জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ

ফিরোজ মাহবুব কামাল 1472 বার পঠিত

কেন এত মিথ্যাচার?

আল্লাহর আর কোন হুকুম বা বিধানের বিরুদ্ধে এত মিথ্যাচার,এত কুৎসা ও এত হামলা হয়নি, যতটা হয়েছে জিহাদের বিরুদ্ধে। আস্তিক-নাস্তিক, সেক্যুলারিস্ট-সোসালিস্ট, জাতীয়তাবাদী-স্বৈরাচারী- ইসলামের সকল বিপক্ষ শক্তি এ হামলায় একতাবদ্ধ। সে মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই বৃটিশ সরকার কোলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা খুলেছিল। ধর্মশিক্ষার নামে তখন ষড়যন্ত্র হয়েছিল ইসলামের মূল শিক্ষা লুকানোর। ফলে সে মাদরাসা থেকে হাজার হাজার আলেম বের হলেও তাদের দ্বারা ইসলামের প্রকৃত খেদমত পাওয়া যায়নি। বরং বিভ্রান্তি বেড়েছে জিহাদ নিয়ে। নবী (ছাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ যেভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিজয় এনেছিলেন তা থেকে এ সকল আলেম অনেক দূরে। জিহাদের বিরুদ্ধে আজ লেখা হচ্ছে বই, দেশী-বিদেশী অর্থে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান।

ধর্মের তাবলীগ বা প্রচার হলেই তা প্রতিষ্ঠা পায় না। বিশ্বজোড়া বিজয়ও আসে না। সে জন্য লাগাতার সংগ্রাম চাই। অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠার সে লড়াই বা প্রচেষ্টাকেই বলা হয় জিহাদ। হতে পারে সে জিহাদ কথার মাধ্যমে, কলমের মাধ্যমে, সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে কিংবা চূড়ান্ত পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। মুসলমানের প্রতিটি কর্ম যেমন ইবাদত, তেমনি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি সংগ্রামই জিহাদ। আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে এটিই মূল হাতিয়ার। জিহাদের মধ্য দিয়েই মুসলিম সমাজে পরাজয় ঘটে শয়তানী শক্তির এবং সে সাথে বিলুপ্ত হয় মানুষকে পথভ্রষ্ট করার সকল শয়তানী প্রজেক্ট। জিহাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও মিথ্যাচারের মূল হেতু এখানেই। কারণ এসব পথভ্রষ্টরা নিজ জীবনে অহি-র বিধানকে মানতে রাজী নয়, রাজী নয় রাষ্ট্রে বা সমাজে তার প্রতিষ্ঠাতেও। ফলে তাদের শত্রুতা শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, গভীর শত্রুতা ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মূল হাতিয়ারটির বিরুদ্ধেও। সে লক্ষ্যেই তারা জিহাদকে মুসলমানদের থেকে কেড়ে নিতে চায় এবং বিলুপ্ত করতে চায় জিহাদের ধারণাকে। সে লক্ষ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল পাশ্চাত্য দেশের সরকার মুসলিম দেশে মসজিদের খুৎবা, পত্র-পত্রিকা ও স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচীর উপর লাগাতার নজরদারী রাখছে- যাতে মুসলমানদের মাঝে জিহাদী চেতনা গড়ে না উঠে। প্রতিটি দেশে তাদের সাথে জোট বেধেছে মুসলিম নামধারী দল ও গোষ্ঠীও।

এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের বিরুদ্ধে জোরে শোরে কথা বলতো কাদিয়ানী ভ্রষ্টতার জনক বৃটিশ মদদপুষ্ট গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী। অনেকেরই ধারণা, কাদিয়ানী ফেরকার জন্মই হয়েছিল জিহাদকে অধর্ম ঘোষণা দিতে। কারণ জিহাদী চেতনার কারণে ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসন কখনই উপমহাদেশের মুসলমানদের কাছে মনেপ্রাণে গ্রহীত হয়নি। বরং সে শাসনের বিরুদ্ধেই ছিল তাদের অবস্থান। তবে এখন শুধু কাদিয়ানীরাই জিহাদের বিরুদ্ধে নয়, বহু আলেম এবং মুসলিম নামধারী বহু নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীরাও ময়দানে নেমেছে। তাদের সে মিথ্যা প্রচারণা যে বিপুল সফলতাও এনেছে, তা বলাই বাহুল্য। তাদের লাগাতার প্রচারণার ফলেই কোনমতে ছালাত-ছিয়াম, হজ-যাকাত বেঁচে থাকলেও জিহাদ বেঁঁচে নেই। আর জিহাদ না বাঁচলে কি বিশুদ্ধ ইসলাম বাঁচে? বাড়ে কি ইসলামের গৌরব? আজ মুসলিম দেশগুলোতে যে ইসলাম বেঁচে আছে সেটি কি রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া সেই ইসলাম? রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া সেই বিশুদ্ধ আক্বীদা-আমলের সন্ধান আজ মুসলিম সমাজে নেই, নেই সেই বিশ্ব মানবাধিকারের চিরন্তন সনদ শরঈ আইন-কানূন। নেই সে ইসলাম, যে ইসলামে লাগাতার জিহাদ ছিল এবং হাযার হাযার সাহাবীর জানমালের কোরবানীও ছিল। সে কোরবানীর বরকতে মুসলমানদের সেদিন বিশ্বজোড়া ইয্যত ছিল। সমাজে ছিল সুবিচার এবং শান্তি। তখন রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) এবং রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাতের পর তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহাবীগণ। মুসলিম রাষ্ট্রের আদালতে আললাহর আইন অনুসারে বিচার হবে না-সেটি সেদিন অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু আজ সে ইসলাম নেই। সে ইসলামী সমাজ ও শরঈ বিধি-বিধানও নেই। ইসলামী রাষ্ট্র বিলুপ্ত হওয়ার পর লুপ্ত হয়েছে মুসলমানদের ইয্যত, জেঁঁকে বসেছে পরাজয় ও অপমান। ইসলামী রাষ্ট্রের স্থান দখলে নিয়েছে জাতীয় রাষ্ট্র বা নেশন স্টেট। শাসকের যে আসনে রাসূল (ছাঃ) বসতেন, সে আসনে আজ  বসেছে অতি দুর্বৃত্ত অপরাধীরা। তাদের অঙ্গীকার আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রতি নয়, বরং শয়তানকে খুশী করা। জিহাদের স্থলে স্থান পেয়েছে ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, গোত্রীয় বা জাতীয় স্বার্থের লড়াই। জিহাদ বিলুপ্ত হলে ইসলামী রাষ্ট্র ও তাঁর শরিয়তী বিধানের বেঁঁচে থাকাও যে অসম্ভব, আজকের মুসলিম ইতিহাসে সেটিই এক প্রতিষ্ঠিত সত্য।

জিহাদ ছাড়া কি ইসলাম-পালন সম্ভব?

