রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ভালোবাসা

আসাদুল্লাহ আল-গালিব 1904 বার পঠিত

ভূমিকা : ভালোবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নে’মত। এই নে’মতের একটি বিশেষ অংশ রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য রাখা ঈমানেরই অংশ। আর এই ভালোবাসার অংশটি হ’তে হবে নিজের জীবন, সন্তান-সন্তুতি, পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজনসহ দুনিয়ার সকল মানুষের চেয়ে বেশী। এতেই রয়েছে ইহলৌকিক শান্তি ও পরলৌকিক মুক্তি। মীলাদুন্নবী, শবে মেরাজ, শবে বরাতের মত অতিরঞ্জিত বিদ‘আতী ভালবাসা রাসূলের শানে কাম্য নয়। প্রকৃত রাসূল প্রেমিক হওয়া তাঁর আনুগত্যে, ঈদ-উল্লাসের মধ্যে নয়। প্রকৃতার্থে এমনটি হ’ল তাঁর বিরুদ্ধচারণ, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বরং একজন ব্যক্তি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে রাসূল (ছাঃ)-কে ভালোবাসবে। নিম্নে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হ’ল।

নিজের জীবনের চেয়ে বেশী রাসূল (ছাঃ)-কে ভালোবাসা :

হাদীছে এসেছে, عَبْدَ اللَّهِ بْنَ هِشَامٍ قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ آخِذٌ بِيَدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ لأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ إِلاَّ مِنْ نَفْسِى فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ فَإِنَّهُ الآنَ وَاللَّهِ لأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ نَفْسِى فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الآنَ يَا عُمَرُ- আব্দুল্লাহ ইবনু হিশাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা একদা নবী (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি যখন উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-এর হাত ধরেছিলেন। উমর (রাঃ) তাকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার প্রাণ ব্যতীত আপনি আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। তখন নবী (ছাঃ) বললেন, না। ঐ মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! এমন কি তোমার কাছে তোমার প্রাণের চেয়েও আমাকে অধিক প্রিয় হ’তে হবে। তখন উমর (রাঃ) তাকে বললেন, এখন আল্লাহর কসম! আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয়। নবী (ছাঃ) বললেন, হে উমর! এখন (তোমার ঈমান পূর্ণ হয়েছে)।[1]

পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি ও সম্পদের চেয়ে বেশী ভালোবাসা :

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لاَ يُؤْمِنُ عَبْدٌ وَفِى حَدِيثِ عَبْدِ الْوَارِثِ الرَّجُلُ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَهْلِهِ وَمَالِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ- আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের কেউই ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার কাছে তার সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা এবং অন্য লোকদের চাইতে অধিক প্রিয় না হব’।[2]

দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী রাসূল (ছাঃ)-কে ভালোবাসা :

মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বলে দাও, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, পুত্র, ভাই, স্ত্রী, স্বগোত্র ও ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন কর, ব্যবসা যা তোমরা বন্ধ হবার আশংকা কর এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা পসন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা হ’তে অধিক প্রিয় হয়। তাহ’লে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহর নির্দেশ (আযাব) আসা পর্যন্ত। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (তাওবাহ ৯/২৪)

হাফেয ইবনু কাছীর স্বীয় গ্রন্থে বলেন, أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا ‘এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা পসন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা হতে অধিক প্রিয় হয়’ অর্থাৎ তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তোমাদের কিভাবে শাস্তি প্রদান করেন এবং তোমাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেন’।[3]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুজাহিদ ও হাসান (রহঃ) বলেছেন, حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ‘তাহ’লে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহর নির্দেশ (আযাব) আসা পর্যন্ত’ অর্থাৎ তাদের শাস্তি অতি সন্নিকটে’।[4] আল্লামা যামাখশারী বলেন, এই আয়াতটি কঠিন শাস্তির কথা বর্ণনা করে’।[5] 

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এই আয়াত দ্বারা দলীল সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ ও তার রাসূল (ছাঃ)-কে ভালোবাসা ওয়াজিব। এর ব্যতিরেকে কোন উপায় নেই। আর যে কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা অগ্রাধিকার পাবে’।[6]

রাসূল (ছাঃ)-কে ভালোবাসার ফলাফল :

