পর্দা নারীর রক্ষাকবচ (শেষ কিস্তি)

নিযামুদ্দীন 8394 বার পঠিত

সৌন্দর্য প্রদর্শন ও পর্দাহীনতা :


উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা চতুষ্পদ জন্তুর স্বভাব। যখন মানুষের মধ্যে এ ধরনের স্বভাব পাওয়া যাবে, তখন মানুষের পতন অবশ্যম্ভাবী ও অবধারিত। মানুষকে আল্লাহ রাববুল আলামীন যে সম্মান ও মান-মর্যাদা দিয়েছে, সে তা থেকে নিচে নেমে আসবে। আল্লাহ রাববুল আলামীন তাকে সে সব নে‘মতরাজি দান করেছে, তা থেকে সে নীচে নেমে আসবে। যারা উলঙ্গপনা, ঘরের বাহিরে যাওয়া ও নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে সৌন্দর্য বা নারীর অধিকার বলে দাবী করে, বাস্তবে তারা মানবতার দুশমন। তারা মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে বের করে পশুত্বের প্রতি ধাবিত করছে। তারা যদিও নিজেদের সভ্য বলে দাবী করছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা অসভ্য ও অমানুষ।

মানবতার উন্নতির সম্পর্কই হ’ল, আত্মসম্ভ্রম হেফাযত করা ও তার দৈহিক সৌন্দর্যকে রক্ষা করার সাথে। মানুষ যখন তার আবরণ ফেলে দিয়ে নিজেকে উলঙ্গ করে ফেলে তখন তার অধঃপতন নিশ্চিত হয়। মানবতার উন্নতি ও অগ্রগতি ব্যাহত হয়। নারীরা যখন পর্দার আড়ালে থাকে তখন তাদের মধ্যে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বোধ অবশিষ্ট থাকে। ফলে তার মধ্যে একটি রূহানী বা আধ্যাত্মিক শক্তি থাকে যা তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর নারীরা যখন লাগামছাড়া হয়ে যায়, আবরণ মুক্ত হয়, তখন তার মধ্যে তার প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়, যা তাকে সৌন্দর্য প্রদর্শন ও অবাধ মেলামেশার প্রতি আকৃষ্ট করে।

সুতরাং একজন মানুষের সামনে দু’টি পথ খোলা থাকে। যখন সে দ্বিতীয়টির উপর সন্তুষ্ট থাকে তখন তাকে অবশ্যই প্রথমটিকে কুরবানী দিতে হবে। আর তখন তার অন্তরে আত্মমর্যাদাবোধ বলতে কোন কিছু থাকবে না। তখন সে অপরিচিত নারীদের সাথে মেলামেশা সহ যাবতীয় সব ধরনের অপকর্মই করতে থাকবে। আর এ ধরনের মেলামেশার ফলে মানব প্রকৃতি ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। লজ্জাহীনতা বৃদ্ধি পাবে, আত্মমর্যাদা ও সম্মানবোধ আর বাকী থাকবে না। মানুষের মধ্যে অনুভূতি থাকবে না এবং তার জ্ঞান-বুদ্ধির অপমৃত্যু ঘটবে।

সৌন্দর্য প্রদর্শন ও পর্দাহীনতার ক্ষতি ব্যাপক, যখন কোন ব্যক্তি কুরআন ও হাদীছের প্রমাণাদি ও ইসলামের ইতিহাসের প্রতি লক্ষ্য করবে, তখন সে দ্বীন ও দুনিয়ার উপর পর্দাহীনতা ও সৌন্দর্য প্রদর্শনের ক্ষতি ও প্রভাব কি তা দেখতে পাবে। বিশেষ করে বর্তমানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার কুপ্রভাব যখন তার সাথে যোগ করা হয়, তখন তার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আমরা আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারব।

সৌন্দর্য প্রদর্শন ও পর্দাহীনতার ভয়াবহ পরিণতিসমূহ

নারীরা তাদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যে নিষিদ্ধ সাজসজ্জা গ্রহণের ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্য নিত্য নতুন পন্থা অবলম্বন করে।

এর ফলে তারা একদিকে তাদের চরিত্রকে কলঙ্কিত করছে, অনুরূপভাবে অনেক পয়সাও এ পথে অপব্যয় করে। পরিণতিতে নারীরা সমাজে নিকৃষ্ট পণ্যে যেমন পরিণত হয়েছে, তেমনি নিজেদের ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করছে। পর্দাহীনতার ক্ষতিগুলো নিম্নরূপ :