কোন ধর্ম এবং সে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র শূন্যে প্রতিষ্ঠা পায়না। সেখানে পূর্ব থেকেই একটি ধর্ম বা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত থাকে। ইসলামের প্রতিষ্ঠা ঘটে সে ধর্ম বা মতবাদের অনুসারীদের পরাস্ত করার মধ্য দিয়ে। কোন একটি গাছ লাগাতে হলেও কিছু মাটি এবং তার আশেপাশের আগাছা ছাফ করে স্থান করে দিতে হয়। তবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা আর গাছ লাগানো এক জিনিষ নয়। আগাছা প্রতিবাদ করে না, কিন্তু মানুষ লড়াই শুরু করে। তাই যে কোন সমাজ বা রাষ্ট্রে অন্য একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে সরানোর কাজ শুরু হলেই সাথে সাথে জিহাদও শুরু হয়। ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় একমাত্র বিপক্ষ শক্তির পরাজয় ঘটার মধ্য দিয়েই। রাসূল (ছাঃ)-এর ন্যায় নরম হৃদয়ের মানুষের পক্ষেও সেটি এড়ানো সম্ভব হয়নি। কোন যুগেও সেটি সম্ভব নয়। ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে সংঘাত অনিবার্য। সে সংঘাত শুধু অর্থ, শ্রম ও মেধা চায় না, রক্তও চায়। আরো কোন ইবাদতই এত বড় কোরবানী চায় না। জিহাদ এজন্যই শ্রেষ্ঠ ইবাদত। সারা জীবন ছালাত-ছিয়াম পালনের মধ্যদিয়েও কোন মু’মিন বিনা বিচারে জান্নাত পায় না, কিন্তু সেটি জিহাদে প্রাণদানকারী শহীদ পায়। মৃত্যুর পরও সে আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক পায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে সে প্রতিশ্রুতি বহুবার এসেছে। অথচ ইসলামের বিপক্ষ শক্তি ইসলামের এ শ্রেষ্ঠ ইবাদতটি চিহ্নিত করছে সন্ত্রাস বা জঙ্গী মতবাদ রূপে। তাদের সে লাগাতার মিথ্যাচারের কারণেই বর্তমান মুসলিম সমাজ চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে জিহাদের সঠিক ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠতে। অথচ জিহাদের দর্শন বুঝতে ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়ে কোরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্যটি অনুধাবন করা। তখন অসম্ভব হয় এ বিশ্বজগত এবং মানবসৃষ্টি নিয়ে মহান আল্লাহর মূল ভিশনটি উপলব্ধি করা। অসম্ভব হয় নবীজীবনের মূল শিক্ষা থেকে সবক নেয়া। বস্তুত ইসলামের মূল শিক্ষাই তার কাছে অজানা থেকে যায়। তখন পদে পদে যেটি প্রকটরূপে দেখা দেয় সেটি হ’ল পথভ্রষ্টতা। আজকের মুসলিম সমাজে তো মূলত সেটিই ঘটছে। ফলে জিহাদ ছেড়ে ‘যিকরে খফী’, ‘যিকরে জলী’ আর নানা অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে তারা প্রবল সুখে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। শিরক-বিদ‘আতী নানা রসম রেওয়াজের স্রোতে প্রকৃত মুসলিম খুঁজে পাওয়াই যে এখন চরম দায়। এ সবই জিহাদী জাযবা বর্জিত হওয়া এবং জিহাদের মূল দর্শন না বোঝার অনিবার্য ফলশ্রুতি।

