মুহাম্মাদ আলী ফারকুস

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 210 বার পঠিত

[আলজেরীয় সালাফী আলেম মুহাম্মাদ আলী ফারকুস (জন্ম-১৯৫৪খ্রি.) একজন একনিষ্ঠ দ্বীন প্রচারক ও সংস্কারক। তিনি সঊদী আরবের মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পর ঘুনে ধরা সমাজকে প্রকৃত দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এই মহান ব্যক্তিত্ব এখনও জীবিত আছেন এবং তাঁর মূল্যবান সময় দ্বীনের প্রচার-প্রসারে ব্যয় করে যাচ্ছেন। আল্লাহ তাঁর খিদমতকে কবুল করুন এবং তাঁকে হায়াতে ত্বইয়েবাহ দান করুন।-আমীন]

নাম ও জন্ম : আবু আব্দুল মুঈয মুহাম্মাদ আলী বিন বুযায়েদ বিন আলী ফারকুস আল-কুববী। তিনি ২৯শে রবীউল আউয়াল ১৩৭৪ হিজরী মোতাবেক ২৫শে নভেম্বর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে আলজেরিয়ার প্রাচীন রাজধানী কুববাতে জন্মগ্রহণ করেন। এদিকে সম্বন্ধ করে তাঁকে আল-কুববী বলা হয়। উল্লেখ্য যে, তার জন্মের বছরেই আলজেরিয়ায় ফরাসী উপনিবেশ থেকে মুক্তির আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

শিক্ষা ও কর্মজীবন : মুহাম্মাদ আলী ফারকুস ছোটবেলা থেকে ইলমী পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কুরআনিক স্কুলের স্বনামধন্য শিক্ষক মুহাম্মাদ আছ-ছগীরের নিকটে। এরপর তিনি রাজধানীর সুপ্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হ’তে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। শারঈ জ্ঞানার্জনের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ থাকলেও উপযুক্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিকেও তিনি ‘আইন ও প্রশাসনিক বিজ্ঞান’ বিষয়ে পড়াশুনা করেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর বিশেষ রহমতে নবীর শহর মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থিত ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে উচ্চতর জ্ঞানার্জনের সুযোগ পান।

তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে যখন কোন কিছু শিখতেন তখন বলতেন, ‘আমি যদি আলজেরিয়ায় উড়ে গিয়ে মানুষকে এ বিষয়ে জানানোর পর আবারও মদীনায় ফিরে আসতে পারতাম’। তিনি প্রকৃত সংস্কারকদের মত পথভোলা মানুষদের সঠিক পথে আহবান জানানোর জন্য জ্ঞানার্জন শেষে ১৯৮২ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ‘ইসলামী শিক্ষা ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধ্যাপক ও পরিচালক। এরপর মুহাম্মাদ আলী ফারকুস পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য ১৯৯০ সালে মরক্কোর জামে‘আ মুহাম্মাদ আল-খামেস, রাবাতে যান। পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের পর পুনরায় তিনি উক্ত ইন্সটিটিউটে ফিরে আসেন এবং অদ্যবধি সেখানে আছেন।

যাদের সান্নিধ্য লাভ করেছেন : মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বিভিন্ন ওলামায়ে কেরামের সান্নিধ্য লাভ করেন। শুধুমাত্র ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে নয় বরং মসজিদে নববীর বিভিন্ন হালাকায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেসময়ের সম্মানিত শায়খদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তন্মদ্ধে ১. আতিয়াহ মুহাম্মাদ সালেম, তিনি মদীনার উচ্চতর আদালতের সম্মানিত বিচারক এবং মসজিদে নববীর সম্মানিত শিক্ষক। ২. আব্দুল কাদের শায়বাহ আল-হামদ, যিনি শরী‘আ বিভাগের একজন সম্মানিত শিক্ষক। ৩. আবুবকর আল-জাযায়েরী, যিনি শরী‘আ বিভাগের উলুমুত তাফসীরের শিক্ষক। ৪. মুহাম্মাদ আশ-শানক্বীতি, তিনিও শরী‘আহ বিভাগের তাফসীর এবং মসজিদে নববীর কিতাবুস সুন্নাহ বিষয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক। ৫. শায়েখ আব্দুর রঊফ আল-লাবাদী, তিনিও শরী‘আহ বিভাগের একজন সম্মানিত শিক্ষক।

