ড. আব্দুর রহমান আস-সুদাইস

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 10244 বার পঠিত

[মহান আল্লাহ মানবতাকে সঠিক পথে পরিচালনা জন্য মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে মুক্তির দূত হিসাবে পবিত্র কুরআনের হেদায়াত দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। যাতে করে অবাধ্যরা আল্লাহর পায়ে মস্তক লুটায়। সেই কুরআনের দরদী ও আবেগঘন কণ্ঠে তেলাওয়াতকারী ক্বারীদের কারী, ইলম অন্বেষণকারী ছাত্রদের ছাত্র, অর্নলবর্ষী বাগ্মীদের বাগ্মী, প্রভাব বিস্তারকারী ভাষাবিদদের অন্যতম, বিশুদ্ধ আক্বীদা প্রচার-প্রসারে ঈর্ষণীয় দাঈ, চারিত্রিক মাধুর্যে অতুলনীয়, দুনিয়া ত্যাগী, ইলাহী নূরে আলোকিত চেহারা, সালাফী মানহাজের অতন্দ্র প্রহরী এবং আহলেহাদীছে আন্দোলনের মর্দে মুজাহিদ মক্কা-মদীনার প্রধান ইমাম ড. শায়খ আল্লামা আব্দুর রহমান আস-সুদাইস বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমাদৃত এবং স্বীয় কর্মগুণে তিনি খ্যাতিমান কারী ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি মুসলিম উম্মাহর দুই পবিত্রতম স্থান মসজিদ আল-হারাম ও মসজিদে নববীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।  যিনি খুব শৈশবকাল থেকেই নিষ্কুলুষ জীবন-যাপনে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এই মহান মনীষীকে নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন।- সহকারী সম্পাদক]  

নাম : আব্দুর রহমান বিন আব্দুল আযীয আস-সুদাইস। তাঁর পূর্ণ নাম আবু আব্দুল আযীয আব্দুর রহমান ইবন আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল আযীয ইবন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ। তবে তিনি আব্দুর রহমান আস-সুদাইস নামেই পরিচিত।

জন্ম ও পরিবার : ১৩৮২ হিজরীর মোতাবেক ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬০ সালে সঊদী আরবের রাজধানী রিয়ায শহরে তাঁর জন্ম। তিনি কাছীম রাজ্যের বুকাইরিয়া অঞ্চলের অধিবাসী। তিনি আনাজ কালন আরব উপজাতি সম্প্রদায়ের অর্ন্তভুক্ত। তার স্ত্রীর নাম ফাহদা আলী রউফ। তার চার ছেলে আব্দুল আযীয, বকর, শুয়া‘ইব, আব্দুল্লাহ এবং পাঁচ মেয়ে সুমাইয়া, যাইনব, উমায়মা, নাসিবাহ ও মালিকাহ।

কুরআন হিফয : ১২ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন হিফয সম্পন্ন করেন। তার পিতা তাকে রিয়াযে শায়খ আব্দুর রহমান ইবন আব্দুল্লাহ আলে-ফরইয়ান এবং শায়খ মাক্বরী মুহাম্মাদ আব্দুল মাজেদ যাকেরের অধীনে তাহফীযুল কুরআন একাডেমীতে ভর্তি করে দেন। অতঃপর বিভিন্ন শিক্ষকের হাতের ছোঁয়ায় আল্লাহর ফযলে-করমে পবিত্র কুরআন হিফয শেষ করেন। পবিত্র কুরআন হিফযের ক্ষেত্রে উনার সর্বশেষ উস্তায ছিলেন মুহাম্মাদ আলী হাসান।

শিক্ষাগত যোগ্যতা: তিনি সঊদী আরবের রাজধানীতে বেড়ে উঠেন। তিনি হিফয সম্পন্ন করার পর সর্বপ্রথম মাদরাসা আল-মুছান্না বিন হারেছাহ আল-ইবতিদাইয়াতে ভর্তি হন। অতঃপর রিয়াদ বিজ্ঞান স্কুলে পড়াশোনা করে ১৯৭৯ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালে রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারী‘আহ বিষয়ে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উছূলে ফিকহ বিভাগে শায়খ আল্লামা আব্দুর রাযযাক আফীফী এবং ড. আব্দুর রহমান দুরাইবীশ-এর তত্ববধানে ‘আল-মাসায়েলুল আছলিয়াহ আল-মুতাআল্লেকাহ বিল আদিল্লাতিশ শারী‘আহ আল্লাতী খা-লাফা ফীহা ইবনু কুদামা গাযালী’ শিরোনামে গবেষণাকর্মটি সম্পন্ন করে মুমতায রেজাল্ট নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। অতঃপর তিনি ১৯৯৫ সালে আহমাদ ফাহমী আবু সানাহ, রাবেতা আল-ইসলামীর পরিচালক শায়খ ড. আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল মুহসিন আত-তুর্কী ও উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদ-দিরাসাতু ঊলইয়া আশ-শারঈয়াহ বিভাগের প্রধান ড. আলী ইবন আববাস হুকমীর তত্ববধানে ‘আল-ওয়াযেহ ফী উছূলুল ফিকহ লি আবীল অফা ইবন ‘আক্বীল হাম্বলী : দিরাসাত ওয়া তাহক্বীক্ব’ শিরোনামে গবেষণাকর্মটি সম্পন্ন করে মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।

