শায়খ ওযায়ের শাম্স (রহঃ)

ড. নূরুল ইসলাম 253 বার পঠিত

বিদগ্ধ মুহাক্কিক শায়খ মুহাম্মাদ ওযায়ের শাম্স (১৯৫৬-২০২২) মুসলিম মনীষা জগতে অত্যন্ত সুপরিচিত এক নাম। তিনি সারাজীবন জ্ঞান-গবেষণার সুমিষ্ট সাগরে অবগাহন করেছেন অত্যন্ত নীরবে-নিভৃতে। পড়াশুনা ও গবেষণা ছাড়া তিনি জীবনে আর কিছুই করেননি। জামে‘আ সালাফিইয়া বেনারসে ছাত্রত্বকালীন বই পড়া ও গবেষণার যে নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত তা অটুট ছিল। মাস্টার্স ও ডক্টরেট পর্যায়ে তিনি প্রতিদিন প্রায় দুইশ পৃষ্ঠা করে পড়তেন। তীক্ষ্ণ ধীশক্তির অধিকারী এই বিরলপ্রজ গবেষক তাঁর মেধা, গভীর অধ্যবসায় ও নিমগ্ন বৈদগ্ধ্যের মাধ্যমে মাখতূতাত বা পান্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ হিসাবে গবেষণা জগতে নিজের এক শক্ত ও মযবুত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য ফৎওয়া, গ্রন্থ ও রিসালা, যেগুলো ইতিপূর্বে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, সেগুলোকে সংকলন করে ‘জামে‘উল মাসাইল’ নামে ছয় খন্ডে প্রকাশ করে তিনি যে অসামান্য ইলমী খিদমত মুসলিম জাতিকে উপহার দিয়েছেন, তা এককথায় অতুলনীয়।

জন্ম : মুহাম্মাদ ওযায়ের শাম্স ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ যেলার ছালেহডাঙায় এক আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা শামসুল হক সালাফী (১৯১৫-১৯৮৬ খৃ.) ভারতের একজন খ্যাতিমান আলেম ও মুহাদ্দিছ ছিলেন। তিনি জামে‘আ সালাফিইয়া বেনারসের দ্বিতীয় শায়খুল হাদীছ ছিলেন।

শিক্ষাজীবন : ১৯৬৬ সালে মাদ্রাসা ফয়যে ‘আম মৌ-য়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনি ১৯৭৬ সালে জামে‘আ সালাফিইয়া বেনারস থেকে ফারেগ হন। অতঃপর ১৯৭৮ সালে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন এবং সেখানে আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে তিনি ১০০০ নম্বরের মধ্যে ৯৯৬ নম্বর পেয়ে লিসান্স (অনার্স) ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে মক্কার উম্মুল ক্বোরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। মাস্টার্সে তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল التأثير العربي في شعر حالى ونقده (উর্দূ কবি) ‘হালীর কবিতায় আরবীর প্রভাব ও তা পর্যালোচনা’)। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি কোর্সে ভর্তি হন। পিএইচ.ডি-তে তাঁর গবেষণার শিরোনাম ছিল الشعر العربي في الهند : دراسة نقدية ‘ভারতে আরবী কবিতা : একটি পর্যালোচনা’। ১৯৯০ সালে থিসিস জমাদানের সময় সুপারভাইজরের সাথে মতবিরোধের কারণে তিনি পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ থেকে বঞ্চিত হন। এভাবেই তাঁর শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

শিক্ষকমন্ডলী : দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা শিক্ষকমন্ডলীর কাছে তিনি জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করেছেন। তাঁর হিন্দুস্থানী শিক্ষকগণের মধ্যে অন্যতম হলেন মাওলানা শামসুল হক সালাফী (পিতা), মাওলানা মুহাম্মাদ রাঈস আহমাদ নাদভী, শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহীদ রহমানী প্রমুখ। আর আরব শিক্ষকগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ড. আব্দুল আযীম আলী আশ-শানাবী, শায়খ আব্দুল বাসিত বদর, শায়খ আলী নাছের আল-ফাকীহী, ড. হাসান মুহাম্মাদ বাজূদাহ, ড. আহমাদ মাক্কী আল-আনছারী, ড. আব্দুল হাকীম হাস্সান, আব্দুল আযীয কিশক প্রমুখ।