এছাড়াও তিনি তৎসময়ের প্রসিদ্ধ ওলামায়ে কেরামদের নিকট থেকে ইলম অর্জন করেন। তাদের মধ্যে শায়েখ আব্দুল আযীয বিন বা‘য ও শায়েখ হাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আনছারী অন্যতম। পাশাপাশি তিনি ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে লেকচারার হলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন থিসিস বিষয়ক আলোচনায় উপস্থিত থাকতেন। যা সেখানকার সম্মানিত অধ্যাপক ও মাশায়েখগণের দ্বারা আলোচিত হ’ত। যার দ্বারা তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন করতেন।

আক্বীদা ও দাওয়াতী জীবন : তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল-জামা‘আত তথা সালাফী আক্বীদায় বিশ্বাসী। তিনি আলজেরিয়ায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ দাওয়াতের একজন গুরুত্বপূর্ণ বার্তাবাহক। তিনি সালাফী মানহাযের উপর বেশ কিছু প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন এবং এর উপরেই দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন। বিশুদ্ধ আক্বীদা প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এবং শিরক-বিদআত ও বাতিল আক্বীদার মূলোৎপাটনে জন্য সর্বদা সচেষ্ট। একবার কিছু বিদ্বেষী ব্যক্তি শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষুণ করলে তিনি নির্ভীকচিত্তে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস জাতির সামনে তুলে ধরেন।

তিনি আল্লাহর ঘর মসজিদকে জ্ঞান বিতরণের উত্তম স্থান হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি আলজেরিয়ার প্রাচীন রাজধানী কুববাতের ‘আল-হেদায়াতুল ইসলামিয়াহ’ মসজিদে ইবনু কুদামা আল-মাক্বদেসী (রহঃ)-এর ‘রওযাতুন নাযেরা’-এর ব্যাখ্যাদান শেষ করেন। তিনি বাব আল-ওয়াদীতে অবস্থিত ‘মসজিদে ফাতাহ’-এ ইবনু ইদ্রীসের ‘মাবাদিঊল উছূল’-এর ব্যাখ্যা শেষ করেন। বালকুরে অবস্থিত আহমাদ হাফীয মসজিদে ‘আল-কাওয়ায়েদুল ফিক্বহিইয়াহ’ দারস দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রগ্রামে অংশগ্রহণ করে নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। যার অডিও রেকর্ড সংরক্ষণ আছে। আলজেরিয়ায় তিনিই প্রথম ইন্টারনেট ভিত্তিক দাওয়াতী কাজ শুরু করেন। তার দাওয়াতকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে ‘আল-ইহইয়া’ নামে সাময়িকী প্রকাশ করেন, যা তার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।

মুহাম্মাদ আলী ফারকুস সম্পর্কে বিদ্বানদের অভিমত :

(১) আব্দুল মুহসিন ‘আববাদ ‘রিফক্বান আহলুস সুন্নাহ বিআহলিস সুন্নাহ’ গ্রন্থে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, জ্ঞানার্জনের পর যেন প্রত্যেক ছাত্ররা নিজ দেশে আহলে সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রচার করে। উক্ত গ্রন্থে দৃষ্টান্ত স্বরূপ আলজেরীয় বিদ্বান মুহাম্মাদ আলী ফারকুসের নাম উল্লেখ করেছেন।

(২) শায়খ রবী‘ বিন হাদী আল-মাদখালী : তিনি স্বীয় প্রবন্ধ ‘হুকমুল মুযাহারাহ ফিল ইসলাম’ গ্রন্থে আরবের প্রসিদ্ধ দাঈদের নাম উল্লেখের পর আলজেরীয় ওলামাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসাবে তিনি মুহাম্মাদ আলী ফারকুসের নাম উল্লেখ করেছেন।