এক. সৌন্দর্য প্রদর্শনের ফলে পুরুষদের চরিত্র ধ্বংস হয়। বিশেষ করে যুবসমাজ ও প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী নারীদের কারণে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয় এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল কাজ ও অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়া হয়।

দুই. পারিবারিক বন্ধন ধ্বংস হয় এবং পরিবারের সদস্যদের মাঝে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং বিবাহ বিচ্ছেদ অহরহ ঘটতে থাকে এই পর্দাহীনতার দ্বারা।

তিন. সামাজিক ব্যাধির সাথে সাথে সমাজে বিভিন্ন ধরনের মহামারি ও রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ، حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا، إِلَّا فَشَا فِيهِمُ الطَّاعُونُ، وَالْأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمُ الَّذِينَ مَضَوْا، ‘যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি’।[1]

চার. চোখের ব্যভিচার ব্যাপক হারে সংঘটিত হতে থাকবে এবং চোখের হেফাযত করা যার জন্য যাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা কঠিন হয়ে যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, فَزِنَا الْعَيْنِ النَّظَرُ، وَزِنَا اللِّسَانِ الْمَنْطِقُ، وَالنَّفْسُ تَمَنَّى وَتَشْتَهِى، وَالْفَرْجُ يُصَدِّقُ ذَلِكَ كُلَّهُ وَيُكَذِّبُهُ –‘চোখের যেনা হ’ল দেখা, জিহবার যেনা হ’ল কথা বলা, কুপ্রবৃত্তি কামনা ও খাহেশ সৃষ্টি করা এবং যৌনাঙ্গ তা সত্য অথবা মিথ্যা প্রমাণ করে’।[2]

পাঁচ. আসমানী মুছীবতসমূহ নাযিল হওয়ার উপযুক্ত হবে। এমন এমন বিপদের সম্মুখীন হ’তে হবে, যা ভূমিকম্প ও আণবিক বিস্ফোরণ হতেও মারাত্মক। আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআন করীমে এরশাদ করে বলেন,وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا-‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন আমরা সেখানকার সমৃদ্ধিশালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নির্দেশ দেই। তখন তারা সেখানে পাপাচারে মেতে ওঠে। ফলে তার উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা ওটাকে বিধ্বস্ত করে দেই’ (বনু ইস্রাইল ১৭/১৬)। রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوُا الْمُنْكَرَ لاَ يُغَيِّرُونَهُ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللَّهُ بِعِقَابِهِ. ‘মানুষ যখন অন্যায়কে দেখে এবং তা পরিবর্তন করে না, আল্লাহ রাববুল আলামীন তাদের অচিরেই তাঁর আযাব দ্বারা ঢেকে ফেলবে’।[3]

অতএব হে প্রিয় মুসলিম মা ও বোন! একটু ভাবুন! রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীর প্রতি একটু চিন্তা করে দেখুন, যেখানে তিনি বলেছেন,نَحِّ الْأَذَى عَنْ طَرِيقِ الْمُسْلِمِينَ ‘মুসলিমদের চলাচলের রাস্তা হ’তে তোমরা কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরাও’।[4]

রাস্তা হ’তে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরানো, যার প্রতি রাসূল (ছাঃ) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তা যদি ঈমানের অন্যতম শাখা হয়ে থাকে, তাহ’লে আপনাদের বুঝতে হবে, রাস্তায় কষ্টদায়ক বস্ত্ত কাঁটা, পাথর, গোবর ইত্যাদি যা মানুষকে দৈহিক কষ্ট দেয় তা মারাত্মক নাকি যা মানুষের আত্মাকে ধ্বংস করে দেয়, জ্ঞান-বুদ্ধি নষ্ট করে এবং ঈমানদারদের নৈতিক পতন নিশ্চিত করে তা বেশি মারাত্মক?

