আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 521 বার পঠিত

[‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’ নওদাপাড়া মাদরাসার অধ্যক্ষ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ও ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাবেক সভাপতি মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল মাদানী গত ২-৩ জুলাই ২০১৩ দাওয়াতী সফরের উদ্দেশ্যে মালদ্বীপ গমন করেন। মালদ্বীপ সফর থেকে ফিরে আসার পর জনাব আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ-এর এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ‘তাওহীদের ডাক’-এর সহকারী সম্পাদক বযলুর রহমান]  

তাওহীদের ডাক : মুহতারাম, আপনারা গত ২ জুলাই দাওয়াতী সফরের উদ্দেশ্যে মালদ্বীপে গমন করেছিলেন। সফরটি আপনাদের কেমন লেগেছে?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের সফরটি সব মিলিয়ে খুব সুন্দর হয়েছে। আমরা সেখানে যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম, সে উদ্দেশ্য যথাযথভাবে পূরণ করতে পেরেছি বলে মনে করছি এবং মালদ্বীপ প্রবাসী বাঙালীরা এর একটা দারুণ সুফল ভোগ করবে ইনশাআল্লাহ।

তাওহীদের ডাক : আমাদের জানামতে আহলেহাদীছ আন্দোলনের পক্ষ থেকে মালদ্বীপে আপনাদের এটাই প্রথম সফর। এই সফরের ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ কিভাবে হয়েছিল এবং আয়োজক কারা ছিলেন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : হ্যাঁ! এটিই মালদ্বীপে আমাদের প্রথম দাওয়াতী সফর। আর এই সফরের ব্যবস্থাপনা হয়েছে সেদেশের কতিপয় প্রবাসী আহলেহাদীছ বাঙ্গালী ভাইদের মাধ্যমে। যাদের আক্বীদা ও আমল আমাদের প্রকাশিত মাসিক ‘আত-তাহরীক’ ও অন্যান্য বইগুলো পড়ে এবং বক্তব্য শ্রবণ করে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ‘আন্দোলন’-এর কুমিল্লা যেলা সভাপতি মাওলানা ছফীউল্লাহ-এর মাধ্যমে মালদ্বীপের কুমিল্লার প্রবাসী ভাইয়েরা সর্বপ্রথম যোগাযোগ করেন। তারা আমাকে এবং শায়খ আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈলকে তাদের প্রোগ্রামে দাওয়াত করলেন। পরে আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল ছাহেব ভিসা সংক্রান্ত কাগজপত্র আমার কাছে চেয়ে পাঠালেন। কয়েকদিনের মধ্যে সার্বিক প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হয়। পরিশেষে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ ও বিদায় নিয়ে গত ২ জুলাই আমরা দু’জন মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।

তাওহীদের ডাক : আপনারা সেখানে মোট কতটি প্রোগ্রাম করেছেন এবং সেখানের মানুষের আক্বীদা-আমল কেমন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : সেখানে আমাদের দুই দিন অবস্থানকালে ২টি প্রোগ্রাম হয়েছে। আমরা প্রোগ্রাম করি যথাক্রমে ২ ও ৩ তারিখ রাতের বেলায়। সংক্ষিপ্ত সময়ে দ্বীপ দেশটি ঘুরে দেখার তেমন সুযোগ হয়নি। ৩ তারিখ সকাল ৮টা থেকে নিয়ে মাগরিব পর্যন্ত দেশটি সফর করি। বিভিন্ন দ্বীপে যাই। শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখি। তারপরে মাগরিব ও এশার ছালাতের পরে প্রোগ্রাম শুরু হয়। উক্ত প্রোগ্রাম দু’টিতে উপস্থিতি ছিল প্রায় দেড় থেকে দুই হাযারের মত। অনুষ্ঠান দু’টি ১ম দিন ইস্কিন্দারিয়া এবং পরের দিন হিরিয়া স্কুলের এক অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। মূলতঃ প্রবাসী আহলেহাদীছ বাঙ্গালীরাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মাযহাবীরাও অনেকে উপস্থিত ছিলেন বলে জেনেছি।