(৩) শায়খ আব্দুর রহমান বিন নাছের আল-বার্রাক বলেন, আমি মুহাম্মাদ আলী ফারকুসের একটি প্রবন্ধ পড়েছি। সেখানে আমি মহামূল্যবান কিছু পেয়েছি।

(৪) শায়খ সা’দ বিন নাছের আশ-শিছরী বলেন, আমার কাছে মনে হয় ড. ফারকুস জ্ঞান, নৈতিকতা, সুন্নাহ এবং জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে শরী‘আহ বিষয়ে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা পন্ডিত। তিনি তাদের মধ্যে একজন যারা তাঁর কথার ভাষ্যকার।

লেখনী সমূহ : তার বিভিন্ন ধরনের লেখনীর সমাহার আছে। তন্মধ্যে কিছু বিশ্লেষণমূলক এবং কিছু ব্যাখ্যামূলক। ফিক্বহী মূলনীতির ব্যাপারে তাঁর লেখনী সমূহ খুবই সূক্ষ্ম। তাঁর প্রসিদ্ধ কিছু গ্রন্থ হ’ল- ১. মানহাযুস সালাফ। ২. আল-ইখলাছ ৩. উদ্দাতুদ দাঈয়া ইলাল্লাহ। ৪. হুকমুল ইহতিফাল লিমাওলি খাইরিল আনাম। ৫. আহকামুল মাওলূদ। ৬. মাজালিসুল আবরার। ৭. আল-মিন্নাহ ইত্যাদি।

উল্লেখযোগ্য কিছু তাহক্বীকৃত গ্রন্থ : ১. তাহক্বীক্ব তাক্বরীবুল উছূল ইলা ইলমিল উছূল। যা আবুল কাসিম মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন জুঝঈ রচিত। ২. তাকক্বীক্ব আল-ইশারাতু ফী মা‘রেফাতিল উছূল ওয়াল ওয়াজাঝাতি ফী মা‘নাদ দালীল যা ইমাম আবুল ওয়ালীদ আল-বাজী রচিত। ৩. যুল আরহামী ফী ফিক্বহিল মাওয়ারিছ। ৪. মুখতারাতুম মিন নুছুছিল হাদীছিয়াহ ফি ফিক্বহীল মুওয়ামালাতিল মালিয়াত।

ফিক্বহী কিছু গ্রন্থ : ১. তরীকুল ইহতিদায়ে ইলা হুকমিল ই‘তিমামে ওয়াল ইক্বতিদায়ে ২. ফারায়েদুল ক্বাওয়ায়েদ লিহাল্লে মা‘আকিদিল মাসাজিদ। ৩. আল-ইরশাদু ইলা মাসায়িলিল উছূল ওয়াল ইজতিহাদ। ৪. মাজালিসুত তাযকিরা আলা মাসায়িলি আ‘রাসিল মিনহাজিন। ৫. আল-আদাতুল জারিয়া ফি আ‘রাসিল জাযায়িরিয়াহ ইত্যাদি।

তাঁর বেশ কিছু ফ্রেন্স ভাষায় অনুবাদকৃত গ্রন্থ : 1. Les Mariages Coutumes et Jugements religieux. 2. La fonction du grand Imam, jugement et critères. 3. Recommandation Salafies 4. Le sommaire des oeuvres de la 'Umra et du Hadj. 5. Quarante questions sur les jugements du nouveau-né. etc.

মুহাম্মাদ আলী ফারকুস কুরআন ও হাদীছের বুঝ শ্রেষ্ঠ সালাফদের নিকট থেকে গ্রহণ করে থাকেন। তিনি মানুষকে প্রচলিত রাজনীতি, ধর্মীয় রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ বা সমাজবাদের দিকে আহবান করেন না। বরং তার আহবান হ’লقُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘তুমি বল এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)

তিনি আলজেরিয়ার মাটিতে সমাজ সংস্কারে যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছেন এবং আহলেহাদীছ আন্দোলনে দাওয়াতি পরিসরকে অগ্রগামী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আল্লাহ তাঁর হায়াতকে দীর্ঘায়ু করুন এবং তার দাওয়াতী মিশনকে আরও বিস্তৃতি ও সফল করুন।- আমীন!

 



আরও