মনে রাখবেন একজন যুবকও যদি আপনার কারণে এমন ফিৎনায় পড়ে, যা তাকে আল্লাহর স্মরণ ও ভয় হ’তে দূরে রাখল বা সঠিক পথ হ’তে তাকে ফিরিয়ে রাখল, অথচ ইচ্ছা করলে আপনি তাকে নিরাপত্তা দিতে পারতেন, কিন্তু তা আপনি করলেন না, তাহলে আপনাকে অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে ভয়াবহ আযাব এবং কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হ’তে হবে।

হে মুসলিম নারী! আপনারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের ইবাদত বন্দেগী ও আনুগত্যের প্রতি অগ্রসর হউন। মানুষের গোলামী করা ও তাদের আনুগত্য হ’তে বেঁচে থাকুন। কারণ, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর হিসাব অনেক কঠিন ও ভয়াবহ। কে কী বলল, তা আপনার বিবেচ্য নয়, মানুষকে খুশী করা ও তাদের পদলেহন করতে গিয়ে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। আল্লাহ রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য কাজ করাই আপনার জন্য অধিকতর কল্যাণকর ও নিরাপদ। আর যারা এই পার্থিব জীবনে আপনার এই সৎপথে চলা বা আল্লাহভীরুতা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তাদের কঠিন পরিণতি দেখবার জন্য এইতো খানিকটা সময় ধৈর্য ধরুন। কালই হয়ত দেখবে পাবেন তাদের কুকর্মের পরিণতি। তখন বুঝবেন প্রকৃতই কে দুনিয়ার বুকে ছিলো লাভবান আর কে ক্ষতিগ্রস্ত! বস্ত্তত তারা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত! রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنِ التَمَسَ رِضَاءَ اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ كَفَاهُ اللَّهُ مُؤْنَةَ النَّاسِ، وَمَنِ التَمَسَ رِضَاءَ النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ وَكَلَهُ اللَّهُ إِلَى النَّاسِ، وَالسَّلَامُ عَلَيْكَ-‘যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ রাববুল আলামীন মানুষের থেকে তাকে ফিরিয়ে নেবে এবং আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে মানুষের নিকট সোপর্দ করবে। তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হৌক’।[5]

একজন বান্দার উপর ওয়াজিব হ’ল, একমাত্র আল্লাহকে ভয় করা এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ‘অতএব তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় কর’ (মায়েদাহ ৫/৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ‘আর তোমরা কেবল আমাকেই ভয় কর’ (বাক্বারাহ ২/৪০)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, هُوَ أَهْلُ التَّقْوَى وَأَهْلُ الْمَغْفِرَةِ ‘তিনিই একমাত্র ভয়ের যোগ্য এবং তিনিই মাত্র ক্ষমা করার মালিক’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৫৬)

মাখলুকের সন্তুষ্টি অর্জনের কোন প্রয়োজন নাই। আল্লাহ রাববুল আলামীন মানুষের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নির্দেশ দেননি এবং এটি কোন যরুরী বিষয় নয়।

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, মানুষের সন্তুষ্টি লাভ এমন একটি পরিণতি যা লাভ করা কখনোই সম্ভব নয়, সুতরাং এর জন্য তোমার কষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি এমন কর্ম অবলম্বন কর, যা তোমাকে সংশোধন করবে। আর অন্য সবকিছুকে তুমি ছাড়।

আল্লাহ রাববুল আলামীন মুত্তাকীদের জন্য নিশ্চিতভাবেই উপায় বের করে দেবেন এবং তাদের ধারণার বাহিরে রিযিক দান করবেন। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا- وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ- ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উপায় বের করে দেন। আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক দান করবেন। বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান’ (ত্বলাক্ব ৬৫/২-৩)

শারঈ পর্দা অবলম্বন বিষয়ে যে সব শর্তাবলী পালন করা যরূরী

এক: নারীদের জন্য তাদের সম্পূর্ণ শরীর ডেকে রাখা :

সাধারণ নারীদের সমস্ত শরীরই পর্দার অন্তর্ভুক্ত। তবে যদি ফিৎনার আশঙ্কা না থাকে, তখন চেহারা ও কব্জিদ্বয় পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ যদি নারী সুন্দরী না হয়ে থাকে, চেহারা ও হাতে কোন সাজ-সজ্জা গ্রহণ না করে, তখন কব্জিদ্বয় ও মুখ খুলে রাখতে পারে। কিন্তু যদি উল্লেখিত শর্তগুলো না পাওয়া যায়, তখন নারীদের জন্য তাদের চেহারা ও কব্জিদ্বয় খুলে রাখা উচিৎ নয়।

দুই: পর্দা করা যেন সৌন্দর্য প্রকাশার্থে না হয় (যেমনটা বর্তমান হচ্ছে): আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ‘আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তবে যেটুকু স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় সেটুকু ব্যতীত’ (নূর ২৪/৩১)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى ‘আর তোমরা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করবে। প্রাচীন জাহেলী যুগের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না’ (আহযাব ৩৩/৩৩)