প্রশ্ন হ’ল- মানবসৃষ্টি, রাসূল প্রেরণ এবং কোরআন নাযিলের মাঝে মহান আল্লাহর মূল অভিপ্রায়টি কি? মহান আল্লাহ তা‘আলার লক্ষ্য কি সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর দখলদারী তার অবাধ্যদের হাতে ছেড়ে দেয়া এবং তাঁর অনুসারীদের কাছে পরাজয় মেনে নেয়া? পবিত্র কোরআনের শিক্ষাকে কি শুধু কিতাবে ও মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে সীমিত রাখা? এটি তো তাঁর দ্বীনের জন্য পরাজয়ের পথ! মহান আল্লাহতায়ালার অভিপ্রায়টি কি সেটি তিনি অস্পষ্ট রাখেননি। পবিত্র কুরআনের নানা স্থানে সেটি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন সূরা হাদীদে তিনি বলেছেন, ‘আমি রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে রয়েছে প্রচন্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ উপকার। এটি এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে (আল্লাহকে) না দেখে তাঁকে ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর ও পরাক্রমশালী (হাদীদ ২৫)। উপরোক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ পাকের যে উদ্দেশ্যটি প্রবলভাবে ব্যক্ত হয়েছে তা হল, সমাজে ন্যায়নীতি ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠা। সে ন্যায়নীতির উৎস কোন রাজনৈতিক নেতা বা দার্শনিকের বাণী নয়, কোন বিচারকের খেয়ালখুশি ভিত্তিক রায়ও নয় এবং কোন সংসদের তৈরী আইনও নয়। বরং সেটি তাঁর নাযিলকৃত মহাজ্ঞানময় কোরআন। তবে সে কুরআনী ন্যায়নীতি ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠা শুধু রাসূল প্রেরণ ও কোরআন প্রেরণের কারণে ঘটে না। সেজন্য অপরিহার্য হলো শক্তির প্রয়োগও। সে বাস্তবতার নিরিখে তিনি শুধু কিতাবই নাযিল করেননি, লৌহও প্রেরণ করেছেন। লৌহ থেকে নির্মিত হতে পারে ঢাল-তলোয়ার, বর্শা এবং কামান যা ব্যবহৃত হতে পারে শত্রুদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে। ইসলাম ও অনৈসলামের সে দ্বন্দ্বে মহান আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের জন্য নীরব বা সরব দর্শক হওয়ার কোন সুযোগ রাখেননি। স্রেফ ছালাত-ছিয়াম ও হজ-যাকাতের আড়ালে ধার্মিক সাজার পথও খোলা রাখেননি। বরং তিনি সর্বদা এ নজরও রাখছেন কারা ইসলামের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবেলায় তাঁকে ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। তাই তাঁর দ্বীনের প্রকৃত ঈমানদারের জন্য জিহাদ থেকে পিছু হটার কোন রাস্তা নেই। জান্নাতে যেতে হলে একমাত্র এ রাস্তা দিয়েই তাকে এগুতে হবে। স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর মহান সাহাবীগণ একমাত্র এ পথ দিয়েই এগিয়েছিলেন। তাদের সামনেও এছাড়া অন্য কোন রাস্তাই খোলা ছিল না। প্রশ্ন হলো, ইসলামের এ প্রাথমিক জ্ঞানটুকু ছাড়া রাসূল (ছাঃ) বার বার জিহাদে যাওয়া এবং সে জিহাদে নিজে আহত হওয়া, শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবীর শহীদ হওয়ার মত মুসলিম ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা নেয়া কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব কি কোরআন নাযিলের উদ্দেশ্য বুঝা? মুসলমানগণ যে সে শিক্ষালাভে আজ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা কি তাদের আজকের পরাজিত অবস্থাই প্রমাণ করে না? তবে প্রকৃত অবস্থা আরো গুরুতর! আঁধারের চামচিকা যেমন আলোকে ঘৃণা করে, তেমনি মুসলিম নামধারী পথভ্রষ্টরা ঘৃণা করে অহি-র আলোময় জ্ঞানকে। চরম ঘৃণা করে সে অহি-র বিধানের অনুসারীদেরকেও। ফলে অহি-র সে আলোকে রুখতে তারা প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কাফের শক্তির সাথে কোয়ালিশন গড়েছে। যুদ্ধ শুরু করেছে কুরআনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

সেকালের এবং একালের ইসলাম :

ইসলামের দুটি রূপ। একটি একালের এবং অপরটি সেকালের-তথা শুরুর সময়ের। একটি উপর্যুপরি বিজয় ও গৌরবের, অপরটি লাগাতার পরাজয় ও অপমানের।  আজকের মুসলমানদের মাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা বিষয়ে প্রচন্ড বিতন্ডা থাকলেও অন্ততঃ একটি বিষয়ে বিতর্ক নেই। তা হলো নিজেদের আজকের পরাজিত, অপমানিত ও শক্তিহীন অবস্থা নিয়ে। সংখ্যায় প্রায় ১৫০ কোটি হলে কি হবে, বিশ্ব-রাজনীতিতে তাদের মতামতের কোন গুরুত্বই নেই। আমলে নেয়া দূরে থাকে, তাদের মতামত কেউ জানতেও চায় না। যে ক্ষমতা ও ইজ্জত নিয়ে ছয় কোটি বৃটিশ বা সাড়ে ছয় কোটি ফরাসী জাতিসংঘে বা বিশ্বের কোন মঞ্চে কথা বলে, সে ক্ষমতা ও ইজ্জত ১৫০ কোটি মুসলমানের নেই। মুসলিম দেশের সংখ্যা ৫৫টিরও বেশী, কিন্তু এর মধ্যে অধিকাংশ দেশই শত্রু শক্তি দ্বারা অধিকৃত। সেটি যেমন সামরিকভাবে, তেমনি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে। ইরাক, আফগানিস্তান,   ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, বসনিয়া, চেচনিয়ার ন্যায় বহু মুসলিম ভূমি পরিণত হয়েছে বদ্ধভূমিতে। সভ্যতার বিনির্মাণে যখন মুসলমানদের যাত্রা শুরু হয়, তখন সংখ্যায় তারা বিশাল ছিল না। তাদের হাতে এত সম্পদও ছিল না। কিন্তু তখন উপর্যুপরি বিজয় এসেছিল। আর আজ সংখ্যা বেড়েছে, সম্পদও বেড়েছে। কিন্তু তাতে বিজয় না বেড়ে মুসলিম ভূমি অধিকৃত হচ্ছে। তখন কুরআনের শরঈ আইন প্রতিটি মুসলিম জনপদে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এবং প্রশংসিত হয়েছিল সবচেয়ে সভ্য ও মানবিক আইন রূপে। সে শারঈ আইন এশিয়া ও আফ্রিকার বাইরেও মুসলিম শাসিত ইউরোপের স্পেন, গ্রীস, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া, সাইপ্রাস, ক্রিমিয়ার ন্যায় বহু দেশে বহু শত বছর যাবত চালু ছিল। আর আজ সে শরঈ আইন মুসলমানদের নিজ দেশেই আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়েছে।

