নারীর মূল কর্মক্ষেত্র

এ্যাডভোকেট জারজিস আহমাদ 1016 বার পঠিত

নারীকে অসম্মান করে কোন জাতি কোন উন্নতি করতে পারেনি। বরং আরো অধঃপতিত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে। ইতিহাস সে কথাই বলে। পাশ্চাত্যের অনুসরণ করতে গিয়ে আমরাও আমাদের মা বোনদের কখনো অর্ধনগ্ন আবার কখনো নগ্ন করে ছেড়েছি। অথচ এটা আমরা বিনোদন বলে চালাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথমে নারী জাতিকে তার পূর্ণ মর্যাদা দান করে বিশ্বে বিপ্লব এনেছিলেন। মায়ের পদতলে জান্নাত, তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। তাঁর পূর্বে মা-বোনদের এত সম্মানের কথা কেউই কোন কালে শুনেনি। তবে এই সম্মান নির্ভর করে নারীর শালীনতা ও তাকওয়াশীলতার উপর। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করবে। প্রাচীন জাহেলী যুগের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না’ (আহযাব ৩৩/৩৩) ।                       

আয়াতটির পটভূমি স্বরূপ উল্লেখ করা যায়, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদীনায় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন বাস্তবায়নের সংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তখন ইসলামের দুশমনরা বিকাশমান মুসলিম সমাজ ব্যবস্থাকে শক্তিহীন করার জন্যে নানাভাবে চেষ্টা চালাতে থাকে। ইসলাম একদিকে নৈতিক পবিত্রতা পরিশুদ্ধি আল্লাহর প্রতি ঐকান্তিকতা একাগ্রতার আহবান জানাচ্ছিল। অন্যদিকে কাফের শক্তি সমাজে নানারূপ বিশৃংখলার সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিল। এই সময় মুসলিম শক্তি ও কাফের শক্তির মধ্যে যে প্রচন্ড দ্বন্দ্ব- সংঘর্ষের উদ্ভব হয়েছিল তাতে ইসলাম তার সমাজ সংস্থাকে সুষ্ঠুরূপে গড়ে তোলার ও মুসলিম উম্মাহকে সুদৃঢ় রাখার জন্যে সমাজের লোকদের পুনর্বিন্যাস করার তীব্র প্রয়োজন বোধ করে; দেশ ও সমাজের সংরক্ষণে নবতর আইন বিধান উপস্থাপন করে। তাতে পুরুষ লোকদেরকে সকল প্রকার আক্রমণ ও ফেৎনা-ফাসাদের মোকাবেলা করার জন্য সারিবদ্ধ করা হ’ল এবং নারীকে নির্দেশ দেওয়া হয় গৃহক্ষেত্রে শক্ত হয়ে সর্বপ্রকার ভাঙ্গন ও বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। কেননা সমাজে গৃহদূর্গই গোটা সমাজের স্থিতির মূল কেন্দ্র। বাহিরের মুকাবিলায় পরাজিত হলেও মানুষ গৃহ দূর্গে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। কিন্তু যে সব সংগ্রামীদের গৃহদূর্গ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তাতে শক্র পক্ষের অনুপ্রবেশ ঘটে, সেই সংগ্রামীদের আশ্রয় নেয়ার আর কোন স্থানই অবশিষ্ট থাকে না। এই দূর্গে শক্তিমান রক্ষী হ’তে পারে সমাজের মহিলারা। তারা এই গৃহদূর্গের নিজেদের মান-সম্ভ্রম ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রেখে গোটা সংগ্রামী বাহিনীকে বিরাট সাহায্যদানের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করতে পারে।

বর্ণিত আলোচনার প্রেক্ষিতে দ্বিধা-সংকোচমুক্ত হয়ে বলা  যেতে পারে যে, ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজের সংরক্ষণের দায়িত্ব নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপরেই অর্পণ করেছে বটে; কিন্তু কার্যতঃ এই দুই লিঙ্গের সংগ্রামক্ষেত্র এক ও অভিন্ন রাখেনি। ইসলাম পুরুষদের চালিত করাতে চায় অগ্রবর্তী বাহিনী হিসাবে আর মহিলাদের জন্য প্রকৃত সংগ্রাম ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাদের গৃহকোণকে। উভয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে পূর্ণ শৃংঙ্খলা ও দৃঢ়তা সহকারে দাঁড়িয়ে থেকে কুফুরী আদর্শ ও কুফুরী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাবে। আর সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রতিটি বাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট ফ্রন্টে অবিচল হয়ে থাকার উপরই নির্ভর করে সংগ্রামে বিজয় লাভের সম্ভাবনা। একটি বাহিনীও যদি নিজের ক্ষেত্র ত্যাগ করে, তাহলে পরাজয় অবধারিত। এই বিষয়ে ওহোদ যুদ্ধ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে প্রায় ৭০০ জন সৈন্য ছিল। প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে একটি ভুলের জন্য মুসলমানদের সাক্ষাৎ বিজয় অবশেষে বিপর্যয়ে পরিণত হয়।