শিক্ষকমন্ডলী :

১. শায়খ ছালেহ আল-আলী আন-নাছের।

২. শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ আলে-শায়েখ (যিনি রাষ্ট্রীয় মুফতী আল-আম)।

৩. ড.শায়খ ছালেহ বিন আব্দুর রহমান আল-আছরাম।

৪. ড. শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান ইবন জিবরীন।

৫. শায়খ আব্দুল আযীয দাউদ।

৬. শায়খ ফাহদুল হুমাইন।

৭. শায়খ ড. ছালেহ বিন গানেম আস-সাদলান।

৮. শায়খ ড. আব্দুর রহমান বিন আব্দুল্লাহ আদ-দুরাইবীশ।

৯. শায়খ ড. আব্দুল্লাহ আলী রুকবান।

১০. শায়খ ড. আব্দুল আযীয বিন আব্দুর রহমান রাবী‘আহ।

১১. শায়খ ড. আহমাদ বিন আলিল মুবারকী।

১২. শায়খ ড. আব্দুর রহমান আস-সাদহান।

১৩. শায়খ আব্দুল্লাহ মুনীফ।

১৪. শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান তাওবীখী।

উল্লেখ্য যে, তিনি বিভিন্ন মসজিদে বিভিন্ন শায়খের কাছে ইলমী ইযাফা নেন। তারা হলেন-

১৫. শায়খ আল্লামা আব্দুল আযীয ইবন বায (রহঃ)।

১৬. শায়খ আল্লামা আব্দুর রাযযাক আফীফী।

১৭. শায়খ ড.  ছালেহ ফাওযান।

১৮. শায়খ আব্দুর রহমান  বিন নাছের বার্রাক।

১৯. শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ রাজিহী।

কর্মজীবন : তিনি উছূলে ফিকাহ বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষে উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শারী‘আহ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এতদ্ব্যতীত তিনি রিয়াযে বিভিন্ন মসজিদে ইমাম ও খতীব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

হারাম শরীফে ইমাম হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ : ১৯৮৪ সালে তিনি কা‘বা শরীফের ইমাম ও খতীব হিসাবে নিযুক্ত হন। আছর ছালাত দিয়ে তার পবিত্রময় জীবন শুরু করেন। একই বছর রামাযান মাসে তিনি প্রথম পবিত্র কা‘বা শরীফে জুম‘আর খুৎবা দেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২২ বছর।

দাওয়াতী কর্মকান্ড : তিনি মাসজিদুল হারামে ইমামতি ও খুৎবার পাশাপাশি ১৪১৬ হিজরী থেকে প্রত্যহ বাদ মাগরিব আক্বীদা, ফিকহ, তাফসীর, হাদীছসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান শুরু করেন। এতদ্ব্যতীত তিনি বিভিন্ন বিষয়ে মাসলা-মাসায়েল প্রদান করে থাকেন। বিশেষ করে হজ্জের সময় ফাতাওয়া-ফারায়েযের দায়িত্বটি তিনি বিশেষভাবে পালন করে থাকেন। তিনি সঊদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইসলামী সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে যোগদান করেন। নিজ দেশের বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মসজিদ, ইসলামিক সেন্টারের দাওয়াতী প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি পৃথিবীব্যাপী মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত ছিটিয়ে-ছড়িয়ে থাকা ইসলামী দাওয়াতী সংস্থা ও সংগঠনের সদস্য হওয়ার সুবাদে তাদের ডাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

তিনি শায়খ আল্লামা আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ) প্রতিষ্ঠিত হায়আতুল ইগাছাহ আল-ইসলামিয়াহ সংস্থার সদস্য। অনুরূপভাবে রাবেতাতুল আলাম আল-ইসলামীর তিনি অন্যতম একজন সদস্য। এছাড়াও তিনি প্রিন্ট মিডিয়া পেপার-পত্রিকায় নানা বিষয়ে হাদীছ সংকলন ও প্রবন্ধ লিখেন। মোদ্দাকথা হ’ল, দাওয়াতী ময়দানে তাঁর সরব পদচারণা রয়েছে। প্রচলিত জঙ্গীপনা ও উগ্রপন্থা থেকে তিনি সকল মুসলমানকে সাবধান থাকতে বলেন। কেননা নিরপরাধ সাধারণ মানুষ হত্যা ইসলাম সমর্থিত নয়। তিনি এসব থেকে যুব সমাজকে সচেতন করে থাকেন।