এ পরাজয়টি নিছক মুসলমানদের নয়, বরং মহান আল্লাহর দ্বীনের। এখানে পালিত হয়নি মুসলমানদের মূল দায়ভার। আল্লাহর সাথে মুসলমানদের এটিই সবচেয়ে বড় গাদ্দারী তথা বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহর দ্বীনের পরাজয় নিশ্চিত করা ছাড়া আর কোন কল্যাণই তারা করেনি। তারা রাষ্ট্র গড়েছে, রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনী গড়েছে এবং বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিশাল বিশাল অস্ত্রভান্ডারও গড়েছে। কিন্তু সেগুলি আললাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নয়, সেগুলির লক্ষ্য বরং নিজ দেশ, নিজ দল বা নিজ গোত্রকে বিজয়ী করা। এসব দেশের ভিত্তি ইসলাম বা ইসলামী ভাতৃত্বও নয়। বরং রাষ্ট্র গড়েছে পৃথক পৃথক ভাষা, ভূগোল ও গোত্রের নামে এবং এগুলোর নামে তারা আন্দোলন করে, যুদ্ধ করে এবং রক্তও দেয়। বিগত বহু শতাব্দী জুড়ে বহু লক্ষ মুসলমানদের রক্ত ঝরেছে মূলত এসব ন্যাশন বা ট্রাইবাল স্টেটের নামে। অথচ মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার দায়বদ্ধতা কাঁধে নেয়া। এ কাজে সে অর্থ দিবে, শ্রম দিবে, মেধা দিবে এবং প্রয়োজনে প্রাণও দিবে-এটাই হলো মুসলমান হওয়ার সে মূল দায়বদ্ধতা। তাদের সে কোরবানীর প্রতিদানরূপে মহান আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দিবেন। মহান আল্লাহর সাথে ঈমানদারের এটিই পবিত্র চুক্তি। পবিত্র কুরআনে সে চুক্তির কথাটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে এভাবে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, এর বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা (আল্লাহর সাথে কৃত এ চুক্তি অনুসারে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং (আল্লাহর দ্বীনের শত্রুকে) নিধন করে এবং নিজে নিহত হয় (তাওবা ১১১)। প্রশ্ন হলো-যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে সে কি মহান আল্লাহর সাথে সম্পাদিত এ চুক্তির সাথে গাদ্দারী করতে পারে? সেটি করলে সে কি মুসলমান থাকে? মুসলমান হওয়ার অর্থই তো হলো আল্লাহর প্রতিটি হুকুমের প্রতি অনুগত হওয়া। অপরদিকে কুফরী হলো সে হুকুমের বিরুদ্ধে যে কোন অবাধ্যতা বা বিদ্রোহ।

সেকালে মুসলমানদের কাছে যে পবিত্র কুরআন ছিল, আজও তাদের কাছে একই কুরআন রয়েছে অবিকল ও অবিকৃত অবস্থায়। রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর মহান ছাহাবীগণ যেভাবে ইসলাম পালন করতেন এবং কাফের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যেভাবে তাঁরা ইসলামের বিজয় এনেছেন সে ইতিহাসও আজ অজানা নয়। রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতসমূহ অতিশয় খুঁটিনাটিসহ বিদ্যমান রয়েছে পবিত্র হাদীছ গ্রন্থগুলিতে। ছাহাবীদের ইসলাম পালন ও জান-মালের কোরবানীর বিবরণ রয়েছে তাদের জীবনচরিতে। সেই একই কুরআন ও একই নবীর (ছাঃ)-এর অনুসারী বলে দাবী করে আজকের মুসলমানগণ। দাবী করে ছাহাবায়ে কেরামের অনুসারীরূপেও। কিন্তু তাদের অর্জিত বিজয় ও গৌরব আজ জুটছে না, বরং জুটছে পরাজয় ও অপমান? কিন্তু এ নিয়ে ভাবনা আজকের মুসলমানদের ক’জনের? একই পথে শত শত বছর চলার পরও যখন সফলতা জুটছে না তখন কি চলার পথটি নিয়ে সন্দেহ জাগে না? ধর্মপালনের নির্ভুলতা নিয়েও কি প্রশ্ন জাগে না? আজকের ধর্মপালন এবং সেকালের ধর্মপালন একই রূপ হলে ফলাফলটিও কি একই রূপ হওয়া উচিত ছিল না? ধর্মপালনে ভুল হলে আখেরাতেও কি তা উপকারে আসবে? সেটিও কি গুরুতর ভাবনার বিষয় নয়? কিন্তু আজকের মুসলমানদের জীবনে সে ভাবনা কই? আজকের মুসলমানদের জীবনে কালেমা পাঠ ও তসবীহ-তাহলীলও আছে। ছালাত-ছিয়াম এবং হজ-যাকাতও আছে। প্যারিস বা লন্ডনের মত কাফের অধ্যুষিত শহরে আজ যত ছালাত ও ছিয়াম আদায়কারী আছে, রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের সময় ততজন ছালাত ও ছিয়াম পালনকারী সমগ্র মুসলিম ভূমিতে ছিল না। কিন্তু তাতে কি কোন গৌরব বাড়ছে? মুসলমানের অর্থ শুধু কালেমা পাঠ বা ছালাত-ছিয়াম, হজ-যাকাত আদায় নয়। ইসলাম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া একটি পরিপূর্ণ প্যাকেজ। ইসলামকে গ্রহণ করতে হলে তার পুরা প্যাকেজটি গ্রহণ করতে হবে। প্রেসক্রিপশনের সবগুলো ঔষধ সেবন না করলে অসুখ সারে? তেমনি আল্লাহর দেয়া প্রেসক্রিপশনের ব্যাপারেও। মুসলমানের অর্থ পরিপূর্ণ মুসলমান। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে কোনরূপ অসম্পূর্ণতা চলে না, বিশ্বাসের অর্থ পরিপূর্ণ বিশ্বাস। ইসলামের হুকুমগুলি তাই ইচ্ছামত গ্রহণ বা বর্জনের নয়। কুরআনে বলা হয়েছে ‘উদখুলূ ফিস সিলমে কা-ফফা’ অর্থাৎ ‘প্রবেশ করো ইসলামে পুরাপুরিভাবে’। তাই ইসলাম কবুলের অর্থ শুধু স্রেফ ছালাত-ছিয়াম, হজ-যাকাত আদায় নয়। ইসলাম শুধু ছালাত-ছিয়াম, হজ-যাকাত নিয়ে আসেনি, এসেছে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিধিবিধান নিয়েও। সে বিধানে শান্তির কথা যেমন আছে, তেমনি শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদের কথাও আছে। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের ইসলাম পালনে এসব কিছুই ছিল। কিন্তু আজকের মুসলমানদের ক্ষেত্রে এখানেই ঘটেছে বিশাল বিচ্যুতি ও বিভ্রাট। সীমাহীন ব্যর্থতা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে জানমালের কুরবানী পেশে। রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবীগণের ধর্মপালনে ছালাত-ছিয়াম, হজ-যাকাতের সাথে লাগাতার জিহাদও ছিল। সে জিহাদই ঈমানদারদের লাগাতার বিজয় এনেছিল। মদীনার সামান্য একটি পল্লী থেকে যতজন ঈমানদার আল্লাহর রাস্তায় প্রাণ দিয়েছেন, প্রাণের সে কুরবানী ১৬ কোটি মুসলমানের বাংলাদেশ দেয়নি। ফলে সেদিন কাফের অধ্যুষিত আরবে ইসলামের সামগ্রিক বিজয় আসলেও মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে সে বিজয় আসেনি। দেশটিতে আল্লাহর আইন তথা শরী‘আতের বিজয়ও আসেনি। কারণ জিহাদের লক্ষ্য শুধু মুসলিম ভূখন্ডের প্রতিরক্ষা দেয়া নয়, পৃথিবী জুড়ে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় সাধনও। ইসলাম শুধু তাবলীগ বা প্রচারের জন্য আসেনি, বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠার জন্যও এসেছে। যা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে- ليظهره علي الدين كله অর্থাৎ সকল ধর্ম বা দ্বীনের উপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী রূপে দেখা এবং সে বিজয়টি অর্জিত হতে হবে মানুষের দ্বারা, ফেরেশতাদের দ্বারা নয়। ঈমানদারের দায়িত্ব হল, মহান আল্লাহর সে ভিশনের সাথে একাত্ম হওয়া, আল্লাহ তা‘আলার সে লক্ষ্যপূরণকে নিজ জীবনের মিশন বানিয়ে নেয়া।

