শায়খ সুলায়মান আর-রুহায়লী

মুখতারুল ইসলাম 942 বার পঠিত

পরিচিতি : মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ ফ্যাকাল্টির উছূলে ফিকহ বিভাগের শিক্ষক এবং মসজিদে ক্বোবার ইমাম ও খত্বীব শায়খ সুলায়মান বিন সালীমুল্লাহ আর-রুহাইলী (৫৫) ইসলামের ভিতরে অনুপ্রবেশকারী বাতিল আক্বীদা ও ফিরক্বা সমূহের বিরুদ্ধে সমসাময়িক সোচ্চার সালাফী বিদ্বানদের অন্যতম। তিনি একাধারে বিশিষ্ট দাঈ, লেখক, গবেষক এবং সমালোচক এবং ধর্মতাত্ত্বিক। ইসলামের নামে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্রের অপনোদনে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বিশ্বব্যাপী ইসলাম ও মুসলমানদেরকে যেভাবে অপদস্থ ও লাঞ্চিত করা হচ্ছে, সন্ত্রাসী তকমা দেওয়া হচ্ছে এবং মুসলিম নিধনে যে অপচেষ্টা ও চক্রান্ত চলছে, তার মৌলিক কারণ ও মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে শিকড় সন্ধানী ধর্মতাত্ত্বিক শায়খ সুলায়মান আর-রুহাইলী বর্তমান শতকে নিজেকে একজন নির্ভরযোগ্য দাঈ ইলাল্লাহ হিসাবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। তিনি জাতির সামনে সকল পথ ও মতের উর্ধ্বে উঠে সার্বিক জীবনে ইসলামকেই একমাত্র মুক্তির পথ হিসাবে গ্রহণ করার উদাত্ত আহবান জানান। তিনি আধুনিক দৃষ্টিকোন থেকে প্রমাণ করেন রাজনীতি, অর্থনীতি বা ধর্মনীতি সকল ক্ষেত্রে ইসলামই একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। তাই অন্যের গোলামী নয়, বান্দার দাসত্ব কেবলমাত্র মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত।

বংশ পরিচয় ও শিক্ষাজীবন : শায়খ সুলায়মান বিন সালীমুল্লাহ বিন রাজাউল্লাহ আর-রুহায়লী (হাফিঃ) মদীনা মুনাওয়ারায় ১৯৬৬ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মদীনার প্রখ্যাত হারব বংশের সন্তান। শৈশব থেকেই তিনি ইলমী বাহাছ-মুবাহাছার মধ্যে মদীনায় বড় হন। তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় মসজিদে নববীতে। প্রথমেই তিনি সঊদী আরবের প্রথাগত নিয়মানুযায়ী দশ বছর বয়স হওয়ার পূর্বেই কুরআন মাজীদ হিফয সম্পন্ন করেন।

অতঃপর প্রাইমারী শিক্ষা গ্রহণের পর হাইস্কুল পর্যায়ে তাঁর পিতা তাঁকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন আক্বীদার মানুষের সাথে বেড়ে উঠেন এবং পারস্পরিক ধর্মীয় আক্বীদা-বিশ্বাসের ভিন্নতা তার জীবনে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। তাঁর প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন আযহারী। অতঃপর তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ অনুষদে ভর্তি হন। তাঁর সূক্ষ্ণ মেধা ও প্রতিভা দেখে শিক্ষকরা তাকে ‘উছূলে ফিক্বহ’ বিভাগে মাস্টার্স অধ্যয়নের জন্য নছীহত করেছিলেন। একজন শিক্ষক তাকে একদিন বলেই ফেললেন। ‘তুমি যদি উছূলে ফিক্বহ বিভাগে পড়তে না চাও, তবে তুমি অন্য কোন বিভাগেই পড়বে না’। এটি মূলত ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। সেখানে তিনি অনেক ঘটনাবহুল জীবন অতিবাহিত করেন। অতঃপর التأويل وأثره في أصول الفقه বিষয়ে থিসিস রচনা করে মাস্টার্স এবং القواعد المشتركة بين أصول الفقه والقواعد الفقهية বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরিশেষে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিকহ বিভাগে তিনি শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সাত সন্তানের জনক।