প্রবন্ধ লিখন : জামে‘আ সালাফিইয়া বেনারসে অধ্যয়নকালে ১৯৭৫ সালে ভারতের বিখ্যাত উর্দূ গবেষণা পত্রিকা মা‘আরিফ’-এ ‘মাওলানা শামসুল হক আযীমাবাদী’ শিরোনামে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। একই সময়ে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় ছয়শ আহলেহাদীছ আলেমের জীবনী লিপিবদ্ধ করেন। যা অদ্যাবধি অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। তাছাড়া তিনি মাজাল্লাতুল জামে‘আ আস-সালাফিইয়া (বেনারস), মাজাল্লাতুল মুজাম্মা‘ আল-ইলমী আল-হিন্দী (আলীগড়), মাজাল্লাতু মুজাম্মাইল লুগাতিল আরাবিইয়াহ (দামেশ্ক), মা‘আরিফ (আযমগড়), বুরহান (দিল্লী), তাহকীকাতে ইসলামী (আলীগড়), তারজুমান (দিল্লী), মুহাদ্দিছ (বেনারস) প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন।

পান্ডুলিপি তাহকীক : শায়খ ওযায়ের শামস্-এর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্য ও অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি সংগ্রহ ও তা তাহকীক করে প্রকাশ করা। পাটনার খোদাবখ্শ লাইব্রেরী ও মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত দুর্লভ ও মূল্যবান অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির তালিকা প্রস্ত্ততে তিনি কয়েক বছর ব্যয় করেন। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ ও হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর হস্তলিখিত পান্ডুলিপি সমূহ তাহকীক করে প্রকাশ করা তাঁর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। তিনি এই দুই জগদ্বিখ্যাত মনীষীর বহু গ্রন্থ তাহকীক করে প্রকাশ করেছেন।

রচনাসমূহ : তাঁর তাহকীককৃত, রচিত ও অনূদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল :

১. ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর ‘জামে‘উল মাসায়েল’ (৬ খন্ড)।

২. কায়েদা ফিল ইসতিহসান (১৯৯৯)।

৩. আল-জামে‘ লি-সীরাতে শায়খিল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (যৌথভাবে, ১৯৯৯)।

৪. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর ‘আর-রিসালাতুত তাবূকিয়াহ’ (২০০৩)।

৫. আল-ফাহারিস আল-ইলমিইয়াহ লি-আছারিল ইমাম ইবনিল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ (২ খন্ড, যৌথভাবে, ২০১৯)।

৬. শাহ ইসমাঈল শহীদ রচিত ‘রদ্দুল ইশরাক’ (১৯৮৩)।

৭. আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদীর ‘গায়াতুল মাকছূদ ফী হাল্লে সুনানে আবীদাঊদ’ (১৯৯৩)।

৮. মুসাদ্দাসে হালীর আরবী অনুবাদ।

৯. মু‘আল্লিমীর আত-তানকীল (যৌথভাবে, ২০১৪)।

১০. মাক্বালাতে মুহাম্মাদ ওযায়ের শাম্স (২০২০)।

মৃত্যু ও দাফন : শায়খ ওযায়ের শাম্স ২০২২ সালের ১৫ই অক্টোবর এশার ছালাতের পর হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন ১৬ই অক্টোবর বাদ ফজর মাসজিদুল হারামে জানাযা শেষে তাঁকে মক্কার মু‘আল্লা কবরস্থানে দাফন করা হয়।

পরিশেষে বলা যায়, শায়খ ওযায়ের শাম্স একজন শেকড়সন্ধানী গবেষক ছিলেন। প্রাচীন পান্ডুলিপির প্রতি তাঁর যে আগ্রহ ছাত্রজীবনে শুরু হয়েছিল, তা আমরণ অক্ষুণ্ণণ ছিল। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর দুর্বোধ্য হস্তলিপির পাঠোদ্ধার ছিল তাঁর জীবনব্রত। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি সর্বমহলে স্বীকৃত ও সমাদৃত ছিলেন। বর্তমান আহলেহাদীছ আলেমদের মধ্যে এমন ধারার নিমগ্ন গবেষক আর নেই বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না। এই প্রখ্যাত মুহাক্কিককে আল্লাহ রববুল আলামীন জান্নাতুল ফেরদাঊসে স্থান দিয়ে সম্মানিত করুন! আমীন!!



আরও