পরীক্ষা এবং মর্যাদা রয়েছে জিহাদেই :

মু’মিনের জীবনে সর্বোচ্চ পরীক্ষাটি হয় জিহাদে। জান ও মালের এমন পরীক্ষা আর কোনভাবেই হয়না। কালেমা পাঠে শ্রম ব্যয়, অর্থব্যয় ও প্রাণের ক্ষতি হয় না। ফলে ঈমানের দাবীতে কে সাচ্চা আর কে ভন্ড-সে পরীক্ষা কালেমা পাঠে হয় না। তেমনি অর্থ ও প্রাণের ক্ষতি ছালাত-ছিয়াম পালনেও হয় না। কিন্তু আরাম-আয়েশের সাথে প্রাণে বাঁচাটি বিপদে পড়ে জিহাদে নামলে। সাথে তো রয়েছে অর্থ-সম্পদের ক্ষতিও। তাই মহান আল্লাহর কাছে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ পরীক্ষা। এ জগতে কোন প্রমোশন বা পদোন্নতিই পরীক্ষা ছাড়া হয়নি। প্রমোশন বা মর্যাদা তো বাড়ে পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পর। যার জীবনে পরীক্ষা নেই, তার জীবনে প্রমোশন বা মর্যাদাও নেই। আর জিহাদ তো ঈমানদারের জীবনে সে পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়। সে পরীক্ষার কথাটি পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে এভাবে- ‘মানুষ কি মনে করে যে তারা এ কথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, ‘আমরা বিশ্বাস করি’ এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নিবেন মিথ্যুকদেরকে (আনকাবুত ২-৩)। ফলে যখন কোন দেশে মানুষের মাঝে বিজয় ও ইজ্জত লাভের আগ্রহ বাড়ে তখন সে জিহাদের পরীক্ষাও ঘন ঘন আসে। রাসূল (ছাঃ)-এর তো সেটিই হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছে করলে যে কোন দেশে যে কোন বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করতে পারেন। সে বিজয় ঠেকাতে কেউ কি মহাশক্তিমান আল্লাহর বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? তাঁর নির্দেশে মুহূর্তের মধ্যে যেমন প্রলয়ংকরী সুনামি আসতে পারে, তেমনি তাঁর দ্বীনের বিজয়ও আসতে পারে। কিন্তু সেটি হলে ঈমানদারদের পরীক্ষা হয় না, তাদের প্রমোশন লাভের সুযোগও জুটে না। ফলে সেটি মহান আল্লাহর হিকমতও নয়। বরং যুগে যুগে যে হিকমতটির প্রয়োগ ঘটেছে তা হল, জিহাদের মধ্য দিয়ে মু’মিনদের পরীক্ষা করা এবং সে পরীক্ষায় কৃতকার্যদের পুরস্কৃত করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সে হিকমাত বা পরিকল্পনার কথাটি ঘোষণা করেছেন এভাবে-‘তোমরা (শত্রুর বিরুদ্ধে) জিহাদ চালাবে যতক্ষণ না যুদ্ধ তার অস্ত্র নামিয়ে ফেলে। এটিই বিধান। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি চান, তোমাদের একজনকে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে। যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তিনি কখনও তাদের কর্ম বিনষ্ট হতে দেন না (মুহাম্মদ ৪)

মুনাফিকদের থেকে ঈমানদারদের পৃথক করতে জিহাদ ছাঁকুনির কাজ করে। আগুনের তাপে আবর্জনা যেমন খাদ রূপে পানির উপরে ভেসে উঠে, জিহাদও তেমনি ভাসিয়ে তোলে মুনাফিকদের। রাববুল আলামীন থেকে মুনাফেকী লুকানোর রাস্তা নেই। ব্যক্তির মনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবই তিনি জানেন। তাই ব্যক্তির ঈমানের অবস্থা জানার জন্য তার ইবাদত দেখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মহান আল্লাহ চান, মৃত্যুর আগেই ব্যক্তি তার নিজের ঈমানের আসল  অবস্থাটি জেনে যাক। ঈমানের প্রকৃত অবস্থাটি প্রকটভাবে তুলে ধরে মূলতঃ জিহাদ, সেটি জিহাদে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তির নিজের সামনে যেমন, তেমনি অন্যদের সামনেও। মুসলমানেরাও একমাত্র জিহাদের ময়দানেই সঠিকভাবে জানতে পারে কে তাদের নিজেদের লোক, আর কে নয়। জানমালের কোরবানীর সে পরীক্ষাটি মসজিদের জায়নামাযে হয় না, ছিয়াম বা হজ্জের জমায়েতেও হয় না। তাই যে সমাজে জিহাদ নেই সে সমাজে ঈমানের দাবী নিয়ে ভন্ডরাও মুসলমানদের সাথে লুকিয়ে থাকে। উঁই পোকা ভিতর থেকে যেমন খেয়ে ফেলে, এরাও তেমনি মুসলিম উম্মাহকে ভিতরে থেকে ধ্বসিয়ে দেয়। মহান আল্লাহর বিধান হল, প্রকৃত ঈমানদার থেকে ভন্ডদের পৃথক করা। তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্যশীল?’ (আলে ইমরান ১৪২)। তিনি আরো বলছেন, ‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছ যে তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এমনি, যতক্ষণ না আল্লাহ জেনে নিবেন তোমাদের মধ্যে কে (আল্লাহর রাস্তায়) যুদ্ধ করেছে এবং কে আল্লাহ ও মুসলমানদের ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা থেকে বিরত রয়েছে। আর তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত (তাওবাহ ১৬)। অন্যত্র বলা হয়েছে ‘তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছ যে, তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ সে অবস্থার মুখোমুখি তোমরা এখনও হওনি যা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রে হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও ভয়ানক কষ্ট। তারা এমনিভাবে শিহরিত হয়েছে যে যাতে নবী এবং তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা একথা পর্যন্ত বলেছে যে কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য? তোমরা শুনে নাও আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটবর্তী (বাকারা ২১৪)। মুসলমান হওয়ার অর্থ-এ পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় সজ্ঞানে প্রবেশ করা এবং নিজের ঈমানদারীর প্রমাণ রাখা।