আক্বীদাগতভাবে স্থানীয় মালদ্বীপবাসীরা পুরোপুরিভাবে আহলেহাদীছ আক্বীদার অনুসারী। অর্থাৎ তাদের আক্বীদা বিশুদ্ধ। আল্লাহ যে সপ্তম আকাশে আছে তারা এটাই বিশ্বাস করে। আল্লাহ নিরাকার নন, তাঁর আকার-আকৃতি আছে এটাই তারা বিশ্বাস করে। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে তারা মাটির তৈরি বলে বিশ্বাস করে। আমরা মালদ্বীপের বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে বেশ কিছু আলেম ও ইমামের সাথে কথা বলেছি। কিছু বিষয়ে তাদের বুঝার ত্রুটি থাকতে পারে হয়ত, কিন্তু তাদের আক্বীদা স্বচ্ছ এবং তারা সালাফী আক্বীদার মানুষ। মালদ্বীপের জনগণ সবাই শাফেঈ মাযহাবভুক্ত। তারা বুকের উপর হাত বাঁধে। জোরে আমীন বলে। অন্য কোন মাযহাবের লোক সেখানে আছে বলে মনে হল না। কেননা কেউ নাভীর নিচে হাত বাঁধছে কিংবা রফঊল ইদায়েন করছে না এরকম কোন লোক দেখা গেল না। তিনদিন যাবৎ যে আমরা ঘুরলাম তাতে এর ব্যতিক্রম কিছু দেখলাম না। মালদ্বীপের জনগণ প্রায় সবাই কুরআন মাজীদ পড়তে পারে। অনেকের মুখেই শুনলাম যে, মালদ্বীপের কোন পুরুষ বা নারী কুরআন পড়তে জানে না এরকম তাদের জানা নেই। ছালাত আদায়েও তারা যথেষ্ট সতর্ক। তারা স্বাভাবিকভাবে তাদের স্থানীয় ভাষা দিবেহির সাথে সাথে ইংরেজী এবং আরবী ভাষা বলতেও অভ্যস্ত।

তাওহীদের ডাক : আয়োজকদের ব্যবস্থাপনা ও আতিথেয়তা কেমন ছিল?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ: যারা আমাদেরকে দাওয়াত দিয়ে দিয়েছিল তারা আন্তরিকভাবে আমাদেরকে খুবই ভালবাসে এবং একেবারে অন্ধ ভক্ত বললেই চলে। তারা আমাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল যে, আমরা কখন সেখানে পেঁŠছব। আমরা পেঁŠছলে তারা একেবারে বুকে বুক মিলিয়ে খুব আনন্দঘন পরিবেশে স্বাগত জানাল। প্রথমে আমাদেরকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে আমরা সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করলাম। এরপর থেকে শুরু করে বিদায় পর্যন্ত তাদের আতিথেয়তায় আমরা এতই মুগ্ধ হয়েছি যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বরং আমরা দুবাইয়ে পিস টিভির আমন্ত্রণে গিয়ে যে আতিথেয়তা পেয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী আন্তরিক আতিথেয়তা এখানে পেয়েছি। তারা সার্বক্ষণিক আমাদের সঙ্গ দিয়েছে এবং সুবিধা-অসুবিধা দেখভাল করেছে। কোন সমস্যাই বুঝতে দেয় নি।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হল যে, হোটেলবয়রা সবাই ছিল বাঙ্গালী। যারা হোটেলের ক্যান্টিনে কাজ করছে তারাও সবাই বাঙ্গালী। অবশ্য ঐ দেশে বিভিন্ন পেশায় যারা কর্মী হিসাবে কাজ করছে তারা প্রায় সবাই বাঙ্গালী। কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, দোকানদার ইত্যাদি পেশায় যাদেরই দেখা মিলছে দেখা যাচ্ছে তারা বাঙালী। তবে কিছু কিছু ইন্ডিয়ান উর্দুভাষীও আছে। প্রোগ্রাম শেষ করে পরের দিন সকালে আমরা যখন বিমানবন্দরে আসলাম, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে ঢুকতেই চার-পাঁচজন বাঙ্গালী দেঁŠড়িয়ে আসল। তারা আমাদের সাথে কোলাকুলি করে বলল যে, আমরা রাতে আপনাদের প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। আমরা খুব খুশি হয়েছি। আমাদের জন্য আপনারা দোয়া করবেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো ছিল খুব আবেগময় ও হৃদয়স্পর্শী।