আল্লাহ রাববুল আলামীন পর্দা করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে নারীরা তাদের সৌন্দর্যকে গোপন করে এবং তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। কিন্তু পর্দা যদি এমন সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়, যা দেখে পুরুষরা নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ফিৎনার সম্মুখীন হয়, তাহলে এ ধরনের পর্দার কোন অর্থই হ’তে পারে না। তা একপ্রকার শরী‘আত নিয়ে খেল-তামাশাই বলা চলে।

তিন. পর্দার জন্য মোটা ও ঢিলে-ঢালা কাপড় পরিধান করতে হবে যাতে করে তাদের শরীর ও সৌন্দর্য দেখা বা আন্দাজ করা না যায়: কারণ এ ধরনের কাপড় ছাড়া পর্দা বাস্তবায়ন হবে না। চিকন পাতলা- কাপড় পরিধান করলে, সৌন্দর্য পুরোপুরি গোপন করা যায় না।

এতে এ কথা স্পষ্ট হয়, নারীদের জন্য পাতলা ও মসৃণ কাপড় পরিধান করা মারাত্মক গুনাহ, যা তাদের পর্দা বা সুরক্ষা তো দূরে থাক বরং সৌন্দর্য প্রকাশে সাহায্য করে।

চার. ঢিলাঢালা কাপড় পরিধান করতে হবে, সংকীর্ণ কাপড় পরিধান করবে না। কারণ, পর্দার উদ্দেশ্য হ’ল, নিজে ফিৎনা থেকে রক্ষা পাওয়া ও অন্যকে রক্ষা করা। কিন্তু যখন কোন নারী সংকীর্ণ কাপড় পরিধান করবে, তখন তার শরীরের গঠন একজন দর্শকের নিকট স্পষ্ট হবে। পুরুষের চোখে তা একেবারেই স্পষ্ট হবে। ফলে পুরুষরা ফিৎনা-ফ্যাসাদের সম্মুখীন হবে। মনে কুপ্রবৃত্তির সৃষ্টি হবে। যা পর্দা না করার কারণে হয়ে থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,كُلُّ عَيْنٍ زَانِيَةٌ وَإِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ بِالْمَجْلِسِ، فَهِيَ كَذَا وَكَذَا يَعْنِي زَانِيَةً ‘প্রতিটি চক্ষুই ব্যভিচারী। আর যে মহিলা সুগন্ধি দিয়ে পুরুষদের সভায় যায় সে এমন এমন অর্থাৎ ব্যভিচারকারিণী’।[6]

তিনি আরো বলেন, أَيُّمَا امْرَأَةٍ اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ بِقَوْمٍ لِيَجِدُوا رِيحَهَا فَهِىَ زَانِيَةٌ- ‘যদি কোন নারী খোশবু ব্যবহার করে কোন পুরুষ সম্প্রদায়ের নিকট দিয়ে অতিক্রম করে যাতে তারা তার সুগন্ধ উপলব্ধি করতে পারে। তাহলে সে নারী ব্যভিচারী’।[7]

তবে নিজে পবিত্রতা অর্জন বা দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা নিষেধ নয় উপরন্তু তা পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা অর্জনের এই উদ্দেশ্য তার জন্য ছওয়াবের কাজ হবে। কারণ মুমীনের প্রতিটি ভালো কাজই ইবাদত ছওয়াবের কারণ। আর স্বামীকে খুশী করার জন্যে তার সামনে নিজেকে যত বেশী ইচ্ছা আকর্ষণীয় করবে, এতে কোন বাঁধা নেই। কারণ তোমার এই সৌন্দর্যের সর্বাধিক হকদার তোমার সেই কাছের মানুষটি বা প্রাণপ্রিয় স্বামী। এছাড়া অন্য কেউ নয়।

ছয়. নারীরা পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِالرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ وَلاَ مَنْ تَشَبَّهَ بِالنِّسَاءِ مِنَ الرِّجَالِ ‘যে নারী পরুষের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং যেসব পুরুষ নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[8]

আবু হুরাইরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الرَّجُلَ يَلْبَسُ لِبْسَةَ الْمَرْأَةِ وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لِبْسَةَ الرَّجُلِ. ‘রাসূল (ছাঃ) যে পুরুষ নারীদের বেশভূষা অবলম্বন করে তাদের অভিশাপ করেছেন আবার যে সব পুরুষরা নারীদের বেশভূষা অবলম্বন করে তাদের অভিশাপ করেছেন’।[9]

রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, ثَلاَثٌ لاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَنْظُرُ اللَّهُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْعَاقُّ وَالِدَيْهِ وَالْمَرْأَةُ الْمُتَرَجِّلَةُ الْمُتَشَبِّهَةُ بِالرِّجَالِ وَالدَّيُّوثُ. وَثَلاَثَةٌ لاَ يَنْظُرُ اللَّهُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْعَاقُّ وَالِدَيْهِ وَالْمُدْمِنُ الْخَمْرَ وَالْمَنَّانُ بِمَا أَعْطَى. ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ রাববুল আলামীন তাদের প্রতি কোন করুণা করবে না। এক. যে মাতা-পিতার অবাধ্য হয়, দুই-যে নারী পুরুষের আকৃতি অবলম্বন করে, তিন-দাইয়ূছ (এমন ব্যক্তি যার পরিবারের মেয়েরা অশ্লীল কাজে লিপ্ত অথচ সে তাতে বিন্দুমাত্র বাঁধা দেয় না)। আর তিন ব্যক্তির দিকে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ রাববুল আলামীন ভ্রুক্ষেপ করবেন না। এক. যে মাতা-পিতার অবাধ্য হয়, দুই-মদ্যপ, তিন. খোঁটাদানকারী দাতা’।[10]

সাত. অমুসলিমদের মত পোশাক পরিধান করা যাবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতির সাথে সাদৃশ্য রাখে, সে তাদেরই একজন বলে বিবেচিত হবে বা সে জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে’।[11]

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,رَأَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَيَّ ثَوْبَيْنِ مُعَصْفَرَيْنِ. فَقَالَ:إِنَّ هَذِهِ مِنْ ثِيَابِ الْكُفَّارِ، فَلَا تَلْبَسْهُمَا. وَفِي رِوَايَةٍ: قُلْتُ: أَغْسِلُهُمَا؟ قَالَ:بَلْ أَحْرِقْهُمَا- রাসূল (ছাঃ) একবার আমাকে হলুদ রঙের দু’টি কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখেন, তারপর তিনি বললেন, এ ধরনের কাপড় পরিধান করা কাফেরদের অভ্যাস তুমি এ ধরনের কাপড় পরিধান করো না। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আমি বললাম, আমি এ দু’টি ধুয়ে ফেলি? তিনি বললেন, বরং দু’টিকেই পুড়িয়ে ফেল’।[12]

আট. মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করার মানসিকতা থাকতে পারবে না। প্রিয় নবী করীম (ছাঃ) বলেন, مَنْ لَبِسَ ثَوْبَ شُهْرَةٍ فِى الدُّنْيَا أَلْبَسَهُ اللَّهُ ثَوْبَ مَذَلَّةٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ أَلْهَبَ فِيهِ نَارًا. ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে যশ লাভের উদ্দেশ্যে পোশাক পরে, আল্লাহ রাববুল আলামীন ক্বিয়ামতের দিন তাকে অপমান-অপদস্থের পোশাক পরিধান করাবেন, অতঃপর তাতে অগ্নিসংযোগ করবেন’।[13]

প্রসিদ্ধ পোশাক হ’ল, যে কাপড় পরিধান দ্বারা মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এটি দুই ধরনের হ’তে পারে। এক- অনেক দামী ও মূল্যবান কাপড়, যা অহংকার ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে পরিধান করে থাকে। দুই- নিম্নমানের কাপড় যা এ কারণে পরিধান করা হয়ে থাকে যাতে মানুষ তাকে ইবাদতকারী, বুযুর্গ ও আল্লাহর অলি বলে আখ্যায়িত করবে। যেমন- সে এমন এক অসাধারণ কাপড় পরিধান করল, যার রঙ, জোড়া, তালি ও অভিনব সেলাই দেখে মানুষ তার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং সে মানুষের উপর বড়াই ও অহংকার করে।

অতএব হে প্রিয় মুসলিম মা ও বোন! আপনি আপনার সৌন্দর্য প্রদর্শন থেকে সতর্ক থাকুন! সৌন্দর্য আল্লাহর বিশেষ নে‘মত, সুতরাং এ নে‘মতের অপব্যবহার করবেন না।