বর্ণিত আলোচনার আলোকে উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করলে বুঝতে পারা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা চান মহিলা সমাজ তাদের গৃহ কোণকেই নিজেদের স্থায়ী কর্মক্ষেত্র রূপে গ্রহণ করুক এবং ঝাঁপিয়ে পড়ার মত ভুল যেন তারা কখনই না করে। অন্যথায় সংগ্রামে শুধু পরাজয়ই বরণ করতে হবে না, বরং চরমভাবে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে যাবে ইসলামের গোটা সমাজ প্রাসাদ।

মহিলারা খোলামেলা অবস্থায় গৃহদূর্গের বাইরে গেলে একশ্রেণীর বিপথগামী যুবসমাজ আকৃষ্ট হয়ে তাদেরকে ছোবল দিবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই জন্য মহান আল্লাহ মহিলাদের উপরোক্ত আয়াত দ্বারা সাবধান করে দিয়েছেন। নারীরা যখন তাদের যরূরী কাজে গৃহ-দূর্গ ত্যাগ করবে তখন তারা নিজেদের মান-সম্মান ও পবিত্রতা অক্ষুন্ন রেখে পর্দা করে বের হবে। বর্তমান সমাজে যেসব বিপদজনক ঘটনা ঘটছে তা নারীদের পর্দা ছাড়া গৃহ দূর্গ ত্যাগ করে খোলামেলা অবস্থারই ফল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, মানুষের উপর শয়তানের পক্ষ থেকে প্রথম হামলা ছিল তার দেহ থেকে কাপড় খুলে বিবস্ত্র করা। আজও পৃথিবীতে শয়তানের পদাংক অনুসারী ও ইসলামের শিখন্ডীদের প্রথম কাজ হল তথাকথিত ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার নামে নারীকে বিবস্ত্র করে ঘরের বাইরে আনা ও তার সৌন্দর্যহানি করা। অথচ পৃথিবীতে বিগত সভ্যতাগুলি ধ্বংস হয়েছে মূলতঃ নারী ও মদের সহজলভ্যলতার কারণেই। অতএব সভ্য ভদ্র ও আল্লাহভীরু বান্দাদের নিকটে ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরয হল স্ব স্ব লজ্জাস্থান আবৃত রাখা এবং ইয্যত আবরূর হেফাযত করা। অন্যান্য ফরয সবই এর পরে। নারীর পর্দা কেবল পোষাকে হবে না, বরং তা হবে তার ভিতরে তার কথাবার্তা, আচার-আচরণে ও চাল-চলনে সর্ব বিষয়ে। পরনারীর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি ও মিষ্ট কন্ঠস্বর পর পুরুষের হৃদয়ে অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে। অতএব লজ্জাশীলতাই মুমিন নর-নারীর অঙ্গ ভূষণ ও পারস্পারিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে একে অপরের থেকে  স্ব স্ব দৃষ্টিকে অবনত রাখবে (নূর ২৪/৩০-৩১) এবং পরস্পরে সার্বিক পর্দা বজায় রেখে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় কথাটুকু স্বাভাবিকভাবে সংক্ষেপে বলবে। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে এক অপরে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য ও পর্দা বজায় রেখে স্ব স্ব কর্মস্থলে ও কর্মপরিধির মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং সংসার ও সমাজের কল্যাণে সাধ্যমত অবদান রাখবে। নেগেটিভ ও পজেটিভ পাশাপাশি বিদ্যুৎবাহী দুটি ক্যাবলের মাঝে প্লাস্টিকের অবরণ যেমন পর্দার কাজ করে এবং অপরিহার্য এক্সিডেন্ট ও অগ্নিকান্ড থেকে রক্ষা করে, অনুরূপভাবে পর নারী পর পুরুষের মধ্যকার পর্দা উভয়ের মাঝে ঘটিতব্য যে কোন অনাকাংখিত বিষয় থেকে পরস্পরকে হেফাযত করে। অতএব শয়তানের প্ররোচনায় জান্নাতের পবিত্র পরিবেশে আদি পিতামাতার জীবনে ঘটিত উক্ত অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা থেকে দুনিয়ার এই পঙ্কিল পরিবেশে বসবাসরত মানব জাতিকে আরও বেশী সর্তক ও সাবধান থাকা উচিৎ।

পরিশেষে বলবো যে সর্বাগ্রে নিজ নিজ ব্যক্তি জীবনে ও পারিবারিক জীবনে ইসলামের কোড অফ কন্ডাক্ট মেনে নিয়ে যে পথে রাসূল (ছাঃ) এগিয়েছিলেন সে পথে আমাদের এগোতে হবে। তাই আসুন! আমরা নারীদেরকে খোলামেলা পোষাকে হাটে বাযারে ঘাটে কাফেরদের অনুসরণ করে দেহ প্রর্দশন করা থেকে বিরত রাখি এবং নারীর মূল কর্মক্ষেত্র গৃহদূর্গ রেখেই বিশ্বনবীর দিক নিদের্শনা মোতাবেক পরিচালিত করি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন-আমীন।


এ্যাডভোকেট জারজিস আহমাদ

লেখক : সিনিয়র এ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, রাজশাহী



বিষয়সমূহ: নারী অধিকার
আরও