(১) আল্লাহর ভালোবাসা ও ক্ষমা :

মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)

(২) ঈমানের স্বাদ আস্বাদন :

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا ، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِى الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِى النَّارِ- আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তিনটি জিনিস এমন যার মধ্যে সেগুলো পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ পাবে। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সবকিছু থেকে প্রিয় হওয়া। ২. কাউকে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসা। ৩. জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে যেভাবে অপছন্দ করে, তেমনি পুনরায় কুফরির দিকে প্রত্যাবর্তন করাকে অপছন্দ করে’।[7]

অপর হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى أُمَامَةَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আললাহর জন্য ভালোবাসবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুশমনী করবে; আর দান করবে আল্লাহর জন্য এবং দান করা থেকে বিরত থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, সে ব্যক্তি তার ঈমান পরিপূর্ণ করেছে’।[8]

(৩) পরকালে রাসূলের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য :

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى ذَرٍّ أَنَّهُ قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ الرَّجُلُ يُحِبُّ الْقَوْمَ وَلاَ يَسْتَطِيعُ أَنْ يَعْمَلَ كَعَمَلِهِمْ قَالَ أَنْتَ يَا أَبَا ذَرٍّ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ قَالَ فَإِنِّى أُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ قَالَ فَإِنَّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ قَالَ فَأَعَادَهَا أَبُو ذَرٍّ فَأَعَادَهَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم- আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি একদিন বলেন, হে আললাহর রাসূল (ছাঃ)! এক ব্যক্তি কোন জাতিকে ভালোবাসে, কিন্তু তাদের অনুরূপ আমল করে না। তখন তিনি বললেন, হে আবু যার! তুমি তাদের সাথী হবে, যাদেরকে তুমি ভালোবাসো। তখন আবু যার (রাঃ) বলেন, আমি তো আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালোবাসি। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তুমি তার সাথী হবে, যাকে তুমি ভালোবাসো। রাবী বলেন, আবু যার (রাঃ) পুনরায় এরূপ বললে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একইরূপ জবাব দেন’।[9] অপর হাদীছে এসেছে, আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ক্বিয়ামত কবে সংঘটিত হবে? তিনি বললেন, তুমি সেদিনের জন্য কী পাথেয় সঞ্চয় করেছ? সে বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তুমি তার সঙ্গে উঠবে যাকে তুমি ভালোবাসো।

আনাস (রাঃ) বলেন, ইসলাম গ্রহণের পরে আমরা এত বেশী খুশী হইনি যতটা নবী করীম (ছাঃ) -এর বাণী,فَإِنَّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ‘তুমি তার সঙ্গেই থাকবে যাকে তুমি ভালোবাসো’ দ্বারা আনন্দ লাভ করেছি। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহ, তার রাসূল, আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ)-কে ভালোবাসি। সুতরাং আমি আশা করি যে, ক্বিয়ামত দিবসে আমি তাদের সঙ্গে থাকব, যদিও আমি তাদের মত আমল করতে পারব’।[10]

রাসূল (ছাঃ)-কে ভালোবাসার আলামত :

রাসূলকে স্বপ্নে দেখার আকাঙ্খা রাখা :

আর এটা তার পক্ষেই সম্ভব হবে যে প্রকৃত অর্থে রাসূলকে ভালোবাসে। তাঁর প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ ও সালাম প্রেরণ করা। দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁর সান্নিধ্য লাভের কামনা করা। তাঁকে দেখার সৌভাগ্য অর্জনের অপেক্ষায় থাকা। এই ধরাধমে কারো মধ্যে রাসূলের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটলে আনন্দিত হওয়া ও রাসূলের অপমানে হৃদয় ব্যথিত ও ব্যাকুল হওয়া। শারঈ সমস্ত আমলের পাবনদী হওয়া। এতেই তো তাঁকে স্বপ্নে দেখার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।

রাসূলের ভালোবাসায় কাঁদা :

