আমার বন্ধু ফাহিম

আরীফ মাহমুদ, আটলান্টা, জর্জিয়া 7956 বার পঠিত

ক্রোধান্বিত না হয়ে কিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির লেনদেন করতে হয় ফাহিম আমাকে শিখিয়েছে। ডারউইন, ইমানুয়েল কান্ট, রিচার্ড ডকিনস, স্যাম হারিস, সেথ এন্ড্রুস, ডেন বার্কার ইনাদের সহ দেশের অভিজিৎ রায়, আরজ আলী মাতববর ছাহেবদের এথিজম আর রেশনালিজম ও যত পড়েছে, উনাদের সম্পর্কে যত জেনেছে মসজিদ থেকে ও ধীরে ধীরে দূরে চলে গেছে। তবে আমাদের সম্পর্ক এজন্য এতটুকু নষ্ট হয়নি। বন্ধুত্বের বাঁধন আলগা হয়নি। ওর জ্ঞান পিপাসাকে বরাবরই শ্রদ্ধার সাথেই দেখেছি। যদিও বা  খালাম্মার (ফাহিমের মা) মন ভারী হয়েছে খুব।

ফাহিমের একটা চমৎকার গুণ হলো-ও খুব পড়ে। আমাদের মতন ভাসমান পড়া না। গভীর মনোযোগের সাথে পড়া। ও স্পষ্টবাদী। নিঁখুত যুক্তিতে পারদর্শী। বিবেক তার শানিত।  নাস্তিক হলেও কোন ধর্মকে ও কোনোদিন গালমন্দ করেনি। কোন  ধার্মিক মানুষকে অশ্রদ্ধা করেনি।

মসজিদের ইমাম বাজার করে আসছেন। ফাহিম ইমামের বাজারের ব্যাগ হাতে নেয়। হাঁটতে হাঁটতে দুজনের গল্প বেশ জমে ওঠে।

আমি শুনি।

ইমাম ছাহেব বলেন-কোনো মানুষ ফেরেশতাও না, আবার শয়তানও না। একজন মানুষকে কোন একটা ঘটনার কারণে একেবারে শয়তান বলাও ঠিক না। আবার একটা ভালো কাজের জন্য কাউকে ফেরেশতা বানানোও ঠিক না। পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে না’। এই কথাটি কেন বলা হয়?

জানিনা-কেন বলা হয়।

ইমাম ছাহেব বলেন- একটা রোগের জন্য রোগীকে ঘৃণা করা ঠিকনা। পাপ হলো রোগ। রোগ দূর করা দরকার। কিন্তু রোগীকে না।

বাহ! কত সুন্দর ব্যাখ্যা।

ইমাম ছাহেবকে দেখি-বেনামাযীর সাথেও দরদ দিয়ে কথা বলতে। হিন্দু ধর্মের মুরুববী সামনে পড়লে নিজ থেকেই প্রথমে আদাব বলে সম্বোধন করতে। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে। ছোট শিশুদের আগে থেকেই সালাম দিতে।

ফাহিম বলে- এই জন্যই উনাকে আমি এত  শ্রদ্ধা করি। ব্যাগ বহন করে আনন্দ পাই।

বর্ষার কর্দমাক্ত পথে হেঁটে  পায়ে মাটি লাগে। ফাহিম বদনা দিয়ে ইমাম ছাহেবের পায়ে পানি ঢালে। ইমাম ছাহেব পা পরিষ্কার করেন।

আমি বলি- জগৎটা আসলেই সুন্দর।

ফাহিম বলে- জগৎ মানে কি?

কি?

যার গতি আছে তাই জগৎ। প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে সংস্কৃত ভাষায় এই শব্দটি এসেছে।  জগৎ যে  গতিময় এই ধারণা না থাকলে- ওরা জগৎ বলল কেমন করে?

তাইতো, জানলো কেমন করে?

ভূগোল শব্দটিও সংস্কৃত ভাষায় আছে। ভূ মানে পৃথিবী। গোল মানে গোল। অর্থাৎ আধুনিক মানুষ এসব আবিষ্কার করার আগেই আজ থেকে আড়াই-তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন মানুষরা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রী ছাড়াই এসব বলে দিয়েছে। প্রায় ৩৬ হাজার বছর আগে মানুষ নিজ হাতে নিঁখুতভাবে আলতামিরার প্রাচীন গুহাচিত্রের বাইসুন এঁকেছে।

আমি বলি- এসব মিরাকল না?

না, এসব কিছু মানুষের নানা সময়ে মানুষের জানার নানা কৌশল।

খালাম্মা পাশে এসে দাঁড়ান। বলেন-মিরাকল অবশ্যই ঘটবে। মায়ের দোয়া কবুল হয়নি- এমন কোন নযীর নেই।

খালাম্মার মিরাকল ঘটা মানে- ফাহিমের আবার মসজিদমুখী  হওয়া।

আমি বলি- জ্বি খালাম্মা মিরাকল অবশ্যই ঘটবে ইনশাআল্লাহ।

বিদ্বান হয়ে নিশ্চুপ থাকলে মানুষের শত্রু বাড়েনা। কিন্তু বিদ্বান হয়ে স্পষ্টবাদী হ’লে মানুষের শত্রু সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ে। স্থানীয় এক বড় নেতার অনৈতিক কাজে প্রতিবাদ করায় ফাহিমের জীবনে ঘোর অমানিশা নেমে আসে। রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে ফাহিম ফেরার হয়। খালাম্মার ঘর আঁধার হয়।

এর মাঝে কেটে গেছে অনেক বছর। ফাহিমের আর কোন খোঁজ নেই। কোন আলতামিরার গুহায় লুকিয়েছে কে জানে।

একদিন জানলাম- মরু, পাহাড়, নদী, উত্তাল সমুদ্র, নিশ্ছিদ্র ট্রাক, নৌকার ভিতরের অন্ধকার, ল্যাটিন আমেরিকা, পানামা, মেক্সিকোর দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ফাহিম আমেরিকা পৌঁছেছে। জীবনের দীর্ঘ উত্থান-পতনে কেটে গেছে অনেক বছর। সবুজপত্র ছাড়া এই দেশে থাকাও মুশকিল। ফাহিম  ইউরোপে ফিরে যেতে উদগ্রীব। ঠিক এমনি সময়ে  আমেরিকার সরকারের বিশেষ দয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে  দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সবুজপত্রটি ফাহিমের হাতে আসে।

মা ফাহিমকে সংসারী হতে বলেন। ফাহিম নাস্তিক হয়ে মাকে কষ্ট দিয়েছে একবার। এখন মায়ের অমতে মেয়ে বিয়ে করে মাকে নতুনভাবে কষ্ট দিতে চায় না।  যদিও সে জানে-যেহেতু সে পলিটিকাল এসাইলামে সবুজপত্র পেয়েছে, তার মানে সে কোনোদিনই নিজ দেশে ফিরতে পারবে না। সব ঘটনা শুনার পরও মেয়ে-মেয়ের পরিবার ফাহিমের সাথেই বিয়ে দিতে রাজী হন।

ফাহিমের বিয়ের যাবতীয় কাজ ভিডিও কলে সুসম্পন্ন হয়। নাস্তিক হয়েও সে কালেমা পড়ে কবুল বলে। এখন, দেশ থেকে মেয়ে আসার প্রতীক্ষা।

মা ফাহিমকে বললেন-দেশে আসতে না পারো, কিন্তু পাশের দেশে তো আসতে পারো। আমি পুত্রবধুকে নিয়ে থাইল্যান্ড আসছি। তুমিও আস।

কিছুদিন পর সবকিছু ঠিকঠাক করে এক শুভক্ষণে ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ফাহিমের সাথে মা-ভাই, বউ-শ্যালকের দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ হয়। এ এক অন্যরকমের পারিবারিক হানিমুন।  মা ছেলেকে এতদিন পর মন ভওে দেখেন। ছেলে মাকে দেখে। গোপনে তার প্রিয়তমা বউকে দেখে।

সেন্ট্রাল ব্যাংককের এক হোটেলে তারা ওঠেন। হানিমুনের দু’সপ্তাহ খুব দ্রুত চলে যায়। ফাহিমের এবার আমেরিকা প্রত্যাবর্তনের পালা। বাকি সবাই ফিরে যাবে ঢাকা।

কিন্তু এর মাঝে শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী এক নতুন ত্রাস। করোনার দখলে চলে গেছে গোটা দুনিয়া। একের পর এক লকডাউন শুরু হয়েছে। সমস্ত ফ্লাইট বাতিল। হানিমুনের পিরিয়ড যত বাড়ছে, ফাহিমের মানিব্যাগও তত ফাঁকা হয়ে আসছে।

খাওয়া-দাওয়া, হোটেল বিল-বাজার সব মিলিয়ে ফাহিমের এখন ত্রাহিমধুসুদন অবস্থা। দু’সপ্তাহের মাঝেই ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা বেড়ে গিয়ে হয়েছে চার সপ্তাহ।

খালাম্মা অভয় দিয়ে বলেন- আল্লাহর উপর ভরসা রাখ বাবা।

ফাহিম বলে- আগে সঠিক পরিকল্পনা মা। পরে আল্লাহর উপর ভরসা।

পরিকল্পনা হ’ল- সবার হোটেল ব্যয় নির্বাহ করা যেহেতু কঠিন। তাই যেভাবেই পারে কোন বিশেষ ফ্লাইটে সুযোগ পেলেই পরিবারের সবাইকে আগে ঢাকা পাঠাতে হবে। কয়েকদিন পর এক বিশেষ ফ্লাইটে ফাহিম বাদে পরিবারের  সবাই ঢাকা ফিরে।

আর ফাহিম ব্যাংককের এক হোটেলে লকডাউনে একা বসে ফাঁকা ওয়ালেট দেখতে থাকে। হোটেল বিল, খাবার খরচ মেটাতে গিয়ে ফাহিম ফতুর। এখন উপায় কি?

মুসলিম হোটেল বয় ইদরীস পরামর্শ দেয়- একটা ভাল ব্যবস্থা আছে। থাকার সমস্যাও মিটবে। আরামও পাবেন। কাল সকালে রেডি হয়ে থাকবেন।

পরদিন সকালে হোটেল বয় ইদরীস ফাহিমকে স্থানীয় দারুল আমান মসজিদের খাদেমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

ফাঁকা বিশাল মসজিদের ভিতর নাস্তিক ফাহিম একা। ভাবছে কীভাবে কি হয়ে গেল। এ কোন রহস্য। আলতামিরার বাইসুন রহস্যের চেয়ে এটা কম কি?

মসজিদের খাদেম ফাহিমকে খাবার দিয়ে যান। জীবন রহস্যের নানা বিষয়ে আলাপ জমে ওঠে। একই মাটি থেকে আঁখ মিঠা সংগ্রহ করে, নিমগাছ তিতা গ্রহণ করে, মরিচ গাছ ঝাল গ্রহণ করে, লেবু গাছ টক গ্রহণ করে- কেমনে হয়?  প্লান্ট সায়েন্সের একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুযায়ী নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু দুনিয়াব্যাপী এই সব প্রক্রিয়ার পেছনের কারিগর কে? কে এই মহাপরিকল্পক?

ফাহিম ভাবে। অনেক গভীর চিন্তাও মানুষের মনে রেখাপাত করেনা। কিন্তু জীবনে হয়তো এমন মুহূর্ত আসে সাধারণ কোনো কথাও কারো হৃদয়কে বিগলিত করে দেয়। ফাঁকা মসজিদের ভিতর একা একা বসে ফাহিমের মনে কি হয় কে জানে? যতই সে ভাবে-ততই তার মনে প্রশান্তি জাগে। এমন নির্জনে এমন ধ্যানের সুযোগ ফাহিম আগে আর কখনো পায়নি। ভাবতে ভাবতে মসজিদের ভিতরেই ফাহিম ঘুমিয়ে পড়ে।

ফজরের আযানের আগেই সে ছালাতের জন্য উঠে দাঁড়ায়। সিজদায় পড়ে এমন অশ্রু বিসর্জনের শান্তি যেন সে আগে আর কখনো পায়নি। মসজিদের ভিতর বসেই মাকে ফোন করে ফাহিম। কাঁদে, শিশুর মতো কাঁদে।

খালাম্মা বলেন- বলেছিলাম না। মিরাকল ঘটবে। মিরাকলই ঘটেছে। ঘর ভর্তি ফাহিমের বইগুলো দেখে দেখে চিন্তা করতাম- আমার ছেলে এত পড়ালেখা করল। এত কিছু শিখল। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর- দু’টো কুরআনের  আয়াত পড়ে একটু মায়ের জন্য রাববুল আলামীনের দরবাওে দোআ করবেনা-এটা কেমন করে হয়। কোন মায়ের মন কি এতে শান্তি পায়। পৃথিবীর সব কিছু এক মহাশৃঙ্খলে বাঁধা। আর এই শৃঙ্খল আর শৃঙ্খলা কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এমনি এমনি হয়না। রাববুল আলামীনও কোন মায়ের মোনাজাতের হাতকে কখনোই শুন্যভাবে ফিরিয়ে দেন না।



আরও