তাওহীদের ডাক : দেশের প্রায় সর্বত্রই দ্বীন প্রচারের কাজে আপনার পদচারণা রয়েছে। ইদানিং দেশের বাইরেও প্রায়ই যাচ্ছেন। প্রবাসীদের মাঝে দাওয়াতী কাজে গিয়ে বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা কি আপনার নজর কেড়েছে?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : আমি দ্বীন প্রচারের লক্ষ্যে ইন্ডিয়া, দুবাই ও মালদ্বীপ গিয়েছি। হজ্জ্ব সফরে সঊদী আরব গিয়ে সেখানেও কিছু দ্বীন প্রচার করেছি। সেখানে জুম‘আর খুৎবাও দিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে যেটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটা হল, যারা বিদেশে গেছে তাদের অন্তরটা নিজের দেশ ছেড়ে যাওয়ার কারণেই স্বাভাবিক ভাবেই নরম থাকে। এ কারণেই বোধহয় ধর্মচর্চার প্রতি তাদের আলাদা একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া বিদেশে নানা আমল-আক্বীদার লোক দেখে তাদের মধ্যে নিজের ধর্ম সম্পর্কে অজানা বিষয়গুলো নতুন করে জানার তাকীদ সৃষ্টি হয়। এজন্যই তারা সেখানে বাঙালীদের কোন ধর্মীয় সমাবেশ হলেই খুব আগ্রহ নিয়ে ছুটে যায়। আর এই সুযোগটা নিচ্ছে মুশরিক-বিদআতী আলেম নামধারীরা। তারা বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে দ্বীন প্রচারের নামে শিরক-বিদ‘আত প্রচার করছে এবং তাদের বিভ্রান্ত বক্তব্য মানুষ শ্রবণ করছে আর গ্রহণও করছে। সে কারণে ছহীহ আক্বীদাপন্থী আহলেহাদীছ আলেমদেরকেও দেশে দ্বীন প্রচারের পাশাপাশি প্রয়োজনে দেশের বাইরেও যাওয়া একান্ত যরূরী। আমি এটাও উপলব্ধি করলাম যে, যারা প্রবাসী তাদেরকে ধর্মের কথা বললে তারা খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ধর্মের কথা মেনে নিতে রাযী হয় এবং মেনে চলতে চায়। সে দেশেও অনেক আলেম-ওলামা রয়েছে যারা ধর্ম প্রচার করছেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই নিজ ভাষাভাষী আলেমদের কথা মানুষ বেশী মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং মানে। তাই সময়-সুযোগমত বিদেশের মাটিতেও আমাদের যাতায়াত করা উচিৎ। যদিও এর পিছনে আনুসঙ্গিক প্রস্ত্ততি ও ব্যবস্থাপনার বিড়ম্বনা অনেক সময় নষ্ট করে দেয় এবং নিয়মিত দারসের ব্যাঘাত ঘটায়, যা বেশ অস্বস্তিকরও।   