যখন আপনি উল্লেখিত শর্তগুলি বিষয়ে চিন্তা করবেন, তখন আপনার নিকট একটি বিষয় স্পষ্ট হবে, বর্তমানে অসংখ্য নারী এমন আছে, যারা পর্দার নামে এমন পোশাক পরিধান করে থাকে, বাস্তবে তা পর্দা নয়। তারা অন্যায় করে অথচ অন্যায়কে ন্যায় বলে চালিয়ে দেয়। ফলে তারা সৌন্দর্য প্রদর্শনকে পর্দা বলে নাম রাখে আর এই অন্যায়কে ইবাদত বলে চালিয়ে দেয়। আর প্রকৃত মুমিন নারী-পুরুষরা আল্লাহ রাববুল আলামীনের আনুগত্য ও তার হুকুমের উপর অটল ও অবিচল থাকে এবং আল্লাহ রাববুল আলামীন মুমিনদের তার অনুকরণের উপর অবিচল থাকার তাওফিক দেন। দুনিয়ার কোন মোহ তাদেরকে তাদের আদর্শ থেকে চুল পরিমাণও সরাতে পারে না (তাদের জন্যই জান্নাতের সুসংবাদ!) পর্দা করা কোন গোঁড়ামি নয়, পর্দা হল এমন একটি মধ্যমপন্থা যা দ্বারা পর্দাশীল মহিলা তার প্রভুর সন্তুষ্টি লাভে সক্ষম হয়। যারা পর্দার সাথে সাথে আধুনিকতার নামে বেপর্দার পথে হাঁটছে আর যাই হোক না কেন, তারা মুখে যাই বলুক বা দাবী করুক না কেন, বাস্তবে তারা দু’টি বিপরীত বিষয়কে একত্রে ঠিক রাখতে চায় একটি সমসাময়িক পরিবেশ আর অপরটি আল্লাহর বিধান ও ইসলামী ঐতিহ্য।

বর্তমান বাজারে পর্দার নামে এমন সব কাপড়-চোপড় পাওয়া যায়, তা নারীদের সৌন্দর্য প্রদর্শন ও আকর্ষণ তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যবসায়ীরা তাদের বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এ ধরনের পোশাক বাযারে ছাড়ে। যেমন কোন এক কবি বলেন, মনে রাখবে, তুমি যে ধরনের পর্দা ব্যবহার করছ, তাকে শারঈ পর্দা বলা হ’তে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করবে, যে পর্দা করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়। যে ব্যক্তি তোমার এ ধরনের আমলকে ধন্যবাদ দেয়, তোমাকে সত্যিকার উপদেশ না দেয়, তাদের কথা দ্বারা ধোঁকায় পড়া হ’তে তোমাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। সাবধান! তুমি ধোঁকায় পড়ে এ ধরনের কথা বলা থেকে বেঁচে থাক। বরং বলো, আমি সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী নারীদের থেকে উন্নত। কারণ, তুমি যে অবস্থার মধ্যে আছ, তা কোন আদর্শ হ’তে পারে না। আর জাহান্নামের বিভিন্ন স্তর আছে যেমনিভাবে জান্নাতের বিভিন্ন স্তর আছে। তোমার করণীয় হ’ল, তুমি সে মহিলাদের অনুকরণ করবে যারা প্রকৃত পর্দা অবলম্বন করে এবং পর্দার যাবতীয় শর্তাবলীসহ যথাযথ পর্দা পালন করে। রাসূল (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,إِذَا نَظَرَ أَحَدُكُمْ إِلَى مَنْ فُضِّلَ عَلَيْهِ فِي الْمَالِ وَالْخَلْقِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْهُ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ، قَالَ: انْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَا تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ، فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لَا تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ‘তোমাদের কেউ যখন এমন ব্যক্তির দিকে তাকায়, যাকে সম্পদে ও দৈহিক গঠনে তার থেকে বেশী শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে, তখন সে যেন এমন ব্যক্তির দিকে তাকায়, যে এ বিষয়ে তার চেয়ে নিম্নস্তরের। মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তোমরা তোমাদের চেয়ে কম সমৃদ্ধশালী লোকদের প্রতি (পার্থিব ব্যাপারে) দৃষ্টি দাও এবং তোমাদের চেয়ে অধিক ধনশালী লোকদের দিকে নয়। কেননা আল্লাহর নে‘মতকে তুচ্ছ না ভাবার এটাই উত্তম পন্থা।[14] অর্থাৎ তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নে‘মতসমূহকে ছোট মনে করবে না।