বুখারীতে হযরত আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে এসেছে,

فَبَيْنَمَا نَحْنُ يَوْمًا جُلُوسٌ فِى بَيْتِ أَبِى بَكْرٍ فِى نَحْرِ الظَّهِيرَةِ قَالَ قَائِلٌ لأَبِى بَكْرٍ هَذَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مُتَقَنِّعًا فِى سَاعَةٍ لَمْ يَكُنْ يَأْتِينَا فِيهَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ فِدَاءٌ لَهُ أَبِى وَأُمِّى وَاللَّهِ مَا جَاءَ بِهِ فِى هَذِهِ السَّاعَةِ إِلاَّ أَمْرٌ قَالَتْ فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَاسْتَأْذَنَ فَأُذِنَ لَهُ فَدَخَلَ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لأَبِى بَكْرٍ أَخْرِجْ مَنْ عِنْدَكَ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ إِنَّمَا هُمْ أَهْلُكَ بِأَبِى أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ فَإِنِّى قَدْ أُذِنَ لِى فِى الْخُرُوجِ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ الصَّحَابَةُ بِأَبِى أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم نَعَمْ-

একদিন আমরা ঠিক দুপুর বেলায় আবু বকর (রাঃ) এর ঘরে বসাছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে আবু বকরকে সংবাদ দিল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাথা ঢাকা অবস্থায় আসছেন। তা এমন সময় ছিল যে সময় তিনি পূর্বে কখনো আমাদের এখানে আসেননি। আবু বকর (রাঃ) তাঁর আগমন বার্তা শুনে বললেন, আমার মাতাপিতা তাঁর প্রতি কুরবান। আল্লাহর কসম, তিনি এ সময় নিশ্চয় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কারণেই আসছেন। রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) পৌঁছে (প্রবেশের) অনুমতি চাইলেন। তাঁকে অনুমতি দেওয়া হ’ল। প্রবেশ করে নবী (ছাঃ) আবু বকরকে বললেন, এখানে অন্য যারা আছে তাদের বের করে দাও। আবু বকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি কুরবান! এখানে তো আপনারই পরিবার। তখন তিনি বললেন, আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আবু বকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান! আমি আপনার সফরসঙ্গী হ’তে ইচ্ছুক। রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ঠিক আছে’।[11] 

হাফেয ইবনু হাযার আসকালানী (রহঃ) বলেন, ইবনু ইসহাক তার রেওয়ায়েতে বৃদ্ধি করেছেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আমি আমার পিতা আবুবকরকে সেই দিন কাঁদতে দেখেছি। আর তাকে খুশিতে এর আগে বা পরে কখনও কাঁদতে দেখিনি’।[12]

রাসূলের আগমনে আনছারদের খুশী :

যখন মদীনাবাসী রাসূল (ছাঃ)-এর কথা যখন শুনলেন তখন থেকে তাঁর আগমনে উদগ্রীব ছিলেন। সীরাত গ্রন্থ থেকে তা খুবই সহজেই অনুমেয় হয়। যখন মদীনার মুসলমানেরা শুনলেন যে রাসূল (ছাঃ) মক্কা থেকে বের হয়ে গেছেন তখন থেকে তারা রোদ্রের দ্বিপ্রহর তাপ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। বুখারীতে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, মদীনায় মুসলমানগণ শুনলেন যে নবী করীম (ছাঃ) মক্কা থেকে মদীনার পথে রওয়ানা হয়েছেন। তাই তাঁরা প্রত্যহ সকালে মদীনার (বাইরে) হার্রা পর্যন্ত গিয়ে অপেক্ষা করে থাকতেন, দুপুরে রোদ প্রখর হলে তাঁরা ঘরে ফিরে আসতেন। একদিন তাঁরা পূর্বাপেক্ষা অধিক সময় অপেক্ষা করার পর নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। এমন সময় একজন ইয়াহুদী তার নিজ প্রয়োজনে একটি টিলায় আরোহন করে এদিক ওদিক কি যেন দেখছিল। তখন নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর সাথী সঙ্গীদেরকে সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় মরীচিকাময় মরুভূমির উপর দিয়ে আগমন করতে দেখতে পেল। ইয়াহুদী তখন নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে উচ্চস্বরে চীৎকার করে বলে উঠল, হে আরব সম্প্রদায়! এইতো সে ভাগ্যবান ব্যক্তি- যার জন্য তোমরা অপেক্ষা করছ। মুসলমানগণ তাড়াতাড়ি হাতিয়ার তুলে নিয়ে এবং মীনার হার্রার উপকন্ঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে মিলিত হলেন। তিনি সকলকে নিয়ে তিনি ডান দিকে মোড় নিয়ে বনী আমর ইবনু আউফ গোত্রে অবতরন করলেন’।[13]

ইবনু সাঈদের বর্ণনায় এসেছে, সূর্যের তাপের প্রখরতা বৃদ্ধি হলে মদীনাবাসীরা তাদের বাড়ীতে ফিরে আসত’।[14] 

মুসতাদরাক হাকেমের অপর এক বর্ণনায় এসেছে, তারা রাসূলের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করত, যতক্ষণ দ্বিপ্রহরের উত্তাপ তাদের জন্য অত্যাধিক কষ্টকর মনে হত’।[15] 

অপর এক বর্ণনায় রাসূলের আগমনের পূর্বে মদীনার অবস্থা কেমন ছিল তা বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনার হার্রায় একপাশে অবতরণ করলেন। এরপর আনছারদের সংবাদ দিলেন। তারা নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এলেন এবং উভয়কে সালাম করে বললেন, আপনারা নিরাপদ এবং মান্যবর হিসাবে আরোহণ করুন। নবী করীম (ছাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) উটে আরোহণ করলেন আর আনছারগণ অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের বেষ্টন করে চলতে লাগলেন। মদীনায় লোকেরা বলতে লাগল, আল্লাহর নবী এসেছেন, আল্লাহর নবী এসেছেন, লোকজন উঁচু যায়গায় উঠে তাঁদের দেখতে লাগল। আর বলতে লাগল আল্লাহর নবী এসেছেন। তিনি সামনের দিকে চলতে লাগলেন। অবশেষে আবু আইয়ুব (রাঃ)-এর বাড়ীর পাশে গিয়ে অবতরণ করলেন’।[16]

সেই দিন রাসূল (ছাঃ) ও আবু বকর (রাঃ)-কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রায় ৫০০ আনছারী এসেছিলেন’।[17] রাসূলের হাবীব আবু বকর (রাঃ) বলেন, আমি ও আল্লাহর রাসূল যখন মদীনায় আসলাম তখন আনছারীরা আমাদের সাক্ষাতে রাস্তায় বের হয়ে আসল। বৃদ্ধ ও বাচ্চারা সেই দিন বলছিল, اللَّهُ أَكْبَرُ جَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم جَاءَ مُحَمَّدٌ ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এসেছেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ) এসেছেন’।[18]

উপসংহার : রাসূল প্রেম মুমিন জীবনে একটি আবশ্যিক বিষয়। কথায় নয়, কাজে তার প্রমাণ দিতে পারলেই, তবেই মুমিনের কাঙ্খিত জান্নাত। অন্যথায় নয়। কোন বিদআতী তরীকায় মুহাববাত প্রকাশ করা প্রকৃতপক্ষে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেম নয়, বরং তাকে অপমান করার শামিল। সুতরাং আমাদেরকে সর্বদা রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা রাখতে হবে এবং তাঁর আদর্শকে সর্বদা অনুসরণ করে চলতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!

[ লেখক : কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]


[1]. বুখারী হা/৬৬৩২

[2]. মুসলিম হা/৬৯ (৪৪)

[3]. ইবনু কাছীর ২/৩২৪

[4]. তাফসীরে কুরতুবী ৮/৯৫-৯৬ পৃঃ।

[5]. তাফসীরে কাশশাফ ২/১৮১।

[6]. তাফসীরে কুরতুবী ৮/৯৫; আইসারুত তাফাসীর ২/১৭৭।

[7]. বুখারী হা/১৬,২১,৬০৪১

[8]. আবু দাঊদ হা/৪৬৮১

[9]. আবু দাঊদ হা/৫১২৬

[10]. মুসলিম হা/২৬৩৯।

[11]. বুখারী হা/৩৯০৫।

[12]. ফৎহুল বারী ৭/২৩৫ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৯৩।

[13]. বুখারী হা/৩৯০৬।

[14]. তবকাতুল কুবরা ১/২৩৩।

[15]. মুসতাদরাক হাকেম হা/৪২৭৭।

[16]. বুখারী হা/৩৯১১।

[17]. আহমাদ হা/১৩৩৪২।

[18]. আহমাদ হা/৩।



বিষয়সমূহ: ভালোবাসা
আরও