মানুষ মাত্রই মর্যাদা খোঁজে। মর্যাদা খোঁজে দেশের রাজা-বাদশাহর সাহায্যকারী হওয়ার মধ্যে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাআলা ঈমানদার বান্দাহকে মর্যাদা দেন তাঁর নিজের সাহায্যকারী বানিয়ে। মুমিনের জীবনে জিহাদ দেয় মওকা। মুমিনদের প্রতি মহান আল্লাহ তাআলা আহবান রেখেছেন এভাবে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও’ (ছফ ১৪)। আর আল্লাহর সাহায্যকারী হওয়ার মধ্য দিয়ে সে পায় মহান আল্লাহর সাহায্য এ জীবনে এবং পরকালীন জীবনে। সে প্রতিশ্রুতিটি শুনিয়েছেন এভাবে, ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান দৃঢ় করবেন (মুহাম্মাদ ৭)। মহান আল্লাহ তাঁর ঈমানদার বান্দাহদেরকে তো দিতে চান বিশাল পদোন্নতি। সে পদোন্নতিতে বড় কোন পদ বা কোটি কোটি টাকার বেতন জুটে না, বরং জুটে জান্নাত। যা অনন্তকালের জন্য-যার এক ইঞ্চি ভূমিও দুনিয়ার তাবৎ সোনা-রূপার চেয়েও মূল্যবান।

আলেমদের অপরাধ :

আলেমদের অপরাধ অনেক। তবে বড় অপরাধ, মুসলমানদের থেকে কুরআনের শিক্ষাকেই তারা আড়াল করেছেন। মেঘ যেমন সূর্যকে আড়াল করে তারাও তেমনি ইসলামকে আড়াল করেছেন। তারা শুধু নিজেরাই জিহাদের এ কথা ভূুলেননি, বরং সাধারণ মুসলমানদের মন থেকেও আল্লাহর পরিকল্পিত চূড়ান্ত পরীক্ষার কথাটিই ভুলিয়ে দিয়েছেন। জিহাদের বদলে কুরআন পাঠ, তাসবীহ পাঠ, নফল ইবাদত ও সাধারণ সুন্নাত পালনের মাঝে জান্নাত প্রাপ্তির খোশখবর শুনিয়েছেন। সমাজে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কোন ভাষা তাদের মুখে প্রকাশিত হয় না। তাদের কারণেই জিহাদ নিয়ে বেড়েছে সীমাহীন ভ্রষ্টতা। আর এ ভ্রষ্টতার কারণে পরাজয় শুধু মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে আসেনি, পরাজয় এসেছে মহান আল্লাহর দ্বীনের। এবং সেটি খোদ মুসলিম দেশগুলিতে। ইসলামে জ্ঞানার্জন ফরয হলে কি হবে, এসব আলেমগণ পছন্দ করে নিয়েছেন অজ্ঞতার প্রসারকে। সে জন্যই পবিত্র কুরআনকে বুঝার বদলে সেটিকে না বুঝে তেলাওয়াতের রেওয়াজ বাড়িয়েছেন।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলছেন, ‘তারা কি কুরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? (মুহাম্মদ ২৪)। এ আয়াতে যা অতি সুস্পষ্ট তা হল, আল্লাহ তাআলা অতিশয় অসন্তুষ্ট হন, যদি তাঁর কুরআনী আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা না করা হয়। অথচ আলেমগণ সে চিন্তাভাবনাই অসম্ভব করে তুলেছেন। ফলে মুসলিম সমাজে তেলাওয়াতকারীর সংখ্যা বাড়ছে, ক্বারী ও হাফেযদের সংখ্যাও বাড়ছে, কিন্তু বাড়েনি চিন্তাশীল মুমিনের সংখ্যা। এমন চিন্তাশূন্যতার কারণেই বেড়েছে ইসলাম নিয়ে প্রচন্ড বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা। মুসলিম দেশগুলিতে মসজিদ-মাদরাসা, ইসলামী বই-পুস্তক ও ইসলামী দলের সংখ্যা বিপুল সংখ্যায় বেড়েছে, বেড়েছে ছালাত আদায়কারীর সংখ্যাও। কিন্তু বাড়েনি জিহাদ নিয়ে সঠিক ধারণা। বাড়েনি মুসলমানদের জিহাদে সংশ্লিষ্টতা। ফলে মুসলিম দেশগুলিতে বেড়েছে ইসলামের পরাজয়।

শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্র থেকে ইসলামের কুরআনী বিধান তার দখলদারী হারিয়ে মসজিদের জায়নামাযে স্থান নিয়েছে। অথচ ইসলামের শরঈ বিধান দখলদারী হারালে মুসলমান কখনো বিজয়ী হয় না, গৌরবও পায় না। আল্লাহর বিধান কোন দেশের আইন-আদালত থেকে অপসারিত হল আর মুসলমানরা সে দেশে বিজয় ও ইয্যত পেল-এমন ইতিহাস কি আছে? মুসলমানের গৌরব তো আসে আল্লাহর সাহায্য আসার মধ্য দিয়ে। আর সে সাহায্য তো একমাত্র তখনই আসে যখন মুসলমানগণ আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। তাঁর কুরআনী বিধানকে বিজয়ী করতে শত্রুর সামনের জানমালের কুরবানী নিয়ে খাড়া হয়। মহান আল্লাহ তাআলা তখন তাঁর বান্দাহর বিশাল বিনিয়োগ দেখে হাযার হাযার ফেরেশতা পাঠান তাদের সাহায্যার্থে। যেমনটি বন্দর, খন্দক, হুনায়নের ন্যায় বহু যুদ্ধে ঘটেছিল। যেমনটি বদরের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘স্মরণ কর, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে; তখন তিনি তোমাদেরকে জবাব দিয়েছিলেন, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক সহস্র ফেরেশতা দ্বারা, যারা সারিবদ্ধভাবে আসবে (আনফাল ৯)। আর সাহায্য তো আসে একমাত্র আল্লাহ থেকেই (আনফাল ১০)। আর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন সাহায্য আসে তখন কোন পরাক্রমশালী শক্রর বিরুদ্ধে বিজয়েও কি কোন বাধা থাকে?

শুধু খুঁটিতে নিরাপত্তা নেই :

ঈমান, ছালাত, ছিয়াম, হজ, যাকাত-এ হলো ইসলামের পাঁচটি খুঁটি। তবে ঘর নির্মাণে শুধু খুটি নয়, আরো বহু কিছু যরূরী। ইসলামের সে ঘর নির্মাণে সে অপরিহার্য বিষয়গুলো হল জিহাদ, সমাজ ইসলামী কায়দায় গড়ে তোলা, ন্যায়-ইনসাফ ও শান্তি-সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তার ইত্যাদি। এগুলো ছাড়া ইসলামের খুঁটিই শুধু দাঁড়িয়ে থাকে, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ঘর তাতে নির্মিত হয় না। তখন সভ্যতাও গড়ে উঠে না। ঘরে যে অনাবিল শান্তি ও নিরাপত্তা জুটে সেটি কি খুঁটির ছায়াতে জুটে? আজকের মুসলমানদের জীবনে সেটিই ঘটেছে। মুসলিম সমাজে শুধু ৫ খানি খুঁটিই কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ঘর নির্মিত হয়নি। ফলে মুসলমানদের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তাও জুটেনি। মুসলমানগণ আজ  নিজ দেশে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের শিকার হচ্ছে। অধিকৃত হচ্ছে তাদের নিজ ভূখন্ড ও সম্পদ। পদদলিত হচ্ছে তাদের স্বাধীনতা। নবীজীর যুগে শুধু খুঁটি ছিল না, সে খুঁটির উপর ভর করে বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল। আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান ও আনুসঙ্গিক ইবাদতের সাথে ঈমানদারের জীবনে জিহাদও ছিল। প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল ইসলামী শরীআতের। সাথে সাথে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ইসলামের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি। শত্রুর প্রতিটি হামলার বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষ থেকে গড়ে উঠেছিল প্রবল প্রতিরোধ। জিহাদ তখন প্রতিটি মুমিনের জীবনে অলংকারে পরিণত হয়েছিল। সে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর গড়ে উঠেছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।

কুরআনী জ্ঞান মানুষকে কেবল সত্যের সন্ধানই দেয় না, তার চেতনারাজ্যে জোগায় অফুরন্ত শক্তি। তখন আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের জন্য তার শুধু অঙ্গিকারই বাড়ে না, তার মাঝে আতমবিনিয়োগ ও অর্থবিনিয়োগের সামর্থ্যও বাড়ে। তখন মুসলিম দেশে শত্রুর প্রতিরোধের তাড়না শুধু বেতনভোগী সৈনিকদের মাঝে সীমিত থাকে না। সমগ্র দেশ তখন ক্যান্টমেন্টে পরিণত হয় এবং প্রতিটি নাগরিক তখন পরিণত হয় সৈনিকে। এমন জিহাদ না থাকলে শয়তানী শক্তির বিশাল কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় অনিবার্য। মুসলিম দেশে আজ ক্যান্টনমেন্ট বেড়েছে, সৈনিকের সংখ্যাও বেড়েছে। বেড়েছে যুদ্ধাস্ত্রও। কিন্তু জিহাদের ধারণা বিলুপ্ত হওয়ায় শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে জনগণের দায়বদ্ধতা ও কোরবানী বাড়েনি। ফলে শত্রুর বিরুদ্ধে ইসলামের কি বিজয় আসবে, দেশ অধিকৃত হয়ে গেছে ইসলামের অভ্যন্তরীণ শত্রুর হাতে।

প্রতিটি মতবাদ বা আদর্শই প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য অনুসারীদের অঙ্গিকার চায়, সে সাথে কোরবানীও চায়। ইসলামের প্রতিষ্ঠায় দখল জমিয়ে রাখা আদর্শ ও তার অনুসারীদের হটাতে হয়, হটানোর সে কাজে শ্রমব্যয়, অর্থব্যয় ও রক্তব্যয় ঘটে। অথচ মুসলিম আলেমদের মাঝে আজ সে কোরবানী পেশের আগ্রহ কোথায়? বরং জিহাদ যে প্রতিটি মুসলমানের উপর বাধ্যতামূলক, ইসলামের সে অতি বুনিয়াদি শিক্ষাটিকে তারা অতি সফলতার সাথে আড়াল করতে সমর্থ হয়েছে। অপরদিকে ইসলামী শরীআতের এমন পরাজয়ের মাঝেও তাদের মাঝে এ নিয়ে কোন মাতম বা আহাজারি নেই। সে হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য জিহাদ এবং সে জিহাদে কোরবানী পেশেরও কোন আগ্রহ নেই। অথচ শয়তানের অনুচরদের কোরবানীটা কত বিশাল। মার্কিনীরা জানমালের বিশাল কোরবানী পেশ করছে নিজ দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের নানা জনপদে। তেমনি প্রাণ দিচ্ছে নানা মতের অনুসারীরা। বাংলাদেশে একমাত্র মুজিব আমলেই প্রায় ৩০ হাজারের বামপন্থী নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়। অথচ কতজন আলেম প্রাণ দিয়েছেন ইসলামের বিজয় আনতে?