তাওহীদের ডাক : মালদ্বীপ শহর কেমন দেখলেন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : মালদ্বীপের জনবসতি তো খুবই কম। মালদ্বীপ আসলে দ্বীপেরই সমাহার। হাজারো দ্বীপ নিয়ে গড়া ছোট্ট দেশটি। দ্বীপগুলো আকারেও খুবই ছোট ছোট। একটা দ্বীপ থেকে আর একটা দ্বীপের দূরত্ব কোথাও হাফ কিলোমিটার, কোথাও এক কিলোমিটার, কোন জায়গাতে পাঁচ কিলোমিটার, দশ কিলোমিটার। ছবির মত সুন্দর একেকটা দ্বীপে হয়তো দশটা, বিশটা, পঞ্চাশটা করে বাড়ি আছে। মালদ্বীপের রাজধানী শহর মালে আমাদের এই নওদাপাড়ার সমান হবে বোধহয়। গাড়িতে বড় জোর দশ-পনের মিনিট সময় লাগে শহরটি ঘুরতে। চতুর্দিকে আমরা ঘুরেছি। অবশ্য বিভিন্ন জনের মুখে আমরা অবগত হলাম যে, অনেক দূরে একটা বড় দ্বীপ আছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় বাইশ কিলোমিটার। এছাড়া বাকি দ্বীপগুলো প্রায় সবই ছোট। একটা দ্বীপের ব্যাপারে জানতে পারলাম যে, সেখান চাষাবাদ করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে এক বাঙ্গালী গিয়েছিল। সে দীর্ঘদিন থেকে কিছু চাষাবাদের চেষ্টা করছিল। তারপর কিছুদিন থেকে চলে এসেছে। মালদ্বীপে অবশ্য বিশেষ চাষযোগ্য কোন ফসল নেই। মূলতঃ ওরা চাষ করে মাছ। মাছ তারা শিকার করে। এটাই তাদের প্রধান আয়ের উৎস। তবে মালদ্বীপে নারিকেল হয় খুব। এ দুটা জিনিস তারা বিদেশেও রপ্তানী করে। আর মালদ্বীপে বহির্বিশ্বের পর্যটকদের থাকার জন্য প্রচুর হোটেল আছে। এগুলিই তাদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম। সব মিলে মালদ্বীপ একটি মনোমুগ্ধকর দেখার মত দেশ।

অতঃপর আমরা পরের দিন সকাল ৮টায় গাড়িতে চড়ে মালদ্বীপের রাজধানী মালের চতুর্দিকে ঘুরলাম। তো সেখানে দেখলাম যে, শহরের চতুর্দিকটা পাকা করে বাঁধ দেয়া হয়েছে এবং ২০-২৫ ফুট দূরে অনেক পাথর ফেলা আছে, যাতে বড় ঢেউ এসে না লাগে। মজার ব্যাপার হল এই যে, সেখানে পানির নীচে দেখলাম ৮-১০ হাত পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেখানে মূল্যবান পাথর এবং বিভিন্ন রঙের ও বর্ণের মাছ দেখা যাচ্ছে। আর কিছু জায়গায় দেখলাম সাঁতার কাটার জন্য কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে হাটার সময় মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল তো গোসল করার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। খুব ভাল লাগছিল তার কান্ডকারখানা। অন্যদিকে দ্বীপের বিভিন্ন দিক থেকে স্টীমার আসছে। তাতে মালামাল বোঝাই। এ দেশে তেমন কিছু উৎপাদন হয় না। সব বাহির থেকে আসে। ইন্ডিয়া থেকে বেশী মাল আমদানী হয়। তারপর সেখান থেকে আমরা স্পীড বোটে চড়ে আর একটি দ্বীপে গেলাম। দ্বীপটির নাম ছিল ভিলিঙ্গিলি। ঐ দ্বীপে ঘুরতে গিয়ে আশ্চর্যের বিষয় দেখলাম যে, দ্বীপের চারদিকে কোন বাঁধ নেই। প্রত্যেক বাড়ি থেকে দেড় হাত থেকে দুই হাত সমান বিস্তৃত হয়ে আছে বালুতট। আর তাতে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। পাকুড়সহ আরও বিভিন্ন গাছ দেখা যায়ে। সেসব গাছের নিচে অনেক দোলনা বেঁধে রাখা আছে। লোকজন দোলনায় বসে বসে দুলছে। একটা দোলনায় মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল উঠে বসে দুলতে লাগলেন। মেজবানদের জোর দাবীতে আমিও একটা দোলনায় চড়ে বসতে বাধ্য হলাম। যাইহোক আমরা এই দ্বীপটি ঘুরে সেখানে আরেকটি জিনিস দেখলাম যে, ঐসব দেশের লোক নিজে কোন কাজ করেনা। সরকার তাদের একটা ভাতা দিয়ে থাকে। কিছু কিছু লোক ব্যাবসা করে। অতঃপর বিকেলে আমরা আর এক দ্বীপে গেলাম। যার নাম ছিল হুলহুমালি। সেই দ্বীপে দেখলাম বাড়িঘর নতুন হচ্ছে। অতঃপর সেখানের একটা হোটেলে নাস্তা সেরে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। ওখানে কোন মাটির ঘর নেই। ইট পাথর দিয়ে তৈরী বিল্ডিংগুলোর উচ্চতা দশ তলা পর্যন্তও আছে।

তাওহীদের ডাক : আপনার বিশেষ কোন অভিজ্ঞতার কথা বলবেন কি?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : মালদ্বীপে গিয়ে আমরা বিশেষভাবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম তা হচ্ছে, মালদ্বীপের মানুষের আক্বীদা সালাফী আক্বীদা। আরো আশ্চর্য অভিজ্ঞতা এই যে, মালদ্বীপের প্রত্যেক মানুষ কুরআন মাজীদ পড়তে জানে এবং তারা সবাই নিজের ভাষাসহ আরবী ও ইংরেজী ভাষাও মোটামুটি বলতে পারে।

তবে তাদের ‘দিবেহি’ নামক একটি মাতৃভাষা আছে। যার উচ্চারণ সাঁওতালদের মত খুব জোরে ধাক্কা খায়। আমরা সেই ভাষা বুঝিনা ও তার অক্ষরও চিনিনা। তবে দিবেহি অক্ষরের চিহ্নগুলো আরবী ভাষার অক্ষরের মত। আমাদের বিশেষ অভিজ্ঞতার মধ্যে মসজিদগুলি লক্ষ্য করলাম। সেখানে অনেক দিন আগে মাওলানা ইবরাহীম সাহেব একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার নাম মাদরাসা ত্বাইয়েবা। তবে সেটা এখন আর মাদরাসা নাই। বরং একটা মসজিদ হয়ে আছে। ত্বাইয়েবা মসজিদ খুব সুন্দর ও দুই তলা বিশিষ্ট। চতুর্দিকে কুরআন মাজীদের আয়াতগুলি সুন্দর কারুকার্য খচিত। সব মিলে একটা দ্বীনী পরিবেশ লক্ষ্য করা যায় দেশটিতে। এটা আমার বিশেষ ভাল লেগেছে। 

তাওহীদের ডাক : মালদ্বীপের মানুষদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা কেমন বলে আপনার নিকট মনে হয়েছে? সেখানে কোন ধরনের কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়েছে কি? 

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : সামাজিক অবস্থা খুবই ভাল। রাস্তা-ঘাটে শত শত মটর সাইকেল পার্ক করে রাখা। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, এই মটর সাইকেলগুলো এভাবে রাখা কেন? তারা বলল, এসব মটর সাইকেলের মালিকরা মটরসাইকেল বাড়ীর বাইরেই রাখে। দিন-রাত এভাবেই থাকে। মটর সাইকেল হারানোর কোন ভয় নেই। কেননা এ দেশে কোন চোর নেই। কোন হৈচৈ বা মারামারি হয় না। কোথাও কোন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতও নেই। দেশের মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপি বা মন্ত্রীরা রাস্তায় চলাচলের জন্য কোন পুলিশের প্রয়োজন বোধ করেননা। সাধারণ একটা নিম্নমানের দোকানদার যেমন আযান হলে মসজিদে চলে যাচ্ছে, তেমনি একজন মন্ত্রী আযান হলে মসজিদে চলে যান। রাস্তায় চলার সময় বোঝাই যায়না মন্ত্রী আর সাধারণ মানুষ আলাদা। ঐদেশে কোন রিকসা, গাড়ী, বাস, ট্রেন নেই। প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা হচ্ছে স্পীড বোট আর ট্রলার। আর তার পরে মটর সাইকেল। তারা মটর সাইকেলে ঘোরাঘুরি করে এবং মটর সাইকেলটি ট্রলারে উঠিয়ে নিয়ে আরেক দ্বীপে চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে মটর সাইকেলগুলো ব্যবহার করে। কিছু দ্বীপে আমরা মটর সাইকেলে ঘুরেছি আর মালেতে আমরা একটি পার্সোনাল গাড়িতে ঘুরেছি। সেখানে অল্প কিছু প্রাইভেট গাড়ি রয়েছে। সেগুলোতে তারা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায়।