ইমাম যুহরী বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তবাব (রাঃ) এ আয়াতটি মিম্বারে তেলাওয়াত করেন, إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ- ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ। অতঃপর তার উপর অবিচল থাকে, তাদের উপর ফেরেশতামন্ডলী নাযিল হয় এবং বলে যে, তোমরা ভয় পেয়ো না ও চিন্তান্বিত হয়ো না। আর তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হয়েছিল’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০)। ‘অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা অটল ও অবিচল থাক, আল্লাহর শপথ করে বলছি আল্লাহর আনুগত্যের অবিচল থাক। শিয়ালের মত বক্রতা অবলম্বন কর’।[15]

হাসান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, إذا نظر إليك الشيطان فرآك مُداوِمًا في طاعة الله فبغاك وبغاك أي طلبك مرة بعد أخرى فرآك مُداوِمًا مَلَّكَ ورفضك وإذا كنت مرةً هكذا , ومرة هكذا طَمِعَ فيك- ‘শয়তান যখন তোমাকে আল্লাহর বিধানের আনুগত্যের উপর অটল ও অবিচল দেখবে, তখন সে তোমাকে আল্লাহর আনুগত্য হ’তে বার বার সরানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু তারপরও যখন তোমাকে অবিচল দেখতে পাবে, তখন সে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আর যখন শয়তান তোমাকে দুর্বল দেখতে পাবে এবং তোমার মধ্যে টালমাটাল অবস্থা দেখতে পাবে, তখন সে তোমার প্রতি ঝুঁকবে। তোমাকে গোমরাহ করার জন্য লালায়িত হবে’।[16]

সুতরাং আসুন! আমরা আল্লাহর ইবাদত ও তাওহীদের উপর অটল-অবিচল থাকি। আর আল্লাহর দরবারে খালেছ তওবা করি। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে যাও যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (নূর ২৪/৩১)

আপনিও হন তাদের একজন, যারা বলে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম। সত্যিকার মুসলিম ব্যক্তি যখনই আল্লাহর কোন নির্দেশ বা হুকুমের সম্মুখীন হয়, তখন সে সাথে সাথে তা বাস্তবায়ন করা বা আমল করার চেষ্টা করে। আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করা বা তদনুযায়ী আমল করতে সে সুখ লাভ করে। সে আল্লাহর আদেশের খেলাপ করা বা বিরোধিতাকে পসন্দ করে না। সে ইসলামের সম্মান, আল্লাহর দেয়া শরী‘আতের মর্যাদা এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের আনুগত্য করাকে পসন্দ করে। এর বিনিময়ে তার উপর কি বর্তাবে বা তাকে কোন অনাকাংখিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হ’তে হয় কিনা সে বিষয়ে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ বা কর্ণপাত করে না। আল্লাহ রাববুল আলামীন যারা তার আনুগত্য করা ও তার রাসূলের অনুকরণ করা হ’তে বিরত থাকে তাদের ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, وَيَقُولُونَ آمَنَّا بِاللهِ وَبِالرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّى فَرِيقٌ مِنْهُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُولَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ- وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ مُعْرِضُونَ ‘কপট বিশ্বাসীরা বলে, আমরা আল্লাহ ও রাসূলের উপর ঈমান এনেছি ও তাদের আনুগত্য করি। অতঃপর তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওরা প্রকৃত অর্থে মুমিন নয়’ (নূর ২৪/৪৭-৪৮)। একটু পরে গিয়ে আল্লাহ রাববুল আলামীন আরও বলেন, إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ- ‘অথচ মুমিনদের কথা তো কেবল এটাই হ’তে পারে যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তার রাসূলের দিকে ডাকা হয় তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেওয়ার জন্য, তখন তারা বলবে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর এরাই হ’ল সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে বেঁচে থাকে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১-৫২)