শিক্ষকমন্ডলী : তাঁর জীবনে দ্বীনী জ্ঞানার্জনের একটা বড় অংশে জুড়ে ছিল মসজিদে নববীতে বিভিন্ন শায়খের হালকায় অংশগ্রহণ। সেখানে তিনি বিশ্ববরেণ্য আলেম-ওলামার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। তন্মধ্য অন্যতম হলেন বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিছ শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ), শায়খ বিন বায (রহঃ), শায়খ উছায়মীন (রহঃ), শায়খ আল-আমীন (রহঃ), শায়খ ওমর ফালাতাহ (রহঃ), শায়খ আবুবকর আল-জাযায়েরী (রহঃ), শায়খ ইফরিক্বী (রহঃ) প্রমুখ। এছাড়াও তিনি অসংখ্য আলেম-ওলামার ইলম ও দো‘আ লাভে ধন্য হন।

বিভিন্ন দেশের শিক্ষকের পাশাপাশি মিসরের আল-আযহারের অনেক জ্ঞাণীগুণী বিজ্ঞ শিক্ষকদের সান্নিধ্যে তিনি দ্বীনী ইলম অর্জন করেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিষ্ঠিত বড় বড় আলেমকে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হ’ল- শায়খ ইয়াসীন মাহমূদ। তিনি তার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ক্লাসে বরাবরই একে অপরের প্রতিযোগিতা চলত। শায়খ ইয়াসীন মাহমূদ একবার ক্লাসে প্রথম হয়েছেন তো আরেকবার শায়খ রুহায়লী প্রথম হতেন। শায়খ রুহায়লী তাঁর জীবনীতে আরেকজন সহপাঠীর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি হলেন শায়খ তারহীব আদ-দাওসারী। তিনি অবশ্য শায়খ রুহায়লীর চাইতে বয়সে বড় ছিলেন। তিনি যবরদস্ত ও প্রখ্যাত সালাফী বিদ্বান। এভাবে তাঁর অসংখ্য সহপাঠী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আল্লাহর দ্বীনের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে বলে তিনি তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন।

রচনাবলী : তিনি বহু গ্রন্থ প্রণেতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হল (১) শারহু উছূলিছ ছালাছাহ (২) ক্বাওয়ায়েদু তা‘আরুযিল মাছালেহ ওয়াল মাফাসেদ (৩) ইমাম রাযী লিখিত ‘আল-কিতাব ওয়াস সুন্নাহ’ বইয়ের তাহক্বীক্ব ও তাখরীজ (৪) আত-তা‘রীফাতুল উছূলিইয়াহ (৫) আল-ই‘লাম বিল আইম্মাতিল আরব‘আতিল আ‘লাম (৬) ইনহিরাফুশ শাবাব : আল-ওয়াসাইল ওয়াল ইলাজ।

বক্তব্য সমূহ : তিনি শরী‘আতের বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল- বিভ্রান্ত খারেজীদের ব্যাপারে পিতাকে নছীহত, আইএসরা খারেজী, তাক্বওয়াই রিযিক্বের ভিত্তি, কখন এবং কিভাবে সন্তানকে ছালাতের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, পরিবারের প্রতি সদাচারণ, পর্ণোগ্রাফির আসক্তি, আল্লাহর পরীক্ষার অর্থ বান্দাকে ভালবাসা, প্রশংসাকারীর মুখে ধুলা নিক্ষেপ, জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব, স্বামী-স্ত্রীর সুখী জীবন, সালাফী মানহাজ ইত্যাদি। তার বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য এবং লেখনী তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইট www.sualruhaily.com-এ পাওয়া যায়।

উপসংহার : শায়খ সুলায়মান বিন সালীমুল্লাহ আর-রুহায়লী দিকভ্রান্ত বর্তমান প্রজন্মের জন্য একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, আপোষহীন অবস্থান, বিদ্যার দ্যুতি বিশেষতঃ যুবকদেরকে আকৃষ্ট করেছে। রাসূলের শহর মদীনার অধিবাসী সুলায়মান আর-রুহায়লীর জীবনের শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জন্মেছি এবং বড় হয়েছি মদীনাতে, আর আল্লাহর নিকট এই মদীনাতেই মৃত্যুর আকাংখা রাখি’। মহান আল্লাহ যেন তাঁকে হায়াতে তাইয়েবা দান করেন এবং মুসলিম উম্মাহর খেদমতে আরো অগ্রণী ভূমিকা পালনের তাওফীক দান করেন-আমীন!



আরও