সামাজিক বা ধর্মীয় কুসংস্কার সেদেশে নেই। সেখানে একটি কবরস্থান লক্ষ্য করলাম যেখানে কোন কবর উঁচু করা ছিলনা। কবর পাকা করার তো কোন প্রশ্নই আসেনা। সেটা দেখে মনে হল ফাঁকা বালুর মাঠ। আর সামাজিকভাবে আমাদের দেশে যে কুসংস্কার আছে যেমন বিভিন্ন দিবস পালন করা, বিভিন্ন জায়গায় মনুমেন্ট বানানো, পীর, ফকীরী ইত্যাদি কোন কিছুই ওদেশে নেই। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার থেকে একেবারেই দেশটি মুক্ত। বলতে গেলে খুবই ভাল পরিবেশ। তবে নারীদের ব্যাপারে আমরা যেটা লক্ষ্য করলাম তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নারীদের মত বোরকা পড়ে ঘুরছে। কিছু কিছু নারী আরবদের মত বোরকা পরে চলছে। তবে কম বয়সী মেয়েদের অনেকেই গেঞ্জি-টপস পরে। কম হলেও এদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতই। এই দিকটা কিছুটা দুর্বল হলেও বাকী বিষয়গুলো ভালো লেগেছে।

অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে সেখানে স্কুল-কলেজ আছে প্রচুর। তবে আমাদের দেশের মত মাদরাসা তেমন একটা নেই। স্কুলগুলোতে তাদের ভাষাসহ কুরআন-হাদীছও শিক্ষা দেওয়া হয়। আর উচ্চ দ্বীনী শিক্ষা লাভের জন্য তাদেরকে সাধারণতঃ দেশের বাইরেই যেতে হয়। যেমন আমরা সেদেশের ধর্মমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে জানতে পারলাম যে, ধর্মমন্ত্রী মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।

তাওহীদের ডাক : সেদেশের বড় কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা রাজনৈতিক ব্যক্তির সাথে আপনাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল কি?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ: ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বলতে আমরা ধর্মমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছি এবং তাঁর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছি। ধর্মমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে আমরা সেখানে আরো কয়েকজন উচ্চ শিক্ষিত অফিসারের সাথে কথা বলেছি। তারা আরবীতেই কথা বললেন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে আরবী তাদের ভালমতই জানা। ধর্মমন্ত্রীকে আমরা আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে বললাম। তিনি খুশী হয়ে বললেন, আপনাদের সাংগঠনিক কোন বইপত্র থাকলে আমরা সেই বইগুলো আমাদের ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করার চেষ্টা করবো। আমরা তাবলীগী ইজতেমায় দাওয়াত দিলে তিনি খুব খুশী হলেন এবং বললেন, ‘সময়সাপেক্ষে সেখানে অবশ্যই উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করবো। আমি বাংলাদেশে আগেও কয়েকবার গিয়েছি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমানের ইন্তেকালের পর তার জানাযায় আমি উপস্থিত ছিলাম। তাই তোমাদের দেশে আমি সব সময় যেতে প্রস্ত্তত’।

