা/২২৭৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৮৫৮।

৩. আহমাদ হা/২২০০৭; মিশকাত হা/২৮২৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৮৫৫।

৪. আবুদাঊদ হা/৩৫৮০; আহমাদ হা/৬৯৮৪।

৫. বুখারী হা/৩১১৮; মিশকাত হা/৩৯৯৫।

৬. বুখারী হা/৫৫৯০; আবুদাঊদ হা/৪০৩৯।

৭. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/২১৫১৮; মিশকাত হা/৪৫০৩।

৮. আবুদাঊদ হা/৪৯২৪।

৯. ইবনু মাজাহ হা/৩৩৫৯; নাসাঈ হা/৫৩৫১।

১০. আদাবুয যিফাফ, ১৬৫-৬৬ পৃ.।

[11]. মাসিক আত-তাহরীক, ১৭/৩ সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১৩, প্রশ্নোত্তর ২৮/১০৮।

[12]. বুখারী হা/৫৯৫০; মুসলিম হা/২১০৯।

[13]. বুখারী ও মুসলিম; মিশকাত হা/৪৪৯৮।

[14]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৬১; ছহীহুত তারগীব হা/২২৩৩, ২৮৬৮; মিশকাত হা/৪৮৬৬।

[15]. তিরমিযী হা/২৩১৫; মিশকাত হা/৩৮৩৪; হাদীছ হাসান।

[16]. আবুদাঊদ হা/৪৯৯১; আহমাদ হা/১৫৭৪০; মিশকাত হা/৪৮৮২।

[17]. মুসলিম হা/২৬০৭; মিশকাত হা/৪৮২৪।

[18]. ছহীহুল জামে‘ হা/২৮৩১, সনদ ছহীহ।



বিষয়সমূহ: হালাল-হারাম
আরও