ছাফিয়া বিনতে শাইবাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন আমরা আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন আমরা কুরাইশী নারীদের আলোচনা ও তাদের গুণাগুণ বর্ণনা করছিলাম। তখন আয়েশা (রাঃ) আমাদের বললেন, অবশ্যই কুরাইশ বংশের নারীদের মর্যাদা আছে, যা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তবে আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আনসছারী নারীদের মত এত বেশী আল্লাহর কিতাবের উপর বিশ্বাসী ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারী আর কোন নারীকে আমি কখনো দেখিনি। আল্লাহ রাববুল আলামীন যখন সূরা নূর নাযিল করল, তখন তাদের পুরুষরা তাদের নিকট ফিরে গিয়ে তাদের প্রতি যে কুরআন নাযিল করা হল, তা তিলাওয়াত করল। পুরুষ তার স্ত্রীকে, তার মেয়েকে, বোনকে এবং প্রতিটি নিকটাত্মীয়কে শোনাল। তেলাওয়াত শোনামাত্রই সাথে সাথে আনছারী নারীরা তাদের নকশী করা কাপড় নিয়ে তাদের দেহকে ডেকে ফেলল। তারা আল্লাহ রাববুল আলামীনর কথার উপর বিশ্বাস করতে এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনতে কোন প্রকার বিলম্ব করল না। তাদের অবস্থা এমন হল, তারা সবাই রাসূল (ছাঃ)-এর পিছনে তাদের মাথা ও চেহারা ডেকে রাখল, যেন তাদের মাথার উপর কাক’।[17]

মোট কথা, আল্লাহর আদেশের সামনে কোন প্রকার গড়িমসি করা ও মতামত ব্যক্ত করার কোন অধিকার নেই। আল্লাহর নির্দেশ আসার সাথে সাথে বলতে হবে আমরা শুনলাম এবং মানলাম। এটিই হল, প্রকৃত ও সত্যিকার ঈমান। হে পর্দাহীন মুসলিম রমণীরা! যদি আপনারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহকে রব হিসাবে স্বীকার করেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে রাসূল হিসাবে মেনে নেন, আর রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রী, মেয়ে এবং ঈমানদার নারীদের আদর্শ হিসাবে মানেন, তাহ’লে আল্লাহর দরবারে তওবা করে নিজের অপকর্ম ও পাপাচারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।

হে আল্লাহর বান্দী! আপনারা এ ধরনের কথা বলা হ’তে বিরত থাকুন যে, আমরা অচিরেই তওবা করব, অচিরেই ছালাত আদায় করব, অচিরেই পর্দা করব ইত্যাদি। কারণ, তওবাকে বিলম্ব করা অপরাধ। তার চেয়ে বরং বলুন, যেমনটা মুসা (আঃ) বলেছেন, وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَى ‘আর আমি দ্রুত আপনার নিকটে চলে এলাম হে আমার প্রতিপালক! যাতে আপনি খুশী হন’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৪)।

অতএব তোমরা এমন কথা বল, যে কথা তোমাদের পূর্বে মুমিন নর-নারীরা বলছিল, وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ ‘আর তারা বলে যে, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম, আমরা আপনার ক্ষমা চাই হে আমাদের প্রতিপালক! আর আপনার নিকটেই আমাদের চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন’ (বাক্বারাহ ২/২৮৫)। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পর্দা করা ও আল্লাহর আনুগত্য করার তাওফীক দান করুন-আমীন!

[লেখক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী ]


[1]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪০০৯।

[2]. বুখারী হা/৬২৪৩; মিশকাত হা/৮৬।

[3]. ইবনু মাজাহ হা/৪০০৫; মিশকাত হা/৫১৪২।

[4]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৩৭৩; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৬৩৪৪।

[5]. তিরমিযী হা/২৪১৪; মিশকাত হা/৫১৩০।

[6]. তিরমিযী হা/২৭৮৬; আবু দাউদ হ/৪১৭৩; মিশকাত হা/১০৬৫।

[7]. আহমাদ হা/২০২৪২; নাসাঈ হা/৫১২৬।

[8]. আহমাদ হা/৬৮৭৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৪৩৩।

[9]. আবু দাউদ হা/৪০৯৮; মিশকাত হা/৪৪৬৯।

[10]. আহমাদ হা/৬১৮০; নাসাঈ হা/২৫৬২।

[11]. আবু দাউদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭।

[12]. মুসলিম হা/২০৭৭; মিশকাত হা/৪৩২৭।

[13]. ইবনু মাজাহ হা/৩৬০৭; মিশকাত হা/৪৩৪৬।

[14]. আহমাদ হা/২৭৩৬৪; বুখারী হা/৬৪৯০; মুসলিম হা/২৯৬৩; মিশকাত হা/৫২৪২।

[15]. তাফসীরে ইবনু কাছীর ৭/১৭৬ পৃঃ।

[16]. আল-ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক ১৪৫ পৃঃ।

[17]. তাফসীরে ইবনু কাছীর ৬/৪৬ পৃঃ।



আরও