ঈমান দৃশ্যমান হয় জিহাদে :

মুসলমানের ঈমান কথা বলে তাঁর কর্ম, সংস্কৃতি, আচরণ ও রাজনীতির মধ্য দিয়ে। তাঁর সে ঈমান তাঁকে সমাজের অন্যদের থেকে পৃথক করে এবং এক ভিন্ন পরিচয়ে খাড়া করে। সে ভিন্নতা স্রেফ নাম, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-পানীয় ও ইবাদত-বন্দেগীতে নয়, বরং সেটি সৃষ্টিকর্তা, জীবন ও জগত, জীবনের এজেন্ডা ও মিশন, মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী জীবন, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয়ে স্পষ্টতর এক বিশেষ ধ্যান-ধ্যারণার ভিত্তিতে। ইসলামী পরিভাষায় সে ধ্যান-ধারণাই হল আক্বীদা। আক্বীদা এবং ঈমান অদৃশ্য, কিন্তু কোন ব্যক্তির মধ্যে তা প্রবেশ করলে সেটির প্রবল প্রকাশ ঘটে তার কর্ম ও আচরণের মধ্য দিয়ে। তখন তার কর্ম, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও রাজনীতিও পাল্টে যায়। এক সার্বিক বিপ্লব আসে তার জীবনে। জিহাদ তখন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়, যেমনটি হয়েছিল সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। কিন্তু যখন সে বিপ্লব আসে না এবং তার জীবনে জিহাদ শুরু হয় না, তখন বুঝতে হবে বিশাল শুণ্যতা বা ভ্রষ্টতা রয়েছে তার ঈমান ও আক্বীদায়। তাই কোন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে পরিবর্তন আনতে হয় তাদের আক্বীদায় তথা ধ্যান-ধারণায়। নবুয়ত প্রাপ্তির পর রাসূল (ছাঃ) আমৃত্যু এ কাজটিই করেছেন। সেই ঈমান ও আক্বীদার বিপ্লবের কারণেই প্রতিটি মুসলিম সেদিন মুজাহিদে পরিণত হয়েছিলেন।

দায়িত্ব জিহাদের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করা :

মুসলমানের আক্বীদা বা ধ্যানধারণার ভিত্তি স্রেফ মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর উপর বিশ্বাস নয়, বরং সমগ্র জগত এবং সে জগতে বসবাসরত মানবসৃষ্টি নিয়ে আল্লাহর নিজের পরিকল্পনা তথা রোডম্যাপের উপর বিশ্বাসও। ইসলামে সে রোডম্যাপটি হল কুরআনে বর্ণিত সীরাতুল মুস্তাকীম। আর সে বিশ্বাসের সাথে প্রতিটি ঈমানদারের উপর দায়িত্বও এসে যায়। সে দায়িত্বটি হল, মহান আল্লাহর সে রোডম্যাপের পুরাপুরি অনুসরণ। এর মাধ্যমে সমাজে পথভ্রষ্টরা পথ খুঁজে পায়। মহান আল্লাহর সে রোডম্যাপের বিরুদ্ধে যেকোন বিদ্রোহ ও অবাধ্যতাই কুফরী। তখন বিপর্যয় ও বিফলতা আসে ব্যক্তির জীবনে এবং মৃত্যুর পর গিয়ে পৌঁছে জাহান্নামের আগুনে। জিহাদ হল রাষ্ট্রের বুকে সিরাতুল মুস্তাকীমের অনুসরণকে জারি রাখার প্রচেষ্টা। যার মধ্যে সে জিহাদ নেই, বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানও নাই। মুসলিম রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল জনগণের মাঝে জিহাদের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা। যে রাষ্ট্রে লাগাতার জিহাদ নেই, বুঝতে হবে সে রাষ্ট্রে সিরাতুল মুস্তাকীমও নেই। তখন পথভ্রষ্টতা বাড়ে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। সে সমাজ ও রাষ্ট্রে তখন সুদী ব্যাংক, পতিতাপল্লী, নাচের আসর, মদের আসর ও ব্যভিচারী অাঁনাচে কাঁনাচে প্রতিষ্ঠা পায়। তখন সাধারণ মানুষ আত্মসমর্পণ করে এমন পথভ্রষ্টদের কাছে যারা আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহী। তখন দেশ রেকর্ড গড়ে দুর্বৃত্তিতে। আর দুর্বৃত্তির প্রতিটি ঘটনাই তো পথভ্রষ্টতা। আইন-আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও পোষাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে অনুসৃত হয় কাফের তথা পথভ্রষ্টদের নীতি। আর একটি সমাজে দুর্বৃত্তির বিশ্বজোড়া রেকর্ড দেখেই বলা যায় সেদেশে জিহাদ প্রতিষ্ঠা পায়নি। জিহাদ না হলে সমাজে ইসলামের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব, তখন অসম্ভব হয় দুর্বৃত্তির অবসান। অসম্ভব হয় অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বাঁচা। বহু দেশের মাঝে আজকের বাংলাদেশও তো বস্তুত তেমনই এক দেশ। এমন দেশে ছালাত আদায়কারী ও ছিয়াম পালনকারীর সংখ্যা যতই বেশী থাক, ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’ তথা আল্লাহর পথে লড়াই যে ভয়ানকভাবে উপেক্ষিত সেটি বোঝার জন্য কি গবেষণার প্রয়োজন পড়ে? আর মহান আল্লাহর প্রদর্শিত পথের প্রতি এমন নির্বিরাম উপেক্ষা নিয়ে কি জনগণ কল্যাণ পায়? জঙ্গীবাদের প্রতিরোধ করতে যেয়ে জিহাদের মৌলিক স্পিরিটটিই কি হারিয়ে দিতে হবে? জিহাদকে উগ্রতার পোষাক পরিয়ে যে সকল গন্ডমূর্খরা জিহাদ শব্দটিকে কলংকিত করেছে, তাদের উপর সমস্ত দায় চাপিয়ে দিতে পারলেই কি আল্লাহর কাছে মুক্তি পাওয়া যাবে? যারা মানুষের সত্যিকার কল্যাণ চায় দুনিয়া ও আখেরাতে, তাদের অন্ততঃ এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিৎ। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!! 

ফিরোজ মাহবুব কামাল



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও