নম্রতা

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1473 বার পঠিত

আল-কুরআনুল কারীম :

1. فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ-

(১) ‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)

2. وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا- وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا-

(২) ‘রহমান’ (দয়াময়)-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অন্ধ লোকেরা (বাজে) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে ‘সালাম’। যারা রাত্রি অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান হয়ে (অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতে রাত্রি জাগরণ করে)’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩-৬৪)

3. تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ-

(৩) ‘আখেরাতের এই গৃহ (অর্থাৎ জান্নাত) আমরা প্রস্ত্তত করে রেখেছি ঐসব মুমিনের জন্য, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে না এবং বিশৃংখলা কামনা করে না। আর শুভ পরিণাম হ’ল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)

4. ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ-

(৪) ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দর পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক ভালভাবেই জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালভাবেই জানেন কে সুপথপ্রাপ্ত হয়েছে’ (নাহল ১৬/১২৫)

5. وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ- وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ-

(৫) ‘আর অহংকারবশে তুমি মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালবাসেন না। তুমি পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু কর। নিশ্চয়ই সবচেয়ে বিকট স্বর হ’ল গাধার কণ্ঠস্বর’ (লোক্বমান ৩১/১৮-১৯)

হাদীছে নববী :


6. عَنْ عِيَاضِ بْنِ حِمَارٍ أَنَّهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ أَوْحَى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لاَ يَبْغِىَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ-

(৭) ইয়ায ইবনু হিমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি অহী করেছেন যে, তোমরা পরস্পর বিনয় প্রদর্শন করবে, যাতে কেউ কারো উপর বাড়াবাড়ি ও গর্ব না করে’।[1]

7. وَعَنْ حَارِثَةَ بْنِ وَهْبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ؟ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لَأَبَرَّهُ. أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ؟ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ.

(৮) হারেছ ইবনু ওয়াহাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল সরলতার দরুণ দুর্বল। যাদেরকে লোকেরা হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। তারা কোন বিষয়ে কসম করলে আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সংবাদ দেব না? আর তারা হ’ল প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী, বদমেযাজী ও অহংকারী’।[2]

8. عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ، وَيُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِ، وَمَا لَا يُعْطِي عَلَى مَا سِوَاهُ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ. وَفِي رِوَايَةٍ لَهُ: قَالَ لِعَائِشَةَ: عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ، وَإِيَّاكِ وَالْعُنْفَ وَالْفُحْشَ، إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ، وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُ-

(৯) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ নরম-কোমল, তিনি নম্রতাকে ভালবাসেন। আর তিনি নম্রতার প্রতি যত অনুগ্রহ করেন, কঠোরতা এবং অন্য কোন আচরণের প্রতি তত অনুগ্রহ করেন না। মুসলিমের অপর বর্ণনায় রয়েছে, একদা রাসূল (ছাঃ) আয়েশা (রাঃ)-কে বলেন, নম্রতাকে নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা হ’তে নিজেকে বাঁচাও। কারণ যাতে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। আর যাতে কোমলতা থাকে না, তা দুষণীয় হয়ে পড়ে’।[3]

9. عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: مَا ضَرَبَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَيْئًا قَطُّ بِيَدِهِ وَلَا امْرَأَةً وَلَا خَادِمًا إِلَّا أَنْ يُجَاهِدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا نِيلَ مِنْهُ شَيْءٌ قَطُّ فَيَنْتَقِمُ مِنْ صَاحِبِهِ إِلَّا أَنْ يُنْتَهَكَ شَيْءٌ مِنْ مَحَارِمِ اللَّهِ فَيَنْتَقِمُ لِلَّهِ-

(১০) আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বহস্তে কোন দিন কাউকে আঘাত করেননি, কোন নারীকেও না, খাদেমকেও না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ব্যতীত। আর যে তাঁর অনিষ্ট করেছে তার থেকে প্রতিশোধও নেননি। তবে আল্লাহর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এমন বিষয়ে তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন’।[4]

10. عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ خَدَمْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَشْرَ سِنِينَ وَاللَّهِ مَا قَالَ لِى أُفًّا. قَطُّ وَلاَ قَالَ لِى لِشَىْءٍ لِمَ فَعَلْتَ كَذَا وَهَلاَّ فَعَلْتَ كَذَا-

(১১)  আনাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি নয় বছর রাসূল (ছাঃ)-এর সেবায় নিয়োজিত ছিলাম। কিন্তু আমার জানা নেই যে, কোন কাজ আমি করেছি, অথচ তিনি সে ব্যাপারে বলেছেন, এরূপ কেন করলে? কিংবা কোন কাজ করিনি, সে ব্যাপারে বলেছেন, কেন অমুক কাজটি করলে না?[5]

11. عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كُنْتُ أَمْشِى مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَعَلَيْهِ بُرْدٌ نَجْرَانِىٌّ غَلِيظُ الْحَاشِيَةِ، فَأَدْرَكَهُ أَعْرَابِىٌّ فَجَبَذَ بِرِدَائِهِ جَبْذَةً شَدِيدَةً قَالَ أَنَسٌ فَنَظَرْتُ إِلَى صَفْحَةِ عَاتِقِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَقَدْ أَثَّرَتْ بِهَا حَاشِيَةُ الرِّدَاءِ مِنْ شِدَّةِ جَبْذَتِهِ ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ مُرْ لِى مِنْ مَالِ اللَّهِ الَّذِى عِنْدَكَ . فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ فَضَحِكَ، ثُمَّ أَمَرَ لَهُ بِعَطَاءٍ .

(১২) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে হাঁটছিলাম। তখন তাঁর গায়ে একখানা গাঢ় পাড়যুক্ত নাজরানী চাদর ছিল। এক বেদুঈন তাঁকে পেয়ে চাদর ধরে সজোরে টান দিল। আনাস বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাঁধের উপর তাকিয়ে দেখলাম যে, জোরে চাদর খানা টানার কারণে তাঁর কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। তারপর বেদুঈনটি বলল, হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আল্লাহর দেয়া যে সম্পদ আছে, তা থেকে আমাকে দেয়ার জন্য আদেশ কর। তখন নবী করীম (ছাঃ) তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন এবং তাকে কিছু দান করার জন্য আদেশ করলেন’।[6]

মনীষীদের বক্তব্য :

১. ইবনু আতা (রহঃ) নম্রতা সম্পর্কে বলেন, ‘যে কোন ব্যক্তি থেকে সত্যকে গ্রহণ করা। সম্মান হ’ল নম্রতায়। যে ব্যক্তি অহংকারে সম্মান তালাশ করবে, তা হবে আগুন থেকে পানি সন্ধানতুল্য’।[7]  

২. আবূ যায়েদ বিসত্বামী (রহঃ) বলেন, নম্রতা হ’ল নিজের জন্য কোন বিশেষ অবস্থান মনে না করা এবং সৃষ্টি জগতে নিজের চেয়ে অন্যকে মর্যাদা ও অবস্থানে নিকৃষ্ট মনে না করা’।[8]

৩. আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক বলেন, বিনয় ও নম্রতার মূল হ’ল, তুমি তোমার দুনিয়ার নে‘মতের ক্ষেত্রে নিজেকে তোমার নীচের স্তরের লোকদের সাথে রাখ, যাতে তুমি তাকে বুঝাতে পার যে, তোমার দুনিয়া নিয়ে তুমি তার চেয়ে মর্যাদাবান নও। আর নিজেকে উঁচু করে দেখাবে তোমার চেয়ে দুনিয়াবী নে‘মত নিয়ে উঁচু ব্যক্তির নিকট, যাতে তুমি তাকে বুঝাতে পার যে, দুনিয়া নিয়ে সে তোমার উপর মর্যাদাবান নয়’।[9]

৪. সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) তাঁর শিষ্যদের বলেন, ‘তোমরা কি জানো যে, নম্রতা কি? তারা বলল, আপনি বলুন, হে আবূ মুহাম্মাদ! তিনি বললেন, প্রত্যেক বিষয়কে যথাস্থানে রাখা। কঠোরতাকে স্বস্থানে, নম্রতাকে তার স্থানে, তরবারীকে যথাস্থানে এবং চাবুককে তার স্থানে রাখা’ ।[10]

সারবস্ত্ত :

১. নম্রতা হলো মুমিনদের একটি বিশেষ গুণ।

২. নম্রতা আল্লাহর পক্ষ মানুষের জন্য রহমত স্বরুপ ।

৩. দাওয়াতী ময়দানে নম্রতা প্রভূত সুফল বয়ে আনে।

৪. নম্রতা মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী প্রভাব ফেলে এবং নরম ব্যক্তি আম জনতার হৃদয়ের মনিকোঠায় জায়গা করে নেয়।

৫. নম্রতা একমাত্র গুণ যা ব্যক্তিকে জান্নাতের অধিকারী করে।

৬. নম্রতা আখেরাতে জাহান্নাম থেকে এবং দুনিয়ায় মানুষের শক্রতা ও অকল্যাণ থেকে বাঁচায়।


[1]. মুসলিম হা/২৮৬৫; আবুদাঊদ হা/৪৮৯৫; ছহীহাহ হা/৫৭০।

[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৬

[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৬৮।

[4]. মুসলিম হা/২৩২৮; মিশকাত হা/৫৮১৮।

[5]. মুসলিম হা/২৩০৯।

[6]. বুখারী হা/৬০৮৮; মিশকাত হা/৪১৫০।

[7]. হাফিয ইবনুল ক্বাইয়িম জাওযিইয়া, মাদারিজুস সালেকীন, ২/৩১৪ পৃ.।

[8]. ঐ, ২/৩১৪ পৃ.

[9] . আবূ বকর আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিদ দুনিয়া, আত-তওয়াযু ওয়াল খামূল, পৃ. ১৬৫।

[10] . ফায়যুল কাদীর ৪/৭৩ পৃ.



আরও