২০০২ সালের ১৯শে এপ্রিল মাসে তিনি তাঁর বক্তৃতায় ইহুদীদেরকে বানর এবং শূকর নামে আখ্যায়িত করেন যা সঊদী গণমাধ্যম প্রচার করেছিল। তিনি তাঁর বক্তৃতায় আরো বলেন, আপনারা ইতিহাস পড়ুন, দেখবেন ইহুদীদের পূর্বসুরীরা ছিল অত্যন্ত খারাপ এবং আজকের ইহুদী সমাজ পূর্ববর্তীদের তুলনায় আরো খারাপ। তারা হ’ল মা‘ছূম-নিষ্পাপ নবীদের হত্যাকারী এবং মূলতঃ তারা দুনিয়ার আর্বজনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা আল্লাহর নিকট অভিশপ্ত, ঘৃণ্য এবং যুলুমবাজ। ফলে আল্লাহ তাদের অবাধ্যতার ফলে শূকর ও বানরে পরিণত করেছিলেন। ইহুদীরা বংশ পরম্পরায় নীচ, ধূর্ত, অবাধ্য, নিষ্ঠুর, নিকৃষ্ট এবং দুর্নীতি পরায়ন। হে আল্লাহ! তুমি তাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত তোমার লা‘নত অব্যাহত রাখ। আর প্রকৃতপক্ষে তারাই এর হকদার।

তিনি সর্বত্র ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তীনী মুসলিম ভাইদের স্বার্থ নিয়ে বিভিন্ন মজলিসে জোরালো বক্তব্য প্রদান করে থাকেন। তিনি দখলদার ইহুদী অবৈধ বসতি এবং যুলুমবাজ ইসরাঈল রাষ্ট্রকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ত করেন। তিনি বলেন, মসজিদুল আকসা বন্দী থাকতে পারে না। মসজিদুল আকসার মুক্তির ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করুন। স্বাধীন ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত তৈরী করুন। হিংসা-বিভেদ ভুলে আন্তরিকভাবে মযলুম ফিলিস্তিনীদের পক্ষে কথা বলুন।

মক্কা ও মদীনার দায়িত্ব ও মন্ত্রীর পদমর্যাদা লাভ : ২০১২ সালে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় মক্কা ও মদীনার দুই পবিত্র মসজিদের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন। শুধু তাই নয় তিনি পবিত্র দুই হারামের সম্মানিত সভাপতি এবং হারাম সংশ্লিষ্ট বিশেষ বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ।     

সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব : ২০০৫ সালে দুবাইয়ে বর্ষসেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসাবে ‘ইসলামিক পারসনালিটি অব দ্য ইয়ার’ (Islamic Personality Of the Year) নির্বাচিত হন। বিশ্বব্যাপী তিনি ইসলাম বিদ্বেষীদের সামনে সন্ত্রাসবাদ ও বোমা হামলা বিষয়ে ভুল ধারণা নিরসন এবং ইসলামের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কথা স্পষ্ট করেন।

উপসংহার : ইহুদী এবং ইসরাঈলীদের মুখোশ উন্মোচন করায় শায়খ আব্দুর রহমান আস-সুদাইসী ইহুদী-খ্রিস্টান এবং পশ্চিমা মিডিয়ায় বিশেষভাবে সমালোচিত হন। শুধু তাই নয়, আমেরিকা তাঁর ইসলামী কনফারেন্সে নিষেধাজ্ঞা জারী করে এবং কানাডা সরকার তাঁর গমনাগমনে কড়াকড়ি আরোপে করে। তিনি অমুসলিম এবং ইহুদী-খ্রিষ্টানদের অপপ্রচারে মোটেও কর্ণপাত করেনি। বরং তিনি সত্যের পক্ষে নিজের বলিষ্ঠ অবস্থান তুলে ধরেন এবং বিশেষ করে ফিলিস্তীনের নির্যাতিত মুসলিম ভাইদের সহানুভূতি জানাতে ও পাশে দাঁড়াতে মুসলিম জাহানের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। পশ্চিমা মিডিয়া তাকে বর্ণবাদী এবং ঘৃন্য ধর্মপ্রচারক হিসাবে নিন্দা করার অপচেষ্টা চালায়। বস্ত্ততঃ তিনি তা থেকে পবিত্র। শায়খ আব্দুর রহমান আস সুদাইস পবিত্র কা‘বা ঘরের সম্মানিত প্রধান ইমাম। বর্তমান দুনিয়ার সর্বোচ্চ সম্মানীত আলেমদের অন্যতম তিনি। উল্লেখ্য যে, শায়খ সুদাইস বিশ্বাস করেন যে, তার মায়ের দোয়ায় আল্লাহ তা‘আলা তাকে কাবার ইমাম হিসাবে কবুল করেছেন। কারণ ছোট বেলায় তাঁর মা এই বলে দো‘আ করেছিলেন যে, মহান আল্লাহ তোমাকে হারামাইনের ইমাম বানিয়ে দিন।

সর্বোপরি কুরআনের সুমধুর তেলাওয়াতের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে কুরআনের পাখী হিসাবে চির জাগ্রত হয়ে থাকবেন।



আরও