তাওহীদের ডাক : মালদ্বীপে ইসলাম প্রচারের সুযোগ ও সুবিধা কেমন বলে মনে হয়েছে? স্থানীয় জনগণের মধ্যে ধর্ম পালনের আগ্রহ কেমন দেখলেন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : স্থানীয় জনগণ ধর্মের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী এবং ধর্মমন্ত্রীর সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারলাম যে, তিনি ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করার মানসিকতা রাখেন। মালদ্বীপে ইসলাম প্রচার করা খুবই সহজ। এখানে কোন বাঁধা-বিপত্তি নেই। তারা যেমন ধর্ম মানতে আগ্রহী তেমনি ধর্মের কথা শুনতেও আগ্রহী। ঐদেশে ধর্ম প্রচার করতে কোন সমস্যা নেই, বাঁধা নেই। তবে বিদ‘আতী বক্তাদেরকে সরকারীভাবে খুব ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়। সেজন্য আমরা যাওয়ার ক’দিন পূর্বে অপর একজন বাংলাদেশী বিদ‘আতী বক্তা সেদেশে উপস্থিত হলে বিমানবন্দর কাস্টমসে তাকে দীর্ঘক্ষণ আটকিয়ে রাখা হয়েছিল।    

তাওহীদের ডাক : মালদ্বীপে প্রবাসী ভাইদের মধ্যে আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর কার্যক্রম কেমন দেখলেন এবং আপনাদের সফরের প্রভাব কেমন পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : মালদ্বীপের প্রবাসী আহলেহাদীছরা আমরা যাওয়ার আগে অবশ্য সাংগঠনিকভাবে সংগঠিত ছিল না। তবে তারা আমাদের বক্তব্য শুনে এবং বই-পত্রিকা নিয়মিত পড়ে। আমি আমার বক্তব্যের পর তাদেরকে বলেছিলাম, আপনাদেরকে বিচ্ছিন্নভাবে থাকা যাবে না, সাংগঠনিকভাবে কাজ করতে হবে। সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক একটি করে বৈঠক করতে হবে। আমার কথায় তারা সাড়া দিল। অতঃপর শরীফুল ইসলামকে সভাপতি এবং কামরুল ইসলাম বিপ্লবকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন মালদ্বীপ শাখা’ গঠন করি। এছাড়া আমরা সাতজনের একটা উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করি। যে কমিটিতে ফয়সাল এবং জসিমুদ্দীন নামের দুই ভদ্রলোক রয়েছেন। পরবর্তীতে জানলাম যে, তারা আরো প্রায় ৫০ জনকে নিয়ে নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠক করছে। দেশে ফিরে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে তাদের এই তৎপরতার কথা জানালে তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন এবং হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘এটাই কি আপনার জীবনে প্রথম কোন সাংগঠনিক শাখা গঠনের অভিজ্ঞতা? আপনাকে এই কাজের জন্য একটি গিফট দেওয়া হবে’। তিনি গিফট দিতে চেয়েছেন। এখনও দেননি। আমি অবশ্য গিফট নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছি। পরিশেষে তারা আমাদেরকে অনেক কিছু হাদিয়া দিল। যেমন কম্বল, মাছের নির্যাস থেকে তৈরী তেলের বৈয়ম ভর্তি চারটি কার্টুন ইত্যাদি। একটা মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের জন্য, একটি আমার জন্য, একটি আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈলের জন্য এবং অপরটি আমার শিক্ষকমন্ডলী ও অন্যান্যদের জন্য। দেশে ফিরে জানতে পারলাম যে, আমাদের সফরের পর সেখানে খুব প্রভাব পড়েছে। যারা অন্যান্য আক্বীদার মানুষ তারাও উপস্থিত হতে না পেরে খুব আফসোস ও দুঃখ করেছে। যারা সেখানে উপস্থিত হয়েছিল তারা আমাদের কথাকে যথাযথ মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছে এবং তারা বিশ্বাস করেছে যে, এটাই হক্ব। এটা জানতে পেরে আমাদেরও খুব ভাল লেগেছে।

তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’কে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ: শুকরিয়া, বারাকাল্লাহু ফীকুম।



আরও